চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বইয়ের পাতা থেকে সেলুলয়েড ফিতায়: বাংলাদেশি সিনেমা


বইয়ের পাতা থেকে সেলুলয়েড ফিতায়: বাংলাদেশি সিনেমা
সাইফ মাহমুদ

এখন যদি কোন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয় সিনেমা বলতে সে কী বুঝে? উত্তর হবে নায়ক, নায়িকা, ভিলেন, একশন, রোমান্স, নাচ গান ইত্যাদি। হ্যাঁ অধিক উত্তর এটিই হবে। মানু কমার্শিয়াল সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত। সিনেমা কমার্শিয়াল হয়? আর সাহিত্য? সাহিত্য পুরোটাই একখণ্ড আর্ট। তাহলে সিনেমা কী? আমার কাছে আর্ট আর কমার্শিয়াল সিনেমা বলে কিছু নেই। প্রত্যেকটি সিনেমার পিছনে আছে একাধিক শিল্পীর অবদান। কেউ কণ্ঠশিল্পী, কেউ নৃত্যশিল্পী, কেউবা অভিনয়, কেউবা সিনেমাটোগ্রাফি, কেউবা শিল্প নির্দেশক।  এত এত শিল্পের মাঝে শুধুমাত্র সিনেমার জনরা থেকে কিভাবে একটি সিনেমাকে বাণিজ্যের কাতারে ফেলে দেয়া হয়? আমি জানি না। হঠাৎ কিছু ভেবে আপনি কবিতা রচনা করে ফেলতে পারেন। মোজার্ট তো তিন পাতায় বিখ্যাত সিম্ফনি রচনা করেছিলেন! আর বই রচনা করতে সাহিত্যিক যে মানসিক শ্রম ব্যয় করেন তার থেকে বেশি শ্রম ব্যয় হয় সিনেমা। হউক সেটা মানসিক কিংবা শারীরিক। প্রচুর পরিশ্রমের পর সেই সিনেমার কলাকৌশলিরা যদি কিছু টাকা আয় করতে চান আর সেটাকে আমরা অশৈল্পীক বলে ফেলে দিই তাহকে সেটা হিপক্রিসি ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

সিনেমার অসংখ্য জনরা আছে। কিন্তু এসবের ভীড়েও সাহিত্য থেকে যেসব সিনেমা হয় তা আলাদা থেকেই যায়। সিনেমা ব্যাপারটি অনেক বিস্তর। এর স্বতন্ত্র ইতিহাস, মর্যাদা এবং গৌরব আছে। বিশ্বের সিনেমা নিয়ে সেসব বলতে গেলে আস্ত কয়েকটা বই লেখা যাবে। কিন্তু আমার লেখার বিষয়বস্তু হল বাংলাদেশি সিনেমা ও সাহিত্যের সম্পর্ক।

বিশ্বের প্রথম সিনেমা নির্মাণ হয় ১৮৮৮ সালে। আর তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সিতে প্রথম সিনেমা হয় ১৯২৩ সালে। নাম 'সুকুমারী' সে হিসেবে ১৯২৩ থেকে আমাদের সিনে যাত্রার শুরু বলা যায়। সিনেমার আদী থেকে আজ পর্যন্ত দুইটি শতাব্দী মধ্যে যদি ভাগ করি তাহলে দুইটা অংশ পাই। এক ১৯২৩-১৯৯ এবং দুই ২০০০- বর্তমান।  কিন্তু এর মাঝে আবার প্রতিটা দশক একেকটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর সাহিত্য এবং সিনেমা নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে।

সাহিত্যকে বলা হয় সমাজের দর্পনস্বরূপ। আর সিনেমা? সিনেমা হল সেই দর্পণের প্রতিবিম্ব। সাহিত্যের কথাকে চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।  সাহিত্য এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলা হয়। কিন্তু এখানে একটি 'কিন্তু' থেকে যায়। প্রমথ চৌধুরী বলেই গেছেন আমারা বই পড়ি না। তাহলে? এই ভাব-গম্ভীর্যের ভাষার বই একদম তৃণমূল পর্যায়ে পৌছাতে সিনেমার অবদান আছে। বই আর সিনেমা বিনোদনের মাধ্যম হলেও বই কিনে পড়ার মত মানুষ খুব কমই আছে। কিন্তু সিনেমা প্রায় সবাই দেখে। বিশেষ করে কয়েক দশক আগে যখন বিনোদনের মাধ্যম ছিল হলে গিয়ে সিনেমা দেখা।  বিনোদনের মাধ্যমে গূঢ় একটি ম্যাসেজ দেওয়া সিনেমার একটি বড় এবং শক্তিশালী হাতিয়ার। সহজেই সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এই হাতিয়ারকে পুঁজি করে অনেক বড় বড় সাহিত্যগুণ সম্পন্ন বইয়ের রস গ্রহণেরর সুযোগ করে দিয়েছে সিনেমা।

১৯২৮ থেকে ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অনেক সিনেমা নির্মিত হলেও সাহিত্য নির্ভর সিনেমার প্রবর্তন হয়নি। যদিও ১৯৫৯ সালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটি গল্প অবলম্বনে উর্দুতে তৈরি হয় 'জাগো হুয়া সাভেরা' (The Day shall Dawn) এবং এটি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ১৯৬০ এ বেস্ট পিকচার এওয়ার্ড পায় ও ৩২ তম একাডেমীক এওয়ার্ডে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে মনসামঙ্গল এর বেহুলা নিয়ে জহির রায়হান নির্মাণ করেন 'বেহুলা'যা ছিল সেই সময়ের হিট একটি ছবি যেখানে নায়ক রাজ রাজ্জাকের অভিষেক হয়। এরপর লম্বা একটা বিরতি শেষে ১৯৭৩ সালে আমরা পাই অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তিতস একটি নদীর নাম এর কাহিনী উপজীব্য করে বানানো সিনেমা তিতাস একটি নদীর নাম। নির্মাতাকে সবাই চেনেন। আমাদের ঋত্বিক ঘটক। নদী ও জীবনের যে দরদ ভরা উপস্থাপন তা ঋত্বিক ঘটক দ্বারাই সম্ভব। একই বছর আরো একটি সিনেমা নির্মাণ হয় নিহারঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস 'বঁধুয়া' অবলম্বনে। নির্মাতা সি বি জামান।

১৯৭৪ সালে সাহিত্য নির্ভর একটি সিনেমা তৈরি হয়। প্রখ্যাত উপন্যাসিক কাজী আনোয়ার হোসেনের জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের উপন্যাস 'বিস্মরণ' অবলম্বনে মাসুদ পারভেজ নির্মাণ করেন 'মাসুদ রানা'এখানে মাসুদ রানা নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সোহেল রানা। ১৯৭৭ সালে শওকত ওসমানের একটি গল্প অবলম্বনে  তৈরি হয় 'জননী'যার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাবানা কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেন নি। 

১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় সারেং বউ। এটি নিঃসন্দেহে আরেকটি মাস্টারপিস। শহিদুল্লাহ কায়সারে উপন্যাস সারেং বউ অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা ছিল সেই সময়ের হিট ছবি। এর একটি গানে কথা দিয়েছিলেন কবি জসীমউদ্দিন। 'ওরে নীল দরিয়া' নামের সেই গান আজও সমান জনপ্রিয়। ঠিক তার পরে মুক্তি পায় ডুমুরের ফুল। এটি ডা. আশরাফ সিদ্দিকী'র নাটক 'গলির ধারে ছেলেটি' ছায়া অবলম্বনে নির্মিত।

সাল ১৯৭৯। সাহিত্য নির্ভর সিনেমার প্রচলন হতে তাও দেরি হচ্ছে। পাশের পশ্চিম বঙ্গেও যদি আমরা চোখ রাখি দেখতে পাবো এমন অনেক অনেক সিনেমা তারা নির্মাণ করেছেন। যাইহোক আমাদের দেশে এটা সুখবর ছিল যে সাহিত্য নির্ভর সিনেমাগুলো হিট হচ্ছিল। ১৯৭৯ সালে আবু ইসহাকের 'সূর্য দীঘল বাড়ি' কালজয়ী উপন্যাস নিয়ে যৌথভাবে সিনেমা নির্মাণ করেন মসিহ উদ্দিন শাকের ও শেখ লিয়াকত আলী। এটিই ছিল প্রথম সরকারি অনুদানে নির্মিত বাংলাদেশি সিনেমা। সাহিত্য নির্ভর সিনেমা কতটা শক্তিশালী তা আবারো প্রমাণিত হয়। এটি শ্রেষ্ট চলচ্চিত্র ও পরিচালনাসহ মোট আটটি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার পায়। এছাড়া ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৮০ তে তিনটি পুরস্কার, ফিগুএরা দা ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে একটি ও বাচসস পুরস্কারে ২ টি পুরস্কার লাভ করে।

১৯৮০ সালে একটি শিশুতোষ সিনেমা নির্মাণ করেন  বাদল রহমান। নাম এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী।  এরিখ কেস্টনারের জনপ্রিয় উপন্যাস এমিলের গোয়েন্দা দল এর ছায়া অবলম্বনে এটি নির্মিত হয়।

১৯৮০-৯০ এ আর কোন উল্লেখযোগ্য সিনেমা নেই সাহিত্য নির্ভর। তখন বাণিজ্যিক সিনেমার বেশ রমরমা ব্যবসা। সাহিত্য নির্ভর না হলেও চ্যালেঞ্জ, তিন কন্যা, বেদের মেয়ে জোসনা, ভেজা চোখ সহ বেশ কিছু অলটাইম হিট ছবি আমরা পেয়েছি।

নব্বুই দশক। এই সময়টাতে অনেক সমৃদ্ধ সিনেমা আমরা পেয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার থেকে একই নামে সিনেমা তৈরি করেন মুস্তাফিজুর রহমান। মানিকের কালজয়ী উপন্যাস 'পদ্মানদীর মাঝি' নিয়ে সিনেমা হয় ১৯৯৩ সালে। ভারত-বাংলাদেশ এর যৌথ প্রযজোনায় এটি নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ।  একই সালের আরেকটি সিনেমা 'একাত্তরের যিশু'শাহরিয়ার কবির এর একাত্তরের যিশু গল্প অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই সিনেমাটি দেশ বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।

১৯৯৪ সালে অভিষেক হয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের। তার উপন্যাস আগুনের পরশমণি থেকে একই নামে নির্মাণ করেন একটি সিনেমা। এটি তার প্রথম সিনেমা হলেও সেরা চলচ্চিত্র, সেরা চিত্রনাট্য, সেরা অভিনেত্রীসহ ৮টি বিভাগে জয় করে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এরপর মোরশেদুল ইসলাম সেলিম আল দীনের গল্প অবলম্বনে নির্মাণ করেন চাকা।

একবছর পর ১৯৯৫ সালে সেলিনা হোসেনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি উপজীব্য করে সিনেমা নির্মাণ করেন মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা গল্প ও সেরা সিনেমাটোগ্রাফির জন্য এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। একই সালে আরো একটি হিট সিনেমা ছিল দিপু নাম্বার টু। মোহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে দিপু নাম্বার টু নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। শিশুতোষ এই সিনেমাটি জনপ্রিয় হয় ব্যাপক এবং জয় করে নেয় ২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

সেলিনা হোসেনের বিখ্যাত উপন্যাস হাঙর নদীর গ্রেনেড অবলম্বনে ১৯৯৭ সালে হাঙর নদীর গ্রেনেড নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম।

শ্রাবণ মেঘের দিনে মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে এটি তৈরি করেন লেখক নিজেই। 

এবার একটি নতুন শতাব্দী তে প্রবেশ। 

সাল ২০০০। সেলিম আল দীনের নাটক কিত্তনখেলা অবলম্বনে নির্মাতা আবু সায়ীদ নির্মাণ করে সিনেমা কিত্তনখেলা।

২০০১ সালে একমাত্র সাহিত্য নির্ভর সিনেমা ছিল লালসালু। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু অবলম্বনে এটি নির্মিত হয়। সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতাসহ মোট ৮টি বিভাগে জয় করে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

২০০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প শাস্তি অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন সিনেমা শাস্তি। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ জিতে  নেয় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, গোল্ডেন জুবিলী অডিয়েন্স চয়েস এওয়ার্ড।

হাজার বছর ধরে সিনেমাটি ছিল এক নতুন সংযোজন। প্রতিভাবান নির্মাতা ও লেখক জহির রায়হানের উপন্যাস হাজার বছর ধরে অবলম্বনে একই নামের সিনেমা তৈরি করেন  কুহিনূর আক্তার সুচন্দা। সিনেমা বোদ্ধা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় এটি। তাছাড়া ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ৪ টি বিভাগে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার জয় করে এই সিনেমাটি।

২০০৬ সালে মুক্তি পায় নন্দিত নরকে, কাবুলিওয়ালা এবং সুভা। এদের মধ্যে নন্দিত নরকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে এবং বাকি দুইটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে নির্মিত।

ততদিনে অশ্লীল সময় চরম তালে বাংলা সিনেমায়। ভাল সিনেমা যেন আসছেই না। তখনই তৌকির আহমেদ নিয়ে গেলেন আমাদের দারুচিনি দ্বীপে। কথাসাহিত্য হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে এবং তারই লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত সিনেমাটি সেরা চলচ্চিত্রসহ মোট সাতটি বিভাগে জয় করে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এছাড়াও বালি ফিল্ম ফেস্টিভাল ইন্দোনেশিয়া তে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে জয় করে নেয় পুরস্কার। সিনেমাটি দর্শকমহলেও সারা ফেলে। জনপ্রিয় ফিকশনাল চরিত্র শুভ্র'কে এই প্রথম চিত্রায়ন করা হয়। এরপরের বছর  অর্থাৎ ২০০৯ সালে আমার আছে জল উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে সিনেমা নির্মাণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ২০১০ সালে বেশ কিছু ভাল সিনেমা আমরা পাই। কিন্তু সাহিত্য নির্ভর সিনেমা ছিল একটি। "এবং কান্না"। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প "কান্না" অবলম্বনে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা এর চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন মারুফ হোসেন ও রবি এবং পরিচালক ছিলেন মারুফ হোসেন। অনেকেই এর কথা জানেন না।

২০১১ সালে আমরা দুইটি সাহিত্য নির্ভর সিনেমা পাই। একটি হল আমার বন্ধু রাশেদ। অপরটি গেরিলা। আমার বন্ধু রাশেদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস আমার বন্ধু রাশেদ এর ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক'র উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে নাসির উদ্দিন ইউসুফ নির্মাণ করেন গেরিলা। উল্লেখ্য এই দুইটি সিনেমাই মুক্তিযুদ্ধের। গেরিলা ছিল বিগ বাজেটের সিনেমা। এবং জয় করে নেয় মোট দশটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

২০১৩ সালে পনেরো তম দেবদাস হন শাকিব খান। অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের প্রেমের উপন্যাস দেবদাস কে নিয়ে যত সিনেমা হয় তার মধ্যে এটি সর্বশেষ এবং পনেরো তম। পরিচালনায় ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। এর আগেও তিনি একবার দেবদাস বানান ১৯৮২ সালে। তখন দেবদাস ভূমিকায় ছিলেন বুলবুল আহমেদ এবং পার্বতী ভূমিকায় করবি।

২০১৪ সালে সৈয়দ মোস্তফা সিরাজের 'গাছটা বলেছিলো' অবলম্বনে ফিচার ফিল্ম নির্মাণ করেন 'বৃহন্নল্লা'একই বছর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'রেইনকোট' গল্প অবলম্বনে জাহিদুর রহিম অঞ্জন নির্মাণ করেন 'মেঘমল্লার'এটি ছিল সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমা। এটির জন্য তিনি সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়াও এটি আরো তিনটি বিভাগে পুরস্কার পায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শ্রেষ্ট কাহিনীকার হিসেবে মরণোত্তর পুরস্কার পান। বিদেশি অনেক ফিল্ম ফ্যাস্টিভালেও এটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

২০১৬ সালে হুমায়ূন আহমেদের কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামের সিনেমা নির্মাণ করেন তাঁর স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। এবং চলতি বছর অর্থাৎ সতেরো সালের সাহিত্য নির্ভর সিনেমা হল আঁখি ও তার বন্ধুরা এবং খাঁচা।

মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন এই শিশুতোষ সিনেমাটি। হাসান আজিজুল হকের ছোট গল্প  অবলম্বনে খাঁচা নির্মাণ করেছেন আকরাম খাঁন। ৯০ তম একাডেমীক এওয়ার্ডে বিদেশি বিভাগের চলচ্চিত্রের জন্য এখন এটি বংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

এই ছিল সাহিত্যকে বইয়ের পাতা থেকে সেলুলয়েড ফিতায় আনার গল্প। সেই সাহিত্যকেই বা সিনেমা কতটা রিপ্রেজেন্টস করেছে সেটাও বিস্তর গবেষণার বিষয়। সেই সম্পর্কে পরে একদিন আলোকপাত করা যাবে। দেশীয় সিনেমায় আরো বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। পরিবর্তন প্রয়োজন সেই সকল পরিচালক এবং প্রযোজকদের যারা সিনেমার আসল মানেটাই জানে না। এখানে  সাধারণত নায়ক, নায়িকা, ভিলেনই মুখ্য কিন্তু সিনেমার প্রাণ গল্প। তার জন্য তেমন অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না কেননা গল্পের জন্য তো আছেই বন্ধু রাষ্ট্রের ছবি মেরে দেয়ার মত বিশ্রী অভ্যাস যা একটা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে চলতে একটা ট্রেন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। এবং সেসকল নকল সিনেমা হিটও হচ্ছে কিন্তু মৌলিক যে গুটিকয়েক সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে তা ফ্লপ হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে অনেক সিনেমার নামই আসতে পারে। কিন্তু সেসব সিনেমা দেখে আমার উপলব্ধি  ছিল এই যে, হিট হবার মত উপাদান থাকার পরও কেন ফ্লপ হলো? কারণ হিসেবে বলব একবিংশ শতাব্দী গ্লোবাল ভিলেজে যেকোনো সিনেমাই আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। ফলে সেসব সিনেমার প্রতি আমরা ঝুঁকে পড়ে ওই কালচারটা অজান্তেই ধারণ করছি। সেই সুযোগ নিচ্ছে পরিচালক সমাজ। তারা ওইসব সিনেমা বিশেষত ভারতীয় দক্ষিণী সিনেমা নকল করে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। ওইরকম কালচার, পোশাকাদি, কথা বলার স্টাইল, নাঁচ-গান, মারামারি পেয়ে আমরাও নিজেদের শিকড় ভুলতে বসেছি
সিনেমাগুলি আর পারিবারিকভাবে দেখা যায় না। 

আমাদের এখন তাই এমন সিনেমা দরকার যা প্রকৃত বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্টস করতে পারে। আর নির্ভেজাল এইসব গল্পের জন্য রয়েছে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য। ভাল নির্মাতার হাতে পড়লে অবশ্যই তা দর্শক গ্রহণ করবে।

দর্শক শ্রেণি আজ শিক্ষিত হচ্ছে। তাদের চাহিদার লেভেলও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু যোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন পরিচালকরা। সময়ের সাথে আপডেটেট না। তারা যদি অবসরেও যান ক্ষতি নেই কেননা একটা ইয়ং জেনারেশন আছে যারা সুযোগ পেলে অনেক কিছু করে দেখাতে পারে এবং তারা তা প্রমাণও করেছে।

ঝোলায় থাকা মান্ধাতা আমলের গল্প না দেখিয়ে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য আসুক সিনেমায়। আসছে বছর সেই প্রত্যাশায়।


৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭
সিলেট।


লেখা পাঠানঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই