চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণা, দ্বিধা এবং একটি পলিথিনহীন পথ



খুঁজে পাওয়ার যন্ত্রণা, দ্বিধা এবং একটি পলিথিনহীন পথ

সালমান সাদিক


আমি মানে যে আমিই এমনটা না, এটা এমন একজন মানুষ হতে পারে অবশ্যই, যে নিজের ভেতরে আটকে থাকে আর তাকে কেউ খোলসের বাইরে আনতে পারে না। এর পিছনে একটা কারণ অবশ্য থাকে। আমি মানুষটা যখন কারো সাথে দেখা করি বা কোনো আড্ডায় বসি তখন আড্ডা বা অন্য মানুষটা আলাপী হতেই পারে। কিন্তু তারমানে এই না, যে আমরা দুজনেই আলাপ করবো, কথা বলবো। বরং বেশিরভাগ সময় দেখা যায় অন্যরা আলাপ করে আর আমি সেই আলাপ শুনি। এইসব আলাপের মধ্য দিয়ে আমি জগতটা বুঝার চেষ্টা করি। কারণ এইসব আলাপে তারা নিজেদেরকে খুলে মেলে আমার সামনে তাদের ভিতরটাকে প্রকাশ করে। এই জন্যই হয়ত আমি তাদেরকে যেভাবে দেখতে পাই তারা আমাকে সেভাবে দেখতে পায় না। তাই আমি এমন একজনকে খুঁজি, যে আমাকে খুলবে, আমার ভেতর থেকে টেনে টেনে কথা বের করে আনবে। অথবা শুধু আমাকে দেখবে যেমন আমি অন্যদেরকে দেখি। এই ব্যাপারটা যদি হয় তাহলে কী হবে সেটা আমি জানি না, কখনোই যেহেতু এমনকিছু ঘটেনি আমার জীবনে। তাই আমি অপেক্ষা করি। এটা এমন একটা ব্যাপার যেন আমি বারবার শুনছি, সলিমুল্লাহ নামক ট্রাক ড্রাইভারের কণ্ঠে—যখন সে এক ট্রাক বোঝাই ময়লা নিয়ে নগরের আস্তাকুঁড়ের দিকে যেতে যেতে গাইতে থাকে, যাকে আমি দেখিনি তাকে কেমনে ভালোবাসি, দেখা হলে তারে কেমনে কই আমি তোমারে ভালোবাসি!

এরপর আমি অনেকের সাথেই মিশতে থাকি। এমন অনেক মানুষ, যারা আমার জীবনে আসে হুটহাট আর আমি তাদের গুরুত্ব দেই এই ভেবে, যে এদের মধ্যেই হয়ত আমার না দেখা সেই মানুষটা আছে যাকে আমি ভালোবাসি মনে মনে। এই ভালোবাসাটা স্রেফ এই কারণে না, যে সে আমাকে দেখতে পাবে আর আমাকে বুঝতে চেষ্টা করবে। মানে যখন কেউ আমাকে এতটাই গুরুত্ব দিতে পারবে তখন তাকে আমি ভালোবাসতেই পারি তাই না! 

এখন সময়টা এমন, যে আপনি একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবেন না। মানে অনেককিছুই ঘটতে পারে। আর তা ছাড়া এমন একজন মানুষ যাকে আপনি ভালোভাবে চেনেন না, জানেন না তার সাথে কী এমন কথাই বা আপনি বলতে পারেন। আর সে-ই বা কেন আপনার প্রতি আগ্রহী হবে। এমন অদ্ভুত একটা সময়ে এসে আমি এমন একজনকেই কিনা খুঁজছি, যে আমার আত্মা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে। ব্যাপারটা কিন্তু এক হিসেবে হাস্যকর একটা চিন্তা। আপনি দেখেন, আপনার আশপাশে তো কত বন্ধু-বান্ধব। আপনি তাদেরকে বাদ দিয়ে যদি অপরিচিত কারো জন্য অপেক্ষা করেন, যে কিনা আপনার জীবনে কখনো আসেইনি বা এত এত বছরের ঘনিষ্ঠতা অস্বীকার করে আপনি আপনার আত্মা অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চান তাহলে ব্যাপারটা অবশ্যই ওরা খারাপভাবে দেখতে পারে। কিন্তু যত যাই হোক আমি এটা মনের বেশ গভীরেই লালন করি। কারণ পরিচিতজনেরা তো আপনাকে চেনেই, তারা আপনাকে নতুন করে আর কেন চিনতে চাইবে। অন্যদিকে একজন মানুষ নতুনভাবে আপনাকে জানছে আর এই জানার অনুভূতিটাই বা কী, সেটা কিন্তু একটা আকাঙ্ক্ষার বিষয় হতেই পারে। মানে এইভাবে অন্যের চোখে নিজেকে দেখার মধ্যে একটা অভিনব আনন্দ থাকতে পারে বলেই মনে হয় আর এই জন্যই আমি খুঁজতে থাকি বহু মানুষের ভীড়ে বা নিরব কোনো রাস্তার মোড়ে। 

একজনকে তালাশ করতে গিয়ে আমার জীবনে এমন বহু অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এসেছে যখন চাইলে আমি কারো সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারতাম। অবশ্য আমি নিজেকে তাদের সামনে মেলে ধরতে চাইতাম। কিন্তু দেখা গেছে তারা আসলে আমাকে নিয়ে ভাবেই না। তাই আমি আমার খোলস থেকে মাথাটা বের করার আগেই আবার ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হই। এমনও হয়েছে যে আমি সেইসব অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তে হুট করে হেসে উঠেছি। আর তারপর যখন অপরজনকে দেখি আমার এই হাসির কোনো অর্থই তার কাছে নেই তখন আবারও আমি আগের মতো হয়ে গেছি। আমি নাকি হাসতে পারি না। ব্যাপারটা অনেকেই বলেছে। কিন্তু সত্যি আমি হেসেছি মাঝে মাঝে। কিন্তু সেইসব হাসি এমন সব বিষয়কে কেন্দ্র করেই ছিলো যেগুলোর জন্য হাসি ব্যয় করাটা নিরর্থক। তাই আমি যখন ওইসব অনর্থক হাসির কথা ভাবি তখন নিজেকে খুব গুরুত্বহীন প্রাণী মনে হয়। যেমন ওই ভাঙা দেয়ালটার উপর বসে সিগারেট খেতে খেতে আমরা যখন জীবন বিষয়ক আলাপে ডুব দিতাম আর আমাদের সামনে যে সত্যটা ফুটে উঠতো, যে এই ভাঙা দেয়ালের ওপাশে রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া নারী-পুরুষের যে দল এরা যদি জন্ম না নিতো, এদের যদি কোনোরকম অস্তিত্ব না থাকতো, মানে হলো এই জগতে এদের প্রয়োজনটা কী! আমিও ওইসব নিরর্থক হাসি আর খোলস থেকে মাথা বের করার নিরর্থক মুহূর্তগুলা ভাবি আর এটা ভাবলেই আমার সমগ্র সত্তা জুড়ে শুধু বিষণ্নতার অস্তিত্বই অনুভব করি আমি। 

আরেকটা ব্যাপার আমার মাথায় বদ্ধমূল হয়ে গেছিলো। কেমন করে ব্যাপারটা ঘটলো আমি জানি না। কিন্তু চিন্তাটা খুব কঠিনভাবেই গেড়ে বসেছিলো মাথার ভেতর। আমি আসলে একজন মেয়েকে খুঁজছি। আমি যাকে সবকিছু বলে দিতে চাই তাকে কেন মেয়ে হতে হবে সেটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনি, বুঝে ওঠার চেষ্টাও করিনি। কীভাবে যে এই চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছে তাও আমি জানি না। কিন্তু তারপরেও আমি আমাকে একজন মেয়ের সামনেই মেলে ধরতে চাইছিলাম। ব্যাপারটা কি অদ্ভুত তাই না! আপনি জানেন না আপনি কী চান বা আপনার চাওয়াটা ঠিক কেন, তাও আপনি চান। 

আমি মিশলাম এক এক করে অনেকের সাথেই। মানে আমি যখন চাইছি বা একজন মেয়েকে খুঁজছি তখন আমি হুটহাট এমন এমন মেয়ের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম যারা আমার প্রতি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আগ্রহ ধরে রাখতো। আবার ব্যাপারটা হয়তো এমন, যে আমি চাইতাম ওরা আমার প্রতি দিনদিন আগ্রহের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে আর আমাকে নিয়েই তারা রাতদিন ভাববে। কেমন অযৌক্তিক এই চিন্তাটা, আপনি একবার ভাবুন। একজন মানুষ কেন নিজের চাইতে এইভাবে আমাকে নিয়ে পড়ে থাকবে! আমি কে, কী এমন আছে আমার বা তাকে আমি এমন কী-ই বা দিয়েছি যার জন্য সে আমার প্রতি এতটা আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে! আর সে জন্যই আমি যখন সদ্য পরিচিত মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতাম, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তোমার অনুভূতি কী? কীভাবে দেখো তুমি এই আমাদের, মানে এই যে এই ব্যাপারগুলা? তখন সে আমাকে যেসব উত্তর দিতো তাতে আমি হতাশ হয়ে পড়তাম আর যে আশা নিয়ে আমি তার প্রতি আগ্রহী হচ্ছিলাম তা হুট করেই ভেঙে যেতো আর আমি আস্তে আস্তে সরে আসতাম। এমন না যে সে ভুল কিছু বলেছে। আসলে আমি তাকে কত বড় করে কত ভাবে ব্যাখ্যা করে প্রশ্নটা করি। আর তার উত্তরে সে কি না বলবে, ভালো! বা শুধু একটা শ্রাগ! আশ্চর্য, আমি কি না আমার এতগুলা সময় এই শ্রাগ দেখার জন্যই ব্যয় করেছি! তারপর নিজের প্রতি মন বিষিয়ে উঠতে থাকে আর আমি তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করি। আসলে কি, আমি ছিন্ন করি না তারাই আমার সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আমি অবশ্য ভেবে পাই না, কেন এমন হয়। মানে প্রত্যেকবারই এমন একটা না একটা ঘটনা ঘটবেই, যা আমাকে একদম রিক্ত আর নিঃস্ব করে দিয়ে যায়। তখন অবশ্য এই ব্যাপারটাও কাজ করে, যে আমি খুবই বিরক্তিকর আর একঘেয়ে ধরনের একজন মানুষ। 

একটা ব্যাপার কাজ করে আমার ভিতর যেটাকে আমি আমার এই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে দেখি। আসলে সামগ্রিকভাবে আমি পুরা মানুষটাই একটা আস্ত ব্যর্থতা। কিন্তু এইসব ছোট খাটো কারণকে সামনে এনে নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে চাই। নিজেকে বলি, আরে এই ব্যাপারটা দূর করতে পারলেই তুই পারবি, তোর তো সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু আদপে কোনোকিছুরই তো ঠিক নাই। ব্যাপারটা এই জন্য ঠিক না যে আমি একজন মেয়েকে খুঁজছি আর তাকে আমি কিছুতেই পাচ্ছি না। আসলে আমি এমন কিছু খুঁজছি যা আসলে খোঁজার মতো জিনিসই না, মানে এই জিনিসটা আসলে পাওয়া সম্ভবই না। আমি যখন কারো সাথে দেখা করি তখন আমি কোনোকিছুই ঠিকঠাক মতো করতে পারি না। যেমন আমি একজন মেয়ের সাথে দেখা করেছিলাম। সেই মেয়েটা ছিলো খুবই প্রাণবন্ত চঞ্চল একটা মেয়ে। যে কেউ-ই এমন মেয়ের সংস্পর্শে আসলে সজীব হয়ে উঠতে বাধ্য। তার প্রাণ চাঞ্চল্যের ছোয়ায় হয়ত জড়পদার্থও লাফিয়ে উঠবে। সে হাঁটছিলো এমন করে যেন একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। আপনি প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখেছেন। কীভাবে ওরা ওড়ে জানেন? ওরা ঠিক পাখির মতো এক ধারায় উড়তে পারে না। মনে হয়, ওরা যেন একেক মুহূর্তে হাওয়ার একেকটা স্তর স্পর্শ করে চলে। এই ব্যাপারটাই ছিলো ওই মেয়েটার মধ্যে। ও এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিলো। আর ওর যে ওড়নাটা, যেটা সে ওইদিন পরে এসেছিলো সুন্দর একটা নীল পোশাকের সাথে; ওর হাঁটার সাথে সাথে সেটা বাতাসে উড়ছিলো, যেন ওর ওড়নাটা দুইটা ডানা আর ডানা দুইটা দিয়ে সে হাওয়ার মধ্যে, মানে যেখানে কোনোকিছুই নাই সেখানে সে অস্তিত্বের চিহ্ন আঁকছিলো ওর পায়ের স্পর্শ, ওর দেহের ভার রেখে রেখে বা ওর সমগ্র অস্তিত্বটাই আসলে আশপাশকে অস্তিত্ব দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো। এত সুন্দর একটা মেয়ে, যে কিনা আমাকে বলছিলো বিভিন্ন কথা আর ওর স্বপ্নগুলা; সবকিছুই যেন সে আমাকে বলতে চাইছিলো। আমি সবকিছু শুনছিলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। আমার যে কিছু বলা উচিত বা তার কথার উত্তরে আমারও যে সাড়া দিয়ে নিজের কথা কিছু বলা দরকার সেটা আমি ভুলেই গেছিলাম। আমি শুধুই শুনছিলাম। আমরা সারাদিন ঘুরলাম, গল্প করলাম। তারপর ঠিক সন্ধ্যে বেলায় ওর বাসায় যাওয়ার আগে আমরা এক রেস্তোরাঁয় খাবো বলে ঢুকলাম। ব্যাপারটা এমন না, যে ও চাচ্ছিলো আমরা কিছু খাই। কিন্তু এইরকম একটা আড্ডার পরে ও খালি মুখে বাসায় ফিরবে আমি এটা চাচ্ছিলাম না। আমি ওকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেছিলাম হয়ত। এখন আর এই বিষয়টা প্রাসঙ্গিক না। মূল যে ব্যাপারটা ঘটলো, খাওয়ার পর আমি বিল দিতে যাবো তখন ও টাকা বের করলো। ভাবলাম, ও যখন দিতে চাইছে তখন না করা উচিত হবে না। সেক্ষেত্রে ও হয়তো কষ্টও পেতে পারে। তাই আমি ওকে বিলটা দিতে দিলাম। 

এরপর মেয়েটা কেমন যেন দূরে সরে যেতে লাগল আমার কাছ থেকে। আগের মতো আর কথা বলে না। আর দেখাও করতে চাচ্ছিলো না সে। আমি তখন খুব মুষড়ে পড়েছিলাম। কারণ আমি মনে মনে ইরাদা করছিলাম সেই সময়ে, যে পরেরবার দেখা হলে ওকে আমি সবকিছু বলব। আমার দুঃখের কথা, আমার স্বপ্নের কথা; সবকিছুই তাকে খুলে বলব। আমি ভেবেছিলাম, যে মেয়ে এতটা উদার হতে পারে, মানে খাওয়ার বিলটা যে মেয়ে দিতে পারে সে অবশ্যই আমার কথাগুলা গুরুত্ব দিয়ে শুনবে। আমি যদি তাকে ব্যাখ্যা করে বলি, যে আমি হতে চেয়েছিলাম একজন লেখক। আমি এমনকিছু গল্পের প্লট আর দৃশ্য নিয়ে কাজ করেছি যেসব দৃশ্যে বাতাসে একটা পলিথিন কত সুন্দরভাবে উড়তে পারে তা-ই দেখাতে চেয়েছি আমি। সে হয়ত বুঝবে যে একটা পলিথিন, যেটা তৈরি হয় কারখানায় বিষাক্ত সব উপাদান দিয়ে সেটার ভিতরেও লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য। সে কেন বুঝবে বা আমার কেন মনে হলো সে বুঝবে সেটা অবশ্য আরেক গল্প। আমি যেহেতু সবকিছুই ভেঙে ভেঙে বলতে চাইছি তাই এই ব্যাপারটাও বুঝিয়ে বলি। 

আমার যখন পড়াশোনা শেষ হলো তখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম একটা চাকরির জন্য। কারণ নিজের খরচ তো বটেই, বাপ-মা ভাই-বোনদের খরচটাও আমাকে চালানোর জন্যই ওরা চাপ দিচ্ছিলো বারবার। যেহেতু আমাকে এতগুলা বছর তারা পড়িয়েছে, আমাকে মানুষ করেছে তাই এটা তাদের হক, তারা এটা চাইবেই। তাছাড়া এটা তো আমার কর্তব্যও বটে। তাই আমি চাকরি খুঁজছিলাম। কিন্তু বয়সে তরুণ আর কোনোরকম কাজই আমি পারি না, তাছাড়া আমার মধ্যে কিছু কল্পনা আর দৃশ্য ছাড়া এমনকিছুই ছিলো না, যা দেখিয়ে আমি একটা কাজ পেতে পারি। তাই শেষ পর্যন্ত আমি রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটা নিতেই বাধ্য হই। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটা পেতে আমাকে যেতে হয়েছিলো নগর ভবনে আর নগর ভবনের ঠিকানাটা দিয়েছিলো যে মেয়েটা ওর নাম জয়া। জয়ার সাথে পরিচয় হয় ওর বাবার অফিসে। ওর বাবার অফিসে আমি গিয়েছিলাম পিয়ন-পদে ইন্টারভিউ দিতে। তখন আমার এই দৃশ্যগুলার কথা আমি ওদের বলেছিলাম। ওই ইন্টারভিউতে জয়া-ও উপস্থিত ছিলো। চাকরিটা হয়নি আমার। কারণ একজন পিয়নের কাজ নাকি মনোযোগ সহকারে চা বানানো। কিন্তু কল্পনাপ্রবণ একজন মানুষ নাকি কখনোই ভালো চা বানাতে পারে না। এই কারণ দেখিয়েই ওরা আমাকে বিদায় করেছিলো। সেই দুপুরবেলায় আমি অফিস থেকে বের হয়ে ফুটপাতে বসে বিড়ি ধরিয়েছি। এমন সময় জয়া আসলো। আসলে ও আসছিলো বলে আমিই ভেবেছি। পরবর্তীতে আমি ভেবে দেখেছি, আসলে ও ঠিক আমার জন্য আসেনি। হয়ত সে এই পথে যাচ্ছিলো এবং আমাকে দেখে হয়ত তার ভিতরে একটু মায়া বা যাই হোক, যে কোনো কারণেই হোক সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

সে বলল, আচ্ছা আপনি এই দৃশ্যগুলা কীভাবে পেলেন? 

বললাম, একদিন রাস্তায় বের হয়েছি সকালে। দেখি রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে একটা লোক। তো এই সময়ে বাতাসে একটা পলিথিন উড়তে থাকে আর লোকটা ঝাড়ু দেওয়া থামিয়ে সেই পলিথিনটা দেখতে থাকে। আর একটা কুকুর ওই পলিথিনটা ধরার জন্য বারবার লাফ দিতে থাকে। তখন মনে হইছিলো, এই পলিথিনটাই আসলে মূল। সেই থেকেই আমি বিভিন্ন মানুষ বা প্রাণী এই পলিথিনটাকে কীভাবে দেখে বা এটাকে পাওয়ার জন্য সে কীভাবে কী করে সেটাই বুঝার চেষ্টা করছি। আর এইভাবেই এই দৃশ্যগুলা আমার মাথায় এক এক করে জমা হয়েছে।

সে বলল, শুনুন আমাদের অফিসে একজন ঝাড়ুদার নিয়োগ দিবে আগামী মাসে। এর আগে আপনি এক কাজ করেন। আপনি সিটি করপোরেশনের হয়ে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটা নিয়ে নিন। তাহলে এই অভিজ্ঞতা দেখিয়ে অনায়াসে আমাদের অফিসে জয়েন করতে পারবেন। 

বললাম, আপনাদের অফিসে জয়েন করে কী লাভ? আপনে এত আগ্রহ দেখাচ্ছেন যে আপনারই বা কী লাভ এইখানে?

সে বলল, আরে আপনি যদি ঝাড়ুদারের কাজটা নেন তাইলে আমি যখন ইচ্ছা আপনার এই দৃশ্যগুলা সম্পর্কে জানতে পারবো। আপনার কাছ থেকে গল্প শুনতে পারবো। কী, গল্প শুনাতে পারেন তো নাকি?

আমি তখন গদগদ হয়ে বললাম, তাইলে আমি আপাতত ঝাড়ুদারের কাজটাতেই মনোযোগ দেই। কাজ টাজ বিষয় না, আপনারে গল্প শুনাতে পারবো এই জন্য হলেও কাজটা নেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করবো। 

তাই পরিবারের জন্য বা পড়ালেখা শেষ বলেই যে আমি চাকরির জন্য দৌড়ঝাপ করছিলাম সেটা মূল কারণ ছিলো না। নাহয় কখনোই ঝাড়ুদারের কাজটা আমার নেওয়া হতো না। সত্যি বলতে আমার ভিতর ওই মুহূর্তটাতেই গেঁথে গেছিলো এই একটা কথাই, যে ঝাড়ুদারের থেকে ভালো কোনো কাজ এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই। 

ওরা কিন্তু শুরুতে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো। আমার মতো একটা মানুষ ঝাড়ুদারের কাজ করছে মানে হলো ওদেরই কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের নিশ্চিত একটা কাজ হারানো। কারণ একজন শিক্ষিত লোক কখনোই রিক্সা চালাতে পারে না। মানে এমনটাই তো আমরা ভাবি। কিন্তু যদি আমার মতো বেকার লোকেরা এই কাজগুলা নিতে থাকে তাহলে আগে থেকে যারা এই কাজটা করে আসছে তারা ব্যাপারটা কোনোভাবেই মানতে পারবে না। কারণ ওরা তো চাইলেই আর আমাদের মতো বড় কোনো চাকরি পাবে না, এই সম্ভাবনাও নাই। কিন্তু যেহেতু আমাদের জন্য সুযোগ আছে তাই ওদের ভাত মেরে দিলে ওরা রাগ করতেই পারে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই কাজটা শুরু হয় ভোরে। যখন বুড়োরাও হাঁটতে বের হয় না আর কুকুরেরাও জেগে থাকে না ঠিক তখনই আমরা ওই বড় বড় ঝাড়ুগুলা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। কখনো ট্রাকের পিছনে করে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে জমা করে রাখা ময়লার স্তূপ সাফ করতে। কাজটার একটা উপভোগ্য দিক হচ্ছে, কেউ আপনার দিকে তাকাবে না আর আপনি কাজ করতে করতেই ইচ্ছে মতো বিড়ি খেতে পারবেন। 

রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজটা এতটাই আনন্দের আর এতটাই অর্থবহ একটা কাজ, যে আমাকে এই কাজটা রীতিমতো নেশাগ্রস্ত করে ফেলে। আমি এরপর কখনো দুপুরে বা বিকেলে বের হলে রাস্তাগুলো দিয়ে যখন হাঁটতে থাকি তখন মনে মনে এইসব রাস্তাগুলোই আমি ঝাড়ু দিতে দিতে যাই। ঝাড়ু দেওয়ার কাজটা যে কতটা আনন্দের সেটা আমি একজনকে দেখে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করি। আমাদের বাসার বাড়িওয়ালার মেয়ে—আমরা তাকে লিপি আন্টি বলে ডাকি। লিপি আন্টি প্রতিদিন নিয়ম করে তিনবেলা সিড়ি ঝাড়ু দেয়। পুরো চারতলা বাসার সিড়ি সে একলাই ঝাড়ু দেয়, তাও আবার তিনবেলা। ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হতো আর ভাবতাম চল্লিশোর্ধ্ব একজন রমণীর বিয়ে না হওয়ায় মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে গেছে বলেই এমনটা করে। কিন্তু আমি নিজে যখন রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া শুরু করলাম তখন বুঝতে পারলাম এটা আসলে একটা নেশা। মানে সবকিছু পরিষ্কার করে রাখাটাও একটা আনন্দের ব্যাপার।

ব্যাপারটা আসলে এমন যে একটা পলিথিন বাতাসে উড়ছে। এই ব্যাপারটা আমি দেখছি আর দেখছি একটা কুকুর আর একটা মানুষকে। মানুষটা একজন ঝাড়ুদার, সে ঝাড়ু দেওয়া বাদ দিয়ে পলিথিনটা দেখছে আর কুকুরটা সেই পলিথিনটা ধরার জন্য লাফালাফি করছে। তো এই যে পলিথিনটা এটা হলো মূল বিষয়। মানে এই পলিথিনটা যদি একটা মহাসড়কে উড়ে তাহলে প্রত্যেকটা গাড়ি যখন ছুটে যাবে তখন এটা আরো উড়বে বাতাসের ধাক্কা খেয়ে আর পিছনের গাড়িটা নিজ গন্তব্যে যেতে যেত তাকে আরেকটু উড়াবে। এই যে পলিথিনটার চারপাশে গাড়িগুলার ছোটাছুটি এখানে কিন্তু পলিথিন ধরার প্রতিযোগিতা নেই। বরং এই সকল ছুটোছুটি পলিথিনটাকে আরো বেশিক্ষণ শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা?

আমার তো মূল উদ্দেশ্য ছিলো ওই অফিসটায় ঝাড়ুদারের কাজ নেওয়া। কিন্তু দিন যেতে থাকে আর ওই কাজের আশাটা আস্তে আস্তে নিভে যেতে থাকে। এর মধ্যেই একদিন জয়ার ফোন পাই। জয়া আমাকে ডাকছিলো বা বলা যায় ফোন পেয়ে আমিই জয়াকে ডেকেছিলাম। জয়া ডাকছিলো আসলে মনে মনে। মানে আমি যেন ওকে ডাকি সে জন্যই হয়ত ও ফোন করেছিলো। ব্যাপারটা অবশ্য আরো অনেকভাবেই ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু এভাবে ব্যাখ্যা করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে, একজন আমার দৃশ্যগুলা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছে এরচেয়ে আনন্দের বিষয় আর কিছু হতে পারে; এইটা সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়নি, এখনো মনে হয় না। জয়া ফোন করেছিলো সকালে। আমি রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে তখন রতনের ফ্লাক্সে করে আনা চা খাচ্ছিলাম বনরুটি দিয়ে। ওর ফোন পেয়ে চায়ের বিল না দিয়ে, চা বনরুটি সব ফেলে রেখে আমি ছুটলাম বাসার দিকে। ভালো করে গোসল করলাম, অন্তত চারবার পুরো শরীর সাবান দিয়ে ডললাম আমি। তারপর সবথেকে ভালো যে কাপড়টা, মানে ওই প্যান্টটা যেটা আমি প্রায় তিন বছর আগে কিনেছিলাম আর সবচেয়ে কম দাগ লাগা পাঞ্জাবিটা; এগুলো গায়ে চড়িয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম। 

আমি এসে বসলাম একটা বহুতল ভবনের নিচে। ভবনের পাশে আমি ওর জন্য একটা পুরোনো সোফা এনে রেখেছিলাম সকালে। এই সোফাটা পড়েছিলো ময়লার একটা স্তূপের সাথে। এটাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতাম হয়তো। কিন্তু ও যখন বলল, যে ও আসবে তখন আমি আমার বন্ধু সলিমুল্লাহর সাহায্যে সোফাটা এখানে এনে রেখেছি। সলিমুল্লাহ শুধু একজন বন্ধুই না, ও একজন ট্রাক ড্রাইভারও বটে। আর সে জন্যই ওর সাহায্য নিতে হয়েছিলো আমার। এই সোফাটা ছিলো খুবই মলিন আর এর একটা পায়া ভেঙে গিয়েছিলো। কভারটা ছিড়ে গেছিলো হয়ত অনেক আগেই। ফোমগুলোও এখানে সেখানে বেরিয়ে ছিলো। মোটকথা এই সোফাটা আমি জয়ার জন্যই এখানে এনে রেখেছিলাম। আর ও এখানে বসবে বলে আমি নিয়ে এসেছিলাম আমার সবচেয়ে প্রিয় লেপের কভারটা, যেটা অল্প অল্প শীত পড়লে আমার কাঁথার কাজে দিতো। এর দুইটা পাশ, এক পাশে সাদার উপরে প্রিন্টের ছাপা ফুলের ডিজাইন, যেটা আবার বহুল ব্যবহার আর মশারি ছাড়া ঘুমানোর ফলে পিষ্ট হওয়া মশা আর রক্তের দাগে ছিলো ভরপুর। আর এর অন্য পাশটা ছিলো টকটকে লাল। আমি এই লাল পাশটাই সুন্দর করে ওর জন্য বিছিয়ে দিয়েছিলাম সোফার উপরে। 

আমি ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম প্রায় আধঘন্টা ধরে। আর যতই সময় যাচ্ছিলো ততই মনে হচ্ছিলো একজন ঝাড়ুদারের সাথে কি সত্যিই জয়া দেখা করতে আসবে নাকি এটা স্রেফ তরুণী মনের একটা রসিকতা মাত্র। আমি দ্বিধা নিয়েও ওর জন্য বসেছিলাম। তবে এই দ্বিধাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি। কারণ, কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম জয়া আসছে। দূর থেকে ওকে দেখেই আমি চিনে ফেলেছিলাম। চকলেট রঙের মেয়েটা পরেছিলো একটা কালো পোশাক। এই পোশাকে ওকে সত্যিই অপ্সরীর মতোই লাগছিলো আমার কাছে। উপমাটা বড্ড সেকেলে হয়ে গেলো হয়ত। কিন্তু সত্যি বলতে আমি এতকিছু বুঝি না। ওকে সুন্দর লাগছিলো এটাই সত্যি। 

ও আসতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। রোদের মধ্যে এতদূর আসায় ওর কপালে ঘামের কয়েকটা বিন্দু চিকচিক করছিলো। আমি ওকে সোফাটা দেখিয়ে বললাম, এইটাই সেই সোফা যেটা শুধু আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ও হেসে উঠলো। বিশ্বাস করেন সেই হাসির মধ্যে আদিকালের কবিতায় ব্যবহৃত সমস্ত উপমার সত্য সত্য রূপ প্রতিভাত হয়ে উঠলো। 

 ও বলল, এখনই বসবেন?

 বললাম, আপনি যা চাইবেন তাই করা যায়। তবে বসলে গল্পটা বলতে সুবিধা হয়। 

 যদি না বসি তাহলে আর কী কী অপশন আছে সেইটা বলেন।

অপশনের তো অভাব নাই। চাইলে হাঁটতে পারি। আপনি চাইলে পাশের পার্কটায় গিয়েও বসতে পারি। আর না হইলে কোনো রেস্তোরাঁয় ঢোকা যায়। 

চলেন কিছুক্ষণ হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে ভাবা যাবে সবগুলা নিয়ে। কিন্তু আগেই বলি পার্কে বসা যাবে না। পার্ক আমার ভাল্লাগে না। মানে পার্কে আছেটা কী, কয়েকটা গাছ আর কিছু বেঞ্চ বাদে!

তাইলে চলেন হাঁটতে থাকি।

আমরা চুপচাপ কিছুক্ষণ হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি জয়ার চুলের ঘ্রাণ পেলাম। হয়ত শ্যাম্পু করেছে বা কিছু মেখেছে। যাইহোক ঘ্রাণটা তীব্র ছিলো আর এটা আমার মধ্যে এক ধরনের মাতোয়ারা ভাব সৃষ্টি করছিলো। এরও পরে যখন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হলো আর ও সোফাটায় বসতে চাইলো তখন আমরা সোফাটার কাছে ফিরে এলাম আর ওকে বললাম, আপনি চুলে কী মেখেছেন বলেন তো!

কেন কী মাখব! মেয়েরা যা মাখে তা-ই মেখেছি। 

ব্যাপারটা আমারে তীব্রভাবে আকর্ষণ করতেছে, মানে টানতেছে আমারে। এই মুহূর্তে আপনি চাইলে আমারে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবেন আমি না করার শক্তিই পাবো না।

আপনার সমস্যাটা কী বলেন তো! চুলে কী মাখলাম না মাখলাম এতেই এত ফালাফালি শুরু করে দিলেন। ধুশ পুরুষ মানুষের স্বভাবটাই খারাপ।

হেহ হে ব্যাপারটা এইভাবে দেখলে এক তরফা হয়ে যায় না! দেখেন মৌমাছি ফুলের উপর বসে কারণ ফুলে মধু আছে। এখন দোষটা কার, মৌমাছির না কি ফুলের?

আপনার আজগুবি দৃশ্যগুলারই আসলে দোষ বুঝলেন। 

হেহ হে তা তো অবশ্যই। সেই দোষেই তো আজ পথে পথে ঘুরে বেড়াই আর রাস্তা ঝাড়ু দেই। 

আচ্ছা!

দৃশ্যগুলার জন্যই তো আসছেন, আমি তাইলে দৃশ্যগুলা নিয়ে কিছু বলি। 

হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই বলতে চাইছিলাম। আপনার এই দৃশ্যগুলা আসলে কী বলেন তো, মানে কেমনে এই দৃশ্যগুলা আপনি তৈরি করেন?

ব্যাপারটা আসলে এমন যে একটা পলিথিন বাতাসে উড়ছে। এই ব্যাপারটা আমি দেখছি আর দেখছি একটা কুকুর আর একটা মানুষকে। মানুষটা একজন ঝাড়ুদার, সে ঝাড়ু দেওয়া বাদ দিয়ে পলিথিনটা দেখছে আর কুকুরটা সেই পলিথিনটা ধরার জন্য লাফালাফি করছে। তো এই যে পলিথিনটা এটা হলো মূল বিষয়। মানে এই পলিথিনটা যদি একটা মহাসড়কে উড়ে তাহলে প্রত্যেকটা গাড়ি যখন ছুটে যাবে তখন এটা আরো উড়বে বাতাসের ধাক্কা খেয়ে আর পিছনের গাড়িটা নিজ গন্তব্যে যেতে যেত তাকে আরেকটু উড়াবে। এই যে পলিথিনটার চারপাশে গাড়িগুলার ছোটাছুটি এখানে কিন্তু পলিথিন ধরার প্রতিযোগিতা নেই। বরং এই সকল ছুটোছুটি পলিথিনটাকে আরো বেশিক্ষণ শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা?

খুবই একঘেয়ে হয়ে গেলো না ব্যাপারটা! মানে একটা পলিথিনের কী হলো না হলো সেইটা নিয়ে এত মাথা ব্যথার কী আছে! এমন বিরক্তিকর একটা ব্যাপারকে আপনি কিনা আপনার সম্বল বানিয়ে নিছেন। 

হেহ হে এই বিরক্তিকর আর একঘেয়ে ব্যাপারগুলাই কিন্তু আমাদের জীবন। আপনি দেখেন একজন গল্পকার, সে কিন্তু মূলত মানুষের জীবনটা নিয়েই লেখে। তারে প্রতিনিয়ত এই একঘেয়ে জীবনকে নিয়েই ভাবতে হয়। ধরেন কথার কথা হুমায়ুন আহমেদ ভাবলো, একজন প্রেমিক বিচ্ছেদের পর একদম ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর তার প্রেমিকা তার কাছে ফিরে আসতে চাইলো। কিন্তু সেই ভবঘুরে প্রেমিক হারিয়ে গেলো, তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। তাইলে এই যে একটা থিম এইখানে আকর্ষণ করার মতো কিছু কি আছে বলেন?

হ্যাঁ এইবার বুঝতে পারতিছি কিছুটা। 

এই ছোট্ট ব্যাপারটা নিয়েই মনে করেন লিখে ফেলা হলো একটা আস্ত উপন্যাস। সেই উপন্যাস সাহিত্যের বিচারে কালজয়ী হয়ে গেলো। কিন্তু দেখেন এই পুরা ব্যাপারটার পিছনে আহামরি কোনো দৃশ্য বা থিম কিছুই নেই। একঘেয়ে জীবনটারে এরা এত সুন্দর করে বলতে পারে বলেই অনেকে মনে করে জীবনটা খুব সুন্দর। এই যে রঙ লাগানোর ব্যাপারটা এইটাই হলো আর্ট। 

আর্টের বিশ্লেষণ করে ফেললেন হ্যাঁ! আপনি খুব সুন্দর করে গুছায়ে ফেলতে পারেন জিনিসগুলা। আপনার উচিত গল্প লেখা। আপনি কি ভাবতেছেন, এই দৃশ্যগুলা নিয়ে গল্প টল্প কিছু লিখবেন?

হেহ হে দেখা যাক কী হয়। আসলে এইটাই আমার সম্বল বুঝলেন। আর আপনারেই শুধু এই কথাগুলা বললাম। আমি এইভাবে আর কাউরে এসব বলিনি কখনো। আপনি কথাগুলা আমার ভেতর থেকে টেনে টেনে বের করে আনছেন।

হা হা আমি টেনে বের করলাম কই! আপনিই না বললেন। আমি কারো থেকে কথা বের করতে পারি না। কথা একটু বেশি বলি ঠিক আছে। কিন্তু ওই ক্ষমতা আমার নাই।

হেহ হে ওই যে বললাম ফুল আর মৌমাছি। মানে মধু মৌমাছিরে টেনে আনবেই। এইটাই তার ক্ষমতা। 

তর্ক আমরা অনেক করেছি। যেমন আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা জিনিসটা আসলে কী? জয়ার কাছে আত্মনিয়ন্ত্রণ মূলত কোনো সংকল্পে স্থির থাকা। ব্যাপারটা সে খুব সরল ভাষায় আমাকে বুঝিয়ে বলছিলো, যখন আমরা খুব চেনা এক পথে রিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। ওই সময়ে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিলো আর আমরা পেছনে ফেলে রেখে এসেছি পুরোনো ভাঙাচোরা ওই সোফাটা, যেটা তখন ভিজে ভিজে আরো নরম হচ্ছিলো আর ভারি হয়ে যাচ্ছিলো। জয়া ব্যাপারটা অনেকটা স্বপ্নপূরণের সংকল্পের মত করেই ব্যাখ্যা করছিলো। সে যখন বলল, আপনি কি আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? আমি তখন ব্যাপারটা বুঝিনি। আমি বুঝেছিলাম, ওর হাত না ধরা বা এরকম কিছু যেটা আমার খুবই ইচ্ছে করছিলো সেই মুহূর্তে। কিন্তু জয়া আমাকে বলল, ব্যাপারটা আসলে এমন। তুমি কোনোকিছু করার ইচ্ছা করলা আর সেইটা করবা বলে তার উপর অটল থাকলা। এইটাই বুঝাইতে চাইছি। আমি তখন বলতে চাইছিলাম, এটারে তো সংকল্প বলে। কিন্তু কী ভেবে আর বলিনি কথাটা। আসলে এই যে ব্যাখ্যাটা জয়া আমাকে করছিলো ওর হাত দুইটা নেড়ে নেড়ে আর কথা বলার একাগ্রতায় মাথাটা এদিক ওদিক দুলছিলো—এই দুলুনিটা রিক্সার ঝাকুনিতেও হতে পারে—সেইসাথে ওর এই ব্যাখ্যা করার সময়ে সবকিছু ভুলে গিয়ে তুমি তুমি করা বা ওর চুল যে বাতাসে উড়তে উড়তে আমার দিকে এগিয়ে আসছিলো এ সবকিছুই ও টের পাচ্ছিলো না। আর ঠিক এই ব্যাপারটা, ওর এই আত্মভোলা মনটা আমি তখন আবিষ্কার করে ফেলি। আর এই আবিষ্কারের পুরো সুযোগটা এসেছিলো ওই আত্মনিয়ন্ত্রণের সংজ্ঞা থেকে। তাই এই সুন্দর আবিষ্কারকে আমি উপভোগ করতে চাইছিলাম। তর্ক করার এক মজা, যেটা আমরা করেছি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বা কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার সময়গুলা এক আর এই নিরব আবিষ্কার একদম ভিন্ন এক জিনিস। 

তারপর সে বলছিলো অনেক অনেক কথা। কিন্তু কথাগুলো ছিলো একটা সুরের সুতায় বাধা মোহের মতো। এই মোহ একটা ঘোরলাগা অপার্থিব কাহিনি, যেখানে সময়গুলা চলে যায় এমনভাবেই, যে সেই সময়গুলারে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এরপর যখন বাতাস বইছিলো আর একটা মিষ্টি গন্ধ, সেইসাথে কিছু মিহি রেশমি সুতা যা একদিক থেকে উড়ে আরেকদিকে যাওয়ার পথে কখনো গাল ছুয়ে নিজস্ব অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিলো, আমি তখন সেই কথা-বাতাস-ঘ্রাণ আর বিভিন্ন জিনিসের সমণ্বয়ে যে একটা সময়ে ঢুকে যাচ্ছিলাম তা এক চেনা পথে অচেনা পৃথিবী আবিষ্কারের মতোই। আমি জানি না। কিন্তু এই নতুন জগতটায় ভার বলে কিছু নেই মনে হয় আর এখনে নেই কোনো তাড়া।

আমি যখন এই ভাবালুতায় আচ্ছন্ন আর ওর কথাগুলা, যেসব কথার মাধ্যমে তখনো সে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো অন্য কোনো অদ্ভুত বিষয় বা খাপছাড়া কোনো স্বপ্নের মতো, যে স্বপ্ন ওর মধ্যে বাসা বেধেছে বহুকাল আর আমার দৃশ্যগুলার মতোই তা মূল্যবান বা জীবনের মতো। কিন্তু আমি তখন সবকিছু বিস্মৃত হয়ে অদ্ভুত এক ঘোরলাগা পরাবাস্তব অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আশপাশে অপসৃয়মান দৃশ্যাবলীর দিকে, যেসব দৃশ্যে আমি কোনো পলিথিন উড়তে দেখিনি। আমার পুরো জীবনের সম্বল এই কয়েকটা দৃশ্য আর আমি সবখানে পলিথিন উড়তে দেখা একজন মানুষ, অথচ এই সময়ের দৃশ্যকল্পে একটা পলিথিনও ছিলো না। 

পরদিন ভোরে ভেজা সোফাটা ট্রাকে তুলে আমি আর সলিমুল্লাহ যখন ময়লার মোড়ে আমাদের পলিথিন আর প্লাস্টিকের বোতল তালাশের স্থান, অর্থাৎ নগরের বর্জ্য যেখানে ফেলা হয় সেই জায়গাটার দিকে যাচ্ছিলাম তখন সলিমুল্লাহকে বললাম, ভাই এইটা কি হইতে পারে, মানে তুমি সবকিছু চিনো, অথচ সেই সবকিছু পাল্টায়ে গেলো কোনোরকম সতর্কবার্তা বা আলামত সরবরাহ না করেই! এমন হয় কেমনে! 

সলিমুল্লাহ তখন তার ফোনের সাথে ব্লুটুথ সাউন্ডবক্সে য়াযিদ ফাহাদের গান ছেড়ে দিয়ে সস্তা বিড়ি টানছিলো আর এক হাতে ধরে ছিলো স্টিয়ারিং হুইল। য়াযিদ ফাহাদকে আমি চিনি না। নামটা ওই আমাকে বলেছিলো। যখন আমি ওকে বলেছিলাম ওই প্রজাপতির মতো হাঁটা মেয়েটার ব্যাপারে। যে মেয়েটা আকাশ বাতাস আর ফুলের উপমায় প্রেমের কোনো দিকই খুঁজে পায় না। এমনকি আমি যখন সেই মেয়েকে বলেছিলাম এমন এক কথা যার অর্থ সে বুঝেনি তথাপি আমাকে বলেছিলো, আমি বুঝিনি আগামাথা কিছুই। কিন্তু আপনি যেটা বলছেন সেইটা সুন্দর। মানে একটা অর্থহীন ব্যাপারকেও সুন্দর বলে স্বীকার করে নিতে তার কোনো অসুবিধা ছিলো না। 

আমি সলিমুল্লাহকে এটাই বুঝাতে চাচ্ছিলাম। একজন মেয়ে, যে আমার কথা সবটাই বুঝলো অথচ সে বলতে পারলো না, ব্যাপারটা সুন্দর নাকি অসুন্দর আর একজন মেয়ে, যে কিছুই বুঝলো না, তাও ব্যাপারটারে সে সুন্দর বলতে রাজি আছে; দুজনের মধ্যে কার কাছে আমার দৃশ্যগুলো নিবেদন করা উচিত। কিন্তু সলিমুল্লাহ আমার কথার কোনো জবাব দিচ্ছিলো না আর একমনে গুনগুনিয়ে সে গেয়ে যাচ্ছিলো এক সংশয়পূর্ণ গানের কলি, যে গানে গায়ক সংশয়ের আশ্রয় নেয় শুধুমাত্র নিজের ভাগ্যে পূর্ণ দখল নেওয়ার জন্য। গানের কলিগুলো ছিলো পরস্পর বিরোধী আর সংশয়ে পরিপূর্ণ। সে গাইছিলো, হাল আনাল ওহিদ মান দল্লাত তরিক, আম আন্নানিল ওহিদ মান ওযাদাহ!

আমি নিজের লাভ ক্ষতির হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। আমি কি সঠিক মানুষটার কাছেই আমাকে মানে আমার দৃশ্যগুলারে তুলে দিয়েছি না কি আমার অপেক্ষা করা উচিত ছিলো এক অবুঝ মেয়ের জন্য যে সুন্দর জিনিস কেন সুন্দর সেটাই জানে না! অন্যদিকে সলিমুল্লাহ তার নাক-উঁচু স্বভাবের পরিচয় দিয়ে গেয়ে যাচ্ছিলো এমন গান যার আগামাথা আমি কিছুই বুঝি না। আমি ভাবতে থাকি এই ব্যাপারটা নিয়ে। আমি দ্বিধার মধ্যে বাস করছি। আমি কী করেছি আর আমার অতীতে করা কাজ আমারে কেমন ভবিষ্যৎ উপহার দেবে। জয়া কি বুঝবে আমি তাকে কী বলতে চেয়েছি আর যদি বুঝেই তখন সে কি সত্যিই আমাকে পথটা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে, যে পথে একটা পলিথিনও উড়তে থাকে না আর যে পথের শেষে মানুষ পলিথিন ধরার জন্য কুকুরের মতো লাফায় না?

 

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com




মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই