সুশীল দাসের বাঁশের গল্প | শামিম রহমান আবির
ময়নার হাট গ্রামের বৃদ্ধ সুশীল দাস গত কয়েক মাস যাবত স্থানীয় চেয়ারম্যানের লোকজনের পেছনে পেছনে ঘুরছে তার ঝাড়ের বাঁশগুলো ফেরত পাবার জন্য। মনটা খুব খারাপ। স্থানীয় চেয়ারম্যানের লোকজন তার বাঁশ ঝাড়ের সব বাঁশ কেটে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকমাস আগে। সেই আগস্টে। কোথাকার কোন বড় নেতা নাকি ময়নার হাটের উপর দিয়ে গিয়ে পাশের গ্রামের কোন জায়গায় ফুল দিতে গিয়েছিল। নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ হয়েছে সেখানে। বড় নেতার যাওয়ার পথে বিশাল বিশাল তোরণ বানাতে হয়েছিল। এই খরচ বাবদ এলাকার চেয়ারম্যান সব জায়গা থেকে চাঁদা তুলেছে। দুই মাইল রাস্তায় বিশটা তোরণ বানানো অনেক খরচের ব্যাপার। বড় নেতার নেক নজরে পড়া দিয়ে কথা, কোন কিছুতেই জাঁকজমকের কমতি রাখতে চান নি তিনি।
যেহেতু সুশীল দাসের চাঁদা দেয়ার সামর্থ্য ছিল না তাই তার বাঁশঝাড়ের বাঁশ দিতে হয়েছে। পাশের বাড়ির খবির মৃধাদের দিতে হয়েছে পাট। দড়ি বানানোর জন্য। সুশীল দাসের সম্পদ বলতে ছিল চারটা বাঁশঝাড়। এমনিতে ছেলে নাই তার, চারটা মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন বুড়াবুড়ি থাকেন শুধু বাড়িতে। মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে সব কিছু খুইয়েছেন। এখন ভিটা-বাড়ি আর বাঁশঝাড়। বাঁশ বিক্রি করেই চলতো তার সংসার। তাই যখন চেয়ারম্যানের লোক তার কাছে গিয়েছিল তখন সুশীল বাঁশ দিতে চায় নি। কিন্তু চেয়ারম্যানের লোকজনের সাথে যদি পেরেই উঠবে তাহলে সুশীল আর লোকজনের পেছনে ঘুর ঘুর করবে কেন? জলে থেকে কুমীরের সাথে লড়াই করবে কিভাবে সে। তার উপর লোকজন কথা দিয়েছিল বড় নেতার চলে যাওয়ার পরে বাঁশগুলা তাকে ফেরত দেয়া হবে। সে কারণেই তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করা। তা হলেও অন্তত কিছু পাওয়া যাবে। বাঁশগুলাকে কেটে শুকিয়ে লাকড়ি বানানো যাবে।
আরও কিছুদিন ঘুরার পরে একেবারে নিরুপায় হয়ে সুশীল দাস চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করল। যদিও সেটা খুব সহজ ছিল না তবুও ভাগ্যগুনে সে সুযোগ পেয়ে গেল। চেয়ারম্যান খুব ব্যস্ত। এই ডিসেম্বরে ময়নার হাট গ্রামেই নাকি কোন মন্ত্রী আসবে। হাইস্কুল মাঠের পূর্বপাশে যে স্মৃতিসৌধ হয়েছে তার উদ্বোধনের জন্য। সে কারণে সবার মধ্যে চঞ্চলতা। এমন কিছু করতে হবে যাতে মন্ত্রী মহোদয়ের নজরে পড়া যায়।
- তো কাকা বলেন। কি সমস্যা? সংক্ষেপে বলবেন। মন্ত্রী মহোদয় আসবে। দম ফালানোর সময় নাই।
- বাবা, আমার বাঁশগুলা। না হইলে অন্তত বাঁশের দাম।
- কিসের বাঁশ?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার নিজস্ব লোকজনের দিকে। তাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন তার কানে কানে তাকে জানালো বড় নেতার জন্য বানানো তোরণে ব্যবহার করা সে বাঁশগুলো বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। টাকা পয়সার কাজ কি বাঁশ দিয়ে হয়? চেয়ারম্যান সাহেব কথাগুলো শুনলেন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। খুব ব্যস্ত তিনি।
- কাকা, আপনার বাঁশগুলা গ্রামের উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়েছে। ঐ বাঁশগুলা ঐ যে গাছ লাগানো হয়েছে তার বেড়া দেয়ার জন্য লাগানো হয়েছে। তারপরেও আপনার যেহেতু সমস্যা, এই কাকারে দুইশ টাকা দিয়ে দে।
দুইশ টাকা হাতে নিয়ে সুশীল দাস বুঝে উঠতে পারেন না কোথায় কোন গাছে বেড়া দেয়ার জন্য তার বাঁশ লাগানো হয়েছে। তার থেকেও বড় একটা ভয় তার মনে। মন্ত্রী কি বড় নেতার থেকে বড় কিনা কে জানে? বড় নেতা গ্রামের উপর দিয়ে গেছে তাতেই তার বাঁশঝাড় সাফ হয়েছ।, মন্ত্রী যদি নেতার থেকে বড় হয় তাহলে তার ঘর থাকবে কিনা কে জানে।
কারণ বাঁশঝাড়ের বাঁশ এখনও বড় হয় নাই। প্ল্যালাকার্ড না কি জানি কয়, ঐ যে শ্লোগান লেখা থাকে, সেটা তো বাঁশের চাটাইয়ের হয়। সুশীল দাসের মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের এক শীতল শঙ্কা বয়ে যায়; কারণ, তার ঘরের বেড়া যে বাঁশের চাটাইয়ের!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন