চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ছোট গল্প বিষয়ক প্রস্তাবনা



ছোট গল্প বিষয়ক প্রস্তাবনা
আখতার মাহমুদ


সরল জীবন, সরল মানুষ বিরল হলেও সরল গল্প আমাদের পছন্দের। এর কারণ হতে পারে যে, এইসব গল্পে দায়িত্ব নিতে হয় না। এইসব গল্প কোনো বোধ তৈরী ব্যতীত আমাদের অনুভূতিগুলোকে (পড়ুন আবেগকে) উসকে দিয়ে আমাদের আক্রান্ত করতে গড়ে ওঠে লেখকের মনে। অথবা লেখক পূর্ব থেকেই আক্রান্ত থাকেন এবং সংক্রামক অসুখের মত এটিকে ছড়াতে থাকেন পাঠক মনে। এবং এটা যে অসুখ, এর যে চিকিৎসা প্রয়োজন সেটা লেখকেরা যদি সমস্তটা জীবন কাটিয়েও না বোঝেন তবে পাঠক হিসেবে আমাদের একটা দায় জন্মায় লেখকের চিকিৎসক হয়ে ওঠার। যত যা-ই হোক না কেন ‘আহা’, ‘উহু’ আহাজারি সৃষ্টি ব্যতিত এইসব গল্পের উদ্দেশ্য নেই বললেই চলে এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সেই সংজ্ঞাকে অনুসরণও এইসব গল্পের উদ্দেশ্য। সংজ্ঞাটা সকলেরই জানা, তবু আসুন আবারো একটু পড়ে নিই সংজ্ঞাটা-

"ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহ¯্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু'চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘন ঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ ।"

ছোটগল্পের এই রাবীন্দ্রিক সংজ্ঞাটা দুর্বল। এই সংজ্ঞা অনুসারে- 
গল্প হবে সরল, ছোট ছোট দুঃখগুলো হবে গল্পের উপজীব্য মানে বলা চলে ব্যক্তিগত ব্যথা-আবেগেই ঠাসা থাকবে গল্পগুলো। তত্ত্ব বা উপদেশ থাকবে না... এটার মানে কিন্তু এটাও হয় যে- কোনো মহৎ আদর্শের প্রচারও গল্পে থাকবে না, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তা থাকবে না, রাজনীতি সচেতনতা থাকবে না, অত্যাচারী শাসকের বিরোধীতা থাকবে না, শাসকের জন্যে শাসনের রূপরেখা থাকবে না। এবং গল্প শেষে একটা মানবিক আহাজারি, অতৃপ্তি থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গল্পের সংজ্ঞায় বিদ্রোহ বা বিপ্লবের ইঙ্গিত না থাকলেও ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে অন্তত দুটো হলেও গল্প রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। আমার জানামতে গল্পদুটো- ‘মেঘ ও রৌদ্র’ এবং ‘রাজটিকা’। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথ শাসকের বিরুদ্ধে কোনো গল্প লিখেছেন বলে আমার জানা নেই, অবশ্যই জানার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, এ বিষয়ে কেউ আমাকে এই উল্লেখ্য দুই গল্পের বাইরে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ শাসন বিরোধী কোনো গল্পের সন্ধান দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। এছাড়াও, বিশেষভাবে এটা উল্লেখ করা জরুরি যে, বাংলায় ছোট গল্পের পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং দুঃখের বিষয়, বাংলায় আজ অবদি কোনো গল্পকারের কোনো গল্পই তাঁর গল্পগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে বলে বলে আমার জানা নেই। অমন স্মার্ট গল্পকার কী আমরা আর পেয়েছি? না বোধহয়।

একটি মজার বিষয় হলো, হুমায়ুন আহমেদের গড়পড়তা উপন্যাসগুলোকে রবীন্দ্রনাথের এই দুর্বল সংজ্ঞার ছকে ফেলা বেশ সহজ। এমনকি পাঠক এই সংজ্ঞার সাথে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসগুলো মেলালে বিভ্রান্ত হবেন হয়তো এই ভেবে যে, রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞাটা বোধহয় উপন্যাসের আর হুমায়ুন আহমেদও একদম অক্ষরে অক্ষরে সংজ্ঞাটা মেনেই উপন্যাস লিখেছেন! 

ছোট গল্পের সাথে একটি বিষয় জুড়ে দেয়া হয় যে, চমক ব্যতীত ছোটগল্প নিরস এবং ব্যর্থ। কেউ কেউ হয়তো এটাও বলেন যে, ছোট গল্প মানেই চমক অবধারিত। কিন্তু, চমক থাকলেই তা গল্প আর না থাকলে তা গল্প নয়- এটা ভুল ধারণা। ছোট গল্পের পুরোনো সংজ্ঞা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। লেখকদের চেষ্টা করা উচিত জনপ্রিয় সংজ্ঞায় গল্পগুলোকে বেঁধে না ফেলা। কেননা এটা অনেকটা এমন ব্যাপার.... কাউকে নড়াচড়া করার জন্যে একটা ছোট্ট সীমানা এঁকে বলা যে- তুমি স্বাধীন, এই সীমানার ভেতর যেমন খুশি চলতে ফিরতে পারো! ছোট গল্প চেনার জন্যে আমার মতে এটুকুই যথেষ্ট যে, ছোট গল্প একটি পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক ভাব/বক্তব্য প্রকাশ করবে এবং এটি আকারে উপন্যাসের চেয়ে ছোট হবে। কিছুটা কাঠখোট্টা শোনালেও ছোট গল্পকে ছোট গল্প হিসেবে চিহ্নিত করার বাইরে আর কোনো বৈশিষ্ট্য আরোপ করতে রাজি নই আমি।

আরো আছে বর্ণনা নির্ভর, উপমা নির্ভর গল্প। এসব নান্দনিক গল্প পড়ে প্রাথমিকভাবে মনে হবে লেখক বেশ নির্মোহ এবং আবেগ ছাপিয়ে মানুষের জীবন/অনুভূতি আঁকছেন। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ওসবও আসলে নিরাপদ গল্প এবং উদ্দেশ্যহীন। পুরোপুরি রবীন্দ্র সংজ্ঞার ছকে তা লেখা না হলেও তা আরো ক্ষতিকর এক ছকে আঁকা, উদ্দেশ্যহীন ছক। এইসব গল্পের কোথাও যাবার নেই, কিছু বলার নেই। কেবলই আকর্ষণীয় বর্ণনা, উপমায় ঠাসা। কখনো এসব গল্প যৌনতায় জর্জরিত, কখনো হতাশায়। কখনো অনাবশ্যক স্ল্যাং ক্লিশে করে তোলে এসব গল্পকে। কখনো জাদুবাস্তবতাও ভর করে এসব গল্পে, ভুল-ভাল ও দুর্বল ঢঙে। এসব গল্পও সরলতা ও নিরাপদ ভাবার্থের গন্ডীতে ঘোরে-ফেরে। কখনো গল্পের ভাষাকে আলাদা রূপ দিতে ধর্মীয় প্রতীক, আচার ইত্যাদিকে ভুলে ভরা অজ্ঞানতায় ব্যবহার করে লেখক। কখনো ধর্মকে আঘাত করে ‘প্রথাবিরোধী’ তকমা পেতে লিখে যান কেউ কেউ। 

আসলে মানুষের আবেগ এতই ঠুনকো আর আত্মকেন্দ্রিক যে, এ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। এটা আমার কাছে আগ্রহ জাগানিয়া বিষয়ও নয়। সরল ও নিরাপদ গল্পগুলো লিখে ফেলা এবং পড়ার সময়েই মাথায় থাকুক আমাদের, এসব গল্প ব্যক্তিগত আবেগ নির্ভর। চমক নির্ভর। এসব গল্পে সমাজ-রাষ্ট্রের-পৃথিবীর প্রতি দায় থাকে না। এসব মানুষকে অথবা নিজেকেই আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে লেখা সরল নিরাপদ গল্প.... সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দদান- এটা যে একপেশে ও পুরোনো ভাবনা, এটা লেখা শুরুর আগেই মাথায় থাকুক আমাদের। খুব বেশি করে থাকুক।

এসব বক্তব্যের মানে কী আবার এই যে, কাউকে আমি নিষেধ করছি সরল, আবেগ নির্ভর, মানুষের সহজ দুঃখ, একান্ত বেদনাগুলো নিয়ে গল্প লিখতে বা উপমা নির্ভর বর্ণনামূলক গল্প না লিখতে? না। ব্যাপারটা তা নয়। আমার উদ্দেশ্য, আমাদের ছকবন্দী চিন্তাকে মুক্তি দেয়া।

আসলে মানুষের আবেগ এতই ঠুনকো আর আত্মকেন্দ্রিক যে, এ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। এটা আমার কাছে আগ্রহ জাগানিয়া বিষয়ও নয়। সরল ও নিরাপদ গল্পগুলো লিখে ফেলা এবং পড়ার সময়েই মাথায় থাকুক আমাদের, এসব গল্প ব্যক্তিগত আবেগ নির্ভর। চমক নির্ভর। এসব গল্পে সমাজ-রাষ্ট্রের-পৃথিবীর প্রতি দায় থাকে না। এসব মানুষকে অথবা নিজেকেই আনন্দ দেয়ার উদ্দেশ্যে লেখা সরল নিরাপদ গল্প.... সাহিত্যের উদ্দেশ্য আনন্দদান- এটা যে একপেশে ও পুরোনো ভাবনা, এটা লেখা শুরুর আগেই মাথায় থাকুক আমাদের। খুব বেশি করে থাকুক।

আমি আসলে আপনাদের চোখ ফেরাতে চাইছি গল্পের বিষয়বস্তুর দিকে। গল্পে ভাষার কাজ জরুরি, তবে বিষয়বস্তুর চেয়ে নয়। এইসব আলাপ হয়তো অনেকেই করেছেন। যেমন সৈয়দ শামসুল হকের কথাই ধরা যাক, তার ‘মার্জিনে মন্তব্যে’ বইয়ে তিনি গল্পের কলকব্জা নিয়ে কিছু আলাপ করেছেন। এই আলাপের বেশিরভাগ জুড়েই আছে ভাষার কারুকাজ, ক্রিয়ার কালরূপ, গল্পের সংলাপ নিয়ে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী-গতিপথ বদলাতে, প্রসারিত করতে সর্বোপরি ভাষার বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে বলেন তিনি এই আলাপে। কিন্তু এইসব আলাপ গল্পকারকে ভাষা ও ক্রিয়ার কালরূপ নিয়ে যতটা সচেতন করে তুলবে ততটা লেখার বিষয়বস্তু বিষয়ে নয়। তবে একটা ইঙ্গিত হয়তো তিনি দিতে চেয়েছেন একটু করে লালসালুর প্রসঙ্গ টেনে এনে যে- নিতান্ত সাধারণ গল্পের আড়ালে থাকতে পারে বিস্ফোরক বক্তব্য, এক প্রজন্ম ভ্রুকুটি, এক তীক্ষ্ন ব্যঙ্গ, এক তীব্র আত্মসচেতনতা এবং চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ‘মার্জিনে মন্তব্যে’-এর শেষে তিনি কিছু চেনা গল্প ‘পোস্টমাস্টার’, ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার, ‘ভয়ংকর’ ইত্যাদি দিয়ে এসবের কলকব্জা পরীক্ষায় নেমে পড়েন। তার এতসব পরীক্ষা নীরিক্ষায় কোথাও একমত হই, কোথাও দ্বিমত করি, কোথাও কোথাও পড়ে মনে হয় তার এই পুরো প্রচেষ্টাই এক করুণ ব্যর্থতা। তবে এই বইটা- ‘মার্জিনে মন্তব্যে’, সংগ্রহে থাকলে যে কোনো লেখকই সচেতন হয়ে লিখতে চেষ্টা করবেন বলেই আশা করি।

গল্পের ব্যাপারটা এত সহজ নয় যে, কারো সংগ্রহে এক বা একাধিক বই থাকলেই সে নতুন আকার-ধরণের গল্প নিয়ে পাঠকের সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে পারবে। আমার সংগ্রহে অন্যান্য বইয়ের বাইরে কেবল নানান লেখকের গল্পসংগ্রই রয়েছে চল্লিশের অধিক। এত গল্পের বই সংগ্রহে থাকার পরও কী আমার লেখা সেই পথ খুঁজে পেয়েছে যে পথে আর কেউই হাঁটেনি? আমি উপলব্ধি করি, লেখাগুলো কিছুই হয়নি। নতুনত্ব নেই একদম। প্রকাশিত লেখাগুলো আমাকে প্রথাগত স্বস্তি ও আরাম দিলেও, আমি প্রায়শই লজ্জিতবোধ করি এই ভেবে যে, ওসব একদম কাঁচা হাতের কাজ হয়েছে। বেশিরভাগই হয়ে গেছে সরল গল্প। 

আমার সবগুলো সংগ্রহ উল্টে-পাল্টে মামুন হুসাইনের গল্প সংগ্রহ: তিন দশকের দীর্ঘ-ছোট গল্প ও কাফকার সমগ্র গল্প বাদে অন্যগুলোতে নতুন কিছু আছে বলে মনে হয় না। শহীদুল জহির আর শাহাদুজ্জামানের ভাষায় অন্যরকম একটা আবহ পেলেও, সরল গল্পের সীমানা ছাড়াতে পারে না যেন তাদের প্রায় সব গল্প। আমি বিস্ময়ে দেখি রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ হতে শুরু করে, জ্যাক লন্ডনের ‘এক টুকরো মাংস’, কিংবা মানিকের ‘ভয়ংকর’, শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ অথবা শহীদুল জহিরের ‘পারাপার’, এমনকি চেখবের ‘চুম্বন’- সব গল্পই মানুষের আবেগ নিয়ে কাজ করে, খেলা করে মানুষের জৈবিক-মানসিক অনুভূতি নিয়ে। সবখানেই দেখি অনুভূতি-আবেগ হয়ে উঠছে বিকট-প্রকট, মূল বিষয়বস্তু। জৈবিক-মানসিক তাড়না ব্যতীত নতুন কিছু নেই এসব গল্পে। শব্দের কারিগরি, শব্দে লেখকের জাদুকরী ছোঁয়া এবং থৈ থৈ আবেগ ঠিক আছে কিন্তু বিষয়বস্তু হিসেবে বোধ পাই না কোথাও। একারণেই গল্পগুলো পড়তে গিয়ে অস্থির হয়ে পড়ি। সবগুলোকেই মনে হতে থাকে চেতনাহীন সরল গল্প। আমি ক্রমেই আবিষ্কার করি, এসকল গল্পের চরিত্রের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে আবেগ প্রশ্রয় দেয়া গল্পগুলো উপভোগ করার যে আনন্দটা আমরা চাই, তা নিতান্তই রোমান্টিসিজম।

সরল গল্প বাদে তবে আর কেমন গল্প হতে পারে? আমার উপলব্ধি- গল্পে সারল্য না থেকে ‘বোধ’ থাকুক। আমাদের প্রজ্ঞা না থাকুক অন্তত যে বোধ-উপলব্ধিকে আমরা জরুরি মনে করি, ন্যায্য মনে করি, নৈতিক মনে করি আবেগ ছাপিয়ে সেসব থাকুক গল্পে। ফুটুক সেসব গল্পে-গদ্যে। ফুটুক তা অবিরাম। বোধের গল্পগুলো তাৎক্ষণিক বোধোদয় হয়তো ঘটাবে না, তবে পাঠকের চিন্তার ছককে প্রসারিত করবে নিশ্চিত। মানুষকে ভাবাবে এসব গল্প। অবশ্যই মানুষ গল্প পড়তে বসে জটিল চিন্তা করতে পছন্দ করে না। জটিল চিন্তার ভার মানুষ দিয়ে রেখেছে প্রবন্ধের ওপর। ফলে, বোধের গল্পগুলো অবশ্যই জনপ্রিয় নয়। কিন্তু আপনি কী কেবলই জনপ্রিয় গল্পগুলো লিখবেন বা পড়বেন? এর বাইরে কী আপনার দায় নেই? আমাদের ‘বোধ’ কোথায় কতটা তলানিতে দাঁড়িয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা আপনার করতে নেই?

সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে আমাদের গল্পগুলোও কী বিকাশ লাভ করতে পারে না? লেখকরা কী পারে না, আবেগের ছাঁচে ঢেলে গল্প না সাজিয়ে নির্মোহ-নির্বিকার ঢঙে নতুন কাঠামোয় গল্পগুলো লিখতে? এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ফ্রেমটাকে ভাঙা যায় কী করে, এ প্রশ্নটা আসবে। এটা বলা মুশকিল, তবে কিঞ্চিত ইঙ্গিত দেয়া যায়। হয়তো এই ইঙ্গিতকে শুভ ধরে নিয়ে কোনো মেধাবী লেখক ভবিষ্যতে কোনো একদিন গল্পের একটা পূর্ণাঙ্গ আনকোড়া নতুন কাঠামো নির্মাণ করবেন। অথবা কেউ কেউ এখনো হয়তো চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আমাদের কেবল তাকে আবিষ্কার করাটা বাকি। নতুন কাঠামোয় কেমন করে গল্প বলা যেতে পারে? এটা নির্দিষ্ট করে বলার মতো বিষয় নয়। যেমন ধরুন, সভ্যতা ও প্রযুক্তি বিষয়ে একটা গল্প দাঁড় করাতে চাইলে আমরা চিরচেনা চিন্তার কাঠামো ভেঙে এগোতে পারি এভাবে ভেবে-  

আমরা আধুনিক সভ্যতার মানুষ... এরকম একটা আত্মশ্লাঘায় আক্রান্ত হতে দেখি আমরা মানুষকে। সভ্যতার শিখড়ে দাঁড়িয়ে আছি ভেবে আমরা বলি, এর মত সভ্যতা পৃথিবীতে আসেনি। আমরা ঘৃণা করি মধ্যযুগকে। প্রায়শই আমরা একটা কথা বলি- মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন, মধ্যযুগীয় আচরণ ইত্যাদি। এসব যে কী ভীষণ অদ্ভুত কথা! ধরা যাক, কাউকে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে অত্যাচার করা হলে সে কী ব্যথা-ট্যথা পায় না? গুলি-বোমা মারলে ইলেকট্রিক শক দিলে ব্যথা পায় না? পুরোনো যুগের মত লাঠি-সোটা, বল্লম, ছুরি-চাকু দিয়ে অত্যাচার করলেই কেবল ব্যথা পায়? যৌক্তিকভাবেই আধুনিক যুগ এবং অতীত বা মধ্যযুগের সকল নির্যাতনেই ব্যথা এবং কষ্ট রয়েছে। এমনকি আধুনিক সময় ও প্রযুক্তি মানুষকে নির্মমভাবে কোনঠাসা করে অস্তিত্বসংকটে ফেলে দিতে পারে, নির্দয়ভাবে তাকে ঠেলে দিতে পারে আত্মহননের দিকে বা মানুষকে নিঃশেষ করে দিতে পারে অতীত যুগগুলোর চেয়েও হাজারগুণ বেশি তীব্র মানসিক আঘাত দিয়ে। এইসব মানসিক আঘাত শরীরের ব্যথার চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। তবে কেন কেবল আমরা আধুনিক যুগের নির্যাতনের দায় কায়দার কথা বলে মধ্যযুগ বা অতীতের ওপরে ফেলে দিই? এর কারণ কী এই যে, আমরা আমাদের সময়টাকে ভালবাসি? আমাদের সভ্যতাকে ভালবাসি? সর্বোপরি আমাদের সভ্যতাকে আমরা আর সব সভ্যতার তুলনায় এগিয়ে আছে ভেবে পক্ষপাতমূলক বিচার করি? 

অবশ্যই, একই কথা অতীত হয়ে যাওয়া মানুষেরাও বলেছে। তারাও হয়তো নিজেদের কালের নির্যাতনের বিষয়ে চোখ বন্ধ রেখে অতীতের নির্যাতনের কায়দা নিয়ে আলাপ করেছে। তারাও হয়তো বলে গেছে তাদের বেঁচে থাকার সময়ের অগ্রগতির তুলনায় আর সব ফিকে, ম্লান। অথচ সভ্যতার অগ্রগতিতে আমাদের তৃপ্ত হবার কিছু নেই। আমরা গর্ব ও অহংকারে বলি- আমাদের এই সভ্যতার যুগে মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মহাকাশে আবাস গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে... কিন্তু আমরা কী কখনো ভেবেছি, এতে আমাদের সাধারণ মানুষের কী আসে যায়? সভ্যতার এই অগ্রগতি যে এক মস্ত আবেগ উসকানো ধাপ্পাবাজি সেটা কী কখনো ভেবেছি আমরা? 

ধরা যাক, একজন মানুষের বেতন মাসে এক লক্ষ টাকা, এখন সেই মানুষটির সমস্ত জীবনে আয় করা টাকা এবং তার চৌদ্দ পুরুষের সমস্ত জীবন ধরে জমানো প্রতিমাসে একই আয় হিসেব করে, সবগুলো টাকা একসাথে জড়ো করলেও একবার চাঁদে গিয়ে ঘুরে আসার খরচ উঠবে না। বর্তমানে একবার চাঁদে গিয়ে ঘুরে আসতে একজন মানুষের হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন। আর চাঁদে বা মহাশূন্যে বসবাস? সেটা যে কত বিশাল অঙ্কের টাকা তা কল্পনায়ও আসবে না আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের। তাহলে এ বিষয়ে আমাদের খুশিটা কী ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চাটার মত নয়? মানুষ চাঁদে-মঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে বলে আমরা যে তৃপ্তি নিয়ে ঘুরি, কখনো কী ভেবেছি এইসব মানুষ কারা হতে পারে?

আধুনিক সভ্যতা আমাদের প্রযুক্তি সুবিধা দিয়েছে, কিন্তু সেসব কী বিনা মূল্যে? আপনি আনন্দিত হচ্ছেন এটা ভেবে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ফ্রি এবং কোনো খরচই নেই এসব ব্যবহারে। অথচ আপনি ভাবছেন না, ইন্টারনেট ব্যবহারে আপনাকে ঠিকই অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আপনি মাথায় রাখছেন না, আপাতদৃষ্টিতে আপনি ফ্রি-তে সামাজিক যোগাযোগ চালিয়ে গেলেও দিনশেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত পণ্যসমূহের ভোক্তা এবং ক্রেতা আপনিই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনাকে বাড়তি-অপ্রয়োজনীয় ভোগ এবং ক্রয়ে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে চলেছে। আপনাকে ঘিরে আপনার পছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞাপনের জালে আপনি আঁটকা পড়ে আছেন, যার থেকে আপনার মুক্তি নেই- এসব কী আপনি ভাবছেন? সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত-অভূতপূর্ব বিষয়টি হলো, রাজনীতিও হয়ে গেছে বিজ্ঞাপনের বস্তু। নানান প্রকার-আকারের রাজনীতিবিদ রাজনীতির ময়দানে না থেকে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের জন্যে জীবনবাজি না রেখে জেল-জরিমানা হজম না করে শুধুই লাইক, শেয়ার, ফলোয়ার সংগ্রহ করছেন স্ব স্ব পোস্ট বুস্ট করে। আর এতে কেউ আপত্তিও করছে না। প্রচারেই পসার- এটা যেসব রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন তারা বিপদজনক এবং তারা নিঃসন্দেহে মেকি দেশপ্রেম-মানবপ্রেম ধারণ করেন.... এভাবে কী ভেবেছেন একবারও?

আপনি কখনোই ভাবেন না সভ্যতার এই চরম উৎকর্ষতার যুগে প্রযুক্তিগত সুবিধা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এক মহামারি- এসব ব্যক্তিজীবন ধ্বংস করে দেয়, মানুষকে অসহিষ্ণু বানিয়ে তোলে, ব্যক্তি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে, মানুষকে নির্বিষ করে, যৌক্তিক প্রতিবাদগুলোকে অক্ষরে বা ছবিতে বন্দী করা শেখায় বা কেবল শেয়ারেই দায়িত্ব শেষ ভাবতে শেখায়। আর হঠাৎ কখনো যদি আধুনিক সুবিধা-প্রযুক্তি না থাকার পরিবেশ তৈরী হয় তবে বিরূপ প্রকৃতি, পরিবেশ, পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করার মন কী মানুষের থাকবে? আর নগর সভ্যতা মানুষকে কতটা অথর্ব আর অন্ধ করতে পারে সেটাও বা কী আমরা কখনো ভেবেছি? অথচ এসব ভাবনা মানুষ হিসেবে আমাদেরই দায়।.....

উপরোক্ত ভাবনা নিয়ে গল্প হতে পারে। ভাবনাগুলোকে গল্পের ফ্রেম না ভেবে ধরে নিতে পারেন একজন পাঠকের পক্ষ হতে আসা চিরাচরিত ফ্রেম ভাঙার প্রস্তাবনা হিসেবে। নিদেনপক্ষে একটা মৃদু ইঙ্গিত। এই প্রস্তাবনা বা ইঙ্গিতের একমাত্র উদ্দেশ্য- আমাদের সরল ও নিরাপদ গল্পগুলোর আবেগময়তা হতে বোধে উত্তরণ। এই চেষ্টাটা করতে হবে। গল্পের ‘আবেগহীন বোধ’ থাকতে হবে। বোধসম্পন্ন গল্পই টিকিয়ে দেবে একজন লেখককে দীর্ঘসময়ের জন্যে। বোধহীন আবেগসর্বস্ব বর্ণনা বা উপমা নির্ভর গল্প সাময়িক ‘আহা’, ‘উহু’ জুটিয়ে দিলেও দীর্ঘযাত্রায় এরা বাতিল। ব্যর্থ। 

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই