চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক পাঠ



অস্তিত্ববাদের প্রাথমিক পাঠ
তৌকির হোসেন

গত শতাব্দীর ইয়োরোপের দার্শনিক চিন্তাধারার একটি বড় জায়গা দখল করে রেখেছে অস্তিত্ববাদী দর্শন। যদিও এর ভিত গড়ে উঠতে শুরু করেছিলো সেই সোরেন কিয়ের্কেগার্দের (১৮১৩- ১৮৫৫) সময় থেকে। পরবর্তীতে ফ্রিদরিখ নীৎশে, মার্টিন হাইডেগার সহ অন্যান্য ইয়োরোপীয় দার্শনিকগণ এর একটি তত্ত্বগত দিক তৈরী করে দেন। 'অস্তিত্ববাদ' নাম দিয়ে এই তত্ত্বগত জ্ঞানকাণ্ডের দার্শনিক ভিত্তি সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র (১৯০৫- ১৯৮০) তাঁর দুটি বিখ্যাত রচনা 'বিয়িং এ্যান্ড নাথিংনেস' (১৯৪৩) ও 'এক্সিস্টেনশিয়ালিজম ইজ হিউম্যানিজম' (১৯৪৬) এর মাধ্যমে। শেষের ছোট গ্রন্থটি মূলত অস্তিত্ববাদের বিরুদ্ধে আরোপিত কিছু সমালোচনার বিশ্লেষণ এবং যুক্তিখন্ডনের সংকলন। আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে এখানে সার্ত্র কিছু ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন এবং ব্যাখ্যাগুলোর দ্বারা চমৎকারভাবে তিনি এই দর্শনের একটি সহজবোধ্য রূপরেখা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এই প্রবন্ধে অস্তিত্ববাদী দর্শনের বিশদ ইতিহাস আলোচনা করা হবে না। বরং এর ভাববাদী ও ব্যক্তিবাদী বৈশিষ্ট্য কিভাবে ব্যক্তিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার বিস্তৃতি ঘটায় তা আলোচনা করা হবে। পরিশেষে বর্তমান শতাব্দীতে এই দর্শনের কোন গুরুত্ব অবশিষ্ট আছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হবে।

অস্তিত্ববাদ নিয়ে এগোনোর আগে আমাদের আগে জানতে হবে 'অস্তিত্ববাদ' কী? এর মূলে কোন কোন প্রশ্ন রয়েছে। যেকোন দর্শনের শিকড়ে থাকে কিছু প্রশ্ন যা জগৎ ও ব্যক্তিকে ঘিরে তৈরী হয়, যার অনুসন্ধান নতুন চিন্তাধারার জন্ম দেয়, নতুন পথের আলো দেখায়। সত্তার যথার্থ প্রকৃতির প্রশ্ন নিয়ে যেমন অধিবিদ্যা (Metaphysics), নৈতিকতার প্রশ্ন নিয়ে যেমন মূল্যতত্ত্ব বা নীতিশাস্ত্র (Ethics), জ্ঞান সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology) তেমনি এই অস্তিত্ববাদের শিকড়ে একটি মূল প্রশ্ন রয়েছে। তা হচ্ছে মানুষ ও ব্যক্তির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন। অস্তিত্ববাদ আলোচনা করে ব্যক্তির অস্তিত্ব নির্ণয়ে ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং ভূমিকা। সার্ত্র তাঁর 'অস্তিত্ববাদ' গ্রন্থে এই দর্শনের প্রথম সূত্র উল্লেখ করেছেন, "মানুষ হচ্ছে তাই, যা সে (ব্যক্তি) নিজেকে বানায়"। অর্থাৎ, ব্যক্তির হাতেই মূল অস্ত্র রয়েছে নিজেকে তৈরী করবার, নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবার। 'মানুষ'-এর সংজ্ঞা আগে থেকে নির্দিষ্ট নয়। একদিকে নীৎশে যেমন 'ঈশ্বর মৃত' বলে ঘোষণা করেছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে, তেমনি বিংশ শতাব্দীতে এসে সার্ত্র-পরবর্তী প্রজন্মের দার্শনিক মিশেল ফুকো এক অর্থে ধারণা দেন, 'মানুষ মৃত'। এখানে 'মৃত' অর্থ বলতে ফুকো বুঝিয়েছেন 'মানুষ'-এর যে সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়েছে তার বয়স তিনশ বছরের বেশি নয়। প্রতিষ্ঠান তৈরী করে দেয় মানুষের সংজ্ঞা, পাগলাগারদ যে উপায়ে স্বাভাবিক/অস্বাভাবিক 'মানুষ'-এর নামকরণ করে, তেমনি রাষ্ট্রও সাধারণ/দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত 'নাগরিক'-এর নামকরণ বা সংজ্ঞায়ন করে। ফলে ব্যক্তিসত্তা হারাতে হারাতে ক্রমেই মানুষ ধাবিত হতে থাকে নামপ্রাপ্ত সত্তার দিকে। একটা পর্যায়ে নিজ স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে মানুষ পরিণত হয় 'অনুকরণকারী বস্তু'তে যা ক্রমশ নিজের নামধারী সত্তাকে প্রমাণ করতে চায়, নিজের স্বকীয় অস্তিত্ব বাদ দিয়ে। সার্ত্র এই জায়গাটিকে বলেছেন 'আত্মপ্রতারণা' (Bad Faith এর সমার্থক বাংলা শব্দ এটিই হতে পারে)। কেননা, অন্যের আরোপিত বিশ্বাস দ্বারা মানুষ নিজেকে যদি চরিতার্থ করতে যায় বা নিজেকে ওভাবেই অন্যের ছবির মাধ্যমে দেখতে থাকে তাহলে তা হবে তার ব্যক্তিসত্ত্বার সাথে আত্মপ্রতারণা। সার্ত্র জোর দেন, মানুষ স্বাধীন হতে বাধ্য তার জন্ম থেকেই। তার মনুষ্য-সত্ত্বা, অস্তিত্বের পূর্বগামী নয়। বরং ব্যক্তির অস্তিত্বই মনুষ্য-সত্ত্বা তৈরী করে। অর্থাৎ, যদি কোন শিশু জন্ম নেয় তবে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে নিজের মতো বিকশিত হয়ে নিজের স্বকীয় সত্ত্বা গঠন করবার। কিন্তু, পারিবারিক কাঠামোর মাধ্যমে যদি শিশুটি আত্মস্থ করে তার লৈঙ্গিক দায়িত্ব এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে প্রলুদ্ধ হয় কিংবা স্কুলে শ্রেষ্ঠ ছাত্র হওয়ার জন্যে আগে থেকেই তার ভিতরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ধারণা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, শিশুটির চাওয়া/না-চাওয়াকে উপেক্ষা করে, তবে নিঃসন্দেহে এটি হবে পরিবারের শিশুর উপর চালিত শোষণ। এই ক্ষেত্রে, অস্তিত্ববাদ সর্বদাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উপর নজর দেয়। অস্তিত্ববাদ জোর দেয় শিশুর স্বাধীন বিকাশের উপর, নিয়ন্ত্রিত বিকাশ নয়। ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং এনলাইটেনমেন্টের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিলো বিংশ শতাব্দীতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সময়ের ধারাবাহিকতায় এই পর্যায়ে তার শিখরে পৌঁছায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফ্রান্স, ইতালি ও জার্মানিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। সামাজিক ব্যবস্থার নৈরাজ্য মানুষের নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাববার পরিবেশ তৈরী করে দেয়। 'রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র' রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পদদলিত হয় সাধারণ মানুষ। এই অন্যায্য সময়ে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে৷ আদৌ কি তার বেঁচে থাকবার কোন মানে আছে? এই মৃত্যু শিবিরে মানুষের গুরুত্ব কোথায়? অস্তিত্ব সংকটের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ফরাসি দার্শনিকগণ, বুদ্ধিবাদীরা তখন অস্তিত্ববাদের ঝান্ডা তুলেন। তাঁরা বলেন, মানুষই প্রথম। এটা তার অস্তিত্ব যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র নয়, সমাজ নয়, পরিবার নয়। মানুষ নিজের সিদ্ধান্তের দ্বারা নিজেকে তৈরী করে। তার অস্তিত্ব হচ্ছে সত্তার পূর্বগামী। সংজ্ঞায়িত মানুষের নিজের অস্তিত্ব তৈরী করবার যুক্তি খোঁড়া, ব্যর্থ। একটা হাতুড়ি বা একটা কোদাল যখন তৈরী করা হয় তখন কামারের বা প্রস্তুতকারকের নির্মাণ করবার আগেই হাতুড়ি বা কোদালের একটি রূপ তার কল্পনায় থাকে। কল্পিত রূপ অনুযায়ী তখন হাতুড়ি বা কোদালের প্রস্তুতকার্য চলতে থাকে। অর্থাৎ, হাতুড়ি বা কোদালের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা তাদের অস্তিত্ব তৈরীতে ভূমিকা রাখে। সার্ত্র বলছেন, মানুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি হয় উল্টো। মানুষ আগে জন্ম নেয়, বেড়ে উঠে এবং নিজেকে নিজেই সংজ্ঞায়িত করে, তৈরী করে। এই সংজ্ঞায়ন বা বিনির্মাণ মানুষের ক্ষেত্রে কিভাবে ঘটে?

সার্ত্রের পরে ফরাসি বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে মিশেল ফুকোর একচ্ছত্রবাদ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ 'অস্তিত্বসংকটে' পড়ে। সিমন দ্য বুভোয়াঁ সার্ত্রকে বলেন, যদিও ব্যক্তিকে পুরোপুরি স্বাধীন ঘোষণা করা হচ্ছে কিন্তু সামাজিক কাঠামোও তো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রিত করে দিচ্ছে। সার্ত্রের কথা কি তাহলে খানিকটা সরলীকৃত হয়ে যায় না? কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে সার্ত্র তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতার বিশ্বাসে অটল থাকেন।

ব্যক্তি যা করে, তাই তার অন্যের সাপেক্ষে ছবি বা তাকে মানুষ হিসেবে তৈরী করে। যুদ্ধের সময় এক তরুণ সার্ত্রের কাছে আসে উপদেশ নেওয়ার জন্যে। সেই সময় ফ্রান্সের সক্ষম যুবকরা দলে দলে যোগ দিচ্ছে যুদ্ধে। তরুণটিও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবার জন্যে তাগিদ বোধ করে। কিন্তু যুদ্ধে গেলে ঘরে তার অসুস্থ মা বিপত্তিতে পড়ে যাবে। তার উপর সে তার মা-এর একমাত্র সন্তান। ঘরে অসুস্থ মা? না দেশপ্রেমের টানে অন্যদের পথে চলা? একমাত্র সন্তান হিসেবে যদি ছেলে থেকে যায় ঘরে তাহলে যেমন সবার ভ্রুকুটির লক্ষ্য সে হবে, তেমনি ঘরে মাকে ফেলে রণক্ষেত্রে চলে গেলে তার নিজের মধ্যে গ্লানির সৃষ্টি হবে। এই উভয়সংকটে পড়ে যখন সার্ত্রের কাছে আসা হলো, তিনি চরমভাবে ছেলেটিকে হতাশ করেন। তিনি সাধারণভাবেই বলেন, 'এটা তোমার সিদ্ধান্ত। তুমি যদি অন্যদের সাথে যুদ্ধে যাও, তাহলে তোমার সৈনিক হিসেবে একটি বাহ্যিক চরিত্র তৈরী হবে তেমনি মা-এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে থেকে গেলে দায়িত্বশীল সন্তান হিসেবে তোমার চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, এটাই তোমাকে নির্ধারন করবে। এবং এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে তুমি মুক্ত, স্বাধীন।' এটাই বাধ্যতামূলক স্বাধীনতা। এখানে তরুণের মধ্যে যে উভয়সংকটজনিত কারণে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্যে তাকে প্রফেসরের পরামর্শ চাইতে আসতে হয়েছে, সার্ত্রের মতে এটি 'অস্তিত্বগত উদ্বেগ' (Existential Angst)। অবধারিতভাবে অস্তিত্ববাদী ব্যক্তিকে এই সংকটকে মেনে নিতে হবে। এই স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা একেকজন ঈশ্বরবাদ, নিরীশ্বরবাদ বা সংশয়বাদ নানা ধারার আশ্রয় নিয়েছেন। সার্ত্র, কাম্যু যেমন নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদ নিয়ে এগিয়েছেন, তাঁদের পূর্বসূরি কিয়ের্কেগাদ আস্তিকতায় ব্যক্তির স্বাধীনতার বিষয়টির সংযুক্তি ঘটিয়েছেন।

নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদে নীৎশের ভাবধারার একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি যখন চলে আসে, একজন ব্যক্তি যাই করুক না কেন তাতে যখন নৈতিক বাধ্যবাধকতার কোন প্রশ্ন থাকে না, তখন কি স্বেচ্ছাচারিতার আশংকা থেকে যায় না? এই জায়গাতেই অস্তিত্ববাদের সাথে মানবতাবাদের সংযোজনের সূত্র নিহিত। অস্তিত্ববাদের আলোকে একজন মানুষ যখনই তার সিদ্ধান্ত অনুসারে নিজেকে নির্মাণ করে তখন সে শুধু নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করে না বরং পুরো মনুষ্যজাতিকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এইক্ষেত্রে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করবার পাশাপাশি পুরো মানবজাতিকে সংজ্ঞায়িত করবার দুটো অবধারিত স্রোত একইসাথে প্রবাহিত হয়। মানুষ নিজের একমাত্র আইন-প্রণেতা, সেইসাথে ব্যক্তিবাদী সত্তা। সবকিছু তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় ব্যক্তিবাদী দুনিয়ায়। তাকে অসংখ্য মানুষের সাথে বসবাসও করতে হয়। যতই সে ব্যক্তিবাদী হোক না কেন, তার তীব্রতা বা কেন্দ্রিকতা যতই একরৈখিক হোক না কেন, সে  আন্তঃমানবীয় সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারে না, সেই শক্তিও তার নেই। এই অর্থে, নিজের স্বার্থে যতই অগ্রসর হওয়া যাক না কেন, আন্তঃমানবীয় সম্পর্কে ব্যক্তি সর্বদাই বিদ্যমান। ব্যক্তি, নিজে মানুষ। সে যদি নিজে তৈরী হয়ে উঠে, এক অর্থে অন্যরাও নিজেদের তৈরী করছে আবার অন্য অর্থে দুনিয়ার সকল মানুষই নিজেদের তৈরী করছে। অর্থাৎ, মানুষের গুরুত্ব কোনভাবেই কমছে না। নিজের প্রতি দায়িত্ব আদতে মানুষের তাদের নিজেদের প্রতি দায়িত্ব। এখানে, রুশোর 'কমন গুড'-এর কথা স্মরণে আনা যেতে পারে। স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ উৎকর্ষ (সেটিও নিজস্ব সৃষ্টি) সাধনে কাজ করে যাওয়ার মাধ্যমে সবাই সমাজ, রাষ্ট্রের কাঠামো তৈরীতে সাহায্য করে পরোক্ষভাবে। 

সার্ত্রের পরে ফরাসি বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে মিশেল ফুকোর একচ্ছত্রবাদ যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ 'অস্তিত্বসংকটে' পড়ে। সিমন দ্য বুভোয়াঁ সার্ত্রকে বলেন, যদিও ব্যক্তিকে পুরোপুরি স্বাধীন ঘোষণা করা হচ্ছে কিন্তু সামাজিক কাঠামোও তো ব্যক্তির সিদ্ধান্ত, স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রিত করে দিচ্ছে। সার্ত্রের কথা কি তাহলে খানিকটা সরলীকৃত হয়ে যায় না? কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবে সার্ত্র তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতার বিশ্বাসে অটল থাকেন। বুভোয়াঁর এই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি পূর্ণ রূপ পায় মিশেল ফুকোর কাঠামোবাদী দর্শনে। ফুকোর ক্ষমতাকাঠামো কিভাবে ব্যক্তিকে শোষণ করে এবং ক্ষমতাকাঠামোর ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্বকারী প্রভাব অস্তিত্ববাদী দর্শনের ভিত্তিগত জায়গায় একটি বিরোধিতার জন্ম দেয়। তা সত্ত্বেও, সার্ত্র, ফুকো প্রজন্ম এবং ফরাসি বুদ্ধিবাদীদের মধ্যে উজ্জ্বল শিরোমণি হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন এবং এখনও আছেন।

আমাদের এই সময়ের ফ্যাসিবাদী জমানায় অস্তিত্ববাদী দর্শনের তাৎপর্য এখনও হারিয়ে যায় নি। অস্তিত্ববাদীরা উত্তরাধুনিক কাঠামোর মধ্যে ব্যক্তির আত্মসংকট আরও ভালো করে উপলদ্ধি করে। ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্পর্কে যা বলেছেন সার্ত্র, তার সময়োপযোগিতা এখন সময়ের সাথে সাথে আরও প্রস্ফুটিত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের মধ্যকার ভৌগলিক বাধা অপসারিত হয়েছে, আন্তঃযোগাযোগের ব্যাপ্তি আরও বেড়েছে। ফলে ব্যক্তির অস্তিত্ব কোথায়? এর তাৎপর্যের জায়গা কোথায়? আমরা কি সবাই একই আঙ্গিকে চিন্তা করি? প্রতিযোগিতার যুগে ব্যক্তির স্বকীয়তা কোথায়? শিক্ষাব্যবস্থার পেষণকলে ব্যক্তির স্বাধীনতা কোথায়? ব্যক্তির সামগ্রিক সংজ্ঞায়ন ও নিজস্ব সংজ্ঞায়নের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এই ধরণের নানাবিধ প্রশ্ন আজ আরও বেশি করে দার্শনিকদের আলোড়িত করে। নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কিত যে তত্ত্ব নতুন করে আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় জায়গা করে নিচ্ছে তার শেকড় খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, এখানে ব্যক্তিগত হতাশার বা আত্মসংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অনস্বীকার্য। তখন কোন কিছুরই কোন মানে নেই বা সবকিছুই ভঙ্গুর, অনর্থক এই ধরণের ভাবের প্রকাশ ঘটে নানা মাধ্যমে। এগুলো কাম্যুর সিসিফিয়ান অনর্থের ও সার্ত্রের অস্তিত্বগত উদ্বেগের নানা রূপ হতেও পারে। তবে পুরোপুরি প্রমাণ করা না গেলেও বর্তমানের নৈরাজ্যবাদের অস্তিত্ববাদী যে একটি শাঁস রয়েছে তা নাকচ করে দেওয়া যায় না। বিশেষত, উত্তরাধুনিকতা ও অস্তিত্ববাদী দর্শনের নতুন মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রথম দৃষ্টিতে দুটিকে পরস্পর স্ববিরোধী মনে হলেও, গূঢ় বিশ্লেষণ এদের মধ্যকার যোগসূত্র বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম।

এই আলোচনা অন্যদিনের জন্যে মুলতবি রাখা যাবে না। এই আলোচনা আজকের হতে হবে, আগামীকালের হতে হবে। এই আলোচনা একপাক্ষিক হওয়া যাবে না, বরং হতে হবে দ্বিপাক্ষিক। কারণ, লেখক পাঠক উভয়েই স্বাধীন। কেউ কারও উপর নির্ভর করে না। পাঠক নিজ দায়িত্বেই এই প্রশ্নের অনুসন্ধানে মগ্ন হতে পারেন। পাঠক-লেখক বিভেদ ভেঙে ফেলে যখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ গতিতে জ্ঞানের সন্ধানে এগুবেন তখন প্রকৃত অর্থেই ব্যক্তি স্বাধীনতার বাস্তব প্রয়োগ দেখা যাবে। কারণ, আমরা স্বাধীন হতে বাধ্য। সার্ত্র এটিই বলেছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ
১. সরদার ফজলুল করিম, দর্শনকোষ, পঞ্চম সংষ্করণ (ফেব্রুয়ারি ২০০২)
২. Jean Paul Sartre, Existentialism, excerpted from Existentialism and Human Emotions (1957, 1985)
৩. Nigel Warburton, A Little History of Philosophy (2011)
৪. Lydia Alix Fillingham, Foucault For Beginners (2000)
৫. Lesley Virgina Herring, The Existential and Postmodern Individual (2005)

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই