চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অলীক যাপন



অলীক যাপন
দেবদ্যুতি রায়

নমি, ও নমি, শোন না। বেলা আটটা বাজে, তোর বৌটা ঘোমের থাকি ওটছে না ক্যান রে? পেত্যেক দিন এক কেচ্চা।আমার বৌ হোলে দিতাম শিখাইয়া......

ঘেরের ছোট ট্যাংরার সাথে ব্রাক্ষ্মী শাকের ঝোল রাঁধবে বলে কেবল কড়াইয়ে জিরে ফোঁড়ন দিয়েছে নমিতা। এমন সময়ে এই কথা শুনে খুব বিরক্ত লাগে ওর। আর তাছাড়া নীরুদির সত্যি আক্কেলজ্ঞান বড় কম। রান্নাঘরের লাগোয়া ঘরটাই বাবু আর তনিমার। ও ঘরে দুই মেয়ে নিয়ে ঘুমিয়েছে তনিমা। বাবু প্রতি সপ্তাহে দু’দিনের জন্য যখন আসে, তখন দু’জনে মিলে পুঁচকে দুটোকে নিয়ে ঘুমায়। কে জানে এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে নাকি তনিমা, নীরুদির কথাগুলো শুনে ফেললে একেবারে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নীরজার কথার উত্তর না দিয়ে লম্বা করে কেটে রাখা আলুর টুকরো কয়টা ফোঁড়নে দিয়ে নাড়তে থাকে ও।

নমিতার কাছে কোনো উত্তর না পেয়ে কী সব গজগজ করতে করতে জগ থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে নীরজা। বাপরে বাপ! কী দিনকাল পড়ল রে বাবা! নমি হাত পুড়িয়ে রান্না করছে আর পন্ডিত বউ রোজ বেলা আটটা না বাজলে ‘ঘোম’থেকে ওঠে না! এমন অশৈল্যেপনা বাপের জন্মে দেখেনি নীরজা। কী না বলে সিজারের তিন মাস হয়নি এখনও, শরীর ঠিকমতো সারেনি তাই সকালে উঠতে পারবে না! কেন নীরজার নাহয় সিজার করতে হয়নি, চার চারটা ছেলেমেয়ের জন্ম তো দিয়েছে নাকি? কই কোনোদিন তো এমন অকাণ্ড ঘটায়নি সে! তাছাড়া তার মেয়ে আর ছেলের বৌয়েরাও তো বিইয়েছে ছেলেপুলে- না না, তারাও কেউ এমনধারা কা- করেনি কোনো সময়। এই প্রথম, এ বাড়িতে এসেই এসব দেখতে হচ্ছে। হয়ত অন্য কেউ হলে কিছু বলত না কিন্তু ছোট বোনটাকে সংসারের খুঁটিনাটি কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে দেখে নীরজা আর চুপ থাকতে পারে না।

লবণ হলুদে আলুগুলো একটু কষিয়ে তাতে অনেকখানি জল দিয়ে ঢাকনা দিয়ে দেয় নমিতা। আলু সেদ্ধ হয়ে এলে শাক আর ভাজা মাছগুলো দিয়ে দেবে। তনিমার ছোট বাচ্চাটার তিনমাস হয়নি এখনও বয়েস, এসময় ব্রাক্ষ্মী শাক খেলে মা, বাচ্চা দু’জনেরই পেট ভালো থাকে। নমিতা তাই যেদিনই পায়, বাজার থেকে ব্রাক্ষ্মী শাক নিয়ে আসে। চুলোর কাছ থেকে সরে হাতটা আঁচলে মুছে নিয়ে নীরজার কাছে গিয়ে বসে নমিতা।

অমন করে বলতিছো ক্যান, নীরুদি? বৌমার শরীরটা তো আসলেই সারেনি বাচ্চা হবার পরে। যখন সাইরে উঠপে তখন এমনিই সকাল সকাল ওঠপেনে। আর এমনি কাজকাম তো করেই টুকটাক, রান্নাও করে। কাইলকেই তোমাগে মোরগ পোলাও রান্দি খাইতে দিল না?

নমিতার কথা শুনে নীরজার মনে হয়, তা নমি ঠিক কথাই বলেছে বটে। নমিতার বৌমার রাঁধা কালকের মোরগ পোলাওটা খেতে খুব ভালোই হয়েছিল, ভালো হয়েছিল সেদিনের পায়েশটাও। সময় সুযোগ পেলেই বৌটা ভালোমন্দ রান্না করে। আবার দুটো ছোট বাচ্চা নিয়ে বাড়িটাও কেমন ঝকঝকে রাখে, তবু এই যে বৌ মানুষের রোজ দেরি করে ওঠা, এই অশৈল্যেপনার জবাব নীরজার জানা নেই।

বৌমা রাতে ঘুমাতি পারেনা ঠিকমতোন। সকালবেলাটা ঘুমাক। তুমি দুইদিনের জন্য আইসে তার মনটা খারাপ কইরে দিও না। আর ওর ছুটিও শেষ হয়ে যাবে ক’দিন পরে, তখন চাইলেও ঘুমাতি পাইরবে না।

নীরুর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে আবার রান্নাঘরে চলে যায় নমিতা। কী জানি বাপু! বৌয়ের গায়ে কথা ‘ফেলতি’ দেয় না, এ কেমনধারা শাশুড়ি! না না, নীরজা তার সারা জীবনে এমন সংসার দেখেনি। শুধু কি ধেড়ে বৌটা নাকি? নমিতার মেয়েটাও কেমন যেন! বাপরে বাপ! কী না কী ভাচ্ছিটি পাশ দিয়ে বলে আরো পড়ালেখা করতে বিদেশ না কোথায় যাচ্ছে, সে আজব দেশের নাম নীরজার মনেও থাকে না বারবার শোনার পরও। নমিকে সেদিন কী কথায় বলেছিল- তা নমি, তোর মাইয়্যের আবার বিদেশ যাবার কী দরকার? এখানেই তো একটা বিয়েশাদি করে নিলি পারে। সেই অশৈল্যে দ্যাশের কারবারডা কী কেডা জানে। আর তাছাড়া তোর ছাওয়ালডাও তো.....

সেদিন নীরজার কথার মাঝখানে ফুঁসে উঠেছিল নমিতা- এমন কইরে কইও না দিদি। মাইয়্যে আমার নিজের যোগ্যতায় পড়তে যাচ্ছে। তাতে ছাওয়াল টানো ক্যান? আর এত অশৈল্যে অশৈল্যে কইরো না তো। তুমি নিজে কোন শৈল্যে দ্যাশে থাকো শুনি?

নমিতার শেষ কথাটা একদম বুকের মাঝখানটায় গিয়ে বিঁধেছিল সেদিন। তাইতো, অন্য ‘দ্যাশ’ নিয়ে মাথা ঘামায় ক্যান সে? সে নিজেই তো পাশের দেশে চলে যাবার সেই কতদিন হয়ে গেল। ঐ দেশটা কি তার নিজের হয়েছে আজও? বারাসাতে বাড়ি, ছেলেপুলেদের ছোটমোটো কাজকারবার, রেশন কার্ড, আধার কার্ড সবই হয়েছে বটে কিন্তু সে দেশ তাকে নিজের করে নেয়নি এত বছর পরও। নাহলে একটা পাসপোর্ট পেল না কেন আজ পর্যন্ত? কম দিন তো আর ধর্না দেয়নি একটা পাসপোর্টের জন্য? পেল কই? এই যে ‘নিজের দ্যাশ’- সেখানেও ওকে আসতে হয়েছে চোরের মতো, দালাল ধরে। বিকাশ দালাল বর্ডারের পাহারাদারদের দুই শিফটের বদলাবদলির সময় ওকে পার করে দিয়েছে, যেমনটা দেয় আরো অগুণতি পাসপোর্টহীন, দেশহীন মানুষকে। তাড়াহুড়ো করে চোরের মতো সেই বর্ডার পেরিয়ে এদেশে পা রেখে লম্বা করে একটা দম নিয়েছিল নীরজা- কতদিন পর সে ফিরে এল এই মাটিতে! কত বছর পর!

নীরজা ভাবের মানুষ নয়, ভাব তার আসে না। সবাই মিলে দু’বেলা খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারলেই সে খুশি। তার বেশি সে ভাবতে পারেনা কখনও। তার লেখাপড়াও বেশি নয়, সুন্দর সুন্দর কথা আসেনা তার মনে মুখে। তবু সেদিন, প্রায় বছর কুঁড়ি পরে এদেশের সীমানায় পা রেখে নীরজার অনেক কথা মনে পড়েছিল। ওর শৈশবের কথা, বড় হয়ে ওঠার প্রতিটা বাঁকের কথা। মোটা গোছার চুলে দুটো বেণি ঝুলিয়ে পাড়ার অন্য মেয়েদের সাথে কুলগাছে পা ঝুলিয়ে টসটসে কুল খাওয়ার কথা। আর, নীরজার সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছিল তেরশো ছিয়াত্তর সালের চব্বিশে আষাঢ়ের কথা। এই বাংলা সাল তারিখটা নীরু ভোলে না কখনোই। আকাশ ভেঙ্গে পড়া আষাঢ়ের চব্বিশে গোধূলী লগ্নে নীরজার শীর্ণ দুই হাত বাঁধা পড়েছিল জলদগম্ভীর সেই মানুষটার সুঠাম দু’টি হাতে। সেই দিন নীরজা কী করে ভুলবে? তবু বুক ঠেলে আসা সব ভাবনা জোর করে ঠেলে সরিয়ে নীরজা হাঁটতে শুরু করেছিল সোজা দক্ষিণে, সেদিকে মাইলখানেক পরেই তিরনই নামে যে গ্রাম, সেখানে ওর জন্য অতীন অপেক্ষা করে ছিল।

অতীন, নীরজার একমাত্র ছোট ভাই। ওদের দুই বোনের পরে এই একটি ভাই ছিল বলে সে ছিল সবার আদরের। বারাসাতে থাকতেই ওর সাথে কথা বলে রেখেছিল সে। প্রায় বছর কুড়ি পরে ক’দিনের জন্য বেড়াতে আসা বোনের আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেনি অতীন। তবু পুরোদস্তুর অন্যরকম সেই পরিবেশে ক’দিন থাকতেই হাঁফ ধরে গিয়েছিল ওর। আর ভাইও সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে, অফিস শেষ করে আসতে আসতে সেই রাত আট নয়টা বেজে যায়। ভাইয়ের বৌ, ছেলে, মেয়েদের সাথে তেমন আলাপের সম্পর্ক নেই ওর। এটা ঠিক যে অতীন পরিবার নিয়ে বা একা যতবার ভারতে গেছে, নীরজার বাড়িতেই উঠেছে প্রতিবার। তবু এইসব শহুরে ছেলেপুলেকে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না সে কিছুতেই। তাই দিন পাঁচেক পরেই নীরজা সে বাড়িতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। আর তারপর তার মনে পড়েছিল খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বোনেদের মধ্যে একমাত্র জীবিত বোন নমিতার কথা। অতীনের কাছে সে জেনে গিয়েছিল নমিতাও এই একই শহরের বাসিন্দা আজকাল। সেদিন বিকেলে অতীনের মোবাইল ফোনটা থেকে নমিতাকে কল করেছিল সে- নমি, এ বাড়ি আইস্যে আমারে একটু লিয়ে যা তো রে বুনডি।

কত মানুষ কত আশ্চর্য কারণে ভিটেমাটি ছাড়ে, গ্রাম ছাড়ে; তারপর দেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় কোনো এক অচিন দেশের আবছায়া ঠিকানায়। নিজের দেশ ছাড়ার সাথে জড়িয়ে থাকা অপমানের কথা মনে করে বারাসাতে কত রাত ঘুমোতে পারেনি নৃপেন, নীরজা ছেলেপুলে সামলে সেইসব রাতে তাকে আগলেছে পাখিমায়ের মতোন। এক এক সময় রাতে ঘুমের মধ্যে মানুষটা চিৎকার করে উঠেছে- আমি কামডা ভালবাসতাম বইল্যেই কী আমার এমুন হইল, নীরু?

তার ঘন্টাখানেকের মধ্যে অতীনের বাসায় পৌঁছে গিয়েছিল নমিতা। একমাত্র জ্যাঠতুতো দিদির সাথে কতগুলো বছর পর দেখা হবে, সে ভাবনায় সেও আবেগাক্রান্ত  হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। তাই সাত তাড়াতাড়ি ও বাসা থেকে দিদিকে নিয়ে ফিরে এসেছিল সে।

এ বাসায় এসে নীরজা একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। হয়ত ভাইয়ের পরিবারের সাথে যেমন একটা প্রায় অচেনার আগল ছিল, বোনের সাথে সেটা নেই বলে। নমিতা দিদির আদর আপ্যায়নের কোনো অন্ত রাখেনি। বাড়ির কাজকর্ম সেরে একটু ফুরসত পেলেই পা দু’টো মেঝেতে পা ছড়িয়ে গল্প করতে বসে। সে কত গল্প! অনেকগুলো বছর পর দু’বোনই কেমন প্রগলভ হয়ে ওঠে। ছোটবেলার মারাত্মক ঝাল আমমাখা খাওয়া থেকে সে গল্প ছড়িয়ে যায় বামুনহাটের নরেনের মেয়ের শ্বশুরবাড়ির গল্পে। এমন গালগল্পে অনেকগুলো বছর পরে নমিতারও যেন মন ভালো হয়ে যায়। কাল বিকেলেই তো বিকাশ দালালের জোকারির গল্প শুনে হাসতে হাসতে নমি বিষম খেয়েটেয়ে একাকার অবস্থা।

এ বাড়িতে আর ক’দিন থেকে নীরজা যাবে বামুনহাটে, এককালে যেখানে ওর শ্বশুরবাড়ি ছিল। সে বাড়ির কথা মনে উঠলে এই বুড়ো বয়সেও নীরজার বুকে আবেগের একটা জগদ্দল পাথর চেপে বসে যেন। সেই সুঠাম হাতের মানুষটার সাথে বিয়ের পর নীরজা বামুনহাট গিয়েছিল প্রথম। আর বামুনহাট ছেড়েছেও সেই একই মানুষের সাথেই, আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগে।

সুঠাম শরীরের নৃপেন ম্যানেজারির কাজ করত রহমান শেখের মাছের আড়তে। সেই কাজটাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত মানুষটা, নীরজা দেখেছে কাছ থেকে। নৃপেন বলত ওকে- কামডা আমার পেশার চাইয়্যে নেশা বেশি নীরু। আড়তের কামডা আমি ভালবাসি।

কাজ ভালবাসত বলেই বাড়িতে নতুন বৌ ফেলে রেখে কাজে যেত নৃপেন, আসতে আসতে সেই রাত দুপুর। সেইসব দিনে নীরজা তাদের উঠোন থেকে প্রায় এক মানুষ উঁচু মাটির দোচালা ঘরে আগল দিত সন্ধ্যে একটু গাঢ় হতেই। ওর শ্বশুরবাড়ির পেছনের বড় বিলটা বর্ষার দিনে ভরে যেত, তারপর সে জলে ভরে যেত উঠোন। অত উঁচু করে ঘর বানানো হতো সে কারণেই। সেই উঁচু ঘরের বাড়িটায় সন্ধ্যে নামলেই কেমন যেন ভীষণ ভয় করত ওর, কে জানে কেন। আর তাছাড়া তখন ও পাড়ায় খুব চুরির ভয়, শ্বাশুড়ি সেই রাত দুপুর পর্যন্ত থাকত ওর পাশে, নৃপেন আড়ত থেকে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত। খুব ভালবেসে যে থাকত না, তা জানত নীরজা। নৃপেন মাকে বলে দিয়েছিল বলে বুড়ি শাশুড়ি আর ফেলতে পারেনি কথাটা। বাড়ির একমাত্র আয় রোজগেরে মানুষকে কেই বা ক্ষ্যাপাতে চায়, তা সে মা হোক আর মাসিই হোক। দিনের বেলা নীরজার প্রথম প্রথম কাটত শ্যামলীর সাথে আড্ডা দিয়ে আর এটা সেটা খেলে, শ্যামলী নৃপেনের ছোট কাকার মেয়ে। শ্যামলী যে কী সুন্দর টক মাখা তৈরি করত বাড়ির আম, কুল, আমড়া এটা সেটা দিয়ে। ধনেপাতা আর শলুকপাতার ঘ্রাণে সেইসব খাবার অমৃত মনে হতো নীরজার। ওদের বাড়ির বাইরের লম্বা কদম গাছটার লাগোয়া উঁচু করে বানানো টংটায় সেইসব অমৃতময় খাবার খেতে খেতে নীরজার কখনও কখনও মনে পড়ত বাড়ির কথা, পিচ্চি পিচ্চি ভাইবোনগুলোর কথা, ছেড়ে আসা বাড়িটার রোদ- বৃষ্টির গন্ধমাখা উঠোন, ঘরের চালের কথা। তারপর একসময় শ্যামলীর বিয়ে হয়ে গেল, নীরজারও ছেলেপুলে হয়ে গেল। শুধু কমলো না নৃপেনের আড়তে যাওয়া আর বাড়ি ফিরে আসার সময়ের পার্থক্যটা।

সেই নৃপেনকে দেশটাই ছাড়তে হয়েছিল আড়তের জন্য। রহমান শেখের আড়তে সেবার মাছের হিসেবে ভীষণ গণ্ডগোল হলো। তখন ঘোর বর্ষাকাল, জলে ভরে গিয়েছিল চারপাশ, ডুবে গিয়েছিল নীরজার শ্বশুরবাড়ির উঠোনটাও। সেই কুড়ি বছর আগে যখন ম্যানেজারির জন্য নৃপেন পেত দু’শো টাকা মাসে, একটা চালানের প্রায় তিন হাজার টাকার মাছের হিসেব মেলাতে পারেনি সে। রাগে অন্ধ রহমান শেখ সবার সামনে চড় মেরেছিল নৃপেনকে। সে রাতে, ভীষণ বর্ষাবাদলের মধ্যে নৃপেন বামুনহাট ছেড়েছিল, দেশ ছেড়েছিল, বউবাচ্চা নিয়ে; ততক্ষণে রহমান শেখের আড়তে মাছ চোর ধরা পরেছে, রুবেল আর হীরণ। নৃপেন তখন চাইলেই আবার কাজে যেতে পারত, নিদেনপক্ষে মাথা উঁচু করে রহমান শেখকে গিয়ে বলে আসতে পারত- দ্যাকলেন তো, আমি চোর নই।

কিন্তু সে কিছুই করেনি। এক বুক হাহাকার নিয়ে রাতের আঁধারে চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে নীরজা আর নৃপেন বেড়িয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। কেবল নৃপেনের বুড়ো মা আর ওদের সবচেয়ে বড় সন্তান নিতাই যেতে চায়নি বাড়ি ছেড়ে, তারা রয়ে গিয়েছিল ওদের জল উপচানো ভিটের ঘিয়ে রঙের মাটির বাড়িটায়।

কত মানুষ কত আশ্চর্য কারণে ভিটেমাটি ছাড়ে, গ্রাম ছাড়ে; তারপর দেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় কোনো এক অচিন দেশের আবছায়া ঠিকানায়। নিজের দেশ ছাড়ার সাথে জড়িয়ে থাকা অপমানের কথা মনে করে বারাসাতে কত রাত ঘুমোতে পারেনি নৃপেন, নীরজা ছেলেপুলে সামলে সেইসব রাতে তাকে আগলেছে পাখিমায়ের মতোন। এক এক সময় রাতে ঘুমের মধ্যে মানুষটা চিৎকার করে উঠেছে- আমি কামডা ভালবাসতাম বইল্যেই কী আমার এমুন হইল, নীরু?

নীরজা সেইসব দিনে ওকে বারবার করে বলেছে ফেলে আসা দুঃসময়ের কথা ভুলে যেতে। চেনা কষ্টে বারবার ভেঙ্গে পড়া নৃপেনের মাথাটা বুকে নিয়ে কত রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি ও। তারপর একদিন মানুষটা এক বুক কষ্ট নিয়েই বুক ধড়ফড় করতে করতে কেমন টুপ করে মরে গেল, কে জানে, ভুলতে না পারা সেই কষ্ট তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওকে বুক ধড়ফড়ানি অসুখটার কাছে নিয়েছিল কী না! সে কথা থাক, মানুষটার অমন চলে যাওয়ার পরও পার হয়ে গেল কতগুলো বছর!

বামুনহাটের কথা উঠলেই তাই একরাশ বিষণ্ণতা ওকে ঘিরে ধরে সব সময়। না, নীরজা কখনোই চায়নি সে আর বামুনহাটে পা রাখবে কোনোদিন। তবু আজ এতগুলো বছর পরে নিতাইয়ের ডাক উপেক্ষা করবার মতো জোর কোথায় পাবে ও? নৃপেন আর নীরজার প্রথম সন্তান নিতাই, তার ডাকে কিছুতেই না করতে পারবে না ও।

পরদিন ভোরবেলা উঠে এ বাড়ির বারান্দামতো ছাদটায় একটা চেয়ার পেতে বসে নীরজা। এই ছাদটা ওর ভালো লেগেছে খুব, কেমন ঘর লাগোয়া ছাদ, অন্য কেউ আসেও না এখানে। এই সাত সকালেই নয়নতারা, ঘাসফুল আর গোলাপ গাছগুলোতে ফুল ফুটে আছে বেশ। পাশের নারকেল গাছের ডালে বসে একটা কাক চেঁচাচ্ছে ভীষণ। নীরজার কাক পছন্দ নয় মোটেও, কিন্তু এত দূর থেকে ওটাকে তাড়াবার কোনো উপায় নেই বলে চুপচাপ সে ডাক শুনতে থাকে। এ বাড়িতে এ ক’দিন বেশ ভালোই কেটেছে ওর। সত্যি কথা বলতে খুড়তুতো বোনের এমন ভরভরন্ত সংসার দেখে ওর মনের মধ্যে আনন্দই হয়েছে। বারাসাতে ওরা এমন করে গুছিয়ে থাকতে পারেনি কোনোদিন। ওদেশে প্রথম প্রথম নুন আনতে পান্তা ফুরিয়েই যেত। ধীরে ধীরে ওরা ওদেশে একটা চলনসই অবস্থায় আসতে পেরেছে।

যাক সে কথা। বোনের বাড়ি এসে নীরজা যেমন আহ্লাদিত হয়ে উঠেছিল সেই আনন্দের ভাবটা আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। তাই বোনের সাথে প্রথমদিকের দিনগুলোর মতো করে আড্ডা আর গল্পের আসর জমছে না কিছুতেই। ক’দিন থেকে ওর ন্যায্য কথাগুলোর নমিতা কেমনধারা উত্তর দেয় যেন। নমিতার মেয়ে আর বৌ তো সেই প্রথম দিন থেকেই ছাড়াছাড়া ভদ্রতার আচরণ করে। কেবল এই বোনটাই ছিল.....

না, আর কিছুতেই থাকা যাবেনা এ বাড়িতে। এ দেশটা সেই কবে ছেড়ে গেছে নীরজা, ছেড়ে গেছে মুঠো মুঠো ভালোলাগার স্মৃতি। এতদিনে মুখ ঝাপসা হয়ে গেছে কত প্রিয়জনের। নমিতার বাড়ির ভালোলাগার স্মৃতিটুকুই না হয় থাকুক ওর কাছে। হারিয়ে যাওয়া সব দিনগুলোয় দাগ লেগে গেলে সে দাগ ওঠেনা কিছুতেই, সে বড় কষ্ট।

একটু পরেই দুই কাপ র চা আর দু’টো টোস্ট বিস্কুট ট্রেতে করে নিয়ে আসে নমিতা। নীরজার সামনে রেখে ঘরের ভেতর থেকে লাল রঙের ছোট টুলটা আনে। দিদির সাথে সেই চা বিস্কুট খেতে খেতে ঘুমের মধ্যে দেখা এক আবোলতাবোল স্বপ্নের কথা বলতে শুরু করে। সে গল্প শুনতে শুনতে নীরজার মনে পড়ে, এ বাড়িতে আর কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর। ওরা কোনোদিন এই হালকা কুয়াশার আস্তর থেকে ধীরে ধীরে জেগে ওঠা লালচে সূর্যের সকাল দেখতে পেল না। দারুণ একটা মুহূর্তের কী এক নিদারুণ অপচয়! তারপরেই তার মনে পড়ে, এ বাড়িতে কে কী করছে না করছে তা ভাববার সে কেউ নয়। এ বাড়িতে সে এক অতিথি মাত্র, যেমন সে অতিথি আজ নিজের দেশে, যেমন অতিথি অনেক বছর থেকে বাস করে আসা দেশটাতেও। এই দেশের মতোই কিংবা পাশের দেশ, যে দেশে ওর বহুকালের বসবাস, সে দেশের মতো এই ছোট বোনের বাড়িতে সে আসলে এক অনাহুত মানুষ। আচ্ছা, ওর সত্যিই কোনো দেশ আছে কি? ঘর আছে কি? নীরজার আজ পর্যন্ত একটা পরিচয় কি সত্যি বেঁচে আছে?

এই সুন্দর ভোরে চমৎকার ছোট্ট ছাদটায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নীরজার মনে পড়ে- অতীন ওকে একটা দরকারি কথা বলেছিল। বামুনহাটের সুকুমার সাহার ছেলে রণেশ নাকি একটা এদেশি পাসপোর্ট করে দিতে চেয়েছে ওর জন্য। হাজার দশেক টাকা হলেই নাকি হয়ে যাবে। অতীনকে সেদিন এ বিষয়ে সম্মতি বা অসম্মতির কোনো কথাই জানায়নি ও। যে দেশ ছেড়েছে একটা জন্ম আগে, সেই দেশের পাসপোর্ট নেবে সে? যে দেশে বহু বছর থেকে ঘরকন্না হলো, ছেলেপুলের সংসার পর্যন্ত হলো, সে দেশের পাসপোর্ট পেল না তো, আর পাবেও না। কিন্তু এই দেশের একটা সবুজ ছোট্ট মলাটবন্দী কতগুলো কাগজ ওকে আসলেই কী দিতে পারবে আর? এ দেশে ফিরে আসার কথা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবে না নীরজা। ওর মনে হয় কোনোদিন নিজের ছেড়ে যাওয়া এই দেশটায় ফিরে আসার চিন্তা আসলে দূর আকাশের তারা হয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাই করা। কত কষ্টে দেশটা ছেড়েছিল মানুষটা! না, অতীনের বাড়িতে ফিরে সে বলে দেবে এই সবুজ দেশের সবুজ পাসপোর্ট লাগবে না তার, বামুনহাট থেকে ফিরে এলে তাকে যেন একটা দালাল ডেকে বর্ডার পার করে আবার। ও যেভাবে এদেশে এসেছে, সেভাবেই ফিরবে। ।

বুকের ভেতর থেকে ঠেলে আসা দীর্ঘশ্বাসটাকে জোর করে ফেরত পাঠায় নীরজা। তারপর মশলার সুঘ্রাণ ছড়ানো লালচে রঙের চায়ে টোস্ট বিস্কুটটা ভেজাতে ভেজাতে বলে- আইজকে আমায় অতীনের বাসায় একটুখানি দিইয়্যে আসিস, নমি।

কুয়াশাভেজা পুব আকাশে লালচে সূর্যটা তখন কুসুমরঙা হতে শুরু করেছে।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই