চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

গন্ধ

গন্ধ | আশিকুর রহমান তানিম


শুরুটা কবে হয়েছিলো আজ আর ঠিক মনে পড়ছে না আতিকের।
খুব সম্ভবত আব্বা যেদিন মারা গেলো ঐদিন। দু'দিন আগেই শাকরাইন ছিলো। তখনো বেচারাম দেউড়ির গলিতে গলিতে উৎসবের আমেজ কাটেনি। তার মাঝেই আব্বা একরাতে মারা গেলেন। রাতের খাবার খেয়ে ছাদে উঠেছিলেন সিগারেট ধরাতে; সিগারেট পুরোটা শেষ হওয়ার আগেই স্ট্রোক করেন। হাসপাতালে নেয়াও এক ঝক্কি পুরান ঢাকায়। চিপাগলিতে অ্যাম্বুলেন্সও ঢোকে না। রিকশায় আসতে আসতে পথেই মারা গেলেন আব্বা।
তার একটু পরই প্রথমবারের মত আতিক ব্যাপারটা টের পায়। ধক করে নাকে এসে লাগে গন্ধটা। জীবনে প্রথমবারের মত পেলেও তাকে বলে দিতে হয়না যে, এটা পাপের গন্ধ। গন্ধটা যে খুব বাজে, তা কিন্তু না। অন্যরকম একদম অপার্থিব একটা গন্ধ। বাসায় ফিরে দেখে আম্মা, চাচা-চাচী, ছোটবোন আফসানা সবাই মাতম করছে। অথচ আতিক তখনো বিহ্বল সেই গন্ধ নিয়ে। গন্ধের উৎসও বুঝতে পারছে না কিছুতেই।
কুলখানির দিন প্রথমবারের মত আতিক ঠিক করে সে কাউকে বলবে গন্ধের কথা। সবচেয়ে কাছের মানুষ হিসেবে পাপের গন্ধের কথা জানার অধিকার পায় তার মা। কিন্তু, আম্মা তখনো আব্বার শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, তাই এসব আজগুবি ব্যাপারে পাত্তা দেয়না শুরুতে। কাকে বলবে কাকে বলবে ভাবতে ভাবতে আতিক মিলাদ পড়াতে আসা হুজুরকে একটু সাইডে নিয়ে এসে বলে এসব কথা। হুজুর কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ''বাবা এইছব আল্লাহপাকের ইশারা হইতে পারে। কিন্তু, তুমি ক্যামতে বুঝলা যে এইটা পাপেরই গন্ধ? এইটা তো নেকীরও গন্ধ হইবার পারে!''
আতিক এর কি জবাব দেবে? আতিক হুজুরকে বুঝাতে চেষ্টা করে, ''চাচা, আমি পয়লাবার নাকে যাওনেই বুঝছি এইটা ভি পাপেরই গন্ধ। জিব্বার সাদ তিতা না মিঠা এইটা যেমুন কাউরে শিখান লাগে না, এমনে আমারেও এইটা কওন লাগেনাই, আমি নিজে নিজেই বুজছি!'' হুজুর আর কি বলবে, পরের জুম্মাতে নামাজ শেষে তাকে থাকতে বলে, তাকে নিয়ে বিশেষ তওবা করবে। হুজুর প্রবোধ দেয় তাকে যে, মাঝে মাঝে আল্লাহ গোণাহগার বান্দাকে শোধরানোর তৌফিক দেয়। আতিক পূণ্যবান বলেই এই সুযোগ পেয়েছে।
একটু দম নিয়ে বলে, ''দ্যাখেন, এইরকম এক-আধটা সম্পর্ক তো আজকাল সব ভার্সিটির স্টুডেন্টগোই থাকে। আপনেরও ছিলো। খামাখা! অই পোলা আপনারে বিয়া করতে পারবো না। আমি না করলেও আরেকজন ঠিকই করবো। এর চেয়ে আপনারে মাশাল্লাহ আমার পছন্দ হইছে। লন, আমরাই বিয়া কইরা ফেলি। সমস্যা নাই, আস্তে ধীরে সব ভুইলা যাইবেন, দেইখেন। আর, বাচ্চা-কাচ্চা হইলে, ঘর-সংসার হইলে পুরান প্রেমের টাইম কই?''
এরপর প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। আতিক তওবা করেছে, মানত করেছে, নিয়ম করে কয়দিন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছে, মেয়েছেলের দিকে তাকায়নি, থুতনিতে ছাড়াছাড়া ভাবে যে কিছু দাঁড়ি ছিলো সেগুলোও কামায়নি, দেখতে ছাগলের মত লাগলেও। কিন্তু, খুব একটা ফল হয়নি। সেই পাপের গন্ধ তার পিছু ছাড়েনি। প্রথমটায় খুব কষ্ট হত। পাপের গন্ধ পেত, কিন্তু, গন্ধের উৎস বুঝতো না। আস্তে আস্তে আতিক বুঝলো, চারিদিকেই আসলে পাপের এত ছড়াছড়ি যে আলাদা করে নির্দিষ্ট গন্ধের উৎস পাওয়া মুশকিল। একবার সিলেটে মালনীছড়া চা বাগানে বেড়াতে গিয়ে অনেকদূর একা একা হেঁটে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ করেই টের পেলো গন্ধটা আর পিছু পিছু আসছে না। যান্ত্রিকতা আর পাপ এমনভাবেই মিশেছে যে, পাপের গন্ধ সবসময়ই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। সারাক্ষণ মনে হয়, বিশাল এক বোঝা কেউ তার মাথার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে কিছুটা অভ্যেস হয়ে গেছে অবশ্য। এখন তো বরং মাঝে মধ্যে একটু আক্ষেপ হয় যে, আহহ! যদি পূণ্যের গন্ধও পাওয়া যেত! অবশ্য, আতিক বিশ্বাস করে, একদিন হয়তো সেটাও পেয়ে যাবে।
এইভাবেই আতিকের জীবন কেটে যাচ্ছিলো। একদিন মা দুম করে ডেকে বলে, ''আতিক্যা বহুত রঙ লাগাইছো গতরে, এইবার বিয়া-শাদী কর।''
ব্যাস। মার উপর তো কথা চলে না। সম্বন্ধ দেখতে দেখতে বাবুবাজারের এক ব্যাবসায়ীর মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তার। মেয়ে মাশাল্লাহ দেখতে সুন্দর। অনার্সে পড়ে। নাম রুবি। আতিকও রাজি হয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধবের চাপাচাপিতে দুইজন মিলে একদিন ধানমন্ডি একসাথে খেতেও যায়। আতিক অবাক হয়ে খেয়াল করে, এই মেয়েটার সাথে থাকা অবস্থায় পাপের গন্ধ পাচ্ছে না সে । মেয়েটার মাঝে কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব আছে। মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে যেন মনে হয় একসাথে কয়েকটা মসজিদে মাগরিবের আজান দিয়েছে, ছাদে ছাদে কবুতর ডানা ঝাপটাচ্ছে ঘরে ফেরার জন্য; কেমন মন খারাপ লাগে।
মেয়েটা চুপচাপ; তারপরও একবার আমতা আমতা করে কি যেন বলতে চায়। আতিক বুঝতে পারে, মেয়েটা তার প্রেম কাহিনী বলবে। একসময় বলেও ফেলে। ছেলেটা সাতক্ষীরার। একসাথেই পড়ে দুজন। ছেলেটার চাকরি পেতে পেতে কমসে কম আরো দু বছর! এতদিন তো বাবা বসে থাকবেনা। বাবাকে ভয়ে বলতেও পারছে না। তাই আতিককে বলা। আতিক কি বলবে কিছুক্ষণ বুঝতে পারে না। মায়ের কথা, বিয়ের সব এন্তেজামের কথা মনে পড়ে।
একটু দম নিয়ে বলে, ''দ্যাখেন, এইরকম এক-আধটা সম্পর্ক তো আজকাল সব ভার্সিটির স্টুডেন্টগোই থাকে। আপনেরও ছিলো। খামাখা! অই পোলা আপনারে বিয়া করতে পারবো না। আমি না করলেও আরেকজন ঠিকই করবো। এর চেয়ে আপনারে মাশাল্লাহ আমার পছন্দ হইছে। লন, আমরাই বিয়া কইরা ফেলি। সমস্যা নাই, আস্তে ধীরে সব ভুইলা যাইবেন, দেইখেন। আর, বাচ্চা-কাচ্চা হইলে, ঘর-সংসার হইলে পুরান প্রেমের টাইম কই?''
এরপর মহা ধুমধাম করে বিয়া শাদী হল। পুরোনো পাপের গন্ধ যে বিয়ের অনুষ্ঠানে এতটা প্রকট হয়ে উঠবে, আতিক নিজেও বুঝেনি। কোলের কয়েকটা পিচ্চি ছাড়া সব অতিথিই মনে হয় চলমান পাপের ডিপো। পাপের গন্ধে আতিকের নাকে কাচ্চির ঘ্রাণও লাগে না। যাই হোক, সব ঝুট-ঝামেলা শেষে নিজের ঘরে ঢুকে আতিক। ভালোই সাজিয়েছে রুমটা। পাপের গন্ধ এখানে আশ্চর্যজনক ভাবে অনুপস্থিত। বরংচ কিছুটা গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস ফুল, দামী পারফিউমের সুবাস ছড়াচ্ছে চারপাশে।
আতিক যখন বিছানায় শুয়ে নিজের বউয়ের ঠোঁটের কাছে মুখ আনে। তখনই সেই পাপের গন্ধটা আবার ধক করে এসে নাকে লাগে। আজকে যেন আগেকার যেকোন সময়ের চেয়েও বেশি প্রকট। মাথার নিউরন সেলে গিয়ে লাগে একদম! আতিক তাড়াতাড়ি উঠে আসে। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধোয়। নাহ, গন্ধ যাচ্ছে না। কিছুতেই না। কেমন অসহ্য লাগতে থাকে সবকিছু। ছাদে চলে যায় আতিক একবারে। গন্ধটাও যেন পিছু পিছু আসে আতিকের। কিছুক্ষণ একলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আতিক।
নিজের চারপাশে প্রথমবারের মত নিজের পাপের গন্ধ টের পেয়ে রুমে ফেরত আসে। রুবি এখনো ঘুমায়নি। কাঁদছে। আতিক মস্তিষ্কে পাপের গন্ধ সংক্রান্ত তীব্র যন্ত্রণা নিয়েই বলে, ''ঘুমায় যাও। রাইত অনেক হইছে। টায়ার্ড হইয়্যা গেছো নিশ্চয়ই। কাইলকা তোমারে আমি তোমগো বাইত লইয়্যা যামু। তোমার বাপরে সব বুঝায় কমু নে। আরে কানতাছো কেলা? আমি দায়িত্ব নিলাম তো!''
রুবি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আরো বেশি কাঁদতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বোধহয় কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। আতিক এখন আর চেষ্টা করেও পাপের গন্ধটা পায় না। রুবির পাশে শুয়ে চুলে শ্যাম্পুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেই গন্ধে আতিকের মাতালের মত লাগতে থাকে। একবার চুলগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে আতিকের... খুব!

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই