চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

শুয়োর ছানার সাহস


শুয়োর ছানার সাহস
আখতার মাহমুদ

আধুনিক পৃথিবী, সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এমন কিছুকে প্রাধান্য দেয়া শুরু করে যা আদৌ প্রাধান্য পাবার যোগ্য নয়। এই অযোগ্য প্রাধান্যপ্রাপ্ত বিষয়গুলোর সাথে জড়িত নানানরকম ভোগ্যপণ্য। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার প্রসারের সাথে সাথে এসব ভোগ্যপণ্যের বিস্ময়কর বিস্তার বা বিজয়রথ চলমান। এসবের বিস্তারের সাথে সাথে, পুঁজিবাদের স্বার্থেই কিছু বিকৃতি এত নিপুণভাবে ঘটেছে যে, ওসবকে বিকৃতি বলে চেনা দুষ্কর। যদি আপনি এসব বিকৃতি চিনেও থাকেন এবং প্রকাশ্যে বলেনও তবে উল্টো দোষারোপ করে হয়তো বলা হবে আপনার রুচিই বিকৃত বা মানসিক বিকৃতি ঘটেছে আপনার। কিছু বিষয় আছে যা চিরকাল একইরকম থাকার কথা, যেমন- বীরত্ব, যৌনতা ইত্যাদি। কিন্তু পুঁজিবাদের আশীর্বাদেই মূলত এসবে ঢুকে গেছে অদ্ভুত সব পরিবর্তন। 

বীরত্বে প্রয়োজন সাহস... সাহস  শব্দটা আমি সবসময়েই ইতিবাচক অর্থে বুঝি। নেতিবাচক অর্থে ‘সাহস’ শব্দটা ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। বীরত্ব-সাহসিকতা এসব শব্দের সাথে অবশ্যই জড়িত নৈতিকতা, সততা, নিঃস্বার্থ মানসিকতা, চারপাশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার মানসিকতা, পরোপকারীতা কিংবা সকলের মঙ্গলার্থে অনুসৃত আদর্শের জন্য সংগ্রাম। সর্বোপরি বীরত্ব-সাহসিকতা, ব্যক্তিগত ইচ্ছে-চাহিদা-কামনার উর্ধ্বে থাকবে । এর বাইরে, সাহস শব্দটা কী যৌনতার জন্যে প্রয়োগ যুক্তিসিদ্ধ, খেলোয়াড়দের সাহসী বলা জরুরি, ঘৃণ্য কীটসম মারমুখি দাঙ্গাবাজ নেতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়?  আমি বলি, না। 

যৌন আবেগ মানুষের স্বাভাবিক সহজাত অনুভূতি। যৌনতার ক্ষেত্রে সাহস দরকার হয় না। যা দরকার তা আবেগ, কামনা বা লালসা। যৌনতার জন্যে দেখানো সাহস ইতিবাচক অর্থে সাহস নয়, সকলের স্বার্থে সাহস নয়, এটা কেবল ব্যক্তিস্বার্থেই। আর ব্যক্তিগত সুখের জন্য দেখানো সাহসকে ইতিবাচক সাহস হিসেবে দেখিনা আমি। কেননা যৌনতা ব্যক্তিগত ইচ্ছে-চাহিদা-কামনার উর্ধ্বে নয়। যৌনতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আবেগ-ইচ্ছে-কামনা-লালসা এড়িয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়। জনস্বার্থবিরোধী নেতার ক্ষেত্রেও সাহস শব্দটা হাস্যকর শোনায়। আর খেলাধুলাতো বিনোদন, তাতে সাহস বা দেশপ্রেম যেটুকু মেশে তা-ও ব্যক্তিগত ইচ্ছে-চাহিদা-বাসনার উর্ধ্বে যেতে পারে না।

যত্রতত্র ‘সাহস’ শব্দটার প্রয়োগ বন্ধ হওয়া জরুরি। ইতিবাচক নয় এমন অর্থে বিশেষ করে ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো ঘটনাকে সাহসী ঘটনা বলা উচিত নয়। ইংরেজিতে ইতিবাচক অর্থে সাহসের জন্যে Bravery, Courage ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। সাহসের জন্যে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয় Audaticy, Impudence, Arrogance ইত্যাদি।  কিন্তু বাংলায় কেন যেন আমরা ইতিবাচক-নেতিবাচক সব ভুলে ‘সাহস’ শব্দটাকে ঢালাওভাবে ব্যবহার করি।

যেমন- 
-‘চোরটার কী সাহস, থানা থেকে চুরি করেছে!’ (এই ক্ষেত্রে ‘সাহস’ শব্দটা ভুলভাবে ব্যবহৃত। এখানে সাহসের বদলে ‘স্পর্ধা’ বলা উচিত। )
-‘ছেলেটা সাহসী, সে নিজের যৌনতার ইতিহাস সকলকে জানাতে ভয় পায় না।’  (এখানে ‘সাহসী’র স্থলে আমি ব্যবহার করব ‘বেহায়া’, ‘নির্লজ্জ’, ‘চক্ষুলজ্জাহীন’, ‘অসভ্য’ ইত্যাদি শব্দ।)
-‘কয়েদীটা কী সাহসী, গরাদ ভেঙে পালিয়েছে!’ (এখানে ‘সাহসী’র বদলে ‘ভয়ঙ্কর’ শব্দটা প্রয়োগ করব।)

সাহসী হয়ে ওঠার জন্যে পূর্বে দরকার ছিল মহৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের, বিশাল নিঃস্বার্থ হৃদয়ের। যিনি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও অত্যাচারীর বুলেটের মুখে দাঁড়ান, যিনি পরের বেলায় খাবার জুটবে কী-না এটা না ভেবে এ-বেলায় যা আছে সব বিলিয়ে দেন ভিখিরীকে বা ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে অকাতরে বিলিয়ে যান ধন-সম্পদ, যে অটল দাঁড়িয়ে থাকে সমস্ত অসততার বিপরীতে, যে আঘাত পেতে হবে জেনেও প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করে সমস্ত দুর্নীতি-অসাম্যের বিরুদ্ধে, যে দাঁড়ায় বঞ্চিত মানুষের পাশে সমস্ত প্রতিকূলতা সত্তেও, যারা সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে সমস্ত সম্পদ পায়ে ঠেলে কাজ করে মানুষের মুক্তির জন্যে, যারা কাজ করে মানুষেরই স্বার্থে- তারাই সাহসী, তারাই বীর।

আজকাল শুনতে পাই, ব্যক্তিগত যৌনতার ইতিহাস বলে ফেলাটা সাহসের কাজ... এমন একটি বক্তব্য চোখের পড়ার পরই মূলত এই লেখাটি ঝিলিক দিয়ে যায় মাথায়। সে যাক, যৌনতার গল্প-ইতিহাস বলে বেড়ানো কী আসলেই সাহসের কাজ? না, তা কখনো নয়। এতে বরং কম দায়িত্বের প্রয়োজন হয়। এমনকি গভীর উপলব্ধি, পড়াশোনারও দরকার পড়ে না এসব গল্প বলতে। যারা যৌনতার গল্প-ইতিহাস লিখতে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাদের প্রতি মানুষ আস্থাহীনতায় ভোগে। যে মানুষটি ব্যক্তিগত যৌনতার গল্প গুরুত্বপূর্ণ মনে করে প্রকাশ করে তার ওপর আস্থা রাখার কিছু নেইও। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ তার নিজের উপর হওয়া যৌন অত্যাচারের ইতিহাস তুলে ধরে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কেননা এতে করে সে অন্যায়কে সামনে আনছে, ভবিষ্যতে এমন অন্যায় থেকে কাউকে বিরত করা, সর্বোপরি প্রতিবাদের উদ্দেশ্যেই এটা করছে। তবে কোনটা প্রতিবাদ কোনটা নির্লজ্জতা এটা ধরে ফেলা কিন্তু কঠিন নয়।

আধুনিক মানুষ তুলনামূলক কম দায়িত্ব নিয়ে বাঁচে। ফলে সে অনেকগুলো ফ্যান্টাসী তৈরী করে নেয় বেঁচে থাকার সময়ে। ‘যৌনতার সাহসী গল্প’, ‘কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণকারী খেলাধুলা’, ‘সফল হবার মূলমন্ত্র’  ইত্যাদি অনেকগুলো ফ্যান্টাসীর মধ্যে অন্যতম। আধুনিক মানুষ নিজেকে বীররূপে দেখতে পছন্দ করে, কিন্তু বীরত্ব দেখানোর উপায় হিসেবে সে বেছে নেয় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বিষয়বস্তু বা কেউ কেউ অত্যাচার করাকেও বীরত্ব ধরে নেয় । পুঁজিবাদি সমাজব্যবস্থা এই মানসিকতায় আরো গতি দিয়েছে। রুচি অনুযায়ী ব্যক্তিগত ভোগকে নিশ্চিত ও ভোগের পরিমাণ বাড়াতে পুঁজিবাদ আপ্রাণ চেষ্টা করে সেটা ক্ষতিকর হলেও। এমনকি এই পুঁজিবাদ, অস্ত্রের ব্যবসায়ের প্রসারে অস্ত্র বিক্রি বাড়াতেও উৎসাহ যোগায়। আপত্তি কখনো করে না, লোক দেখানো ব্যতিত। এছাড়াও মদ বিক্রি, পতিতার সংখ্যা বৃদ্ধি , পর্ণ ইন্ডাস্ট্রির সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ও পুঁজিবাদ হাসিমুখে মেনে নেয়। এসবেও আপত্তি করে না।

পুঁজিবাদ তার চেষ্টায় সফল। কেননা আমরা দেখি- পুঁজিবাদি কর্পোরেট পৃথিবী মানুষের মনন-রুচি নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রেমিকাকে জনসমক্ষে ফুল-চিঠি-চকলেট দেয়াও সহজাত প্রবৃত্তিগত বিষয় না হয়ে সাহসী কাজ হিসেবে বিবেচিত আজকাল। পর্ণস্টার হওয়াও সাহসী কাজ হয়ে গেছে। মানুষ একটি গোল দেয়া বা দু-তিনটে ছক্কা হাঁকানোকেও বীরত্বসূচক কাজ বলে মেনে নেয় এবং এর জন্যে পুরস্কার দিতে কার্পণ্য করে না। অথচ একজন খেলোয়াড়ের দায়িত্বই ভালো খেলা, গোল দেয়া বা ছক্কা হাঁকানো বা উইকেট নেয়া। সে বেতনও পেয়ে থাকে, তবু ভালো খেলার জন্যে তাকে পুরস্কৃত করা হয়, সেটাতে আপত্তি করেন না কেউই। এভাবে আরো অনেক কিছুতেই মানুষ আপত্তি করে না।

আপনি কি বলবেন ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ তথা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ অত্যাচারীদের উৎসাহিত করেনি? সে সুযোগ নেই। আপনার যদি কোনো শুয়োর ছানার সাথে পরিচয় ঘটে থাকে, তাকে বা তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানবেন, তারা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। লালন করে। চর্চা করে। এবং নিজেদের ইঙ্গিত করে বলে থাকে- সাহসীরাই জেতে।

এইসব অনাপত্তির বিষয় এতই ভয়ানক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেকোনো অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে দেশের মানুষ কোন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত বর্তমানে। যদি কোনো ক্রিকেট সিরিজ চলে বা জনপ্রিয় দলের ফুটবল খেলা চলে বা টিভিতে সুন্দরী প্রতিযোগিতা চলমান থাকে কিংবা জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত কারো পরকীয়ার গল্প ভাইরাল হয়ে পড়ে অথবা পাশের দেশের নির্বাচন চলমান থাকে, তবে বুদ্ধিমানের কাজ হবে অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে সেটা সাময়িকভাবে গিলে ফেলা। কেননা সেসব কথার চেয়েও মানুষ গুরুত্বপূর্ণ করে নিয়েছে খেলাধুলা, যৌনতা, সেলিব্রেটিদের কেলেংকারী, পাশের দেশের নির্বাচন ইত্যাদি প্রসঙ্গ। 

আসলে মানুষের মজ্জায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে- দেখো, খেলাধুলা-যৌনতা-সেলিব্রেটিদের কেলেংকারী-পাশের দেশের নির্বাচন এসবই গরুত্ব বহন করে, এর বাইরে জরুরি কিছু নেই, এমনকি তোমার নিজের চারপাশ নিয়ে কোনো পরিবর্তনের ভাবনা থাকাটাও জরুরি নয়। থাকাটা ভুল, পাপও। ফলে, আপনাকে অনাচারের কথাগুলো তখনই বলতে হবে যখন মানুষের সামনে মিডিয়ার উপস্থাপিত কোনো প্রসঙ্গ নেই। তবে এরপরও মানুষের সাড়া মিলবে কী-না সেটা বলা দুঃসাধ্য। এমনকি এ-ও হতে পারে যে, আপনাকে অনাচারের চিত্র তুলে ধরার জন্যে সাহসী না বলে বিশৃঙ্খলাকারী বলবে মানুষ।

পুঁজিবাদের প্রভাবেই হয়তো আমরা কিছু প্রশ্ন কখনোই মাথায় রাখি না, রাখলেও গভীর পর্যবেক্ষণে যাই না। যেমন-
একজন কৃষক যদি ভালো ফসল ফলান, একজন শ্রমিক যদি বেশি পরিশ্রম করে কাজ এগিয়ে নেন, একজন মৎস্যজীবি যদি বেশি মাছ ধরেন তাদেরকে কী কেউ পুরস্কৃত করে? খেলোয়াড়রা সেঞ্চুরি করলে বা গোল দিলে যেমন কর্পোরেট হাউজগুলো ঝাঁক বেধে পুরস্কার-সম্মাননা দিতে মুখিয়ে থাকে তেমন করে কৃষক-শ্রমিকদের কাজগুলোকে কী পুরস্কৃত করতে এগিয়ে আসেন কেউ? খেলোয়াড়দের কাজ যেমন বীরত্বসুলভ ভেবে নেয়া হয়, দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ মনে করে হয়, কৃষক-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কী তেমনটা ঘটে? তাদের কাজকে বীরত্বসূচক ধরে নেয়া হয়? তাদের দেশপ্রেমিক আখ্যা দেয়া হয়? 

অথচ প্রচন্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিতে বা প্রখর রোদে হিংস্র প্রাণী, বিষধর সাপ বা কীটপতঙ্গ উপেক্ষা করে দীর্ঘসময় কাজ করে এরা। এতে সত্যিকারের সাহসের প্রয়োজন রয়েছে। এরাই সাহসী। মধ্যবিত্ত পিতারা যখন পরিবারের জন্য ভয়ানক পরিশ্রম করে উপার্জন করেন, প্রতিদিন অফিস যান বিপদজনকভাবে বাসে ঝুলতে ঝুলতে, বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাবার পরও যারা অফিস কামাই করেন না, দৃঢ় চিত্তে ডুবে-ভিজে কাজে চলে যান, ঈদে-উৎসবে বেতনের টানাটানি সত্ত্বেও নিজে টিফিন কম খেয়ে বা গাড়িভাড়া বাঁচিয়ে যারা সন্তানের জন্যে বাজারের সুন্দর জামাটা কেনেন, তাদের আমি সাহসী বলি। একজন নারী, যিনি কঠোর পরিশ্রম করেন ঘরে-অফিসে, তিনি যখন অফিসের প্রচন্ড কাজ ও সংসারের চাপ সহ্য করেও একজন সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেন, সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, সন্তানকে বড় করে তোলেন, তাকে আমি সাহসী বলি এবং এ সাহসের তুলনা হয় না।। 

সাহসী তাকে বলি না যে ব্যক্তিগত যৌনতার গল্প বলে; ব্যক্তিগত যৌনমুক্তির স্লোগান যে দেয়; যে কেবল খেলেই দেশপ্রেমিক হতে চায় এসব মানুষতো স্রেফ আত্মপূজারী, কেবল আত্মসন্তুষ্টিই এদের লক্ষ্য। এদের ভাবনায় পরিবার-দেশ-সমাজ-পৃথিবী নেই। এরা ফালতু। পৃথিবীর আবর্জনা।

আরো একপ্রকার সাহসের সুবাস সহসাই নাকে লাগে পত্রিকা খুললে, টিভি নিউজ দেখলে, আজকাল ফেসবুকের নিউজফিডও এসব সাহসের কাজ কারবারের সংবাদে ভরপুর। প্রায়শই দেখি নিরীহ কারো ওপর ইট-পাথর, চাপাতি-লাঠি নিয়ে বা খালি হাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে কিছু সাহসী তরুণ.... এসবে আমার শুয়োর ছানার অভ্যাসের বিষয়ে মনে পড়ে যায়। শুয়োর ছানার যখন দাঁত গজায় তারা ক্রমেই সাহসী হয়ে ওঠে আর অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের আক্রমণ করে, কামড়ায়। রক্ত তাদের আকৃষ্ট করে। নোংরা, ময়লা, দুর্গন্ধ এদের পছন্দের। তো, যখন নিরীহরা এমনকি নারী ও শিশুরাও বেঁচে যেতে পারে না এইসব তরুণদের সাহসী হাত হতে, যখন নিরীহদের রক্ত দেখা এদের নেশায় পরিণত হয়, যখন নারীর বুকে এদের হাত চলে যায় প্রকাশ্যে, যখন সকল দুর্গন্ধময় কাজে এদের অগ্রগামী দেখা যায়, তখন এইসব তরুণের এই সাহসকে আমি বলি- শুয়োরের বাচ্চার সাহস। 

একটা প্রশ্ন আসতে পারে যে, পুঁজিবাদের সাথে এমনতর শুয়োরছানাসম সাহসের সম্পর্কটা কোথায়? উত্তরটা সরল। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করে – ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’- এই বক্তব্যটি [1]। এই বক্তব্য অবশ্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উগ্রতার সাথে সম্পর্কিত। আর শুয়োরের ছানার সাহসকে আপনি উগ্রতাই বলবেন, তাই না? প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটি প্রথম বলেন হার্বাট স্পেন্সার। তবে ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটির ভিত্তি মূলত ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্ব । ডারউইনের এই তত্ত্ব বা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ বক্তব্যটি হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনীকে অনুপ্রাণিত করেছিল [1] [2] [3]। এটিকে জীবনদর্শন হিসেবে নিয়েছিলেন- স্তালিন [3] , মাও-সে-তুং [4] [5] [6] প্রমুখ ব্যক্তিগণেরাও। বেশ একটা লম্বা নামের তালিকা দেয়া যাবে, যারা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ তথা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ কথাটি দ্বারা অনুপ্রাণিত। 

যদিও কেউ কেউ বলেন শাসক বা অত্যাচারীরা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ বা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটি ভুল অর্থে প্রয়োগ করেন। এ নিয়ে নানান মতপার্থক্য  রয়েছে। কিন্তু  মতপার্থক্য সত্তেও আপনি কি বলবেন ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ তথা ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ অত্যাচারীদের উৎসাহিত করেনি? সে সুযোগ নেই। আপনার যদি কোনো শুয়োর ছানার সাথে পরিচয় ঘটে থাকে, তাকে বা তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানবেন, তারা ‘সারভাইভাল অফ দা ফিটেস্ট’ কথাটি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। লালন করে। চর্চা করে। এবং নিজেদের ইঙ্গিত করে বলে থাকে- সাহসীরাই জেতে।

সাহসী বলতে যাদের বুঝি আমি, আমি জানি আপনারাও একমত হবেন- তারা ছিলেন সেসব মানুষেরা যারা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে আওয়াজ তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাহসের প্রয়োজন ছিল যখন তিনি আঙুল তুলে বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সাহসের প্রয়োজন ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের। নুর হোসেন যখন বুকে-পিঠে স্বৈরাচার বিরোধী স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমেছিল, তখন তার ভীষণ সাহসের প্রযোজন ছিল। 

কিন্তু যৌনতার গল্প বলার জন্য মানুষ যখন কাউকে সাহসী বলে, খেলোয়াড়দের যখন বীর উপাধি দেয়া হয়, যখন কিছু শুয়োর ছানা সাধারণের বিরুদ্ধে লড়ে, সাধারণের ওপর হামলে পড়ে, সেসব কোন সাহস? কোন বীরত্ব? এসবে সমাজের-রাষ্ট্রের-সাধারণের কী আসে যায়? সাহসটা কেন কেবল যৌনতার ক্ষেত্রে বা খেলাধুলায় বা সাধারণের বিরুদ্ধে? সেটা কেন নয় এলাকার গুন্ডার সামনে, লোভী ব্যবসায়ী বা দুর্নীতিবাজ নেতার সামনে? প্রকাশ্যে? অর্থলোভী কিংবা নারীলোভী বসের সামনে? কেন আমাদের সাহস কেবল ফেসবুকে, লেখার খাতায়? কোন সাহসের কথা বলি আমরা আজকাল? 

এ-কেমন সাহস, হে পৃথিবীর মানুষ? হে তরুণ, এ কোন সাহস নিয়ে তুমি এগিয়ে চলছো, যে সাহসে তোমার ব্যক্তিগত কামনা-ভোগ-লাভ ব্যতিত আর কিছু মিশে নেই? ব্যক্তিগত ভোগ-কামনা নিশ্চিতে ও প্রকাশে তুমি যে সাহস দেখাও, তোমার যে সাহসে আমার মনে পড়ে যায় শুয়োর ছানার কথা সেই সাহসে থুতু। ঘৃণা।


টীকা লিংকসমূহঃ

  1. https://www.history.com/topics/social-darwinism
  2. https://creation.com/darwinism-and-the-nazi-race-holocaust
  3. http://www.geocities.ws/films4/evolutionbreedsmonsters.htm
  4. https://www.newyorker.com/magazine/2010/12/20/staying-power-3
  5. https://creation.com/the-darwin-effect-review
  6. https://evolutionnews.org/2009/12/darwin_and_mao/
লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই