আখতার মাহমুদ বাংলাদেশি একজন লেখক। তিনি একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রবন্ধকার, সাহিত্য সমালোচক ও একনিষ্ঠ পাঠক। জন্মস্থান- কাউখালি, রাঙ্গামাটি। জন্ম- ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সালে। পড়াশুনা, বেড়ে ওঠা সবই চট্টগ্রাম শহরে। ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স, এম.এ. করেছেন সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম থেকে। এছাড়া, তিনি আইন ও সাংবাদিকতা নিয়েও একাডেমিক পড়াশুনা করেছেন। বর্তমানে একটি সরকারি সংস্থায় জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।লেখালেখিতে তার পছন্দের বিষয়বস্তু- মনস্তত্ত্ব, স্যাটায়ার, ইতিহাস, ফ্যান্টাসি এবং দর্শন। এছাড়া, ধর্মতত্ত্ব ও তুলনামূলক সাহিত্যেও তার আগ্রহ রয়েছে।

তার লেখালিখিতে এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম-এর প্রভাব রয়েছে। কেননা পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের প্রতি সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গী তার রয়েছে। তার প্রবন্ধ ‘পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়েও ভালো বোঝে?’ এ নিয়ে তিনি সংক্ষেপে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তার অন্য আরেকটি ‘পাশ্চাত্যবাদ: প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ নামের প্রবন্ধে পাশ্চাত্যবাদ (Occidentalism) নিয়ে আলাপ করেছেন যা তার পাশ্চাত্যমুখী মতাদর্শের বিপরীতে অবস্থান স্পষ্ট করে।

সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরাচার বিরোধী মনোভাবও তার লেখায় স্পষ্ট। মিলিট্যান্ট সেক্যুলারিজম নিয়েও তিনি সমালোচনা করেছেন। তার জনপ্রিয় হিস্ট্রিক্যাল থ্রিলার ‘পশ্চিমের পিতা’ বইয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের বিপরীতে প্রাচ্য দর্শনের দ্বন্দ্ব, মিলিট্যান্ট সেক্যুলারিজমের সাথে ধর্মের মতবিরোধ তিনি দেখিয়েছেন। তার আরেকটি সমালোচিত বই হচ্ছে ‘অবিশ্বাসীর মনস্তত্ত্ব’। এই বইয়েও তিনি মিলিট্যান্ট সেক্যুারিজমের তীব্র সমালোচনা করেছেন দর্শন ও মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে। তার উল্লেখযোগ্য একটি উপন্যাসের চরিত্র হলো ‘পথিক রাজপুত্র’। এ চরিত্রটি মূলত রোমান্টিক ও আন্তকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত যুক্তির পৃথিবীতে বাস করতেই সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজ চিন্তার বাইরে সে যেতে পারে না। আধুনিক মানুষের মনন তিনি এ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ধরতে চান।

সম্প্রতি তার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ‘ভাবনার সাতকাহন’ নামে একটি সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান আরম্ভ করেছেন যার সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে চিলেকোঠা পাবলিকেশন। এ অনুষ্ঠানে সাহিত্য-সমাজ, রাষ্ট্র বিষয়ক আলাপ করে থাকেন।

জীবনী

আখতার মাহমুদ এর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আখতার কামাল। আখতার মাহমুদ তার পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র। তার ছোট দুই বোন আছে। যার একজন শিক্ষকতা করছেন একটি সরকারি স্কুলে। অন্যজন্ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশে চা বোর্ডের অধীন একটি সংস্থায় কর্মরত আছেন। আখতার মাহমুদের মাতা হাসিনা আক্তার। কর্মজীবি ও সংগ্রামী নারী। মায়ের আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও নিবিড় তত্ত্বাবধানই তাকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসেছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই পুত্রের জনক। তার স্ত্রী ইসরাত জাহান একজন নারী উদ্যোক্তা।

শিক্ষাজীবন

তিনি চট্টগ্রামের মনসুরাবাদ এলাকায় খান সাহেব আব্দুল হাকিম উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করেন ২০০২ সালে। সরকারী সিটি কলেজ চট্টগ্রাম হতে তিনি এইচএসসি এবং ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ল কলেজ থেকে তিনি এলএলবি পাশ করেন এবং বর্তমানে তিনি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ হতে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন।

কর্মজীবন

ছাত্রাবস্থা থেকেই আখতার মাহমুদ চাকুরি করেছেন। তিনি অনাস ২য় বর্ষে চট্টগ্রাম, কোতোয়ালিতে অবস্থিত যুব উন্নয়ন ট্রেনিং কমপ্লেক্সে কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ও অনিয়মিত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামের খাজা আজমেরী উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিঃ এ অদ্যাবধি জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন।

সাহিত্যকর্ম

লেখালিখির হাতে খড়ি দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার সুজনেষু নামক একটি পাঠক পাতার মাধ্যমে। এটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষক মোজাম্মেল মাহমুদ। ২০১২ সালে পাঠক পাতাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকায় আখতার মাহমুদের প্রকাশিত লেখা পঞ্চাশের অধিক। তার প্রথম উপন্যাস ‘পথিক রাজপুত্র’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়। চট্টগ্রামের একটি অখ্যাত প্রকাশনা হতে। প্রথম উপন্যাসটি রোমান্টিক ঘরানার উপন্যাস হলেও পরবর্তীতে তিনি রোমান্টিক ঘরানার রচনা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন। রোমান্টিক উপন্যাস-গল্পগুলো একজন লেখককে পুরোপুরি বিকশিত করে না বলেই তিনি মনে করেন। পরবর্তীতে তিনি মনোযোগ দেন দর্শন, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বে।

তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম

বই

পশ্চিমের পিতা (২০২২)

‘পশ্চিমের পিতা’ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের গল্প বলে। এটি একটি হিস্ট্রিক্যাল থ্রিলার হলেও ট্রেডিশনাল থ্রিলারের বৈশিষ্ট্যের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘পশ্চিমের পিতা’ ভিন্ন ভিন্ন সময়ের গল্পগুলোকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে মূলত এমন এক বয়ান নিয়ে হাজির হয় যে বয়ানে মিলেমিশে আছে সভ্যতার সংঘাত, পাশ্চাত্যবাদ এবং আদর্শিক দ্বন্দ্ব। এ থ্রিলারটি আখতার মাহমুদের এ যাবতকালের প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বই। এটি চিলেকোঠা পাবলিকেশনের অন্যতম বেস্ট সেলার বই।

অবিশ্বাসীর মনস্তত্ত্ব (২০২২)

অবিশ্বাসীর মনস্তত্ত্ব একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। সেক্যুলারিজম নিয়ে সাইকোলজি ও ফিলোসফির দৃষ্টিকোণ থেকে কখনও আলাপ করা হয় না। অথচ মানুষের মনের আলাপ এ দুটোকে বাদ দিয়ে হয় না। এ বইয়ে সেক্যুলার মননকে সাইকোলজি ও ফিলোসফির আঁতসকাঁচের নিচে রেখে সতর্কতার সাথে আলাপ করা হয়েছে। বইটিতে বাংলাদেশি জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদ এর আমার অবিশ্বাস গ্রন্থে আলাপ করা ধারণার ভ্রান্তি তুলে আনা হয়েছে। পাশাপাশি পাশ্চাত্য দর্শনে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা সেক্যুলারিজমের ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থানকে ব্যক্তিগত যুক্তির আলোকে বিচার করার চেষ্টা আখতার মাহমুদ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস: আতুম (২০২২)

এটি লেখকের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ফ্যান্টাসি রচনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে এক কিশোরের অ্যাডভেঞ্চার তুলে আনা হয়েছে এ উপন্যাসে। লেখকের দাবি এ উপন্যাসে তিনিই প্রথম বাংলায় রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো উপন্যাসে ফ্যান্টাসির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। জাদু, কল্পিত মিথিক্যাল চরিত্র, কল্পিত প্রাণী ইত্যাদির সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

উপন্যাস: বাটিনামা (২০২৪)

বাটিনামা লেখকের নতুন ডিস্টোপিয়ান ঘরানার উপন্যাস। রূপক ও ফ্যান্টাসির প্রয়োগের নানান এক্সপেরিমেন্ট তিনি প্রথমবারের মতো এ উপন্যাসে করেছেন। লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছেন-

বাটিনামা মূলত দ্বীপদেশের এক দানবের গল্প বলে। দ্বীপে প্রায় সবরকম উপায়ে সাধারণের স্বার্থ এড়িয়ে যাবার হাজারো প্রথা-নিয়ম-আইনের যে দেয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে; আমাদের এই দানব সেসব ভেঙে দিতে চায়। কিন্তু দ্বীপের ক্ষমতাবান ও সুবিধাবাদী শ্রেণী কি বিনাযুদ্ধে ময়দান ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক? কিংবা সাধারণ মানুষ ঠিক কতদূর ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত? দানবের প্রতি তাদের মমতা-সমর্থন কতদিন পর্যন্ত টিকে থাকে? সাধারণ মানুষেরা কি আদৌ সুবিধাবাদী শ্রেণীর বাইরের কেউ?...

এটি রুদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো উপন্যাস নয়। সচেতনভাবেই, পাঠকের জন্য মূল গল্পে ঢুকে পড়াটাকে চ্যালেঞ্জিং করে তোলা হয়েছে। যে সকল পাঠক শেষতক মূল গল্পটা ধরে ফেলবেন তাদের জন্য আবার নানা উপায়ে এই উপন্যাসে পাতা আছে একাধিক ফাঁদ!

বা বলা যেতে পারে, আছে একাধিক ফিল্টার। পাঠকের সবরকম অস্বস্তি, বিরক্তি, ক্রোধ, আনন্দ-বিস্ময় ও সম্ভাব্য পাল্টা যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে ফিল্টারগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফলে, ফিল্টারগুলো আলাদা আলাদা করে ছেঁকে বের করে আনবে পাঠকের আদর্শ-মতবাদ-পেশা কিংবা ব্যক্তিগত রুচি।

আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে- এ উপন্যাস পাঠে পাঠক যে সকল জায়গায় অস্বস্তিতে পড়বেন, বিরক্ত হবেন, ক্রোধান্বিত হবেন, আনন্দ লাভ করবেন কিংবা পাল্টা যুক্তি তৈরি করবেন; ঠিক সেসব জায়গাতেই আসলে এঁকে দেয়া আছে পাঠকের প্রকৃতি ও পরিচয়। ^[6]

আখতার মাহমুদের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহ

‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’- এক ভুল দর্শন ^[7]
অরওয়েলের কর্তৃত্ববাদ বিরোধী রচনার অন্তরালের অবচেতন কর্তৃত্ববাদ ^[8]
ট্যাবুর নতুন ধরণ ^[9]
‘পাশ্চাত্যবাদ: প্রেক্ষাপট ও করণীয়’ ^[10]
‘পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে প্রাচ্যের চেয়েও ভালো বোঝে? ^[11]
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোপাগান্ডা মডেল ^[12]

আখতার মাহমুদের উল্লেখযোগ্য গল্পসমূহ

প্রতিদ্বন্দ্বী ^[13]
একটি ইঁদুর বিষয়ক মিথ ^[14]
চিরযুবক ^[15]
বাড়ি ভাড়া ^[16]
না-পুরুষ ^[17]
বগা জামালের পাড়া
বানর
অনির্ধারিত বিরতি ^[18]
মৃত সুখী নগর
নাইকোস্ত্রাতাস ^[19]
পিরামিডে শেষ যুদ্ধ ^[20]
ভদ্রলোক পিল খেয়েছিলেন
বিড়াল বিষয়ক বিবিধ গল্প
অশালীন
জনৈক দর্শনপ্রেমী ভদ্রলোক

ভাবনার সাতকাহন (সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান) ^[21]

মানুষের চিন্তাজগত এক অসীম ক্ষমতাময় এক জগত। এ জগতটাই মূলত একটা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ কিভাবে ভাবে, কী কী যুক্তি নিজের কাজের পক্ষে তৈরি করে। তার চোখে মানবিকতা কেমন? সমাজের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী কেমন। এসব জানতে সকলেই দারুণ আগ্রহী। এ কারণেই আখতার মাহমুদের পরিকল্পনায় চিলেকোঠা পাবলিকেশন আরম্ভ করেছে ‘ভাবনার সাতকাহন‘ নামে অনুষ্ঠানটি। এ অনুষ্ঠানে নানান গুণীজনের সাক্ষাৎকারের নেয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে আখতার মাহমুদ তুলে আনতে চান মানুষের মনোজগতের নানান দিক।

তথ্য সূত্র

↑"পশ্চিমের পিতা - আখতার মাহমুদ"। www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-২২।

↑"পশ্চিমের পিতা - আখতার মাহমুদ"। www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-২২।
↑"'সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট'- এক ভুল দর্শন"। ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’- এক ভুল দর্শন। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-১০-২২।