অধর্ম | আখতার মাহমুদ
ধ্বংস ও অশান্তির মূল- অধর্ম
অধর্ম (অবিশ্বাস) মানুষকে শেখায় যুক্তিহীন প্রলাপে ধর্ম ও স্রষ্টাকে আঘাত করতে। যে কাজটি হুমায়ুন আজাদ ক্রমাগত করেছেন। প্রথাবিরোধীতার নামে পুরোটা জীবন ধর্মবিরোধীতাই করেছেন। যেমন “আমার অবিশ্বাস” গ্রন্থের পঞ্চম পরিচ্ছেদের এক জায়গায় ধর্মকে বাতিল প্রমাণ করতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন ‘ধর্ম লৌকিক-মানুষের প্রণীত এবং বেশ সন্ত্রাসবাদী, ব্যাপার। মানুষ উদ্ভাবনশীল; মানুষের অজস্র উদ্ভাবনের একটি, ও সম্ভবত নিকৃষ্টটি, ধর্ম। ধর্মকে শাশ্বত সর্বজনীন মনে করার একটা চাপ রয়েছে; তবে ধর্ম শাশ্বত নয়, সর্বজনীন নয়।’
তিনি তথ্য-উপাত্ত তুলে না ধরেই, আপন বিশ্বাস ও আবেগে কথাগুলো বলেছেন। একমাত্র ধর্মের বিধি নিষেধ ছাড়া পৃথিবীর কোনো আইনই সার্বজনীন নয়, হতে পারে না। প্রথম পরিচ্ছেদে এ নিয়ে আলাপ করা গেছে। তবু সামান্য কথায় বলা যায়, পৃথিবীতে ন্যায়বিচারের সার্বজনীন মানদন্ড প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না ধর্ম ছাড়া। ধর্মের দেখানো পথ অনুসরণ করা ছাড়া কোনো সার্বজনীন মানদন্ডে পৌঁছানো অসম্ভব।
এছাড়াও অন্য এক জায়গায় তিনি বলেছেন- ‘নাস্তিক হত্যা আর ধ্বংস করে না; কিন্তু ধার্মিক সব সময় হত্যা ও ধ্বংসের জন্যে ব্যগ্র থাকে; তারা ইতিহাসের পাতাকে যুগে যুগে রক্তাক্ত করেছে।’
বিপদগামীদের প্রমাণ ধরে নিয়ে ধর্মকে সন্ত্রাসবাদী এবং ধ্বংসাত্মক একটা ব্যাপার বলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রপাগান্ডা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তারই ধারাবাহিকতায় ধর্ম এবং শান্তি বিষয়টা যে সমার্থক তা বোধহয় লোকে ভুলতে শুরু করেছে। আমি জানি তথ্য উপাত্ত ছাড়া আপনারা কিছুই মেনে নেবেন না তাই আসুন, দেখে নিন তথ্য উপাত্ত কী বলে। কারা আসলে ধ্বংস হত্যার পেছনে দায়ি এবং তাদের আপনি সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেন কী-না। সিদ্ধান্ত নিন, তারা ধার্মিক না অবিশ্বাসী।
নিচে বিংশ শতাব্দির বিভিন্ন যুদ্ধে ও কোনো কোনো শাসকের শাসনামলে নিহতদের সংখ্যা তুলে ধরা হল সংক্ষেপেঃ
১. ১ম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)-------------------------------------------নিহত ১.৫০ কোটি (প্রায়)
২. রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ (১৯১৭-২২)--------------------------------------------নিহত ৯০ লক্ষ (প্রায়)
৩. সোভিয়েত ইউনিয়ন (স্টালিনের শাসনামল (১৯২৪-১৯৫৩)----------নিহত ২ কোটি (প্রায়)
৪. ২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫)-------------------------------------------নিহত ৫.৫০ কোটি (প্রায়)
৫. চীনের গৃহযুদ্ধ (১৯৪৫-১৯৪৯)------------------------------------------নিহত ২৫ লক্ষ (প্রায়)
৬. স্পেনের গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৩৩৯)--------------------------------------নিহত ৩ লক্ষ (প্রায়)
৭. গ্রীসের গৃহযুদ্ধ (১৯৪৩-৪৯)----------------------------------------------নিহত ১.৫৮ লক্ষ (প্রায়)
৮. যুগোশ্লাভিয়া (টিটোর শাসনামল)----------------------------------------নিহত ২ লক্ষ (প্রায়)
৯. প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধ (১৯৪৫-৫৪)-----------------------------------------নিহত ৪ লক্ষ (প্রায়)
১০. ভিয়েতনাম কলম্বিয়া যুদ্ধ (১৯৪৬-৫৮)--------------------------------নিহত ২ লক্ষ (প্রায়)
১১. রোমানিয়ার যুদ্ধ (১৯৪৮-৮৯)-----------------------------------------নিহত ১.৫ লক্ষ (প্রায়)
১২. আলজেরিয়ার যুদ্ধ (১৯৫৪-৬২)-----------------------------------------নিহত ৫.৩৭ লক্ষ (প্রায়)
১৩. সুদানের যুদ্ধ (১৯৫৫-৭২)-----------------------------------------------নিহত ৫ লক্ষ (প্রায়)
১৪. গুয়াতেমালার যুদ্ধ (১৯৬০-৯৬)----------------------------------------নিহত ২ লক্ষ (প্রায়)
১৫. ইন্দোনেশিয়ার যুদ্ধ (১৯৬৫-৬৬)---------------------------------------নিহত ৪ লক্ষ (প্রায়)
১৬. উগান্ডার যুদ্ধ, ইদি আমিনের শাসনামল (১৯৭২-৭৯)------------------নিহত ৩ লক্ষ (প্রায়)
১৭. ভিয়েতনামের যুদ্ধ (১৯৫৪-৭৫)------------------------------------------নিহত ২০ লক্ষ (প্রায়)
১৮. বাংলাদেশ (১৯৭১)-------------------------------------------------------নিহত ৩০ লক্ষ (প্রায়)
১৯. অ্যাঙ্গোলার যুদ্ধ (১৯৭৫-২০০২)------------------------------------------নিহত ৫.৫০ লক্ষ (প্রায়)
২০. কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধ (১৯৭৮-৯১)-----------------------------------------নিহত ২.২৫ লক্ষ (প্রায়)
২১. কোরিয়ার যুদ্ধ (১৯৫০-৫৩)----------------------------------------------নিহত ৫০ লক্ষ (প্রায়)
(সূত্রঃ ইন্টারনেট ও The Devil’s Delusion, Chapter: Nights of Doubt)
বিশ্বাসের দুনিয়া পা রাখার আগ পর্যন্ত আপনাকে কোনো উত্তরই সন্তুষ্ট করবে না। তবু ধর্ম সম্পর্কীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন কেন করেন? এভাবে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি জ্ঞানী, আপনার বুদ্ধিসীমা সাধারণের লেভেলের নয়? নাকি আপনি কেবলই বিশৃঙ্খলাপ্রিয় কপটাচারী?
আপনি যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন তাহলে বিংশ শতাব্দির এই পরিসংখ্যান সম্পর্কে নিরপেক্ষ মতামত ব্যক্ত করবেন এই যে, উল্লেখ্য যুদ্ধসমূহ ধর্মযুদ্ধ ছিল না। বরং শক্তি প্রকাশ, জবরদখল, ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া, শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করা, স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা ইত্যাদিই ছিল এতগুলো লোকের মারা যাবার মূল কারণ।
পৃথিবীর ইতিহাসে যে তিনজন লোক সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে তারা হলো- হিটলার, স্টালিন, মাও-সে-তুং। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সাথে একমত হবেন যে, এইসব ভদ্রলোকেরা ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। ধর্মযুদ্ধ এরা করেননি। স্টালিন এবং মাও-সে-তুং ধার্মিক ছিলেন না এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। হিটলারও প্রকারান্তরে অবিশ্বাসীই ছিলেন। গবেষকরা বলেন, চূড়ান্ত বিজয়ের পর হিটলারের পরিকল্পনা ছিল জার্মানী থেকে চার্চসমূহ নিশ্চিহ্ন করা। কেননা হিটলারের একটাই ধর্ম ছিল- ক্ষমতার লোভ। ক্ষমতা অর্জনের পথে যা-ই এসে দাঁড়াত, সে তা-ই ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত ছিল। এরা সকলেই ধর্ম প্রচারে ভূমিকা রাখেন নি বলে আপনি অবিশ্বাসী হিসেবে স্বভাবতই এদের সন্ত্রাসী বলেন না।
উল্লেখ্য, মাও-সে-তুং এর শাসনামলে প্রায় আট লক্ষ লোককে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে বা খুন করা হয়েছে। কোনো কোনো তথ্য বলে মাও-সে-তুং সাত কোটি, কোনো তথ্যে আছে পাঁচ কোটি, আবার কোথাও আছে দুই কোটির ওপর মানুষের মৃত্যুর জন্যে দায়ি। এ নিয়ে মত বিরোধ আছে। সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সংখ্যা আট লক্ষ পেয়েছি এক জায়গায়, আপাতত সেটাই ধরেছি ।
প্রদত্ত তথ্য উপাত্ত সমূহ কেবলমাত্র বিংশ শতাব্দীর। সমগ্র বিশ্বে মানবজাতির ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর মত ধ্বংসাত্মক শতাব্দী অদ্বিতীয়। এত মৃত্যু, এত ধ্বংস পৃথিবী আর কখনো দেখেনি। অথচ অদ্ভুত বিষয়, এত এত ধ্বংস এবং খুনকে আপনি কখনোই সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড বলেন না। কিন্তু কেন? উত্তরটা যাইহোক এটুকু নিশ্চয়ই বিনয়ের সাথে স্বীকার করবেন যে, উল্লেখযোগ্য ধর্মসমূহ বিংশ শতাব্দীতে প্রচারকার্য শুরু করেনি। নাকি?
বিংশ শতাব্দীকে বরং আপনি উল্লেখযোগ্য বলতে পারেন অবিশ্বাসের উত্থানের জন্যে, পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, ক্ষমতালোভী, হতাশাবাদী মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবার জন্যে। এক্ষেত্রে আপনি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন যে, বিংশ শতাব্দী ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠার পেছনে নিশ্চিতভাবেই আলাদা আলাদা করে অবিশ্বাস, পুঁজিবাদ, ভোগবাদ, ক্ষমতার লোভ, হতাশা ইত্যাদির কোনো একটি অথবা সামগ্রিকভাবে এসব কিছুরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব আছে।
উল্লেখ্য তিন ভদ্রলোক ছাড়াও যেসব নিষ্ঠুর ভদ্রলোকের কথা বক্তব্য সংক্ষেপের উদ্দেশ্যে এড়িয়ে যাব তারা হলো- আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, চেঙ্গিস খান প্রমুখ; ইতিহাসে কোথাও কোথাও এদের মহানায়ক হিসেবে দেখালেও এরা প্রত্যেকেই ছিল সাম্রাজ্যলোভী, ঠান্ডা মাথার খুনি। এরাও অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্যে সরাসরি দায়ি। আমি জানি আপনারা অবশ্যই স্বীকার করবেন, এরা কেউই ধর্মপ্রচারক ছিল না। ধ্বংসযজ্ঞ আর জবরদখল ছিল এদের মূল লক্ষ্য। স্বর্গপ্রাপ্তি নয়। তবুও এদের আপনি সন্ত্রাসী ভাবেন না, কারণ এরা ধার্মিক ছিল না। ধার্মিক হলে হয়তো সন্ত্রাসী বলতেন।
নিষ্ঠুর জাতি হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বৃটিশদের নাম। সাম্রাজ্য বিস্তারের সময়ে এদের মত নিষ্ঠুর জাতি পৃথিবী দ্বিতীয়টি দেখেনি। খোদ আমেরিকার মূল অধিবাসীদেরই মেরে সাফ করে দিয়েছে এরা। আর তারা নিজেদের সভ্য ও আধুনিক লোক বলে দাবি করতো, এখনো করে। এটা ঠিক যে বৃটিশরা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু এরা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল ধর্মপ্রচারের জন্য নয়; ব্যবসা তথা মুনাফার জন্যে, লুটে-পুটে খাওয়ার জন্যে। তিনশ-চারশ বছর ধরে প্রায় গোটা পৃথিবীকে লুটে-পুটে খেয়ে এরা এখন এলিট জাতি হিসেবে বসবাস করছে পৃথিবীর বুকে। অথচ এ জাতিটিকে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য, বর্বর, আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী জাতি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। সাদা চামড়া হিসেবেই কী-না জানিনা, আপনি বরং এদের নীরিহ, শান্তিপ্রিয়, সভ্য ও আধুনিক জাতি হিসেবেই বিবেচনা করতে বেশি ভালবাসেন! এরাও, আপনি ভাল করেই জানেন, স্বর্গের চেয়ে নগদ নারায়ণে বেশি বিশ্বাসী এবং তৃপ্ত। ধর্ম নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই বলে আপনার দৃষ্টিতে এরা সন্ত্রাসী নয়।
মূলকথা, যেসব মানুুষ এবং জাতি উল্লেখিত ধ্বংস এবং মৃত্যুসমূহের পেছনে দায়ি, তারা কেউই বিশ্বাস করত না যে, সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনো একদিন জবাবদিহি করতে হবে। নরকে যেতে হবে। এদের কাছে আকাঙ্খিত ছিল কেবল মাত্র পৃথিবীর জীবন। এরা কখনোই ভাবেনি যে তাদের অন্যায় কাজগুলো স্রষ্টা দেখছেন এবং একদিন হিসাব নেয়া হবে প্রতিটি অন্যায় কাজের। এমনকি তা অণু পরিমাণ হলেও। এটা প্রমাণিত যে, উল্লেখ্য ধ্বংসযজ্ঞসমূহের ভিলেনদের কর্মকান্ডের পেছনে ক্ষমতার লোভ নামক অধর্ম ছিল, ধর্ম কোথাও ছিল না।
ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ কেন?
প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে কেন ধর্মের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চলছে? হুমায়ুন আজাদও বা কেন ধর্মের পেছনে লেগে ছিলেন। সাধারণ অবিশ্বাসী হিসেবে প্রদত্ত ধ্বংসযজ্ঞের তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে আপনার জ্ঞান ও জানা শোনার পরিধি সীমিত হতে পারে, কিন্তু হুমায়ুন আজাদ তো এসব তথ্য জানতেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, মানুষের নিকৃষ্টতম উদ্ভাবন আধুনিক মারণাস্ত্রসমূহ; ধর্ম নয়। তবু কেন তিনি এসব তথ্য চেপে গেলেন? প্রদত্ত যুদ্ধ-বিগ্রহের তথ্য-উপাত্ত কোনোভাবেই এটা প্রমাণ করে না যে, পৃথিবীতে অশান্তির কারণ ধর্ম। বরং পৃথিবীর প্রতি লোভ, সমৃদ্ধ জীবনের প্রতি লোভ, উপভোগ আর ক্ষমতার লোভই সমস্ত অশান্তির কারণ। ধর্ম তো জৌলুসপূর্ণ জীবনের লোভ, উপভোগ ও পৃথিবীর আরাম-আয়েশের লোভ ত্যাগে উৎসাহ দেয়। ইচ্ছেমত ভোগে নিষেধ করে। ইচ্ছেমত মুনাফায় নিষেধ করে। ক্ষমতার অপব্যবহার নিষেধ করে।
ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ আসে মূলত ভোগবাদী মানসিকতা থেকে। একথা ধর্ম বারবার বলে যে, ভোগ নয় ত্যাগই আসল। আর ঠিক এই বক্তব্যই ভোগবাদী/পুঁজিবাদী সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষকে ধর্মের বিরুদ্ধাচারণে উৎসাহিত করে। কেন? কারণ ধর্ম মাদকদ্রব্য নিষেধ করে। ধর্ম মানলে আপনি মাদকদ্রব্য কেনা-বেচা করতে পারবেন না যদিও পৃথিবীতে হাজার কোটি ডলারের মাদকদ্রব্য কেনা-বেচা হচ্ছে প্রতিদিন। ধর্ম জুয়া নিষেধ করে; যদিও হাজার হাজার কোটি ডলারের জুয়া খেলা চলছে পৃথিবীতে প্রতিদিন। ধর্ম পতিতাবৃত্তি নিষেধ করে; যদিও পৃথিবীজুড়ে পতিতালয় ও নীলছবির রমরমা ব্যবসা চলছে। ধর্ম দুর্নীতি নিষেধ করে; অথচ পৃথিবী ব্যাপী দুর্নীতি করে ধনী হয়ে যাচ্ছে অজস্র মানুষ। ধর্ম ধর্ষণ নিষেধ করে; অথচ বিশ্বজুড়ে ধর্ষণ ভয়াবহ ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম ব্যভিচার নিষেধ করে; অথচ ব্যভিচার প্রকট আকার ধারণ করেছে পৃথিবীতে।
ধর্মের বিরুদ্ধাচারণকারীরা কখনোে উপলব্দি করতে পারে না। কী করে একজন মানুষ জীবনে ভোগ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা এড়িয়ে যায়। কী করে পারে তারা? কোথায় তাদের শক্তি? কী করে কেউ কেউ স্রষ্টার অনুগত হয়ে সমস্তটা জীবন কাটিয়ে দেয় সাধারণ হয়ে। সমস্ত সাফল্যের হাতছানি পায়ে ঠেলে? এমন কি তার হাতের কাছে সমস্ত সুযোগ থাকলেও সে সাধারণই থেকে যায়। ধর্মের এবং ধর্মের মানুষগুলোর সেবা করে। এইসব প্রকৃত মানুষেরা বাড়ি চায় না, এদের গাড়ি না হলেও চলে। এদের মাসে-বছরে দু-তিনটা লাক্সারি ট্রিপ লাগে না। বাজারে গেলে সব্বাইকে দেখিয়ে সবচেয়ে বড় ইলিশটা এদের কেনার প্রয়োজন হয় না। দুটো জামা হলেই এদের বছর কেটে যায়। এরা যতটা খায় তার চেয়ে বেশি বিলায়। এমনকি যথেষ্ট সামর্থ থাকলেও তারা ভোগ করে না। এদের একটাই লক্ষ্য- স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। এরাই প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত ধার্মিক। এরা অন্যদেরও একইভাবে চলতে উৎসাহ দেয়। আর এখানেই অন্যদের, বিশেষ করে অবিশ্বাসী এবং ব্যবসায়ীদের সমস্যা। অন্যরাও যদি এদের মত চলতে শুরু করে তবে তো ব্যবসায়ের বারোটা বেজে যাবে, ভোগ-উপভোগে নানান বাঁধা-বিপত্তি আসবে!
কেউ কেউ হয়তো বলবেন কিভাবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের সমস্যা হতে পারে? সহজে বলি তাহলে, ধরা যাক, কোনো এলাকায় জমজমাট পতিতাপল্লী এবং ক্যাসিনো/জুয়ার আড্ডা গুলো বন্ধ করে দেয়া হল। এর সরাসরি রিঅ্যাকশন হিসেবে নীলছবি, মদ, নেশাদ্রব্য, হোটেল ব্যবসা আর কনডমের বাজার পড়ে যাবে; দালালদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। উগ্র প্রসাধনীর বেচাবিক্রি কমে যাবে, এ সংক্রান্ত পার্লারগুলো বসে বসে মাছি মারবে। যৌনতা নির্ভর পোশাকের বাজারে মন্দা দেখা দেবে। কেননা সাহসী নারীদের তুলনায় পতিতারাই মূলত যৌনতা নির্ভর পোশাকে বেশি অগ্রগামী। একইভাবে ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে গেলে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, মদ-নেশাদ্রব্যের ব্যবসা কমে যাবে। পতিতাপল্লী এবং ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে গেলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যাবে। তারা বলবে- কোনোরকম মজা/আনন্দ/বিনোদনের ব্যবস্থা ঐ এলাকায় নাই। যাবোই না শালার ওই এলাকায়। বিদেশি পর্যটক না আসলে এয়ারলাইন্সগুলো, পর্যটনকেন্দ্রগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। পৃথিবীজুড়ে এইসব ব্যবসায়ে জড়িত অসংখ্য মুনাফাখোর ব্যবসায়ী কখনোই এসব ঘটতে দিতে নারাজ। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে মূলত ব্যবসায়ীরা মসৃণভাবে নিজেদের ব্যবসা বাঁচিয়ে নিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ধর্মকে সন্ত্রাসবাদী ব্যাপার-স্যাপার আখ্যা দিয়ে।
ধর্ম দান ও ত্যাগে বারবার জোর দেয়, তাগিদ দেয়, ধৈর্য ধারণে উপদেশ দেয়। এখন ধর্ম মানলে তো এতসব লোভনীয় বিষয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এছাড়াও ব্যবসায়ীরা/পুঁজিবাদীরা ‘সবার ওপরে মুনাফা সত্য তাহার উপরে নাই’ নীতিতে বিশ্বাসী বলে ধর্মকে তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাতিল বিবেচনায় এগিয়ে আসে অথবা কেউ কেউ ধর্মকে নিজের মত আকার-আকৃতিতে সাজিয়ে মুনাফা হালাল করে নেয়। তো পৃথিবীতে ধর্ম মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা বলে, ধর্মকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়ে দিয়ে রীতিমত এটিকে বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হয়েছে। ভীষণ চাতুর্যের সাথে ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ঘৃণার আগুন আরো উসকে দেয়া হয়েছে এক ধর্মকে অন্য ধর্মের পেছনে লেলিয়ে দিয়ে কিংবা একই ধর্মে নানান বিভাজন তৈরী করে। এই ঘৃণার আগুন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে দিনদিন। এখনো হচ্ছে।
হুমায়ুন আজাদও এই ঘৃণার আগুনে পুড়েছেন এবং তিনি একে নিজ সমাজ-দেশের গন্ডীতে আরো উসকে দিয়েছেন। তিনি নিজস্বার্থে ও ইচ্ছায় এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন যা কাউকে না কাউকে একইরকম ঘৃণার আগুন উসকে দিতে লালায়িত করে। যে ঘৃণার আগুন সাধারণের আগ্রহ ও পছন্দের বিষয় এবং সহজ সাধারণ জীবন-যাপনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। একপ্রকার Social dilemma [1] তৈরী করেছেন তিনি সমাজে। এক্ষেত্রে তিনি যে ভোগবাদী/পুঁজিবাদী সমাজের ধারক-বাহক-কর্ণধার ছিলেন তা নয়; বা কেবলমাত্র বইমেলায় বইয়ের কাটতির জন্যে বা বিতর্ক সৃষ্টি করে নিজের নাম ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তা-ও বলছি না। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের আধিপত্য-শৃঙ্খলা-নীতি-শাসন-আদর্শ মেনে নিতে পারতেন না বলেই বরাবর ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। কারণটা অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিগত, সার্বজনীন নয়। অবিশ্বাসীরা মূলত ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণেই ধর্মের বিপরীতে দাঁড়ান।
ধর্মকে অপ্রয়োজনীয়, বাতিল ভাবার মনোভাবকে বৈশ্বিক বা সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার সুযোগ নেই। অথচ এটাকে সার্বজনীন বলে চালানোর চেষ্টায় বিশৃ্খলা সৃষ্টি করে গেছেন কেউ কেউ। এমনিতেও আপনি দেখবেন, যারা অবিশ্বাসী, তারা স্বভাবতই বিশৃঙ্খল, কিছু মাত্রায় সৌজন্যবোধহীন এবং অন্যকে তাচ্ছিল্য করা এদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। এদের কারো কারো খিস্তি খেউড়ের প্রতি আছে দারুণ দুর্বলতা। ভক্তরা এসব দিককে প্রতিভাবানদের বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় উৎফুল্ল হয় এবং কেউ কেউ সচেতনভাবেই বিশৃঙ্খলা, সৌজন্যবোধহীনতার চাষ করে হাজারো সামাজিক-পারিবারিক দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। আর সেই চর্চার নাম দেয় এরা- প্রথাবিরোধীতা। যদিও ব্যক্তিগত উৎসাহে এবং ভোগবাদের পথ সুগমে ধর্মকে আক্রমণ করা মানেই যে প্রথাবিরোধীতা নয়, এটা বুঝতে একজন সাধারণ অবিশ্বাসীর অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে, অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। নিজের চারপাশে তুলে দেয়া দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে জানা-শোনার পৃথিবী বড় করে নিতে হবে।
তালগাছটা আপনারই
“আমার অবিশ্বাস” গ্রন্থের এক জায়গায় আজাদ স্যার বলেছেন, ‘মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি বর্ণনা ধর্মের এক প্রিয় বিষয়; এ-এলাকায় ধর্মগুলো মানুষকে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে লোভের পর লোভ আর ভয়ের পর ভয় দেখায়। মৃত্যুর পর মানুষের পরিণতি সম্পর্কে ধর্মগুলো যা বলে, তা হাস্যকর, যাতে বিশ্বাস করতে পারে শুধু লোভী ও ভীত মানুষ।’
তো এটাই আপনি বলতে চান যে, যারা বর্তমান ত্যাগ করে, পৃথিবীর ভোগকে ‘না’ বলে, সংযত থাকে তারা মূলত লোভী? যৌক্তিকভাবেই আপনি ভুল। যুক্তিহীনতায় আপনার হাস্যকর বসবাস নিত্যদিন। যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্যে বর্তমান ত্যাগ করে তারাই মূলত সুন্দর করে তোলে পৃথিবী। মানবতা তারাই প্রতিষ্ঠা করে, সহানুভূতি এবং মমত্ববোধ তাদেরই সহজাত গুণ। তারা মূলত প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠে ঠিক এই জায়গায় এসে। কেননা একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব বর্তমানের লোভ, ভোগ, আরাম-আয়েশ, উন্নতি, ধন-সম্পদের লোভ এড়িয়ে এক মহত্তর, অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করা। ধর্ম ও স্রষ্টায় বিশ্বাসই কেবল এটাকে সম্ভব করতে পারে।
ধর্ম না থেকে অধর্ম থাকলে সমাজ-রাষ্ট্রের যারপরনাই সুখি চিত্রটা কিরূপ দাঁড়ায় তা পূর্বের পরিচ্ছেদ এ দেখিয়েছি একটি অবিশ্বাসী রাষ্ট্রের উদাহরণ টেনে। তারপরও যদি বলেন একটি মাত্র রাষ্ট্রের উদাহরণে কখনোই বোঝায় না, অবিশ্বাস থাকলেই সমাজ-রাষ্ট্র খারাপ হবে। এমনটাই যদি ভাবেন সেক্ষেত্রে আমাকে অন্যান্য অবিশ্বাসী রাষ্ট্রের মন জুড়ানো সুখের তথ্য-উপাত্ত টেনে আনতে হয় সঙ্গত কারণেই। অন্য রাষ্ট্রগুলোর তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরার আগে অবিশ্বাসীদের জন্যে পূর্বোক্ত রাষ্ট্রের একটি আনন্দঘন তথ্য জানিয়ে রাখতে চাই পত্রিকা মারফত [বাংলাদেশ প্রতিদিন] জানলাম গত তিন বছরে সে দেশে দুর্নীতির জন্যে সাজাপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র দশ লক্ষ!
তাহলে যারা সাজা পায় নি তাদের সংখ্যা কত? ধরা পড়েনি যারা তাদের সংখ্যা কত? আমি অনুমান করতেও ভয় পাচ্ছি। যাকগে, আপনি এই তথ্যও অস্বীকার করতে পারেন। সে অধিকার আপনার আছে। তাহলে আসুন অবিশ্বাসীদের অন্যান্য রাষ্ট্র সংক্রান্ত সুখি তথ্যের দুনিয়া ঘুরিয়ে আনি আপনাদের। আমি আশ্বস্ত করতে পারি, খুশিতে আত্মহারা হবার মত চিত্র দেখবেন আপনারা।
অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্র হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে জাপান। এদেশে সমঅধিকার দূর আকাশের তারা। শ্রেণী বৈষম্য তো আছেই। শ্রমিক ইউনিয়ন গুলো দিনদিন দুর্বল হয়ে পড়ছে সেখানে অথবা সেগুলোকে দুর্বল করে ফেলছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। এদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা অস্বাভাবিকরকম বেশি। সব থেকে মজার এবং বিনোদনমূলক ব্যাপার হচ্ছে জাপানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে। এটা হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়ে যাবার মত তথ্য। যদিও আমি একদম হাসিনি। যে দেশে অবিশ্বাসীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজতন্ত্র কিভাবে সম্ভব? এটা তো অবিশ্বাস্য! বিচিত্র! ভয়ানক অব্যবস্থা! অযৌক্তিক!
তবে হ্যাঁ, জাপানে সম্রাট সকলের মধ্যমণি ও মাথা হলেও ক্ষমতা তার সীমিত। সম্রাটকে মূলত রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক ধরে নেয়া হয়। তবুও অবিশ্বাসীদের ভাষ্য মতে সকল বৈষম্যের কারণ ধর্ম হয়ে থাকলে অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো উচিত, নাকি? কিন্তু ক্ষমতা যতই সীমিত হোক, রাজতন্ত্রের প্রভাব সমাজ-রাষ্ট্রে থাকেই। আর রাজতন্ত্র থাকলে সাম্যের গাল-গল্প বহুত দূর কি বাত, ব্রাদার। রাজতন্ত্র চলমান থাকায় অভিজাতরা দিন দিন আরো অভিজাত আর সাধারণরা দিন দিন আরো সাধারণ বলে গণ্য হয়। এমনকি নারীর অধিকার দেবার বেলায়ও দেশটি পিছিয়ে আছে হয়তো রাজতন্ত্রের প্রভাবেই। রাজনীতিতে নারীদের অবমূল্যায়ণও সেদেশে সাধারণ বিষয়। [Japan’s Growing Political Gender Gap]
একটি সরকারি রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে জাপানে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে বাইরে কাজ না করে নারীদের ঘরে থাকা উচিত! এই তথ্য জেনে চরম হতাশ হয়েছি আমি। এ কী কথা! অবিশ্বাসীদের মানবতা তাহলে কোথায়? কোথায়?
রিপোর্টটির কিয়দংশ তুলে ধরা গেল-
“ ‘There’s no other solution than to use your existing population more. Women comprise 50 percent of the Japanese population; they are highly educated but stop working at a certain age. There are no other options than to take measures to try keeping women on the working track. This is not a feminist point of view but the objective analysis of an economist.’ However, Japanese society doesn’t seem very willing to accept the idea. A poll conducted by the Japanese government in December showed that 51 percent of the population thinks women should stay at home and care for the family while their husbands work”. [Japan Values Women Less ]
আপনি অবিশ্বাসী হলে এসব তথ্যে গুরুত্ব দেবেন না, এ আমি জানি। কারণ, অবিশ্বাস দেয়াল তুলে দেয় মানুষের চারপাশে। যে দেয়ালের বাইরে এমন অনেক কিছুই থাকতে পারে যা অবিশ্বাসীরা কোনো ছকেই এঁকে নিতে পারে না। এমন অনেক জীবন-যাপন থাকে যা ধারণ ও পরিচালনার সুষ্ঠু ব্যবস্থা অবিশ্বাসীরা নিশ্চিত করতে পারে না। এমনকি মানুষের ন্যায্য অধিকারই অবিশ্বাসী সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে না। মানবতা প্রতিষ্ঠা তো আরো দূরের কথা। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত এটাই বারবার প্রমাণ করে। এরপরেও আপনি বলতে পারেন অবিশ্বাসই মানবতা। তবে আপনার এমন বলায় মানুষ বুঝবে- তালগাছটা আপনারই!
আসুন আমরা দেখি, পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের রাজধানী ফ্রান্সে কত সুখ! ফ্রান্সে ড্রাগ এবং মদ্যপানে আসক্তি ভীতিকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর চোর/পকেটমারের উৎপাত ফ্রান্সের প্রধানতম সমস্যা, ক্ষেত্র বিশেষে জাতীয় সমস্যা বলে গণ্য করা হয়। পাশাপাশি দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্ম পালনে বাঁধা এসব তো আছেই। এই রাষ্ট্রটিতে ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। আর নারীদের অবস্থান কতটা নড়বড়ে চলুন দেখি- Women in France earn, on average, 25 percent less than their male counterparts. They make up only 27 percent of the Assembly and 22 percent of the Senate. Only 3 percent of chief executives in France are women. [The Rights of French Women]
নারীদের অত্যাচারের ক্ষেত্রে এদেশটি বেশ এগিয়ে। ২০১৪ সালে করা একটা সমীক্ষা [2] এ তথ্য নিশ্চিত করে। আপনি আমার চেয়ে আরেকটু বেশি পড়াশুনা করে খোঁজ নিলে অবাক হয়ে জানবেন- ফ্রান্স নারীদের ফ্রি মিক্সিং, নগ্নতা, সমকামিতা এবং অবাধ যৌনতার অধিকার যতটা সমর্থন করে, নারীদের মানবিক অধিকার সমূহ ততটা সমর্থন করে না। যেমন নারী-পুরুষ সমতা, পারিবারিক অত্যাচার (মানসিক ও শারীরিক) বন্ধ করা, রাজনীতিতে বেশি বেশি অবদান ইত্যাদি। এমনকি একটি রিপোর্টে [Sexual Harassment On Public Transport] এসেছে দেশটির পাবলিক পরিবহনে প্রায় শতভাগ নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার। আমি বিনীতভাবে রিপিট করছি, সে দেশের যানবাহনগুলোতে শতভাগ নারী যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়। এটা এমন এক তথ্য যা রোমহর্ষক। আপনি ভাবছেন, ছবির মত সুন্দর দেশ ফ্রান্স নিয়ে আমার এত মাথাব্যথা কেন? কারণ অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্র হিসেবে এটি চতুর্থ অবস্থানে আছে।
উল্লেখ্য তথ্য-উপাত্তসমূহ জেনেও আপনি গলার রগ ফুলিয়ে বলতে পারেন, অবিশ্বাসী মাত্রই মানবতার ধারক ও বাহক। তবে তা হবে আপনার আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আপনি আপনার বক্তব্যের স্বপক্ষে সামগ্রিকভাবে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারবেন না। কেননা, এই পরিচ্ছেদের শুরুতেই পৃথিবীর যুদ্ধ বিগ্রহের যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা আপনার বক্তব্য সমর্থন করে না। অবিশ্বাসীদের রাষ্ট্রের যে উদাহরণগুলো (যৌক্তিক প্রমাণসহ) দেয়া হয়েছে, তা আপনার আবেগঘন বক্তব্য সমর্থন করে না। বরং এই মতই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে যে, অবিশ্বাস মানবতার সমাধান নয়। এটি ভুল জীবন-যাপন, ভুল বিশ্বাস, ভুল উপলব্দি এবং ধর্মনির্ভর জীবন-যাপন এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং উন্নত।
অবিশ্বাস কেবলমাত্র ভোগবাদীর সমাধান। পৃথিবীতে প্রাপ্তির হিসেব যতটা মধুর এদের কাছে ততটা মধুর এদের কাছে কিছুই নেই। এরা মূলত পৃথিবীর জাকজমকের প্রতি লোভী। অথচ উল্টোদোষ দেয়া হয় স্রষ্টায় বিশ্বাসীদের প্রতি। মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস করে বলে ধার্মিকরা নাকি লোভী আর ভীত! যৌক্তিকভাবেই এটা অসম্ভব। কেননা আপনি ভাল করেই জানেন, দুনিয়ার প্রতি প্রকৃত বিশ্বাসীদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ-আসক্তি নেই। আর যুক্তি বলে, যে মানুষ নগদ প্রাপ্তি/লাভ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে তাকে আর যা-ই হোক লোভী বলা চলে না। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্যি। অন্যদিকে যার সবটুকু আগ্রহের বিষয় এই দুনিয়ার চাকচিক্য। নিজের প্রাপ্য কণা পরিমাণ হলেও যে মানুষ বুঝে নিতে কার্পণ্য করে না, মানে নগদ প্রাপ্তি/লাভ যে মানুষ ছেড়ে দেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় কখনো ত্যাগ করে না, তাকেই আপনি লোভী বলতে পারেন। ভোগবাদী বলতে পারেন। এরপরও যদি বলেন, ধার্মিক মানেই লোভী; তবে ঠিক আছে, তালগাছটা আপনারই।
স্রষ্টা কেন দেখা দেন না?
কোথাও কোথাও আজাদ স্যার, শিশুর মত সরল ছিলেন। তিনি রাগ-অভিমান ও সমালোচনা প্রকাশে অকপট-সরল ও আবেগি ছিলেন। সবসময়ই। এই কথার সত্যতা মিলবে, কেউ যদি হুমায়ুন আজাদের নাম এবং বইটির নাম লুকিয়ে কেবল পঞ্চম পরিচ্ছেদটি পড়তে দেয় কাউকে, তাহলে সেই কেউ একজন নির্ঘাত বলবে- লেখক মানসিক বৈকল্যে ভুগছে। লেখক ক্রমাগত বকে গেছেন। কখন কি বলছেন তার তাল লয় যুক্তি কিছুই ঠিক নেই। পরিচ্ছেদটি পড়তে পড়তে একসময় তাঁকে বিভ্রান্তই মনে হতে পারে। কোন ধর্ম রেখে কোনটাকে তিনি গাল দেবেন সেটাই স্থির করে উঠতে পারেন নি। তবে অদ্ভুত কোনো কারণে তিনি এই পরিচ্ছেদে যিশু খ্রিস্টের পেছনে লেগেছেন বেশি।
তিনি বলেছেন, যিশু খ্রিস্ট নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। তিনি মিথ ছিলেন, বাস্তব ছিলেন না। তার বাস্তব উপস্থিতির সত্যি ইতিহাস রক্ষিত নেই, প্রমাণ নেই। কিন্তু মজার কথা, হুমায়ুন আজাদ দু’হাজার বছর আগে যিশু খ্রিস্টের জন্ম ও অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও তার সমসাময়িক এবং তারও অনেক আগে বেঁচে থাকা মানুষজন ও ঘটনাবলী ও ইতিহাস ধ্রুব বলে মেনে নিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন! এ-যে দ্বৈত নীতি তা আর ঘটা করে প্রমাণের দরকার পড়ে না।
তবে কেন বিশেষ করে জেসাস ক্রাইস্টের প্রতি তার ক্ষোভ, এর উত্তর খুঁজে পেতে বোধহয় খুব একটা বেগ পেতে হবে না আপনাকে। যিশু খ্রিস্ট অবিবাহিত ছিলেন, সুদর্শন ছিলেন, খুব অল্প বয়সেই তিনি সাধারণ মানুষের মন জয় করেছিলেন এবং জনপ্রিয়তায় সমসাময়িক সকল মানুষকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন; ইত্যাদি বিষয় তরুণ বয়স থেকেই হুমায়ুন আজাদকে ইর্ষান্বিত করে থাকতে পারে। হুমায়ুন আজাদ নারী সংসর্গহীন জীবন কল্পনাই করতে পারতেন না, সুদর্শনও তিনি ছিলেন না, আর সাধারণ মানুষ কখনো তাকে মাথায় তুলে রাখেনি। মনস্তাত্ত্বিকভাবে এ সবকিছুই তাকে যিশু খ্রিস্টের প্রতি ইর্ষান্বিত করে তুলেছিল হয়তো।
যৌক্তিক রাগ-অভিমান-সমালোচনা হুমায়ুন আজাদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। অন্তত আমি তার সম্পর্কে কোনো লেখায় বা কারো স্মৃতি কথায় পাই নি যে তিনি মার্জিত ছিলেন, সহনশীল ছিলেন, যৌক্তিক উত্তর গ্রহণে অমায়িক ছিলেন, ভুল স্বীকারে আগ্রহী ছিলেন। তার সরল বিস্ময়ে করা প্রশ্নগুলোর উত্তরও ছিল সবসময় সহজ ও সাধারণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে কখনো উত্তর চান নি। সঠিক উত্তর খোঁজেন নি। তিনি চেয়েছেন নিজ মতবাদ-ভাবনা কেবল ছুঁড়ে দিতে এবং চেয়েছিলেন ওগুলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। এক দাবানল জ্বলে উঠুক, পুড়ে দিক সব। এতে করে বিশ্ঙ্খৃলা কিছু ঘটলেও তিনি নিজে তো জনপ্রিয় হবেন। তা তিনি হয়েছিলেনও, আর সেটা সম্ভব হয়েছিল কিছু বিভ্রান্ত অনুসারী সৃষ্টির মাধ্যমে। যাদের অবস্থা অন্ধের হাতি দর্শনের মত। যার যার অবস্থানে নিজেদেরই সঠিক ভেবেছে তারা। কিন্তু অন্যেরাও যে নিজ নিজ অবস্থানে সঠিক এবং সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঠিকতা মিলে যে এক বৃহত্তর ধ্রুব থাকতে পারে, এটা তারা কখনো ভাবেনি।
যেমন হুমায়ুন আজাদ এক জায়গায় স্রষ্টা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন- ‘তিনি কেনো শুধু এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন? তিনি কেনো একজনের কাছে বাণী পাঠান? তিনি কেনো শুধু প্রাচীন কালেই দেখা দিতেন? কেনো তিনি দেখা দিচ্ছেন না আধুনিক কালে?’
উদ্দেশ্য যাইহোক, এটা বোঝা যায় যে, তিনি কিছু উত্তর খুঁজছেন। আপনি একজন অবিশ্বাসী হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন স্যারের মতই? আপনি একনিষ্ঠ হয়ে খুঁজলে অবশ্যই উত্তর পাবেন। কিন্তু উত্তরে শত যুক্তি থাকলেও তা মানবেন না। অস্বীকার করবেন, মিথ্যে বলবেন। তাই এখানে পাল্টা প্রশ্ন করি- উত্তর যদি যৌক্তিক হয় তবে কি অবিশ্বাস ছেড়ে বিশ্বাসের পথে হাঁটবেন?- আমি জানি, বেশিরভাগ অবিশ্বাসী বন্ধুরা এ প্রশ্নে নিরুত্তর থাকবেন।
বিশ্বাসের দুনিয়া পা রাখার আগ পর্যন্ত আপনাকে কোনো উত্তরই সন্তুষ্ট করবে না। তবু ধর্ম সম্পর্কীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন কেন করেন? এভাবে কী প্রমাণ করতে চান? আপনি জ্ঞানী, আপনার বুদ্ধিসীমা সাধারণের লেভেলের নয়? নাকি আপনি কেবলই বিশৃঙ্খলাপ্রিয় কপটাচারী?
যাইহোক, অল্পকথায় বলতে গেলে কেন স্রষ্টা কেবল একজনের সাথেই যোগাযোগ করেন, এর উত্তরে একটু ভেবে দেখুন- একটি দেশে একই সময়ে দুটি সরকার থাকলে কি অবস্থা ঘটবে? কি পরিমাণ বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি ছড়াবে? একইভাবে স্রষ্টা যদি দুজন ধর্মপ্রচারককে একই সাথে, একই সময়ে বাণী দিতেন তাহলে কেবল বিভ্রান্তি ও বিশ্ঙ্খৃলা ছড়াতো, স্রষ্টার সত্যিকারের বাণী নয়। পৃথিবীর প্রধানতম ধর্মগুলো নিয়ে পড়াশুনা করলে দেখবেন, সবচেয়ে যোগ্য ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী মানুষগুলোই এককভাবে ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন। তারা যদি কোনো ক্ষেত্রে একের অধিক হতেন, তবে অবশ্যই ধর্মপ্রচারে বিঘ্ন ঘটতো।
এরপরের প্রশ্ন, কেন স্রষ্টা প্রাচীনকালেই দেখা দিতেন? আধুনিক কালে কেন দেখা দেন না? আগেই এক পরিচ্ছেদে আলোচনা করেছি ‘আধুনিকতা’ ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গীর বিষয়। নিউটনের যুগের মানুষ ভাবত, তাদের যুগের চেয়ে আধুনিক কোনো যুগ হয় না। একইভাবে আইনস্টাইনের যুগের লোকেরাও তা ভাবতো। এমনকি এরিস্টটলও নিজের যুগকে আধুনিক ভেবে গেছেন। আজকের যুগে এসে আমরা জানি, সেইসব লোকেদের দাবি কী হাস্যকর। সেইসব লোক কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ফেসবুক, মহাকাশযান এসব না দেখেই নিজেদের আধুনিক বলেছে। আরে আধুনিক তো আমরা মশাই! একই ভাবে কয়েকশ বছর পর আমাদের প্রাচীন বিবেচনা করে তৎকালীন মানুষেরা হাসাহাসি করবে।
আধুনিকতা ব্যপারটা সুনির্দিষ্ট বা স্থির নয়। এভাবে দেখলে আধুনিক-প্রাচীন বলে কোনো বিষয় থাকে না। আধুনিক যুগের জায়গায় আমি সমসাময়িক যুগ বলতে বেশি ভালবাসি। আর সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য হতে গেলে কিছু একটাকে আধুনিক, মানে আপনার সমসাময়িক কালের হতে হবে, এটা যৌক্তিক নয়।
হ্যাঁ, স্রষ্টা অতীতে তার মনোনীত মানুষদের সাথে সরাসরি বা মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন। তো সে যোগাযোগটা আর এখন হয় না কেন? কারণ, স্রষ্টার সংজ্ঞা-প্রকৃতি-উদ্দেশ্য যখন থেকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তখন থেকেই স্রষ্টার আর নতুন করে মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে না।
হ্যাঁ, স্রষ্টা অতীতে তাঁর মনোনীত মানুষদের সাথে সরাসরি বা মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু দেখা দিয়েছেন এমনটি নয়। তো সে যোগাযোগটা আর এখন হয় না কেন? কারণ, স্রষ্টার প্রকৃত সংজ্ঞা-প্রকৃতি-উদ্দেশ্য যখন থেকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তখন থেকেই স্রষ্টার আর নতুন করে মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে না।
স্রষ্টা মহাজ্ঞানী বলেই সব মানুষের সামনে অলৌকিক প্রমাণ দেন না নিজের অস্তিত্বের। বরং দেখা না দিয়ে তিনি পরীক্ষা করেন মানবজাতিকে। অদেখা মহাশক্তিধর স্রষ্টায় বিশ্বাস স্থাপনই মানুষের মূল পরীক্ষা। স্রষ্টা এভাবে পরীক্ষা করে দেখেন কারা কত বেশি বিশ্বাসী, মানবিক, সত্যবাদী, সহানুভূতিশীল, পরোপকারী, ন্যায়বিচারক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল, প্রকৃত ধর্মপালনকারী ইত্যাদি। আর এই সকল মানুষের জন্যেই মৃত্যুর পর রয়েছে অশেষ পুরস্কার, সীমাহীন আনন্দ।
চলবে......
- Social dilemma is a situation that can tempt a person to seek a selfish gain by putting the interests of other people at risk.
- European Union Agency for Fundamental Rights, Violence against women, March 2014 survey.









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন