চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

পিরামিডে শেষ যুদ্ধ



পিরামিডে শেষ যুদ্ধ
আখতার মাহমুদ


[প্রাক কথনঃ ২০৩০ সালে কোভিড-১৯ এর উত্তরসূরী ভাইরাস কোভিড আলফা সমস্ত পৃথিবী বিরান করে তোলে। পৃথিবীর প্রায় পঁচানব্বইভাগ মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অসম্ভব জেনে অল্প কিছু বিত্তবান ও প্রভাবশালী মানুষ কোয়ারেন্টিন ফ্যাসিলিটিতে চিরতরে আশ্রয় নেয় সব সাধারণ মানুষকে ভাইরাসের কবলে ফেলে রেখে। সাধারণ মানুষ পিঁপড়ের মতো মরে সাফ হয়ে যায়। শেষতক বিরান পৃথিবীতে রাজত্ব করতে থাকে ভাইরাসটা। কিন্তু, পৃথিবীর সব দুঃসময়েই কিছু মহানায়ক তৈরি হয়। যারা ভাবুক বা শিল্পী নয়, তারা যোদ্ধা। এটা তেমনই এক যোদ্ধার গল্প। পাঠককে কোভিড আলফা সিরিজের প্রথম গল্পে স্বাগতম।]


রাফিক রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছে। সামনের ভাঙাচোরা পিরামিড ছাড়া লুকোনোর পথ নেই। মাইল তিন দূরে তার গ্রাম। আজ গ্রামের মন্দিরে সাপ্তাহিক প্রার্থনার সময় হঠাৎই এক সুদর্শন বিশালদেহী উপস্থিত হয় মন্দিরে। গ্রামের গণ-মান্য সবাই ছিলো। তার দাদা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত আকারা-ও ছিলেন। সে দাদার নিত্যসঙ্গী। 
চমক কাটার আগেই আগন্তুক অস্ত্র তাক করে বিদ্যুৎ রশ্মি ছোঁড়ে নিরীহ মানুষের ওপর। রশ্মি গায়ে পড়তেই ভস্ম হয়ে যাচ্ছিলো তাদের শরীর। প্রথম সুযোগেই দাদা মন্দিরের গোপন পথে রাফিককে নিয়ে পালায়। কিন্তু মানুষটা বেশিদূর যেতে পারে না। বলে- ‘আমি পারবো না। তুই পালা।’
ওদিকে বিস্ফোরণে প্রচন্ড কাঁপছে মন্দির। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে।  নিরূপায় রাফিক জলভরা চোখে পালায়। মন্দির থেকে কিছুদূর গিয়ে দেখে ধ্বসে পড়েছে মন্দির। বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীতে বুড়োটা ছাড়া তার আর কেউ নেই। কিন্তু ধূলি-ধোঁয়া ভেদ করে আততায়ী বেরিয়ে তাড়া করলে শোক ভুলে প্রাণভয়ে ছোটে।

উপায় না দেখে শেষতক পিরামিডেই ঢোকে রাফিক। অযত্নে ভেঙে-চূড়ে আছে ওটা। পিরামিডে ঢুকে গা ছমছম করে তার। পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে পিরামিডের গহ্বরে নেমে যেতে থাকে। সিড়ি যেন অন্তহীন। সিঁড়ি শেষে দেখে চারপাশে অসংখ্য সুড়ঙ্গ। মাঝখানে বিশাল বিশাল দেবতার মূর্তি। কিছু ভেঙে আছে। ছুটে একটা সুড়ঙ্গে ঢোকে। আবছা আলোয় সামনে এগোয়। একসময় সামনে খোলা মুখ দেখে খুশিতে সুড়ঙ্গ মুখ দিয়ে বেরিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। যে সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকেছিলো তার উল্টো দিকের সুড়ঙ্গ মুখে দাঁড়িয়ে আছে! পাশেই নড়াচড়ার আভাস পেয়ে কলজে লাফিয়ে ওঠে। আততায়ী অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে। চোখ বন্ধ করে রাফিক। কেন পৃথিবী ছাড়তে হচ্ছে সে জানে না।

চোখ বন্ধ থাকলেও আলোর ঝলক টের পায়। প্রচন্ড ধাক্কায় ছিঁটকে পড়ে। সবশেষ? চোখ খুলে দেখে তার সামনে  ধূসর আলখেল্লা পরা এক অবয়ব পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে। এক হাতে তলোয়ার। অন্য হাতে কী যেন আছে। মৃত্যুর দেবতা? বিড়বিড় করে- ‘হে দেবদূত, আমার আত্মা নিতে পারেন আমি প্রস্তুত।’
দেবদূত ভারি কণ্ঠে বলে- ‘আপাতত আত্মাকে পালাতে প্রস্তুত রাখো।’
মানে কি? লাফিয়ে দাঁড়ায়। দেখে- আততায়ী চিৎ হয়ে আছে মেঝেতে। তার বিদ্যুৎ ছুঁড়ে দেয়ার অস্ত্রটা দু’টুকরো। মুহূর্ত পরেই আততায়ী উঠে ছুটে আসে ম্যাশেটি বের করে। দেবদূত বিদ্যুৎ গতিতে তলোয়ারে ম্যাশেটি ঠেকিয়ে বাঁ হাতের অদৃশ্য বস্তু দিয়ে ধাক্কা দেয়। ছিঁটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ে সে বিস্মিত। কিসে ধাক্কা খেয়েছে বুঝতে পারছে না।
দেবদূত মাথার হুড নামিয়ে বলে- ‘সাইমুম ফিরে যাও। তোমার ক্ষতি করতে চাই না।’
সাইমুমের চোয়াল ঝুলে পড়ে। ‘আপনি আমাকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ। আমার ডিএনএ থেকে তুমি ল্যাবে জন্মেছো।’
‘আমি জানি, আপনি অন্ধকারের রাজা। তবু আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমি পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে এসেছি।’ গর্জে ওঠে সে।
সাইমুমের গর্জনে ভয়ে পিছিয়ে এক মূর্তির সাথে ধাক্কা খায় রাফিক। মূর্তি দুলে উঠলে ধরে সেটার দুলুনি থামিয়ে বিস্ময়ে দেখে আলখেল্লাধারীর ঘাড় সমান সুন্দর চুল। তার মানে দেবদূত আত্মা নিতে আসে নি! কিন্তু ইনি আকাশ থেকে না মাটি ফুঁড়ে এসেছেন?
মানুষটা নরম গলায় বলে- ‘অন্ধকারের রাজা নই, লোকে আমাকে চিরযুবক নামে চেনে। ’
‘মিথ্যে!’ বলেই বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসে সাইমুম। চিরযুবক আবারো বাম হাত মুঠো করে সামনে বাড়ায়, কিন্তু অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় সাইমুম সেটা এড়িয়ে তরবারি ধরা হাত ধরে সর্বশক্তিতে তাকে ছুঁড়ে দেয় দেয়ালে। প্রচন্ড আঘাতে ভাঙাচোরা পুতুলের মতো পড়ে থাকে চিরযুবক। বোধহয় শরীরের সব হাঁড় ভেঙে গেছে। হাতের তরবারি ছিঁটকে গেছে। চিরযুবকের চুল ধরে তাকে প্রায় ঝুলিয়ে সোজা করে সাইমুম। ব্যথায় আধবোজা চোখ চিরযুবকের। হঠাৎ তীক্ষ্ন চিৎকার দিয়ে বসে পড়ে সাইমুম। তার ডান পায়ের পিঠে একটা ছোট্ট ছুরি গেঁথে আছে।
চিরযুবকের আধবোজা চোখ খুলে যায়। ‘সন্তানকেও আমি দ্বিতীয় সুযোগ দিই না।’
সাইমুম জবাবে অক্সিডানাইল গান বের করে তার মুখে বিষাক্ত তরল ছিটিয়ে দেয়। তীব্র বিষে চিরযুবকের গলার নীল রগ ফুটে ওঠে। গলা চেপে ধরে কাতরায়, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়।
সাইমুম পা থেকে ছুরি তুলে সিধে না হতেই দেখে রাফিক বিশাল এক মূর্তি ধাক্কা দিয়ে ফেলছে তার ওপর। সরার আগেই গম্ভীর দেবমূর্তি তাকে চাপা দেয়। 
রাফিক দ্রুত চিরযুবকের কাছে এসেও অসহ্য ঝাঁঝালো গন্ধে সরে পড়ে। চিরযুবক অনেক কষ্টে কেশে বলে- ‘নিঃশ্বাস নেবে না। সুড়ঙ্গ ধরে বেরুতে হবে। এ পিরামিডে যেদিকেই মুখ করে দাঁড়াবে সে দিকের দ্বিতীয় আঁধার সুড়ঙ্গেই আছে বেরুনোর পথ।’
রাফিক দ্রুত চিরযুবককে ধরে সামনের এক দ্বিতীয় আঁধার সুড়ঙ্গে ঢোকে। তার আগে তলোয়ার কুড়িয়ে নিতে ভোলে না। অন্ধকার হাতড়ে কিছুদূর গিয়ে রাফিক কাতর হয়ে পড়ে। ‘এবার দম নিই?
চিরযুবক সায় দিলে বুক ভরে শ্বাস টানে। আহ, জীবনের কী স্বাদ!
কিছুক্ষণ পর চিরযুবক থামলে রাফিক হাতড়ে বোঝে সামনে দেয়াল। ‘এখন?’
‘যে কোনো দ্বিতীয় পাথরে চাপ দাও।’ বলেই চিরযুবক নিথর হয়ে যায়।

রাফিক অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে দ্বিতীয় পাথর খুঁজে চাপ দিতে থাকে, কিন্তু কাজ হয় না। তবে একদম নিচের দিকের এক পাথরে চাপ দিতেই ঘড়ঘড় শব্দে দেয়াল সরে। দিনের আলোয় প্রথমবারের মতো দেখে সে চিরযুবককে। হালকা দাঁড়ি আছে। চুলগুলো সুন্দর। কিন্তু সম্পূর্ণ শরীর নীল এখন। জ্ঞান হারিয়েছে। বেরিয়ে দেখলো, পিরামিড থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরের বালির ডিবির কাছে ওরা। 
পানি দরকার। গলা শুকিয়ে খসখসে। নীল নদের দিকে চলতে থাকে রাফিক। আলখেল্লা ধরে অজ্ঞান চিরযুবককে বালিতে টেনে নিয়ে চলে।

প্রায় মাঝ রাতে নীলনদের কাছে পৌঁছায়। শরীর ব্যথায় টনটন করছে। পিপাসায় চোখে ফুটছে তারা। নীলনদে নেমে আগে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে অল্প পানি খেয়ে পরণের কাপড় পানিতে ধুয়ে ভিজিয়ে চিরযুবকের ওপর নিয়ে কাপড় চিপে দেয়। মুখে পানি যেতেই নড়ে চিরযুবক। 
‘আমরা কোথায়?’
‘নীলনদের কাছে।’
‘এতদূর কিভাবে….’ উঠতে গিয়েও পারে না।
‘শুয়ে থাকুন।’
‘এছাড়া উপায়ও নেই। হাত-পা নাড়াতে পারছি না। পশুর রক্ত দরকার। সাইমুম আমাকে অক্সিডানাইল দিয়েছে। আমরা যারা কোভিড আলফায় আক্রান্ত তাদের জন্যে বিষ ওটা। ভাইরাসগুলো নির্জীব এখন। তাজা রক্তেই কেবল সচল হবে। পশু খোঁজো, সাইমুম আমাদের খুঁজে পাবার আগেই।’
‘সে-তো মরেছে মূর্তির নিচে পড়ে।’
‘গ্রেট আলফারা এত সহজে মরে না।’
‘গ্রেট আলফা?’
‘তুমি জানো, কিছু মানুষ কোয়ারেন্টিন ফ্যাসিলিটিতে বাস করতে বাধ্য কোভিড আলফা ভাইরাসের কারণে। বাইরে এলেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরবে কয়েক মিনিটে। অথচ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও আমরা শরীরে ভাইরাস নিয়ে টিকে আছি অলৌকিকভাবে। ভাইরাসটা শরীরে না থাকলেই বরং মরবো আমরা। আর ফ্যাসিলিটিতেও বাঁচবো না। কারণ ফ্যাসিলিটির ডিজইনফেকশন সিস্টেম এমনভাবে তৈরি যে শুধু ভাইরাস নয়, ভাইরাস আক্রান্ত শরীরও ধ্বংস করে। গ্রেট আলফারা ভাইরাসটায় আক্রান্ত হয় না। তারা ফ্যাসিলিটি আর উন্মুক্ত পৃথিবী দু’জায়গাতেই থাকতে পারে।’
‘কিন্তু কেন?’
‘সব ব্যাখ্যার সময় নেই। দেখো পশু পাও কী না।’

চিরযুবক বাম হাত সামনে বাড়িয়ে মুঠো করতেই অদৃশ্য কোনো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিঁটকে পড়ে সাইমুম। মাথা ঝাঁকিয়ে প্রায় পরমূহূর্তেই উঠে দাঁড়ায়। অদৃশ্য ঢালটার কথা ভুলে গেছিলো।
‘আপনি কী জাদুকর?
চিরযুবক হাসে। ‘এটা শিল্ড অব লাইট।’
জবাবে বুলডোজারের মতো ছুটে আসে সে। এবার ম্যাশেটি ধরা হাত ধরে ফেলে চিরযুবক। হাতের কব্জি উল্টো দিকে চাপ দিতেই আর্তনাদ করে ওঠে সাইমুম। ম্যাশেটি খসে পড়ে। এসময় হঠাৎ দূরে একটা বালিয়ারি নড়ে উঠতেই চিরযুবক বিস্ময়ে দেখে একটা ভীতিকর ল্যান্ড ড্রোন রাইফেলের নল বাগিয়ে উঠে আসছে বালি থেকে!

রাফিক নদীর ধারে চলে যায়। সেখানে বন্য ছাগল দেখেছে কিছু। সে জাত শিকারী, একটা ছাগলের বাচ্চাকে তাড়িয়ে ধরতে সময় লাগে না। ওটাকে জবাই করে চিরযুবকের মুখে ধরলে আকণ্ঠ রক্ত পান করার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে আর রাফিক ছাগলের মাংস পুড়িয়ে খায়। খাবার পর কখন সে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে জানে না।
ঘুম ভাঙে ভোরের পাখির ডাকে। হন্তদন্ত হয়ে উঠে দেখে চিরযুবক পাশে নেই। লাফিয়ে ওঠে। সাইমুম কি চলে এসেছে? নদী তীরের দিকে চোখ পড়তেই স্বস্তি বয়ে যায় শরীরে। মানুষটা সতর্ক পায়ে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে একদম সুস্থ। 
কাছে গিয়ে বলে, ‘দুঃখিত, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’
চিরযুবক হাসে। ‘ঠিক আছে। ছাগলের কিছু মাংস থাকলে দাও।’
চিরযুবকের জন্যে কিছু মাংস পুড়িয়ে রেখেছিলো। সেগুলো দিলে চিরযুবক তৃপ্তির সাথে খায়। 
‘বুঝতে পারছি না, ওই মানুষটা আমাকে মারতে চেয়েছে কেন? কেন গ্রাম তছনছ করেছে?’ রাফিক প্রশ্ন করে।
‘আমার জন্যেই সব আয়োজন।’
‘মানে?’
‘প্রথমে ভেবেছি তোমরা বিপদে পড়েছো, কিন্তু সাইমুমের অক্সিডানাইল গান বলে লক্ষ্য ছিলাম আমি।’
‘আপনাকে কেন এত আয়োজন করে মারতে চাইবে কেউ?’
‘ব্যাপারটা জটিল। আপাতত সংক্ষেপে বলি, প্রায় ত্রিশ বছর আগে যখন পৃথিবীর পঁচানব্বই ভাগ মানুষ কোভিড আলফা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তখন কিছু ধনী ও প্রভাবশালী মানুষ কোয়ারেন্টিন ফ্যাসিলিটি তৈরি করে নিজেদের বাঁচায়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সামান্য কিছু মানুষ আর কিছু শিশু ভাইরাসটায় আক্রান্ত হয়েও বেঁচে যায়। সমস্ত পৃথিবী মিলিয়ে এদের সংখ্যা মাত্র হাজার কয়েক। এখন ফ্যাসিলিটির মানুষেরা মনে করে কেবল তারাই সভ্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদেরই অধিকার। তো এ বৈষম্যটা বদলাতে চাইছি আমি। সে কারণেই আমার মাথা চায় ওরা।  বলতে পারো, ওরা এক নতুন ক্রুসেড শুরু করেছে।’ 
‘ক্রুসেডের গল্প আমি জানি। মুসলিম বীর সালাউদ্দিনের বীরত্বের কাহিনী শুনে বড় হয় এখানের বাচ্চারা। কিন্তু আরেকটা বিষয়, আপনি কেন আমাদের বিপদে ছুটে আসবেন? আপনাকেতো এ অঞ্চলের মানুষ মনে হয় না।’
‘শশশ.... কে যেন আসছে!’ তলোয়ার হাতে নেয় চিরযুবক। ‘কেউ একজন দুটো উঠ নিয়ে আসছে।’
কিন্তু খুশিতে লাফায় রাফিক। ‘ওটা আমার দাদা!’ ছুটে যায় সে। 
আকারা নাতিকে দেখে নেমে জড়িয়ে ধরে। রাফিক কাঁদে আনন্দে। ‘ভাবিনি তুমি বেঁচে আছো।’
‘তোকে রেখে মরি কী করে!’
‘কিভাবে আমাকে খুঁজে পেলে?’
‘তোর পায়ের ছাপ পিরামিডের দিকে গেছে দেখে সেদিকে গিয়েছিলাম। পিরামিডে ঢোকার মাইল খানেক আগে চক্কর দিয়ে জায়গাটা রেকি করতে গিয়ে এক সুড়ঙ্গ মুখে তোর পায়ের ছাপ দেখে বুঝি কোনোভাবে পিরামিড থেকে বেরিয়ে নীলনদের পথ ধরেছিস।’
‘দাদা, দেখো ইনি চিরযুবক। আমাকে বাঁচিয়েছেন।’
আকারা নাতিকে পাশে সরিয়ে দু’হাত বাড়ায়- ‘বন্ধু আমার! জানতাম, আমার ডিসট্রেস সিগন্যাল পেয়েই তুমি আসবে।’
চিরযুবক হেসে জড়িয়ে ধরে আকারাকে। ‘বন্ধুর বিপদে আসবো না?’
রাফিক বিভ্রান্ত। চিরযুবকের বয়স পঁচিশ-ত্রিশ। আর দাদার বয়স ষাট বা সত্তর। তারা বন্ধু হয় কী করে?
বিভ্রান্ত নাতিকে আকারা বোঝায়- ‘দুই হাজার ত্রিশ সালে মানুষ মরণ ভাইরাসে মরে বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে আমরা-ও ছিলাম। আমরা সমবয়সী। কিন্তু ভাইরাসটা ওর শরীরে কিছু একটা ঘটিয়েছে, তাই সে বুড়ো হয় না।’
‘এ কারণেই চিরযুবক?’
‘হ্যাঁ। আমাদের কিন্তু দ্রুত নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে।’
‘ওরকম জায়গা একটাই আছে।’ আকারা জানায়।
‘পথ দেখাও।’ বলেই পিছনে ফিরে উটের দিকে পা বাড়াতেই আকারা বিদ্যুৎ গতিতে বিশেষ ঔষধ মাখানো কাঁটা গেঁথে দেয় চিরযুবকের পিঠে। সে বিস্মিত হওয়ার আগেই জ্ঞান হারায়।

রাফিক চেঁচায়- ‘কী করলে!’
চিরযুবককে বাঁধতে ব্যস্ত আকারা চুপ করে থাকে।
রাফিক কৈফিয়ত চায়- ‘কী করেছো ওনাকে?’
‘অজ্ঞান করেছি। ওকে উঠের পিঠে বেঁধে দে।’
‘চিরযুবক বলছিলো, তার জন্যেই এতো আয়োজন?’
‘আমার সাথে গেলে তুই সব জানবি। ভয় নেই চিরযুবকের ক্ষতি হবে না।’
‘কোথায়?’
‘তুতেনখামেনের দ্বিতীয় পিরামিডে।’
‘সেখান থেকেই তো পালিয়েছি।’
‘সে কারণেই যাব। ওখানে শত্রুরা খুঁজবে না।’
বিভ্রান্ত রাফিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদার সাথে রওনা দেয়। 


পিরামিড থেকে বেরিয়ে ভাঙা কিছু অংশের আড়ালে সাইমুম অপেক্ষা করছিলো। বেশ আহত। এক পা ফুটো হয়েছে ছুরিতে, এক হাতের দুটো আঙুল থেতলে গেছে, মাথা ফেটেছে। কিন্তু তাকে বলা হয়েছে অপেক্ষা করতে। ভোরের আলো ফোটার সামান্য পরেই তার মাইক্রো দূরবীনে ধরা পড়ে ছেলেটা আর এক বৃদ্ধ এদিকে আসছে। বৃদ্ধের উটে বাঁধা চিরযুবক! ক্রুর হাসি ফোটে তার মুখে।

জ্ঞান ফিরলে চিরযুবক বোঝে, হাত-পা বাঁধা। জিজ্ঞেস করে, ‘কেন আকারা?’
চিরযুবকের জ্ঞান ফেরায় চমকায় বৃদ্ধ। ‘তোমাকে না ধরলে আমার নাতিকে মেরে ফেলতো ওরা।’
‘মিথ্যে বলছো।’
একটা দীর্শ্বাস চাপে আকারা। ‘তোমাকে ঈর্ষা করি। তুমি সুদর্শন, অমরত্ব পেয়েছো। পৃথিবীর সম্রাট তুমি। আর আমি কী পেয়েছি জীবনে?’
‘সম্রাট নই, আমি যোদ্ধা।’
‘ওরা বলেছে তোমাকে গবেষণার জন্যে দরকার। আরো বলেছে, তোমার রক্ত থেকে আমাকে অমরত্বের ঔষধ বানিয়ে দেবে….’
রাফিক চেঁচিয়ে ওঠায় তাকায় ওরা। সাইমুম খুঁড়িয়ে এগোচ্ছে। হাতে ম্যাশেটি।
‘আকারা, ভুল করছো। আমাকে বিশ্বাস করো। পৃথিবীর কোনো মানুষই অমর নয়। আমিও নই। বাঁধন খুলে দাও। তোমাদের মারবে সাইমুম।’

আকারা উট থেকে নেমে এগোয় সাইমুমের দিকে। জোরে বলে- ‘আপনার কর্তাদের জানান, চিরযুবককে ধরেছি আমি।’
এগিয়ে তার বুকে ম্যাশেটি ঢোকায় সাইমুম। ‘ধন্যবাদ!’
দেহটা বালি ছোঁয়ার আগেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। সাইমুম এরপর এগোতে গিয়ে থমকায়। ছেলেটা কখন যেন চিরযুবকের বাঁধন কেটে দিয়েছে। দেখে ম্যাশেটি উচিয়ে ছুটে যায়। কিন্তু চিরযুবক বাম হাত সামনে বাড়িয়ে মুঠো করতেই অদৃশ্য কোনো দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিঁটকে পড়ে সাইমুম। মাথা ঝাঁকিয়ে প্রায় পরমূহূর্তেই উঠে দাঁড়ায়। অদৃশ্য ঢালটার কথা ভুলে গেছিলো।
‘আপনি কী জাদুকর?
চিরযুবক হাসে। ‘এটা শিল্ড অব লাইট।’
জবাবে বুলডোজারের মতো ছুটে আসে সে। এবার ম্যাশেটি ধরা হাত ধরে ফেলে চিরযুবক। হাতের কব্জি উল্টো দিকে চাপ দিতেই আর্তনাদ করে ওঠে সাইমুম। ম্যাশেটি খসে পড়ে। এসময় হঠাৎ দূরে একটা বালিয়ারি নড়ে উঠতেই চিরযুবক বিস্ময়ে দেখে একটা ভীতিকর ল্যান্ড ড্রোন রাইফেলের নল বাগিয়ে উঠে আসছে বালি থেকে! সাইমুমের হাত ছেড়ে ওকে আড়াল করে শিল্ড অব লাইট বাড়িয়ে ধরে চিৎকার করে চিরযুবক- ‘রাফিক শুয়ে পড়ো....’  কথা শেষ হতে না হতেই গুলি বৃষ্টি হতে থাকে। রাফিক মুহূর্তেই ঝাঁপ দেয় বালিতে। 
অবাক সাইমুম দেখে মানুষটা তাকে গুলি থেকে বাঁচাতে চাইছে। প্রশ্নটা করেই ফেলে সে- ‘কেন?’
চিরযুবক প্রাণপনে শিল্ড অব লাইট ধরে রেখে বলে- ‘আমি চাই না কেউ অকালে মরুক।’
‘আমাকে বলা হয়েছে, আপনি অন্ধকারের রাজা। পৃথিবীর জন্যে ক্ষতিকর।’
গুলির তোড়ে ক্রমেই পিছু হটছে চিরযুবক। বলে- ‘আমি কেবল তাদেরই শত্রু যারা জেনে-বুঝে অন্যায় করে। তুমি জানতে না, অপরাধীর পক্ষে লড়ছো... কোনো পবিত্র দায়িত্ব পালন করছো না। অন্ধ হয়ে কোনো মানুষের নির্দেশ করাটা পবিত্র দায়িত্ব নয়। এখন বোধহয় বুঝতে পারছো যারা তোমাকে পাঠিয়েছে তাদের কাছে তোমার মূল্য নেই।’
সাইমুম কিছু মুহূর্ত ভয়ঙ্কর যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে সেটা ভালোই উপলব্ধি করে। তাকে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতে না পেরেই নিশ্চয় ওটাকে ব্যাক আপ হিসেবে পাঠিয়েছে। চার পায়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিহীন বুলেট ছুঁড়ছে। বুলেটের আঘাতে বোঝা যায় চিরযুবকের বাড়ানো হাতের সামনে আছে এক অদ্ভুত আলোর দেয়াল। সে বোঝে, বেশিক্ষণ টিকবে না ওই ঢাল। মুহূর্তেই নিজের করণীয় উপলব্ধি করে চিরযুবকের আড়াল থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় বৃত্তাকারে ছুটতে শুরু করে । চিরযুবক হাহাকার করে ওঠে- ‘না!’

সাইমুম কাছে যেতেই ড্রোনের গুলি বৃষ্টি ওর দিকে ঘুরে যায়। বুকে অজস্র বুলেট নিয়ে ড্রোনের পিঠে ঝাঁপিয়ে এক ঘুষিতেই দুমড়ে মুচড়ে দেয়  মাদারবোর্ড। গুলি বৃষ্টি থামে। সে রক্তাক্ত শরীরে পড়ে থাকে ড্রোনের পিঠে। এত কিছু ঘটে মাত্র কয়েক মুহূর্তে।

চিরযুবক ছুটে গিয়ে দেখে সাইমুম নিথর। চোয়াল শক্ত করে ফেলে। এর পেছনে কে আছে জানা নেই তার। তবে কোনো একদিন সে অবশ্যই খুঁজে বের করবে অদৃশ্য শত্রুকে। এই শত্রু বারবার তাকে ধ্বংস-মৃত্যুর মুখোমুখি করে।
আকারার লাশের পাশে বসা রাফিকের কাছে গিয়ে বোঝে শোক হজম করে ফেলেছে ছেলেটা। 
ওর সাহায্যে লাশদুটো দাফন করে বলে, ‘এখন কী করবে?’
‘জানি না।’
‘আমার দেশে চলো। চিরসবুজের দেশ ওটা।’
‘কী নাম আপনার দেশের?’
‘বাংলাদেশ।’
‘অদ্ভুত নাম!’
‘যাবে তুমি অদ্ভুত দেশে?’
‘যাবো।’

চিরযুবক রওনা হলে সে-ও অন্য উটে গিয়ে বসে। ভাবে- মাত্র দু’দিনেই জীবন কত বদলে গেছে! সামনে ছুটন্ত উটে বসা চিরযুবকের পিঠে তাকায়। বুঝে গেছে, মানুষটা সাথে থাকলে কোনো অনিশ্চিত যাত্রায় ভয় নেই। নিশ্চিন্ত মনে সে অনুসরণ করে চিরযুবককে।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই