সাতকাহন | অনিন্দ্য কুমার সিনহা
কদিন ধরেই শরীরটা মোটেও ভালো নেই| প্রবল গরমের চোটে কাহিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল| কত কথা কত স্মৃতি| গ্রামের ভাড়াবাড়িতে কেটেছে অনেকদিন| বাড়ির পিছোনে ছিল বাঁশবাগান| তার মাথার ওপর চাঁদ উঠলেই মায়ের গলায় কাজলাদিদির গানের সুর ভেসে উঠত| দিদি ছিল না তবু কেন জানিনা মন খারাপ হত| বাড়িতে একটা পাতকুয়োতলা ছিল| তাতে একবার একটা চ্যাং মাছ ছেড়ে দিয়েছিলাম| চ্যাং মাছ অশুভ বলে মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছিলাম| মাছটা কখন-সখন জলে ভেসে উঠলে দেখতাম কত বড় হয়েছে| আর একবার এক হেলেসাপকে মেরে বোতলে জল ভরে পুরে রেখেছিলাম| তখন জানতাম না ল্যাবরেটরিতে ফরম্যালডিহাইডে ডোবান থাকে সাপ-ব্যাং এইসব| সেবারো খুব বকুনি খেয়েছিলাম| শরীর খারাপ হলে পুরনো কথা খুব মনে পড়ে| বিশেষ করে সেই সোনালি দিনগুলোর কথা| সেই ফেলে আসা দিনগুলো যেগুলো আর ফিরে আসবে না কোনোদিন|
যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম সেই বাড়িওয়ালা ভারতীয় রেল-এ চাকরী করতেন| পরে অবিশ্যি আমরা থাকাকালীনই অবসর নেন| নি:সন্তান দম্পতী| কলকাতার এন্টালী আর জামালপুর এই দুই জায়গায় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থাকতেন| আমার বাবাকে সন্তানের মত স্নেহ করতেন| সেই সুবাদে আমিও নাতিসুলভ কিঞ্চিত স্নেহ উপভোগ করতাম| (তবে আমার থেকেও আমার বোনের প্রাপ্তিযোগ বেশী ছিল| সে নিয়ে পরে কথা হবে|) নবান্নের লক্ষ্মীপূজো খুব ঘটা করে হত| রান্না যা হত সব নিরামিষ| দুপুরের খাওয়ায় থাকত আতপ চালের ঘী দিয়ে ভাত, আলুভাতে, ডালভাতে, পটল ভাজা, রাঙা আলু ভাজা, আরো কত কি| সব নাম কি মনে আছে ছাই! সব থেকে ভাল লাগত ফ্যাটফ্যাটে সাদা ছোটো ছোটো দানার আতপ চালের ভাত আর তার ওপর এক দলা গাঢ় সোনালী হলুদ গাওয়া ঘী| ঘী যখন গলত মনে হত একটা মস্ত হিমবাহ গলে স্রোতস্বিনী নদী হয়ে পর্বতের চূড়া থেকে মাটিতে নেমে আসছে...তার কি রূপ কি গন্ধ...নির্ভেজাল সেইসব সুগন্ধী দিনগুলি..."দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইবে না"...আজও পাতে ঘী পড়লে সেই গন্ধ খুঁজি|
আমাদের সেই পাতকুয়োতলায় ছিল এক আমগাছ আর এক কাঁঠালগাছ| আমগাছটা যেমন গায়েগতরে কাঁঠালগাছটা তেমনি রোগাপাতলা...কার্টুনের লরেল-হারডি আরকি! একদিন এমনি এক দুষ্টুমি-করা সকালে কি খেয়াল চাপলো দিলাম কাঁঠালগাছের গোড়ার কাছের এক ছোট্টো কাঁঠাল ভেঙ্গে| ওমনি গাছ থেকে টুপ-টুপ করে সাদা গাঢ় রস গড়িয়ে পড়তে লাগলো! (সেদিন বুঝলাম, কিছু অপরাধ আছে যার না চাইলেও প্রমাণ থেকেই যায়|) পাতকুয়োতলা মূলত: ভাড়াটিয়াদের জন্য বরাদ্দ হলেও গরমকালে সরকারমশাই মানে আমাদের বাড়িওয়ালা এবং কদাচিৎ তাঁর স্ত্রী (বাবা-মা কাকাবাবু-কাকীমা আমরা দাদু-দিদু বলতাম) পাতকুয়োর ঠান্ডা জলে স্নান করতেন| বাবা জানত, ওনারা স্নান করতে এসে কচি কাঁঠাল ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে দেখলে ঠিক ধরে ফেলবেন কার কাজ এটি এবং এটা নিয়ে বাবাকে নিশ্চিত অভিযোগ করবেন| আমার বাবার শিক্ষকসত্বা চিরকাল সন্তানের বিরূদ্ধে কারোর কোন অভিযোগকে চূড়ান্ত গুরূত্ব দিয়েছে এবং নিয়ম-নিষ্ঠার অবমাননা হিসেবে দেখে এসেছে| আমি ছোটবেলা থেকেই কড়া শাসনে বড়ো হয়েছি, আমার বোন এই ব্যাপারে অবশ্য খুব ভাগ্যবতী! মাঝে-মাঝেই আমার লঘু পাপে গুরু দণ্ড হতো...সেদিনও তার ব্যতয় হল না| খুব মার খেলাম বাবার হাতে| কিন্তু যেটা আমার মার খাবার দু:খ ভুলিয়ে দিল তা হোল আমার বাবার নিস্ফল প্রয়াস ওই ছেঁড়া কাঁঠালটাকে গাছে আবার জুড়ে দেওয়ার! বাবা যতবার জুড়ছে বেয়াড়া কাঁঠাল ততবার গড়িয়ে পড়ে...সে এক বিষম অবস্থা...হাসতেও পারছিনা...আমার দোষেই এই পরিস্থিতি...বাবার সেই অসহায় মুখটা যেন দেখতে পাচ্ছি| দেখতে পাচ্ছি একজন বাবার আপ্রাণ প্রয়াস সন্তানের নিস্পাপ দেহে যেন অভিযোগের কালি না লাগে...
ছোটবেলা থেকেই কুকুরের প্রতি আমার এক মিশ্র অনুভূতি| পুষতে ভালবাসি কিন্তু ঘেউ ঘেউ করলে ভয়ে সিঁটিয়ে যাই| একবার দুর্গাপূজোর সময় বাড়ি ফিরছি| রাত হয়ে গেছে| বন্ধুদের সাথে আড্ডা ইত্যাদি| খেয়াল নেই, পাড়ার রাস্তাটা বড় নির্জন| বেয়াড়া কুকুরও আছে খানকতক| বড় রাস্তা ছেড়ে পাড়ার গলিতে ঢুকতে যাব, মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল...একটা কুকুর চেঁচালে তার গুষ্টিবর্গ রে রে করে তেড়ে আসবে...সর্বনাশ! সাইকেল নিয়ে যে পোঁপোঁ দৌড় মারব তার যো নেই...ছুটে এসে পায়ে কামড়ে দেবে| প্রাচীন 'অরণ্যের প্রবাদ'...কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে আর যাই কর, খবর্দার ভুলেও দৌড়বে না...জোরে সাইকেল চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে না| অত:কিম? একটা রিক্সা আসছে দেখে বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়| রিক্সায় সাইকেল সমেত আমি চেপে গেলাম...মানে, সিটে আমি বসলাম সাইকেলটা তুলে ধরলাম হাঁটুর ওপর| রিক্সাওয়ালা ব্যাপার-স্যাপার দেখে অবাক| বুঝিয়ে বললাম...বোধহয় বুঝল...আর কোন প্রশ্ন করল না| নিজের কান্ড দেখে নিজেই অবাক...রাস্তার কুকুরগুলোরও প্রায় ভিরমি খায় আরকি!
আমার মা আক্ষরিকভাবে হলেও বাস্তবিকভাবে কখনই 'অরুণ'-এর 'ছায়া' ছিল না| মা নিজগুণেই একজন স্বাধীনচেতা আধুনিকমনস্ক মহিলা সেকালেও এবং একালেও| বাড়িতে হারমনিয়াম নেই এমন বাঙালিবাড়ি সেকালে বড়ো একটা ছিল না বললেই চলে| মেয়ে-ঝিরা হারমনিয়াম ছেলে-ছোকরারা তবলা বা কিঞ্চিত শৌখিন হলে গিটার শিখতই| আমার মাও শিখেছিল| মা হারমনিয়াম নিয়ে গান করত, অনেক গান...সব মনে নেই| "কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধূলো যত..." নজরুলগীতি কিংবা "আমি ভবে একা দাও হে দেখা প্রাণসখা রাখ পাশ মন মজায়ে লুকালে কোথায়..." সেকালের নট্ট কোম্পানির বিখ্যাত যাত্রাপালা 'নটী বিনোদিনী' এর গান| মা প্রাণভরে গাইত| আমি অবাক হয়ে শুনতাম| মা বলে, আমার যদিও মনে নেই, মা "আমি ভবে একা দাও হে দেখা..." গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলত আর আমি বলতাম, দেখা দাও দেখা দাও...তখন কি বুঝতাম, যার দেখা পেতে তাবড় লোক জীবনপাত করে ফেলল তার দেখা পাওয়া কি অতই সহজ! পরে বড় হয়ে যখন বাড়িতে 'নেলকো' কোম্পানির রেডিও-কাম-ক্যাসেট প্লেয়ার এলো তখন তাতে ক্যাসেটে শুনলাম সেই বিখ্যাত যাত্রাপালা "নটী বিনোদিনী"| (যারা যাত্রার নাম শুনে নাক কোঁচকান তারা একবার শুনে দেখতে পারেন...হতাশ হবেন না, হলপ করে বলতে পারি|) কি সব ঐতিহাসিক চরিত্র! গিরিশ ঘোষ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, বিনোদিনী দাসী...ঠাকুর যেখানে বিনোদিনীকে বলছেন, তোর চৈতন্য হোক...বা যেখানে গিরিশ ঘোষকে বলছেন, তবে দে শালা দে তুই আমায় বকলমা দে...গায়ে সত্যি বলছি কাঁটা দিত| আরেকটা এইরকম অনুভূতি হত বাবা যখন ছাত্র-ছাত্রীদের অস্কার ওয়াইল্ডের বিখ্যাত লেখা "সেলফিশ জায়েন্ট" পড়াত...বিশেষ করে সেই লাইনটা...দৈত্য শিশুটিকে বলছে, হু হ্যাথ ডেয়ারড টু উনড দী? শিশুটির জবাব, দীস আর দ্য উনডস অব লভ! বাবার সেই নাটকীয় করে বলা কানে আজও ভাসে...গায়ে আজও কাঁটা দেয়| ভাবি, চারিদিকে এত সাজান বাগান...সেই শিশুরা আজ আর খেলতে আসে না...ফলের ভারে নুয়ে পড়া গাছের ডাল কবেই কাটা পড়েছে নাগরিক সভ্যতাকে জায়গা করে দিতে...দৈত্যরাই শুধু আছে আনাচে-কানাচে...সেই বাচ্চাটার প্রতীক্ষায়...যে তাদের সব্বাইকে একদিন মুক্তি দেবে আর তার নিজের বাগানে নিয়ে যাবে চিরকালের মত| আর একটা গান ভীষণ টানত, "শেষের দিনে স্বজন বিনে খ্যাপা পর কি আপন হবে রে..." একদল কীর্তনীয়া প্রায়ই আমাদের সেই ভাড়াবাড়িতে গান গেয়ে ভিক্ষা চাইতে আসত| হারমোনিয়াম, খোল আর খঞ্জনী| মা-র অনুরোধে প্রতিবার ঐ গান তাদের গাইতেই হত| তারাও খুশী হয়ে গাইত| মা-র চোখ জলে ভিজত...আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম| পরে অনেক খুঁজেছি সেই গান...কোত্থাও পাইনি| খোঁজা শেষ করিনি এখনও...আশাকরি পেয়ে যাব...শেষের দিনের আগেই...
ছোটবেলা থেকেই কুকুরের প্রতি আমার এক মিশ্র অনুভূতি| পুষতে ভালবাসি কিন্তু ঘেউ ঘেউ করলে ভয়ে সিঁটিয়ে যাই| একবার দুর্গাপূজোর সময় বাড়ি ফিরছি| রাত হয়ে গেছে| বন্ধুদের সাথে আড্ডা ইত্যাদি| খেয়াল নেই, পাড়ার রাস্তাটা বড় নির্জন| বেয়াড়া কুকুরও আছে খানকতক| বড় রাস্তা ছেড়ে পাড়ার গলিতে ঢুকতে যাব, মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল...একটা কুকুর চেঁচালে তার গুষ্টিবর্গ রে রে করে তেড়ে আসবে...সর্বনাশ! সাইকেল নিয়ে যে পোঁপোঁ দৌড় মারব তার যো নেই...ছুটে এসে পায়ে কামড়ে দেবে| প্রাচীন 'অরণ্যের প্রবাদ'...কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে আর যাই কর, খবর্দার ভুলেও দৌড়বে না...জোরে সাইকেল চালিয়ে পালানোর চেষ্টা করবে না| অত:কিম? একটা রিক্সা আসছে দেখে বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়| রিক্সায় সাইকেল সমেত আমি চেপে গেলাম...মানে, সিটে আমি বসলাম সাইকেলটা তুলে ধরলাম হাঁটুর ওপর| রিক্সাওয়ালা ব্যাপার-স্যাপার দেখে অবাক| বুঝিয়ে বললাম...বোধহয় বুঝল...আর কোন প্রশ্ন করল না| নিজের কান্ড দেখে নিজেই অবাক...রাস্তার কুকুরগুলোরও প্রায় ভিরমি খায় আরকি! রিক্সার ওপর মানুষ তারা রোজ দেখে...কিন্তু সাইকেল-সমেত মানুষ? এই আজব দৃশ্য দেখে মাইরি বলছি কুকুরকূলকে বেবাক চুপ থাকতে দেখে নিজের বুদ্ধির ওপর যা গর্ব সেদিন হল সে ভাষায় প্রকাশের নয়| সে কি মজার দৃশ্য! কুকুরগুলো দৌড়ে আসছে চেঁচাবে বলে...একবার কি দুবার ভৌ করেই ওই অদ্ভুতুড়ে দৃশ্য দেখে পুরো যাকে বলে 'অ্যাবাউট টার্ন'!
আমি তখন ক্লাস নাইন কি টেন এ পড়ি| আমাদের গ্রামের স্কুলে সরস্বতী পূজোর দায়িত্বে সেবার আমাদের ক্লাস| তখন স্কুলে স্কুলে এত ডেকরেটর প্যান্ডেলওয়ালা ক্যাটারার এদের ভীড় ছিল না| তাছাড়া গ্রামের স্কুলে এত আর্থিক সঙ্গতিই বা কোথায় তখন? দল বেঁধে ঠাকুর আনা বা প্যান্ডেলের বাঁশ কেটে আনা বা প্যান্ডেল বানানো বা ফল কেটে প্রসাদের জোগাড় করা...বেশ মজার ছিল| আর আমার বাবা ঐ স্কুলেরই শিক্ষক হওয়ায় সরস্বতী পূজোর বাহানায় কদিন আমার 'আশ্রমিক' জীবন থেকেও মুক্তির স্বাদ! বাঁশ কাটতে যাওয়াটা বেশ 'অ্যাডভেঞ্চেরাস' ছিল| স্কুলের তো কোন নি:জস্ব বাঁশঝাড় ছিল না...অজানা অচেনা গ্রামবাসীদের বাঁশঝাড় থেকে আদপে বাঁশ চুরি করতাম আমরা| একদিনে সব যোগাড় হত না...বেশ কয়েকদিন ধরে এই বাঁশ-চুরি অভিযান চলত| বারবার 'চুরি' বলছি বটে কিন্তু তখন কোন গ্লানি অনুভব করতাম না| বরং মনে হত, স্কুলের সরস্বতী পূজোর মত এক মহান কাজে এ যেন গ্রামবাসীদের স্বেচ্ছা অনুদান হওয়া উচিৎ| নিজে থেকে কেটে দিচ্ছে না, তাই আমরা কেটে নিয়ে যাচ্ছি| ধরা যে পড়িনি তা নয়...কিন্তু পূজোর বাঁশ শুনে কেউ আপত্তি করত না...তারাও ওই একই স্কুলের প্রাক্তনী কিনা! ভালই চলছিল...গোল বাঁধল কালু মিত্তিরের বেলা| আমরা না বলে বাঁশ কাটছি দেখে ওনার কোন লোক চেঁচামিচি জুড়ে দিল| আমরা যত বোঝানোর চেষ্টা করি, আমরা স্কুলের ছাত্র, সে তত চেঁচায়| সে তার মনিবের কাছে আমাদের ধরে নিয়ে যাবেই! অগত্যা আমরা অপরাধী অপরাধী মুখ করে গেলাম| শুনেছিলাম, ওনার বাড়িতে একটা বড় কুকুর আছে...সবাই একটু যেন বেশী সতর্ক| কি হবে কি বলবেন এই সব সাতপাঁচ ভাবতে-ভাবতেই একটা বিশাল কুকুর কোথা থেকে বেরিয়ে একলাফে আমাদের এক সহপাঠীর বুকের ওপর পা তুলে তাকে শুঁকতে শুরু করে দিল| সবাই আমরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ| যার ওপর লাফ দিল কুকুরটা সে তো প্রবলভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে যেন কিছুই হয়নি...সেটা কুকুরটাকে না আমাদেরকে, সেইটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না| কুকুরটাও সমানে গরগর করে যাচ্ছে...মানে বেচাল দেখলেই কামড়ে দেবে| এইরকম মিনিটখানেক কুকুর-মানুষের অসম কোলাকুলি চলার পর বাড়ির মালিক উদয় হলেন| ওনাকে দেখে কুকুরটি আমাদের সহপাঠীকে মুক্তি দিল...আমরাও হাঁফ ছাড়লাম| যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে কালু মিত্তির বললেন, কটা বাঁশ লাগবে বল, আমার লোক গিয়ে কেটে নিয়ে আসছে...তোমরা ততক্ষণ আমার দাওয়ায় বসে জিরিয়ে নাও| প্রস্তাবটা গ্রহন করতে যাব, দেখি সেই বাঘের মত বিশাল কুকুরটা দাওয়ায় উঠে একটা কাঠের বেঞ্চির তলায় বসে লম্বা জীভ বার করে হাঁফাচ্ছে| আমরা সবিনয়ে বললাম, না আজ থাক, আর একদিন নাহয়...আজ দেরী হয়ে গেছে| কালু মিত্তির জোর করেন নি সেদিন...আমরাও আর কোনোদিন ওনার বাঁশঝাড়ে যাই নি| সেদিন বুঝেছিলাম, প্রকৃত অর্থে 'বাঁশ খাওয়া' কাকে বলে|
তা বাঁশ খাওয়ার গল্পই যখন হচ্ছিল আরও কিছু সে রকম ঘটনার কথা বলি| তবে, এই সমস্ত ঘটনার সময়কাল সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা; কোন নির্দিষ্ট সময়সারণী বেয়ে বেয়াড়া স্মৃতিগুলো নামতে চায়নি আরকি!
তখন কলেজে পড়ি| (কোন কলেজ সেটা উহ্যই থাক...পাছে কেউ ভেবে বসে, এ মা এত নামী কলেজে বুঝি এইসব সুশিক্ষার পাঠ দেওয়া হয়! কলেজের নাম অনর্থক ডেকে এনে বিতর্ক সৃষ্টি না করাই শ্রেয়|) আবাসিক কলেজ| নয় নয় করে প্রায় বারশো কি তেরশ ছাত্র-ছাত্রীর বাস| হস্টেল দুরকম - মাল্টিসিটার অর্থাৎ এক ঘরে একাধিক ছাত্র বা ছাত্রী এবং সিঙ্গলসিটার অর্থাৎ এক ঘরে একা একজন ছাত্র বা ছাত্রী| সিঙ্গলসিটারের সৌভাগ্য (বা দূর্ভাগ্য...যে যেরকম ভাবে নেবে আরকি!) শুধু অন্তিম বা চতুর্থ বর্ষেরই প্রাপ্য ছিল...যদিও বিশেষ ক্ষেত্রে তৃতীয় বর্ষেরও ঠাঁই মিলত...অবশ্য তার জন্য প্রথম বর্ষে যথেষ্ট ভাল ফল করে ছাত্র সংগঠনের সম্পাদকের কাছে আবেদন করতে হত দ্বিতীয় বর্ষের শেষ দিকে| প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় (তখনও আমাদের সেমেষ্টার পদ্ধতি চালু হয় নি) প্রাপ্ত মার্কসের ওপর ভিত্তি করে তালিকা তৈরি হত...জল যে মিশত তা বলাই বাহুল্য এবং জল মিশত সেই ছাত্র বা ছাত্রীর বিগত দু-বছরের রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর...সেসব অপ্রাসঙ্গিক কথা নাহয় বাদ দেওয়া যাক| অনেক ছাত্র বা ছাত্রী নিজের যোগ্যতায় না সুযোগ পেলে অন্য কেউ যে সুযোগ পেল অথচ যেতে চাইল না তার নাম নিয়ে সিঙ্গলসিটারে চলে যেতে পারত...যদিও হস্টেলের আবাসিক-তালিকায় নামের রদবদল হত না...ব্যাপারটা একটু জটিল ছিল...তাই এই পর্যন্তই থাক| যাইহোক, প্রথম বর্ষে ভাল ফল না থাকার দরুণ আমার আবেদন করার যোগ্যতা ছিল না...অথচ দ্বিতীয় বর্ষের শেষ দিকে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে সিঙ্গলসিটারে যাওয়াটা আমার জরুরি হয়ে পড়ল| আমার মাল্টিসিটার হস্টেলের এক আবাসিক বন্ধুকে ধরলাম...প্রথমে নিমরাজি হলেও সব বুঝিয়ে বলাতে রাজি হয়ে গেল| নির্দিষ্ট সময়ে নিজের মাল্টিসিটার হস্টেল ছেড়ে সিঙ্গলসিটারে চলেও এলাম|
একটা অলিখিত নিয়ম ছিল...সিঙ্গলসিটার হস্টেলে তৃতীয় বর্ষের আবাসিকদের জন্য খালি একতলার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলোই বরাদ্দ| মাল্টিসিটার হস্টেলের সবচেয়ে 'প্রবীণ' (যেহেতু মাল্টিসিটারে তৃতীয় বর্ষই শেষ) হবার দৌলতে সবচেয়ে ভাল ঘর দখল করার সুবর্ণ সুযোগ ছেড়ে সিঙ্গলসিটারের দ্বিতীয় শ্রেণীর 'নাগরিক' হওয়া যে কি কষ্টের মনে হত সে আমিই জানি| কিন্তু, কি আর করা! অবস্থার বিপাকে সেটাই মানতে বাধ্য হলাম| চলে তো এলাম...মন কিন্তু পড়ে রইল পুরনো মাল্টিসিটারে...ওখানেই সব বন্ধু কিনা! আমার 'বর্তমান' এবং 'প্রাক্তন'...দুই হস্টেল একদম মুখোমুখি| আমি বাস করতাম 'বর্তমান'-এ কিন্তু আত্মাটা পড়ে থাকত আমার 'অতীত'-এ...বিষম পরিস্থিতি আরকি! এভাবেই বেশ চলছিল| গোল বাঁধল কলেজের ইন্টার-হস্টেল সীমিত ওভার ক্রিকেট প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে| কলেজের দুই খেলার মাঠ...দুই মহল্লায় (আমরা 'সাহেবপাড়া' ও 'মুচিপাড়া' বলতাম)| দুই ময়দানের দুইটি ভিন্ন সাহেবী নাম...আমাদের 'সাহেবপাড়া'-র টি 'লর্ডস' এবং 'মুচিপাড়া'-র টি 'ওভাল'...কানা ছেলের নাম 'পদ্মলোচন' গোছের আরকি! কেন জানতাম না, 'ওভাল'-এ এইরকম বালখিল্য ক্রিড়ানুষ্ঠান হত না...'লর্ডস' বরাদ্দ ছিল তার জন্য| তা সেই 'লর্ডস'-এ খেলা পড়ল আমার 'প্রাক্তন' ও 'বর্তমান'-এর| আমি পড়লাম মহা ফাঁপড়ে...কাকে সমর্থন করব এবার? কলেজ শেষে মাঠের সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছি...'বর্তমান' ফিল্ডিং করছে 'প্রাক্তন' ব্যাটিং...ম্যাচ জমে উঠেছে| 'প্রাক্তন'-এর ব্যাটসম্যান বলটাকে মারল...বল দ্রুত ছুটছে বাউন্ডারীর দিকে...'বর্তমান'-এর ফিল্ডার বেশ কিছুটা দূরে...ডাইভ দিয়েছে ধরার জন্যে...ফস্কেছে...নিশ্চিত চার রান!
ও মা একি? বাউন্ডারি লাইনে বসা 'বর্তমান"-এর কিছু চতুর্থ বর্ষের আবাসিক দাদা বাইরে থেকে চকিতে বলটা ধরে ডাইভ দেওয়া ফিল্ডারের হাতে তুলে দিল| নিশ্চিত চার রান শুধু জোচ্চুরি করে বাঁচিয়ে দিল! এত দ্রুত সব ঘটল অত দূর থেকে না আম্পায়ার না অন্য কেউ বুঝতে পারল কি আসলে হল| সবাই দেখল, ফিল্ডিং সাইড একটা বাউন্ডারি বাঁচিয়েছে| ভোটের দিন নিরীহ নির্দল প্রার্থী যেমন গোবেচারা মুখ করে ছাপ্পা দিতে দেখে সেরকমই বসে ছিলাম| কিন্তু কি যে হল...মাথার ক্যাড়াপোকাগুলো কিলবিল করে উঠল বোধহয়! দিলাম 'আওয়াজ' (এই শব্দের কোনো যুতসই সমশব্দ আমার জানা নেই| যারা জানেন না তারা পাড়ার সুন্দরী মেয়ে-বৌদিদের জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন, এই শব্দের গূঢ়ার্থ...যা মোটের ওপর চূড়ান্ত অসম্মানসূচক শব্দ বা শব্দগুচ্ছ|)! 'বর্তমান' -এর ঐ আবাসিক দাদাদের দলে এক-দুজন ছিল যারা নিয়ম করে ভাত-তরকারি না খেলেও গাঁজাটা খেতই| তাদেরই একজনকে কথা কাটাকাটির মাঝে বলে বসলাম, যা গাঁজা খা গে যা! শালা, বাপ-মা তুলে গাল দিতিস তবু মেনে নিতাম| গাঁজা খাওয়া নিয়ে খোঁটা? তায় আবার জুনিয়র হয়ে সিনিয়র কে? তার ওপর 'বর্তমান' -এ খাবি-হাগবি...আবার খেলার মাঠে 'বর্তমান' কে গাল পাড়বি 'প্রাক্তন'-এর হয়ে? মুহূর্তে গোটা 'সাহেবপাড়া'য় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল এই 'রাষ্ট্রদ্রোহ'-এর খবর| 'প্রাক্তন'-এর শুভাকাণ্খী বন্ধুর দল প্রমাদ গুণল...সেই রাতে আমি স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিলাম...'রাজনৈতিক' আশ্রয় নিলাম 'প্রাক্তন'-এর নিরাপদ আশ্রয়ে|
সেরাত তো কাটল কোনওমতে| কিন্তু ভোর হতেই একটা চিন্তা মাথায় ঢুকল, আমার যাবতীয় জিনিস তো 'বর্তমান'-এর ঘরে...জামা-কাপড়, বই-খাতা মায় টাকা-পয়সা অব্দি...এক রাত বাইরে কাটালাম, ঠিক আছে...কিন্তু অত:কিম? অনেক ভাবলাম| ভেবে দেখলাম, যেতে তো হবেই...আজ নয় কাল...তাই ভয় পেলে হবে না...জল মেপে দেখতে হবে! সকালে চুপি চুপি উঠে নিজের ঘরে চলে গেলাম...সকালের কাজ-টাজ সেরে বই-খাতা নিয়ে আবার ফিরে এলাম 'প্রাক্তন'-এর ডেরায়| আমার বাসস্থান পরিবর্তন হলেও 'প্রাক্তন'-এর ক্যান্টিনেই সকাল-সন্ধ্যে খেতাম| কলেজে গিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই ঘিরে ধরল সহপাঠীরা...বিশেষ করে পাশের 'মাল্টিসিটার' ১৫ নং-এর ছেলেরা| সেসময় বিশেষ বিশেষ 'সিঙ্গলসিটার'-এ কোনও বছর বিশেষ বিশেষ ডিপার্টমেন্ট বা 'মাল্টিসিটার'-এর ছেলেদের ভীড় বেশি থাকত| যেমন সেই বছর যে বছরের কথা হচ্ছে আমি যে 'সিঙ্গলসিটার'-এ থাকতাম সেখানে ওই ১৫ নং-এর সিনিয়ররা সংখ্যায় বেশী ছিল| ১৫ তে আমার ব্যাচের আমার ডিপার্টমেন্টের ছেলেরাও ছিল অনেক...তাই ওদেরকেই ধরলাম...এখন যাকে লোকে 'ট্রাক ট্যু ডিপ্লমেসি' বলে আরকি! দুপক্ষেই গাঁজা কমন ফ্যাক্টর ছিল আর ওটাই সেতুবন্ধের কাজ করেছিল...ফলত: সেযাত্রায় কোনমতে রেহাই|
'বাঁশ' খাওয়ার ঘটনা আরও একবার ঘটেছিল...সেই বছরই...তবে হস্টেলে নয়...আমাদের ক্লাশে| আগেই বলেছি ১৫ নং-এ আমাদের ডিপার্টমেন্টের আমার ব্যাচের ছেলেরা বেশী থাকত| সেকারণে দিনে-দুপুরে-সন্ধ্যায় মায় গভীর রাতেও ওই হস্টেলে আমার অবাধ বিচরন ছিল| সম্পর্কের সেই গভীরতার কারণে যে মানুষ 'বাঁশ'ও খেতে পারে, তায় আবার যেচে...সেইটা সবিস্তারে বলি| যেকোনো কলেজে 'প্রক্সি' ব্যাপারটা খুব সাধারন| ঘনিষ্ঠ বন্ধুর হয়ে ক্লাসে 'প্রক্সি' দেওয়া লোকজন আমাদের চারপাশে অনেক| আমাদের কলেজেও আকছার হতো| এরকমই কোন এক দিন ১৫ নং-এর এক বন্ধু বলল, ডাকাত (আমাদের কলেজে অনেক পরম্পরার মধ্যে এটাও একটি...নামকরন! বাপ-মায়ের দেওয়া নাম কলেজের সিনিয়রদের মন:পূত না হলে চেহারা-আচরন-ভঙ্গী-গুণাগুণ দেখে নামকরন হত| তবে কিছু ব্যতিক্রমও ছিল, যেমন আমি...আমার 'ডাকাত' নামকরনে সিনিয়রদের কোনও ভূমিকা ছিল না...এই নাম আমার ক্লাশমেটদের দেওয়া...তবে ঠিক কি কারণে সেটা কেউ কখনও ব্যাখ্যা করেনি|) আমার হয়ে কাল ক্লাশে 'প্রক্সি' দিয়ে দিবি? আমার বোঝা উচিৎ ছিল, ওদের হস্টেলে ওর এত ক্লাসমেট থাকা সত্ত্বেও আমাকেই কেন বললো? যাঁর ক্লাশ ছিল উনি খুব একটা সুবিধের ছিলেন না| আমার রোল নং ছিল ৯৬...যার 'প্রক্সি' দেবো তার ৮৪| আমার উপস্থিতি আমি যথাসময়ে জানান দিলাম| রোলকল শেষ হলে ৮৪-এর জন্য আবেদন করলাম| শিক্ষকের সন্দেহ হওয়ায় উনি জিগ্যেস করলেন, আর য়্যু সিওর য়্যু আর ৮৪? গোটা ক্লাস আমার উত্তরের প্রতীক্ষায় থমথম...শিক্ষকের চোখ আমার ওপর নিবদ্ধ| আর আমি? আমার অবস্থা, শ্যাম রাখি না কূল রাখি! মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম...সবাইকে হতবাক করে বললাম, হ্যাঁ আমিই ৮৪| সেদিন তো কাটলো| কলেজ শেষে দৌড়ে গেলাম ১৫ নং-এর ওই বন্ধুর কাছে| সবিস্তারে জানালাম কি হয়েছে ক্লাসে...এও বললাম, পরের দিন ক্লাসে ও যেন আমার ৯৬ নং-এ হাত তোলে আর আমি ওর ৮৪ নং-এ হাত তুলবো| কিন্তু আমার সেই বন্ধুটি উলটে আমাকেই বিদ্রুপ করল এত ঝুঁকি নিয়ে তার 'প্রক্সি' দেবার জন্য! বোঝো ঠেলা...যার জন্যে চুরি করলাম সেই কিনা শেষে বলে চোর? হায়রে কপাল আমার! বুঝলাম, পরের ক্লাসে একটা ঝড় আমার জন্যে অপেক্ষা করছে| ঠিক তাই হল| পরের ক্লাশে রোলকলের সময় আমার সেই বন্ধুটি তার ৮৪ নং-এ হাত তুলতেই সেই শিক্ষক আমাদের দুজনকেই উঠে দাঁড়াতে বললেন এবং আসল ব্যাপারটা জানতে চাইলেন| জানাতে হল...আমি আমার দোষ স্বীকার করলাম...কিন্তু ওই শিক্ষক নাছোড়! মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু ক্লাশ শেষে ওনার সাথে দেখা করতে বললেন| দেখা করতেই বললেন, আই শ্যাল কমপ্লেইন এগেইনস্ট য়্যু টু দ্য এইচ ও ডি ফর সাচ গ্রস ইনডিসিপ্লিন য়্যান্ড মিসবিহেবিয়র| সব্বোনাশ...ইনি কি বলছেন? এ তো লঘু পাপে গুরু দন্ড স্যর? উনি কিছুতেই মানবেন না| শেষমেস অনেক কাকুতি-মিনতি করে ওনাকে রাজি করালাম ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশী দূর না যেতে| ওনার শর্ত একটাই, আমাকে লিখিত 'আন্ডারটেকিং' দিতে হবে আমি ভবিষ্যতে এমন দু:সাহস আর কখনও দেখাব না| না আর কখনও সত্যি দেখাইনি...ওই 'বাঁশ'-এর স্মৃতি তো এত বছরেও অমলিন!
ছোটবেলার কথা লিখতে বসে আমরা প্রায়শ:ই আমাদের প্রিয় না-মানুষদের কথা উল্লেখ করতে ভুলে যাই...না ভেবেই যে আমাদের অতিপ্রিয় মানুষ-মানুষীদের ভীড়ে ওই না-মানুষদেরও একটা গুরুত্ব আছে বা ছিল আমাদের জীবনে| না-মানুষ অর্থে পোষ্যই হতে হবে কোনও মানে নেই...বাড়ির দাওয়ায় অযত্নে অবহেলায় শুয়ে থাকা নেড়ি কুকুরের সাথেও অনেকের ছোটবেলার অজস্র স্মৃতি থাকতেই পারে...এতে আশ্চর্য্যের কিছু নেই!
আমাদের ছোটবেলার সেই ভাড়াবাড়িতে ছিল অনেক নেড়িকুকুরের বাস| নি:সন্তান বাড়িওয়ালা সরকারমশাই যাকে আমাদের বাবা-মা কাকাবাবু, আমরা দুই ভাই-বোন দাদু সম্বোধন করতাম...উনি ওই কুকুর দলের 'পালক পিতা' ছিলেন| ওনার স্ত্রী যদিও স্বামীর এই কুকুরপ্রীতি দুচক্ষে সহ্য করতে পারতেন না তবু নিয়ম করে নিজেদের রান্না-বান্নার শেষে কুকুরদের জন্যে খুদ-ঘঁাটা বানিয়ে দিতেন| চাষের সময় জামালপুরের বাড়ি আর অন্য সময় কলকাতার এন্টালী আর যতদিন না দাদু ভারতীয় রেলের চাকরী থেকে অবসর নিলেন ততদিন ফি-বছর হয় পুরী নয় হরিদ্বার মাসখানেক করে...এই ছিল সরকার দম্পতির জীবন| কোথাও দীর্ঘ যাত্রার আগে আমার মায়ের ডাক পরত...এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের| ওনাদের অনুপস্থিতিতে কুকুরদের খুদ-ঘাঁটা বানানোর এবং খাওয়ানোর গুরুদায়িত্ব! মা-কে কখনও না করতে শুনি নি|
বাড়িতে ছিল এক পরিত্যক্ত কলতলা অর্থাৎ চাপাকলতলা যাকে লোকজন টিউবওয়েল বলতে অভ্যস্ত| সেই কলতলায় রাখা থাকত পুরনো দই-মিষ্টির মালসা (মাটির কানা-উঁচু পাত্র)...তাতে ঢালা হত গরম খুদ-ঘাঁটা| খুদ হল ভাঙ্গা ছোট চাল| এই খুদ থেকেই বাংলা তথা ভারতের অগ্নীযুগের বীর সন্তান খুদিরাম বসু-এর নাম!
সে যাই হোক, খুদ-ঘাঁটা দেবার পর সে এক দেখার মত দৃশ্য হত! পৃথিবীর আদিমতম যুদ্ধ...খাদ্যের জন্যে যুদ্ধ! এক একটা রোগা-পটকা নেড়ি কুত্তা তখন যেন রয়াল বেঙ্গল টাইগার! আমাদের কাউকে বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়াতে হত...শক্তিমান বলবান ছেলে কুকুরদের হাত থেকে অপেক্ষাকৃত দূর্বল নিরীহ মেয়ে কুকুরগুলোকে বাঁচানোর জন্যে| নাহলে মেয়ে কুকুরগুলো নির্ঘাৎ না খেয়ে মরত!
আমার মজার দিন ছিল যখন কুকুরের ছানা হত| বাচ্চা সমেত ভারী পেট নিয়ে যখন মেয়ে কুকুরগুলো একটু নিরালা নিভৃতি খুঁজত তখনই আমরা সতর্ক হয়ে যেতাম...কোথায় বাচ্চা দিল দেখার জন্যে| আমাদের যে দায়িত্ব আরও বেড়ে যেত...ভাঙ্গা ঘরে যেন সাপ-খোপ না আসে...ঠান্ডায় মা ও বাচ্চাগুলোর যেন কষ্ট না হয়...মা কুকুর তো বাচ্চার জন্ম দিয়ে কাহিল, তার নড়ার ক্ষমতা নেই, তার মুখের কাছে মালসা রেখে আসা, আলাদা করে তাকে খেতে দেওয়া...কত্ত কাজ! মা-কুকুর সাধারণত: বাচ্চার আসেপাশে কাউকে ঘেঁশতে দেয় না...আমাকে দিত| সব্বাই বারণ করত, ওরে যাস না, কামড়ে দেবে! কে শোনে কার কথা? বাচ্চাগুলোর চোখ ফুটলেই কুঁই কুঁই করে সারা বাড়ি চলে ফিরে বেড়াত...এখানে মুততো...ওখানে হাগতো...আর আমার বাবার কাজ বাড়ত! চান করতে যাবার আগে হাতে কোদাল নিয়ে কুকুরছানাদের গু পরিস্কার...নিত্য লেগেই থাকত| বাবার ফাঁকি মারার যো ছিল না...সরকার গিন্নি যাঁকে মা-বাবা কাকিমা আর আমরা দিদু বলতাম তক্কে তক্কে থাকতেন| বাবার সকালের ছাত্র-ছাত্রীর দল বিদায় নিলেই উনি হাজির ওনার ফরমায়েশ নিয়ে, অরুণ আজ ওই জবাগাছের গোড়ায় করেছে গো...ইত্যাদি|
এমনই এক বছর এক হতভাগিনী বয়স্ক বুড়ি মেয়ে কুকুরের ছানাপোনা হল...কিন্তু তারা কেউ বাঁচলো না| সে তো কেঁদেকেটে অস্থির...মানুষকে বোঝানোর ভাষা আমাদের...এই অভাগী মা-কুকুরকে বোঝায় কার সাধ্যি! তারই কোনও এক প্রজন্মের মেয়ে সন্তানেরও সেবার ছানাপোনা হয়েছিল...তার থেকে ধপধপে সাদা একটি পুরুষ ছানাকে নিয়ে তুলে দেওয়া হল ওই অভাগীর কোলে! ব্যাস...তার কান্নাকাটি শেষ...আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম| দিদিমার দুধ খেয়ে বড় হতে লাগল সেই ছানা| কি আশ্চর্য্য! ছানাটির আসল মা কিন্তু একবারের জন্যও প্রতিবাদ করেনি...কামড়াতে আসেনি...ছানাটিকে না পেয়ে কাঁদে নি...এমনকি মুখে করে আবার নিয়ে চলেও যায় নি| না-মানুষ জগতের এ এক বিচিত্র ও দূর্লভ ঘটনার সাক্ষী আমি| এই রকম সমব্যথী উদারতা যদি আমাদের মধ্যেও থাকত...আহা!
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com










মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন