চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

এক টুকরো কাঁচের স্বপ্ন

 এক টুকরো কাঁচের স্বপ্ন ।। রহমান মিজান

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। বাড়ির সামনে খালি একটি জায়গা। বর্ষা হলে পানিতে ভরে যায়। বৃষ্টির পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ জায়গাটি। বিশাল সাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা শীতল হাওয়া তার পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবখানে। সব জায়গায়। আমার দৃষ্টি খালি জায়গাটিতে জমে থাকা পানির উপর। শীতল হাওয়া আলতোভাবে বয়ে যাচ্ছে পানির উপর দিয়ে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউয়ের সৃষ্টিতে ঝলমলিয়ে উঠছে পানির উপরিভাগ। একদিকে উপভোগ করছি প্রকৃতির এলোমেলো খেলা আর অন্যদিকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নানান ভাবনা। কারো কারো কাছে জীবনটা কত সহজ আবার কারো কারো কাছে জীবনটা ভীষণ কঠিন। কেউ কেউ মেঘ না চাইতে বৃষ্টির পরশ পেয়ে যায় আর কেউ কেউ নীল আকাশে খুঁজে ফেরে একখন্ড মেঘের টুকরো। যারা স্বপ্নের ফেরি করে বেড়ায় তাদের কাছে স্বপ্ন ছাড়া কিছুই থাকে না। স্বপ্নের ফেরি করতে করতে এক সময় পৌঁছে যায় জীবনের শেষ সীমানায়।
‘কিয়ের লেহাপরা। মাইয়াগো বেশি লেহাপরার দরকার নাই। মাইয়ারা লেহাপরা বেশি করলে নষ্ট হইয়া যায়, পোলাগো হাত ধইরা বাড়িততন পলাইয়া যায়, বুঝবার পারছ? হেরলাইগা তাড়াতাড়ি...’
তেমনি এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা পুষ্পিতা (ছদ্মনাম)। বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা ও আদরের সন্তান। দুই ভাই ও একবোনের মধ্যে পুষ্পিতাই সবার বড়। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বাবা-মা পণ করেছিলেন নিজের ছেলে-মেয়েগুলোকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করবেন। তাই একমাত্র মেয়েকে শত কষ্টের মাঝেও পড়ালেখা করিয়েছিলেন এইচ.এস.সি পর্যন্ত। এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আরো পড়ালেখা করার ইচ্ছে ছিল মেয়েটির। কিন্তু বা-মা ও মেয়ের ইচ্ছায় ছাই ছিটালেন পুষ্পিতার সেজ চাচা। পুষ্পিতার বাপ-চাচাদের মধ্যে একমাত্র সেজ চাচাই প্রাতিষ্ঠানিক  শিক্ষায় শিক্ষিত (ডিগ্রী পাস)। এ অহংকারে তিনি পৃথিবীর উপর ভর করে হাঁটেন না। হাটেন শূন্যে। বাবা ও অন্য চাচারা অশিক্ষিত হওয়াতে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যে কোন কাজে সব সময় সবাই স্মরণ করেন পুষ্পিতার সেজ চাচাকে। আর সেই সুযোগগুলো হাত ছাড়া করতে রাজী নন তিনি। নিজের মেয়ে পড়ালেখা করছে বা করবে তাতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু অন্যের মেয়ের বেলায়। নয়ত পুষ্পিতার পড়ালেখা বন্ধ করতে পুষ্পিতার সেজ চাচা এভাবে উঠে-পড়ে লাগতেন না। তিনি চান না তার ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করে শিক্ষিত হোক। মানুষ হোক। কিন্তু নিজের ছেলে-মেয়ের ব্যাপারে ষোলআনাই ঠিক।
এইচ.এস.সির রেজাল্ট বেরুনোর এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ একদিন সেজ চাচা পুষ্পিতার বাবা-মাকে বললেন, ‘মাইয়ার বিয়া ঠিক কইরা আইলাম।’ পুষ্পিতার বাবা-মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। যাদের মেয়ে তারাই জানেন না, অথচ মেয়ের নাকি বিয়ে ঠিক।
পুষ্পিতার বাবা ছোট ভাইকে বললেন, ‘বিয়া ঠিক করছস, কি কইতাছস? মাইয়াতো আরো পরবার চায়। লেহাপরাটা কইরা লক হেরবাদে না অয়....।’
‘কিয়ের লেহাপরা। মাইয়াগো বেশি লেহাপরার দরকার নাই। মাইয়ারা লেহাপরা বেশি করলে নষ্ট হইয়া যায়, পোলাগো হাত ধইরা বাড়িততন পলাইয়া যায়, বুঝবার পারছ? হেরলাইগা তাড়াতাড়ি...’
ছোট ভাইয়ের সাত-পাঁচ কথার কাছের হার মানলেন পুষ্পিতার বাবা। এত তাড়াতাড়ি মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ছোট ভাইয়ের কাছে তিনি অসহায়। ছোট ভাই শিক্ষিত, অপরদিকে পুষ্পিতার বাবা অশিক্ষিত। তাই বাধ্য হয়েই ছোট ভাইয়ের সকল যন্ত্রণা সয়ে যাওয়া, সকল কথা মেনে নেওয়া। নিজে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে যে যন্ত্রণার আগুনে পুড়েছেন ছেলে মেয়েগুলোকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে সে যন্ত্রণার আগুন নেভাতে চান। কিন্তু আরেক যন্ত্রণা এসে ভীড়ল মনের বন্দরে। মাইয়াডারে মনে অয় আরও শিক্ষিত করবার পারুম না। বাবার মনে শঙ্কা মেয়ের জন্য।
রেজাল্ট বেরুনোর ৪ দিন আগে বিয়ে হয়ে গেল পুষ্পিতার। বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে তাকে পড়ানোর কথা বলা হলেও, বিয়ের পরে পরিবর্তন হয়ে গেল তাদের ভাবমূর্তি। শ্বশুর বাড়ির লোকজনের মতে, “বিয়া হয়া গেলে মাইয়াগো আর কিয়ের লেহাপরা?’
পুষ্পিতার শ্বশুর বাড়িতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি, তার উপর সে সংসারের বড় বউ। বড় বউ হিসাবে সংসারের সকল দায়িত্ব তার উপর। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত শাশুড়ি, শ্বশুর, দেবর, ননদ এবং নিজের সংসার। সকল কিছুর সামাল দিতে গিয়ে দিন পেরিয়ে কখন রাত, রাত পেরিয়ে কখন দিন আসে পুষ্পিতা নিজেই বুঝতে পারে না। নিজের কষ্টকে লুকিয়ে রেখে সকল কাজ করে যায় সে নীরবে। বিয়েতো একদিন করতে হতো। কিন্তু এভাবে হুট করে করতে হবে তা ভাবনাতেও ছিল না। পড়ালেখাটা অন্তত শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু বিধাতা সেই আশাটুকু ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন।
বাপের বাড়ি ছেড়ে যে বাড়িতে সারাজীবনের জন্য আসল, সেখানেও হল বঞ্চনার শিকার। আজ তার মনে কষ্ট শুধু একটাই, তার বাবা যদি শিক্ষিত হতেন তাহলে ছোট ভাইয়ের কথায় উঠা-বসা করতে হতো না। হতো না তার এত তাড়াতাড়ি বিয়ে। পড়ালেখা করে মানুষ হওয়ার স্বপ্নটি অন্তত পূরণ হতো। কিন্তু এখন সবকিছুই আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
মাঝ পথে এসে থেমে গেল পুষ্পিতার স্বপ্ন। পরিবার, সমাজ সবাই যেন প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ করে চলেছে মেয়েদের পড়ালেখার পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে। তাতে মেয়েরা যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে যায় তা যেন সবাই বুঝেও না বুঝার ভান করে। স্বামীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুষ্পিতার পড়ালেখা হয়ত আর করা হবে না। তবে সুযোগ পেলে সে-ও হাতছাড়া করবে না। বাবার আশাটা অন্তত পূরণ করার চেষ্টা করবে।
গোধূলি লগ্নে পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিম আভা। রাত বাড়ার সাথে সাথে রক্তিম আভা বিলীন হবে ঘন কালো অন্ধকারে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে দাবড়িয়ে বেড়াবে ঘন কালো অন্ধকার। দাবড়াতে দাবড়াতে মুখোমুখি হবে ভোরের আলোয়। ভোরের আলোর কাছে পরাজিত হয়ে লেজ গুটিয়ে পালাবে অজানার উদ্দেশ্যে। দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে পূর্ব আকাশে দেখা দেবে ভোরের সূর্য।


মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই