চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

সারা শহর ফ্যাতাড়ুতে ছেয়ে যাইতেছে



সারা শহর ফ্যাতাড়ুতে ছেয়ে যাইতেছে
তৌকির হোসেন


গলিতে গলিতে, এ দালান, ও দালান, ওই এ্যাপার্টমেন্ট, সেই পার্কে- বস্তুত কলকাতায় ফ্যাতাড়ুদের ছড়িয়ে যাওয়া শুরু হইছে সেই ৯৫ সন থেকে। যেহেতু তারা কোন সাইডে থাকে না, তাই তাদের কোন ট্যাগে ট্যাগায়িত করা যায় না। তারা মুক্ত, স্বাধীন। স্রেফ ঝামেলা পাকাবে এখানে, সেখানে। ধরেন, কোথাও শুভ বিবাহ হইতেছে। সেখানে উড়তে উড়তে গিয়ে সাজানো খাবারদাবারের উপর বলা নাই কওয়া নাই বোঁদপড়া পুকুরের দামড়া শামুক ছেড়ে দিবে। কিংবা সুশীল কবি সম্মেলনে ধুপধাপ বাদুড়ের মতো উড়ে গিয়ে ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাব্যপ্রেমিক/পিয়াসী, পাঠক, অনুরাগীদের উপর আরশোলা ছেড়ে দিবে। কিন্তু, ফ্যাতাড়ুরা কোন সাইডে থাকে না। স্রেফ ঝামেলা পাকায়।

কারা এই ফ্যাতাড়ু?
তো এই ব্যাপারে মদন ফ্যাতাড়ু বলতেছেন, "ফ্যাতাড়ুরা খুব স্পেশাল। ইতিহাসে দেখবে কত মহাপুরুষ মানুষকে নতুন করে বানাবার জন্যে কত ফন্দি বাতলেছে। আমার তো মনে হয় অনেক ঘেঁটে ঘুঁটে শেষমেশ এই ফ্যাতাড়ু তৈরী হয়েছে।"

ফ্যাতাড়ুরা ভয় দেখায়, নোংরা করে ভণ্ডুল করে দেয়। এতেই তাদের মজা। কিন্তু, ফ্যাতাড়ু হওয়া না অত সোজা। ফ্যাতাড়ু হইতে হইলে কিছু কোয়ালিফিকেশন তো থাকা লাগেই প্লাস উড়তে শিখবার মন্তর জানা চাই- "ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই/ ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ সাঁই সাঁই।"

"প্রোপার কোয়ালিফিকেশন থাকার দরকার। বড় বড় অফিসে গেলে, দেখা করছে না, বসিয়ে রাখছে, তুমিও থেমে থাকার পাত্র নও-মনে মনে খিস্তি করছ, নাক খুঁটে চেয়ারের হাতলে লাগাচ্ছ, নখ দিয়ে চিমটে চিমটে ছিঁড়ছ,...
ড্যামেজ। পারলেই ড্যামেজ করতে হবে। এইটা মাথায় থাকতে হবে। এরকম যারা করে তাদের আমরা রিক্রুট করি।"

তাইলে, ফ্যাতাড়ুরা কি খুনখারাপি করে, চুরি করে না রাস্তায় আগুন জ্বালে, দামামা বাজায়? এইসব কিছুই না। বরং যদি ফ্যাতাড়ু মদনকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, রেগেমেগে রদ্দা মেরে বসাইতে পারে যাতে ঘাড় কেলিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তারা চোরও নয়, ডাকাতও নয়। কেবল হুটহাট করে বিঘ্ন ঘটাবে সুন্দরমতো চলা কোন অনুষ্ঠানে। এই ঝামেলা পাকাবার ওস্তাদ ফ্যাতাড়ুদের যিনি তৈরী করেছেন শ্রম দিয়ে, কলম দিয়ে তাঁকে তারা অর্থ, যশ বা তাঁব কোন কিছুই দেয় নাই। বরং এরকম কোনকিছু দেবার প্রতিশ্রুতিও ফ্যাতাড়ুদের কাছ থেকে ছিলো না। কিন্তু অনির্বাপিত প্রতিহিংসার আগুন যে আমাদের মধ্যে সদা জাগ্রত, যার ধিকি ধিকি শিখা স্তিমিত করা যায় না তা চরিতার্থ করবার মোক্ষম চরিত্রগুলো হচ্ছে এই ফ্যাতাড়ুরা।

ফ্যাতাড়ুদের নিয়ে যিনি গল্প ফেঁদেছেন যাকে ফ্যাতাড়ুরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও অবজ্ঞা করে না, সেই নবারুণ ভট্টাচার্য এদের অবস্থান বর্ণনা করতেছেন, "...একটা ব্যর্থতা বোধ তো ওদের মধ্যে আছেই। কারণ রাজনৈতিকভাবে আমরা যা কিছু অর্জন করেছিলাম তার অনেকটাই হারিয়ে গেছে। সেই বোধটা যদি আজকের কোন রাজনীতি সচেতন লেখকের মধ্যে না থাকে আমি সেটাকেই আশ্চর্য বলে মনে করব। কিন্তু ফ্যাতাড়ু শুধু একটা রাজনীতির ব্যাপার না। একটা দৃষ্টিভঙ্গি towards রাজনীতি। আর ফ্যাতাড়ুরা ব্যর্থতা বা সার্থকতার কোন তোয়াক্কাই করে না। তাদের কাজ হলো উড়ে বেড়ানো এবং যেখানে সেখানে ঝামেলা পাকানো। তারা সেটাই করছে। ওদের পসিবিলিটিটা অনেক বেড়ে গেছে। ফ্যাতাড়ু হলো মানুষের স্বপ্নের সেলিব্রেশন, তার প্যাশানের সেলিব্রেশন।… 

...এই যে স্থিতাবস্থা, বড়োলোকদের বদমাইশি ওগুলো তো দেখতে ভালো লাগে না। কিছু করতে পারি না। ফাইভস্টার হোটেলে গিয়ে তো চোখ মারতে পারি না। চারটে ফ্যাতাড়ু ঢুকিয়ে দিই। তারা যা পারে করুক। কিছু বানচাল করে দিক, ভেস্তে দিক, এর মধ্যে Spoil করার একটা আনন্দ আছে। আমি মনে করি, এতে অপমানিত মানুষদের একটা Revenge নেয়ার ব্যাপার আছে। অনেকেই আমাদের জীবনে নানা ক্ষেত্রে ভয়ংকর Insulted । কারণ এ শহরটা আমাদের অপমান করছে এখন। কারণ এখন রাস্তা বানাচ্ছে আর শপিং মল বানাচ্ছে, এখানে তুমি এসো না। এখানে তুমি এক্কেবারেই ফ্যাতাড়ু। আমি যদি আমার মতো জামাকাপড় পরে সেখানে যাই কিচ্ছু হবে না, কেউ আমাকে পাত্তা দেবে না। এখন আমি তো শুধু নবারুণ, নিজেই না বরং বাংলা সাহিত্যে ফ্যাতাড়ুর আবির্ভাব এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিছু করতে পারি না। অন্তত আমার ডি.এস, মদন এরা করবে আর পুরুন্দর ভাট কবিতা লিখবে। এগুলো চলবেই, কিছু করার নেই।"

তবে এই ফ্যাতাড়ুরা সময়ের অন্যান্য যেকোন চরিত্র থেকে আলাদা। তাদের অবস্থান লোয়ার মিডল ক্লাসে। সেখানে তারা বঞ্চিত, অবহেলিত, ঘৃণিত। তারা তাদের জীবনযাপনে সেভাবেই অভ্যস্ত। ট্যাঁকে কিছু থাকলে বাংলুর ঠেকে চলে যায়, আলুর চপ, পাকোড়া বা কয়েক বোতল বাংলা কিনে মৌজ মাস্তি করে। কিন্তু, ফ্যাতাড়ুরা এর মাঝেই উড়ে গিয়ে সব বড়লোকদের কারবারে গিয়ে হানা দিবে। হাসপাতালে, টিভি শো-তে, বইমেলায়, আইপিএলে, রবীন্দ্র জয়ন্তিতে, সম্পাদকদের আখড়ায়, ঠিকাদারের ঠিকানায় তারা গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসবে। তারা যে সমাজে এক্সিস্ট করে, কোনভাবেই যে তারা আউটকাস্ট নয় এর প্রমাণই তাদের ঝামেলাগুলো। এগুলো ছাড়া সভ্য, ভদ্র, সুশীল, উঁচুতলার মানুষজন ফ্যাতাড়ুদের বেল দিতো না কিংবা তাদের গুনতো না। ফ্যাতাড়ু কবি পুরন্দর ভাট, যাকে আউটকাস্ট করে রাখা হয়েছে কবিকূল সমাজে, ব্যক্ত করতেছেন নিজেকে, 

"হামাগুড়ি রেসে হয়েছি লাস্ট
কবিকূলে আমি আউটকাস্ট
ভবহাটে দেখি হাঁড়ির বার্স্ট
জবরজাঁক।"

আবার বড়লোকদের প্রতি যে ক্ষোভ, শোধবোধ তা প্রকাশ পায় তার আরেকটা কবিতায়,

"বোকাছেলে পুচু পুচু
কোকাকোলা খায়
বোকাচোদা বাপ তার
পয়সা জোগায়।"

সাধারণ খিস্তিখেউড়, এককথায় সাধারণ করেও অসাধারণ কথাবার্তায়, নবারুণ ভট্টাচার্যের বেপরোয়া স্টাইল চরিত্রগুলোর সাথে আরও আমাদের আপন করে। পুরন্দর ভাটের নামের আগে আসা উচিত ছিলো ফ্যাতাড়ু মদন আর ডিএস-এর। কালো, কুতকুতে কোলা ব্যাঙ, বেঁটেখাটো দেখতে ডিএস বা ডিরেক্টর স্পেশাল এক অর্থে ফ্যাতাড়ু মদনের শিষ্য। একটুতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে, বোকাসোকা শিষ্যের উপযুক্ত গুরু মদন। মদন দেশবিদেশের হালহাকিকত সম্পর্কে ভালো রকম অবগত। সে যেকোন জায়গায় ঝামেলা পাকাবার আগে সেখানটা সার্ভে করে নেয়। মদন, ডিএস, কবি পুরন্দর ভাট- এই তিন ফ্যাতাড়ু মিলে বিভিন্ন জায়গায় হানা দেয় যাদের উড়ন্ত অবস্থায় দেখতে লাগে ড্রাকুলা বা বিরাট বাদুড়ের মতো।

ফ্যাতাড়ুদের মধ্যেই নবারুণ ভট্টাচার্য টেনে এনেছেন ক্লাস কনশাসনেসের সচেতন প্রয়োগ। আপার ক্লাসের প্রতি যে ক্ষোভ, যে প্রতিহিংসার বোধ মার্কস বলে গেছেন সেটির উপযুক্ত পাত্র হচ্ছেন এনারা। ক্লাস কনশাসনেস ভেতরে ক্রিয়া করে বলেই এনারা ক্ষিপ্ত, বিরক্ত উঁচুতলার মানুষজনের প্রতি। বাংলা সাহিত্যে অন্য কোন কিংবদন্তি চরিত্রগুলোর মধ্যে (ফেলুদা, ব্যোমকেশ, টেনিদা, ঘনাদা, প্রফেসর শঙ্কু, কিরীটি ইত্যাদি) এই শ্রেণী চেতনার সরাসরি বা মেটাফোরিকাল প্রতিবাদ উঠে আসে নাই। অন্তত ফ্যাতাড়ুদের মধ্যেই এই চিত্র সচেতনে ফুটে উঠেছে।

ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক, ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক আর দুইটি অগ্রন্থিত গল্প মিলেঝুলে ফ্যাতাড়ুদের আখ্যানের সংখ্যা বিশ। কিন্তু ফ্যাতাড়ু এক বিশেষ চরিত্র বলেই কেবল এই বিশে আটকে থাকে নাই। নবারুণ ভট্টাচার্যের কাঙাল মালসাটেও ফ্যাতাড়ুরা হানা দিয়েছে। এদের নিয়ে টুকটাক ফিল্মও হচ্ছে নাকি।

তবে বিশেষ গোপনসূত্রে জানা গেছে, নবারুণ নিজেও এক ফ্যাতাড়ু ছিলেন। ফ্যাতাড়ুদের সাথে ঘ্যাঁচর ম্যাঁচর করাতে একবার লিস্ট থেকে তাঁর নাম কাটতে কাটতে আর কাটা হয় নাই। তবে আজকাল ফ্যাতাড়ুদের সংখ্যা আড়ালে আবডালে অনেক বেড়ে যাইতেছে। কে গ্যারান্টি দিতে পারে, পাঠক নিজেও একজন ফ্যাতাড়ু কিনা?

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই