চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

নীল

নীল | মাসুম সরদার  


১.

-এই শুনছো!
-হুমমমম।
-সকাল হয়ে আসছে তো ওঠো গোসল করে নাও। ইচ্ছে করছে না, আর একটু ঘুমিয়ে নিই।
-না ওঠো। একটু পরেই কিন্তু আম্মু উঠে যাবে তখন বুঝবে কেমন লাগে ঘুম। ওঠো প্লিজ, আমি নাস্তা রেডি করছি। কই ওঠোনা........
-উমমমমমমমমম যাও তো সাত সকালে আর বিরক্ত করনা। এবার একটু আরামে ঘুমোতে দাও প্লিইইইইইইইইইইইইজ। -দাঁড়াও ছুটাচ্ছি তোমার আরাম।
নীল আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ডাক নাম পুতুল। মাঝেমধ্যে অতি আদরে জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা তোমার এই পুতুল নামটি কে রেখেছে? কেন রেখেছে?
প্রায়শই এই বলে সদ্য গোসল করে আসা নীল তার মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে আমার মুখে ধরে ভিজিয়ে দিতো কয়েক ফোটা ভালোবাসা মেশানো শ্যাম্পু করা চুলের সুগন্ধি জলে। ঠিক এমনই একটা সুখী-সুন্দর সংসার ছিলো আমার আর নীলের। সাথে মা আর ছোট বোন রুপা। বেশ কিছু মাস হয়ে গেলো, নীল আর সেই আগের মতো আমার ঘুম ভাঙাতে আসেনা। অনেক অভিমানের পরে এসে বলেনা sorry আমার ভুল হয়ে গেছে আর এমন হবেনা। সেই আগের মতো সন্ধ্যা হলেই দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেনা আমার ফেরার জন্য । বাসায় ফিরলেই একটা মুচকি হাসি হেসে বলেনা- এই তোমার সময় হলো? আমার বুঝি একা একা থাকতে কষ্ট হয় না? যাও ফ্রেশ হয়ে নাও একসাথে খাবো।
নীল আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ডাক নাম পুতুল। মাঝেমধ্যে অতি আদরে জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা তোমার এই পুতুল নামটি কে রেখেছে? কেন রেখেছে?
কারণ ওর কথা, হাঁটাচলা, শারিরীক গঠন সবকিছুতেই আমি খুঁজে পেতাম মানুষ রূপের এক জীবন্ত পুতুলের মন মাতানো ছায়া।
ও বলতো- সে আমি জানিনা। তবে এটা জানি নামটা আমার আব্বু রেখেছে। আব্বু ছাড়া আর কেউ আমাকে এই নামে ডাকে না।
আমি তাকে পুতুল বলে ডাকতে অনীহা জানাই। বলি তোমার এ নাম আমার ভালো লাগেনা। জীবনের প্রথম রাতেই পছন্দ আর অপছন্দ নিয়ে তার সাথে আমার দ্বন্দ্ব বাধে। শেষে তাকে তার পছন্দ মতোই একটা নাম দেই- নীল। নীলের সাথে আমার পারিবারিক আত্মীয়তার সুত্র থাকলেও সে আত্মীয়তার লেজ ধরে আমাদের মাঝে কখনো মন দেয়া নেয়ার সম্পর্ক গড়ায়নি। সম্পূর্ণ পারিবারিক সম্মতিতেই আমাদের বিয়ে হয়। একদিন অফিসের কাজে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে হয় আমাকে। হোটেল ভাড়া বাঁচানো আর পুরোনো ক্ষয়ে যাওয়া এক আত্মীয়তার বন্ধন নতুন ভাবে ঝালাই করে নিতেই সেদিন নীলদের বাসায় যাওয়া । নীলদের বাসায় যাওয়ার আগ মুহুর্তেও ভাবিনি যে, সেখানে গেলে এতো সুন্দর কোনো এক নারীর দেখা পাবো। শেষ বার যখন নীলকে দেখেছিলাম তখন সে পাঁচ কি ছয় বছরের এক পুঁচকে খুকি। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের আল্লাদি মেয়ে। প্রথম দেখাতেই তাকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। শেষে চট্টগ্রাম এসে কারো কোনো সাহায্য ছাড়াই নীলের আম্মুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই। প্রথমে তার আম্মু আমাকে পাগল ভাবলেও পরে বুঝতে পারে আমি সিরিয়াস। শেষতক দুই ফ্যামিলির অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিয়ে।
বেশ ভালোই চলছিলো ছোটখাটো নতুন সংসার। নীলের খুব স্বপ্ন ছিলো একটা ফুটফুটে বাচ্চার মা হওয়ার কিন্তু তার বয়স আর আমার চাকরির কথা ভেবে বাচ্চা নেয়া হয়ে ওঠেনি। একদিন রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম দুজনে। রাত তখন কত ঠিক মনে নেই। হঠাৎ নীলের ফোন বেজে উঠলো। আমার ঘুম ভাঙার পরেও চুপচাপ ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলাম। নীলকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি, বিশ্বাস করি। দুই বছরের সংসার জীবনে কখনোই কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস বা সন্দেহের চোখে দেখিনি। দেখলাম, ও নাম্বারটা দেখে রিসিভ না করেই কেটে দিলো।

২.

নীল আর আমি দুজন দুজনার হাতে হাত রেখে হেটে চলছি পতেঙ্গা সমুদ্র শৈকতে। অবশ্য হঠাৎ করে সমুদ্র পারে বেড়ানোর জন্যে প্রস্তুত ছিলনা নীল। কিন্তু আমি একপ্রকার জোর করেই নিয়ে আসলাম তাকে। সূর্যটা সমুদ্রের গর্ভে বিলীন হয়েছে বেশ খানিকটা সময় হয়ে গেলো। চাঁদহীন আকাশ গভীর অন্ধকারে ছেয়ে আছে। দশ বিশ হাত দূরত্বের মানুষ গুলোকেও যেন অদৃশ্য ছায়া মনে হচ্ছে। হঠাৎ নীলের ফোন বেজে উঠলো। নীল নাম্বারটা দেখেই অসস্তিতে পড়ে গেলো।
আমি সহানুভূতি দেখিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম রিসিভ করো, কথা বলো, দেখো কে? পরিচিত কেউ হতে পারে। ও রিসিভ না করে কেটে দিলো। আমি কিছুই বললাম না। ও জানে আমি কখনো ওর মোবাইলে হাত দেইনা, সেও দেয়না। একদিন নীল রান্না নিয়ে খুব ব্যস্ত, আমি শুয়ে আছি। পাশেই মাথার কাছে নীলের ফোনটা। কোনো উদেশ্য ছাড়াই নীলের মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ অপশনে গেলাম। কিছু মেসেজ পড়ে নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, নীল কি তাহলে............????
এই প্রথম নীলকে আমি সন্দেহ করতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে নীলের আচরণ আমার মনে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের জন্ম দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে অফিস টাইমে নীলের ফোন বিজি হতে লাগলো। মধ্য রাতেও কখনো কখনো মিস্ডকল, বা কল, ঘনঘন মেসেজ টোন আমাকে ভাবাতে বাধ্য করলো। আমি কিছুই বলতাম না তাকে। শুধু সঠিক রহস্য বের করার চেষ্টা করলাম। তার সব মেসেজ কপি করে আমার ফোনে নিয়ে নিলাম। ছোটবোনকে কিছুটা খুলে বলাতে সেও সাহায্য করলো। সে ভাবতো নীল হয়তো আমার সাথেই কথা বলে। একদিন রাতে নীলের মোবাইলে খুব বাজে একটা মেসেজ আসলো। মোবাইল তখন আমার হাতেই।
আমি নীলকে মেসেজটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম এটা কে দিয়েছে? এসবের মানে কি নীল???
সে কিছুই বলতে পারলো না। চুপ করে রইলো। আমাকে চালাকি করে বোকা বানানোর মতো মেয়ে নীল এখনো হয়ে উঠতে পারেনি। কোন জবাব না পেয়ে রাগে-ক্ষোভে আমি নীলকে একটা চড় দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম- হে আল্লাহ এই ঘটনার আগে আমার মৃত্যু হলো না কেনো।
নীলও চোখে টলমল পানি নিয়ে শুয়ে পড়লো। সকালে উঠে দেখি নীল বাসায় নেই। অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে বিল্ডিং এর ছাদে গিয়ে দেখি ছাদের এক কোণে একটা ইটের নিচে নীলের গায়ের একটা ওড়না চাপা দেয়া। ছাদ থেকে নিচে তাকাতেই দেখলাম প্রায় ৫0 ফুট নিচে শুয়ে আছে নীল। এর পর আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি নিথর নিষ্প্রাণ হয়ে ঘরের মেঝেতে পরে আছে নীল। যে নীল রোজ সকালে আমার ঘুম ভাঙাতে ব্যাকুল থাকতো, ঠিক তেমনই এক সকালে আজ নীল নীরব। কিছু একটা বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছেনা। শুধু চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে নীলের ডান হাতটা ভাঙ্গে গেছে । মাথার চুলে জমাট বেধে আছে রক্ত। বাড়ি ভর্তি শুধু মানুষ আর মানুষ। সবার মনেই শুধু একটাই প্রশ্ন কেন এমন করলো নীল। কেবল আমার কিছুই বুঝতে আর বাকি রইলনা । বুঝতে পারলাম কেন সে এমন করেছে। নীলের বাবা মা আসলো। আত্মীয় স্বজন আসলো। পুলিশ আসলো। কেউ আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করলনা। এমনকি আমার মা-ও না। মা কখনোই নীলের কোনো কথা কোনো কাজে বিন্দুমাত্র অসুখী ছিলেন না। মা কখনোই তাকে পুত্রবধূ হিসেবে ভাবতেন না। ভাবতেন এটা তার নিজের পেটের মেয়ে। মায়ের কান্না জরিত বিলাপে যেন পুরো দুনিয়াটাই আজ ভারি হয়ে উঠলো। নীলকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামে। আর আমাকে জেলে।
দুমাস পর ধরা পরলো সেই ফোন করা ব্যাক্তি নীলের আপন ফুপাতো ভাই সাহেদ। বেরিয়ে আসলো আসল কাহিনী। সেও বুঝতে পারেনি তার এহেন পাগলামীতে ঘটে যাবে আমার জীবনের এতো বড় একটা দূর্ঘটনা । সেই রাতে নীল তার ডায়েরিতে লিখেছিলো- আমি জানি নিজের অজান্তেই হয়তো আমি তোমাকে অনেক বড়ো কষ্ট দিয়ে ফেলেছি যা তুমি কখনোই আমার থেকে আশা করোনি। তবু কি করে অবিশ্বাস করলে সেটাই ভেবে পাইনি। কষ্ট হয়েছে ভীষণ। তোমার মুহূর্তের অবিশ্বাসও আমার জন্যে সহ্য করা কঠিন। তাই আমি আমার জীবনের মায়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি! তোমার উপরে আমার কোনো রাগ বা অভিমান নেই। তুমি সত্যিই অনেক ভালো। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।
ইতি নীল।
দুমাস সতের দিন পর ছাড়া পেলাম জেল থেকে। নীলের বাবা মা এসে বাসায় নিয়ে গেলো। বুঝালো স্বাভাবিক হতে। আমি কিছুই মেনে নিতে পারলাম না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারলাম না।সারাক্ষণই নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে। তবু অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নীলের স্মৃতি বুকে বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে হয় বলে বেঁচে আছি।

লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই