চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অতীত কখনো সখনো বর্তমান



অতীত কখনো সখনো বর্তমান
যিয়াদ বিন সাঈদ

দুই হাজার সাত কি আটের দিকে। নানুবাসায় তখন আমাদের ঘনঘন আসা-যাওয়া। মাস পেরিয়ে ছুটি এলেই বোঁচকাবুচকি নিয়ে আমরা ছুটতাম ময়মনসিংহ। সকাল সাতটা বিশের তিস্তা ধরে মৌজমাস্তি করতে করতে আমরা চলে যেতাম নানুবাসায়, দুলতে দুলতে। সে কী আনন্দের একেকটি সকাল আমাদের জীবনে নেমে আসতো সে সময়ে; আজকাল আর সেসব ভাবতে পারিনা। আধুনিক হ'তে হ'তে হারিয়ে গেছে রসে টইটুম্বুর আমাদের সেই শৈশব। চিরচেনা আনন্দময় হাসের ছানা দৌড়ানো সেই উঠোন।

নানুবাসায় যাওয়ার পর ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে দৌড়োবার গল্প ছাড়া আমার আর কিছুই মনে পড়েনা আজকাল। শোয়েব সিফাতদের সাথে ডরমিটরি মাঠে ছোট সীমানায় ছক্কা পেটানো আর হলের বাউন্ডারিতে বল চলে যাওয়ার দুঃখে ঘরে ফেরা সেইসব মলিন মুখগুলোও মনে পড়ে মাঝেমাঝে।  তবে খেলা ছাড়া আরও একটি গল্প আমার সে শৈশবের প্রফুল্ল মনে দাগ কেটে গিয়েছিলো। সে গল্প করতেই কিনা আজকের এ সন্ধ্যেয় এতো এতো তমহিদের চাহিদা। 

নানাভাই তখন এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ান পদ থেকে সদ্য রিটায়ার্ডপ্রাপ্ত। লাইব্রেরীতে তখন নানাভাইয়ের খুব নামডাক। লোকে এক নামেই চিনে ফেলে। আর তখনই আমাদের বইয়ের প্রতি জন্মানো প্রেমের শুরু সময়। ভাইয়া তো তখন রীতিমতো নেশাগ্রস্ত। আমি পেলে পড়ি না পেলে খুঁজি না। এরকম এক সময়কাল চলছিলো। নানাভাইয়া আমাদের বইয়ের এ প্রীতি দেখে গ্রন্থাগারে যেতে উদ্বুদ্ধ করলেন। আমরাও সুযোগকে রীতিমত কাজে লাগানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। খেলাধুলা ফেলে সকালে নাশতা সেরেই লাইব্রেরীতে চলে যাওয়ার রুটিন হলো। নানুবাসায় তখন খুব ভোরেই আমাদের সকাল হতো। ফজরের পর ঘুমাবার রেওয়াজে কেউ অভ্যস্ত নন। ঢাকা থেকে কেউ গেলে তারা একটু ভিন্ন। ঘুমাতেন বারোটা নাগাদ। নানা নানু আড়চোখে দেখতেন এ আয়েশী জীবনযাপন।  আমরা সব আয়েশ ফেলে সে ভোরেই উঠে যেতাম। পিঠে পায়েশ খেয়েই ছুটতাম গ্রন্থাগারে। 

বইটা হাতে নিয়েই আরাম পেলাম যেন। আজ বেশ হলো তবে৷ বই শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লাম মনে হয়। প্রকটভাবে শব্দ করে হাসেনা মানুষ? ওইরকম হাসিতে দম বন্ধ বন্ধ ভাব।

গ্রন্থের সুবিশাল মোকাম। চোখ জুড়িয়ে যায়। কোনো শব্দ নেই। পৃষ্ঠা উল্টাবার একটা ছন্দ টের পাওয়া যায়। মধুময়। আমরা পাবলিক গ্রন্থাগারে ঢুকতাম। নির্দিষ্ট একটা জায়গা করে রেখেছিলাম। ওখানে গল্প উপন্যাসের বিশাল সংগ্রহ ছিলো। ভাইয়া তখন উচ্চমার্গের সব বইটই পড়া শুরু করে দিয়েছে। ছফা টফা আবার মাঝে মাঝে বঙ্কিম জীবনানন্দও পড়ছে। এসবে আমার ইন্টারেস্ট ছিলোনা। নাক সিঁটকাতাম। আমার পছন্দ হুমায়ূন আহমেদের বোতল ভূত, ভূত ভুতোং ভুতৌ কিংবা অনিন্দিতার রেগেমেগে ছক্কা অথবা আহসান হাবীবের নয়শো নিরানব্বইটা জোক্স, একটা ফাও। এগুলো খুঁজে খুঁজে পড়তাম। পাবলিক গ্রন্থাগারে শুধু এগুলো পাওয়া যেতো৷ 

নানুবাসা থেকে চলে আসবার আগের দিন দুপুরেও একবার গেলাম আমরা। রোদহীন বৃষ্টি বৃষ্টি দুপুর। ফুরফুরে মেজাজ। আবার কিছুটা মন খারাপও।  আমাদের নির্ধারিত বেঞ্চে বসে খুব খুঁজে একটা বই বের করলাম 'লেবেনডিশ'। লেখকের নাম ঠিক মনে নেই আমার। সবুজ প্রচ্ছদে গবেট ধরণের একটি ছেলে দাঁত বের করে হাসছে। বইটা হাতে নিয়েই আরাম পেলাম যেন। আজ বেশ হলো তবে৷ বই শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লাম মনে হয়। প্রকটভাবে শব্দ করে হাসেনা মানুষ? ওইরকম হাসিতে দম বন্ধ বন্ধ ভাব। আশেপাশের লোকজনকেও দেখা গেলো বিরক্ত হবার বিপরীতে তারা বেশ মজা পাচ্ছে৷ আমিও চলতে থাকলাম। গোলাপের গরুর রচনা পেরিয়ে পৃষ্ঠা উল্টাতেই বেল বাজালো লাইব্রেরিয়ান। চারটা বেজে গেছে। এখনি বন্ধ হবে গ্রন্থাগার। কিন্তু আমার কী হবে? বাকিটুকু কীভাবে পড়া যায়? চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। 

ভাইয়াকে কোনোমতে বের করে দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। মাথায় কুবুদ্ধি খেলা করছে। কুবুদ্ধি হলেও একবার ভাবলাম এটা কোনো দুষ্টচিন্তা না। এ হচ্ছে বই। ঠুস করে বইটি ফতুয়ার নিচে নিয়ে পাজামার ভেতর অর্ধেক গুঁজে ফেললাম। পাতলা ফতুয়া৷ বই বের হয়ে আসতে চাইছে। কী করবো এখন? লাইব্রেরিয়ান লাইট অফ করতে করতে দূর থেকে বলছেন, আঙ্কেল কাল এসো আবার। যাও যাও। নানুভাইয়াকে সালাম বলবে, কেমন? আমি কৃত্রিম হাসি দিয়ে সায় দিতে চাইলাম। নাহ৷ এখানে সময় গেলেই বিপদ। ভীড় কমে গেলে আজ আর রেহাই নেই। হাঁটতে হাঁটতে দরজার একদম কাছাকাছি চলে এসছি। হুট করে কী হলো, পাজামার ভেতর থেকে বইয়ের বেশীরভাগ বেরিয়ে আসলো। বুকে চেপে রাখতে চাইলাম খুব। নাহ। হলোনা। গার্ড দেখে ফেলেছে। হুরহুর করে চলে আসলো কাছে। 

-গুঞ্জি উডাও ম্যা, কী করলা এইডা তুমি? হায় হায়রে। মানিজ্জত সব মাইরা দিলা। তোমার নানা কতো ভালা লোক আছিন। আর নাতিডি!!

অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমার কান্না চলে আসলো। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। লাইব্রেরিয়ান দৌড়ে আসলো। মানুষ ভীড় করলো। সবার একই প্রশ্ন, বাচ্চাটার কী হলো হঠাৎ! মূর্খ দারোয়ানও সবাইকে খুব রসকষ মিশিয়ে ঘটনা শোনাতে থাকলো। লাইব্রেরিয়ান আমার দিকে কৃত্রিমভাবে চোখ গরম করে তাকালেন৷ আমি কান্না থামিয়ে মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। 

-ফোন দিব নানার কাছে? আর করবে এমন? কথা বলো। দিব ফোন? 
আরো কী কী বললেন মনে পড়ছে না৷ এরপর লাইব্রেরিয়ান আঙ্কেল আমার হাত ধরে বাইরে চলে এলেন। জব্বারের মোড় পর্যন্ত আমরা চুপচাপ হাঁটলাম। দুই টাকার কুলফি মালাই আর কাচের বৈয়মে থাকা সন্দেশ কিনে ছেড়ে দিলেন। আর গ্রন্থাগারের সে 'লেবেনডিশ' বইটিও আমাকে গিফট করে দিলেন। মেইনরোড ঘেষে দীর্ঘ খালের পাড় ধরে সন্দেশ খেতে খেতে বাসায় চলে এলাম। ঘরে ঢুকতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি৷ সেদিন মেঘের ভয়ে কোনো কাককেও হয়তো দেখা যায়নি; সে উড়ছে ময়মনসিংহ এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির আধো আধো আলো জড়ানো আকাশে। দেখা যায়নি কোনো শালিক অথবা ডাকে মাধুকরী কোনো ঘুঘুকেও। 


লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই