ছোঁয়াচে | শত্তুর মিত্তির
ডিনারের পর কতগুলো রীফার আগুন ছুঁলে একটা আস্ত সূর্য জ্বলে ওঠে, সেই দুর্বোধ্য সমীকরণ তোমায় কষিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ এক কুঁড়ে রাত্তিরে খবর পেলাম এস্রাজে..তুমি নাকি তেইশে পড়লে, সুন্দরী ? মাশাআল্লাহ..! ব্যস্...কি আর..! ইতিহাস জিতে যায় আমাদের টুকরো করে, কথা ছিলো একদিন.., কথারা থেকেই যায় এমনি..; অতীতের ইগলু'তে ওরা কাঁথামুড়ি দিয়ে আমাদের দুঃখ সেলাই করে। তারপর তুমি বেছে নাও জীবন, একটি বুকলুকানো শিশু..। অগত্যা আমি নিই মৃত্যুর চুমুক, একটি নামতাপড়ানো চাকরি। বাথরুমে নাকি ল্যাভেন্ডার ফোটাও, উইকেন্ডে ধন্তেরাস ধরে আনে বর..! আমার এখানে শালা শুধু শ্যাওলা, ম্যাচিসের খোলা, হলদেটে ফিল্টার.., আর কফ্-থুতু পরীক্ষার ডেট্ ফেল সারাবচ্ছর..!
পাড়ার লোকেরা ঘেন্না করে খুব, নাকে রুমাল দিয়ে সাবধান করে.."ছোঁয়াচে"! আমি মিচিক মিচিক হাসি, তুমিও বলতে ওকথা..। চার-ছ'টা কাপল্'কে বেঞ্চে অন্যমনস্ক বসিয়ে আমি দূরে বসি মাটিতে, তোমার গল্প বলি..মন দিয়ে..। "আমার হাজার দৌরাত্ম্য আর নোংরা বদভ্যাসকে হয়তো অজ্ঞানেই ভালোবেসেছিলো এক মেয়ে, এমনকি নিজের অজান্তে কেন জানি সেগুলিতে অভ্যস্ত হতে থাকে সে নিজেই"...এমনটি দিয়ে শুরু করি..। তারপর বলি সেই ঘটনাটা, যেদিন ভোরে তুমি খোলা কোলগেটে'র স্মেল্ নিলে আমার নকল করে। আমার মতো উদ্ভটকে ছুৃঁয়ে কেউ সুখে সাইকো হতে পারে, এই ভাবনায় হৃদয়ে হুহু নিয়ে হাসিতে হে হে করে উঠি………..! তারপর..আরো বকি, আরো আরো শব্দ বুনি, উলকাঁটা থামেনা, অথচ সন্ধ্যে ঘনায়, রাজ্যশ্রী'কে চুরি করে ফেলে শশাঙ্ক, কচ্ছপের আয়ু বাড়ে অফুরান গুণিতকে..! আমারও এখন আর চলতে ইচ্ছে করে না, তাই কতক স্থবির হয়ে রই, কতক বাধাশূন্য হয়ে নীচে গড়িয়ে পড়ি সচ্ছন্দে।
জানি, আকাশ ছুঁতে চাওয়া লবণাম্বুরা যেহেতু কেবল তারুণ্যই ভালোবাসে, আর তাই বয়স হলেই কোনো ঝড়ের কাছে সব ব্যর্থতা জমা দিয়ে ওরা একে একে আত্মহত্যা করে.., তাই অসমাপ্ত নোটে লাল কালির স্বীকারোক্তি ফেলে মাঝেমাঝে পিলস্'দের হামদর্দিতে চোখ ডুবিয়ে নিই ! আমি বুঝি সেই ঔচিত্যবোধ, যে নিখোঁজ পর্যটকের মৃত্যুর আগেই তার সাত বছরের বোবা মেয়ে সমাধির সামনে তিনটে বাৎসরিকী দেখে, নিজের হাতে বোনা কালো হ্যাটের ভেতর বরফশুভ্র ক্যাক্টি রেখে যায় তার পাথুরে বুকে, এপিটাফের দিকে চেয়ে কান্না চোখে বোঝায়.."আমি লুলাবি গাইতে পারি না, জেরোম..!"; আমি বুঝি তার মহানুভবতা, শেষমেষ পথ খুঁজে পেয়েও সেই ক্যাকটাসপ্রেমী ফেরেনা আর, মেনে নেয়..এ পৃথিবী ঘড়ি দেখে খুব, সময়কে আরও কিছুটা ত্বরিত করে বাড়ির মাথার ওয়েদার'কক্ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, চলে যায় সে, হারিয়ে যায় আরও..গন্তব্যহীন। জানি তো সবই। তাও ভয় হয়, তোমার চোখ থেকে দূর করেছো, বেশ, কিন্তু তোমার দূর থেকেও দূর..! আর দূরত্বে যেতে মন সরে না..! পরজন্মে বিশ্বাস নেই মোটে, তাই মরতে এখনো ভয় পাই। আর, বস্তুতই, মৃত্যুর মতন উচ্চতা না পেলে কোনো প্রাণই আশাচ্যুত হয়না। তাই নিঃস্বতার অ্যাতো কাছাকাছি বসেও, নিরাশাকে ঘরে ডেকে চা খাওয়াতে পারিনি অ্যাখনও, বাইরে থেকে জানালার কাঁচে নাক লাগিয়ে ওরা কিসব ফিসফাস করে আর দেখে… আমাদের পরিচয়বার্ষিকী'গুলোতে আমি বিনিদ্র মাতালের মতো বসে থাকি ডেড্ হয়ে যাওয়া ল্যান্ডফোনটার পাশে, একঠায় কুঁজো হয়ে।
ঠাকুরঘরের প্রনামি বাক্স, আর একটা দাবিদারহীন খেলনা লক্ষীভাঁড় ভেঙে তৎক্ষণাৎ যা পাওয়া গেল, তাতে টেনেটুনে দুবেলার বাজার হয়ে যেতে পারে..এমনি ভেবেই গেছিলাম। লোভ সামলে নিলে খুব একটা যে অসুবিধে হয়না, তা জানি। চারটে তেলাপিয়া, বাঁধাকপি রাঁধবার জন্য রুইয়ের হাফটা মাথা..গরীবের রান্নাবাটি আর শুনিয়ে কাজ নেই, যাই হোক্, ভাবী লাঞ্চের উপাখ্যান যে কেমন হবে..সেই নিয়েই বেশ ফুরফুরে ভাবনায় ফিরছিলাম।
মনে মনে তাই অ্যাখনও তোমায় চোখে হারাই মুহুর্মুহু, খুঁজি খুব, ছুঁতে চাই, তোমার বুকে যেন নতুন করে ফের প্রথম থেকে জন্মাতে চাই; ওখানে শুধু স্তন্যপায়ী অপত্যের স্নেহ, মমত্ব বা মাতৃত্বেরই বাস নেই, ওই খনিজে সেজে আছে অমেয় বিষ ও বিষ্ময়, যাতে প্রেমিক পাগল হয়ে রয়, সুখী হয় রাতেদেরও বেশী, ওখানে ঘুমিয়ে থাকে আমাদের সাতকাহনি অভিযোজন, পাতাওড়া ম্যারাথনি গল্প..; সঙ্গতই, যে পথে চলে যাবে তুমি, সম্মোহনে সেই পথে বুক পেতে থাকি! বুঝছোই..বড়ো দোটানায় পড়েছি। বলতে নেই, হাতটানও খুব!! আজকাল তাই ফি'বছরে ডাবরের কৌটোখানেক গুড়ো মাজন কিনি, সকালে উঠি অ্যালার্মকে হারিয়ে, ব্যয় সংকুলানের হিসেবপাতি না করেই আহাম্মকের মতো ডিবেটা উলটে নিই বামহাতে..গর্ত করা তালু থেকে সেই অতুল সুগন্ধি আবহ চিরে দেয় আমায়, ডান তর্জনী মুখ থেকে টেনে নিয়ে গুঁড়োর সুখ মেখে নিই, এপিঠে ওপিঠে, চিলতে চিলতে সেই মেরুন মিহিকনা আসঞ্জিত হয় আঙুলে, ঝাপসা দৃষ্টি আর বুভুক্ষু ঔৎসুক্যে নাকের দিকে উঠে আসে প্রিয় বদভ্যাস…!!!
"ওয়াক্ত'কে পাশ লতিফে ভি হ্যা মরহম ভি হ্যা.." এই অভিজ্ঞতার শায়র কিন্তু এক, অথচ আমরা শতাধিক এই সুর ঠোঁটে রাখি, প্রিয়তা দিই, জাতীয়তা দিই, উপকথার মতো বিশ্বাসে বেঁধে রাখি। অথচ এই যে অ্যাসিডের বোতল, জং ধরা নকশাল গুলি, বদনাম পাওয়া অভিশপ্ত ফ্যান্, অনিচ্ছুক হিংস্রতাপায়ী চকচকে রেলপাত, সাত'তালা ফ্ল্যাটবাড়ি আর অভিকর্ষের অগুণতি পুতুলচুক্তি…এরা? এরাও আছে, এরা সব চোরপথে হেঁটে চলে আমাদের পাশাপাশি, আমাকে, কখনো বন্ধুকে কলার জাপটে জিজ্ঞেস করে, কই? তোমার সুরের মোরাল কই? কোবেন' কি গাইতো না? আরও কতশত জটিল ধাঁধা! প্রতি সন্ধ্যেয় ওরাই তো ডাকে সপ্তর্ষি'কে। নালিশ জানায়, মলম কই? কতোদিন আর? সেইজন্য, সেই জন্যই তো..আকাশের বুকে অমন সপ্রতিভ প্রশ্নবোধক জ্বলে, আবিশ্ব জিজ্ঞাসায় আমার কষ্টের কৈফিয়ৎ চেয়ে..!! তবে কখনো কখনো মনে হয়, মিথ্যে নয়, কিছু আবছা সম্ভাব্যতা ভালোবাসা দিয়ে বোঝায়.. সময় চিরকাল নিরপেক্ষতাই বয়ে চলে..;
অবাক হলে? না সত্যিই..এই তো সেদিন। ভোর রাতের দিকে ভয়ানক খিদে খিদে পাচ্ছিল। ভাবলাম, আজ একটু ঘটা করে রান্না করবো..; পাশের চৌধুরী বাড়ির চাকরটা, লেটো না লাটাই কি যেন নাম, ফালতু পেছনে লাগে, কবে কি বাজার করে আনছে, রান্না কেমন হয়েছে, কে কে কব্জি অব্দি চেটেছে, সেই নিয়ে শালা এন্তার বক্তব্য..! সব মিলিয়েই একটু পুরোনো রেওয়াজে ফিরবো বলে বাজারে গেছিলাম, যে-সে বাজার না, তোমাদের ফ্ল্যাটপাড়ার বাজারে! নাহ্, বেশি কিছু ছিল না কাছে, তাও বিছানার তলা, ঠাকুরঘরের প্রনামি বাক্স, আর একটা দাবিদারহীন খেলনা লক্ষীভাঁড় ভেঙে তৎক্ষণাৎ যা পাওয়া গেল, তাতে টেনেটুনে দুবেলার বাজার হয়ে যেতে পারে..এমনি ভেবেই গেছিলাম। লোভ সামলে নিলে খুব একটা যে অসুবিধে হয়না, তা জানি। চারটে তেলাপিয়া, বাঁধাকপি রাঁধবার জন্য রুইয়ের হাফটা মাথা..গরীবের রান্নাবাটি আর শুনিয়ে কাজ নেই, যাই হোক্, ভাবী লাঞ্চের উপাখ্যান যে কেমন হবে..সেই নিয়েই বেশ ফুরফুরে ভাবনায় ফিরছিলাম।
জানতাম, এ'পাড়ায় কোথাও তোমার বাড়ি, না-মানে সংসার, মেয়েদের বাড়ি আর সংসার দুটো সমার্থক নয়। তাও কোনটা তা তো জানতাম না, তাই ভয়ের কিছু ছিলোনা। আনমনা এবাড়ি ওবাড়ির দিকে তাকাই, নামের ফলকগুলো আড়ালে না থাকলে পড়ে নিচ্ছি, কোনো অজানা দুরাশার ষড়যন্ত্রে পড়ে ক্রমশ নিষিদ্ধ তস্করবৃত্তির অপরাধ এসে বুক বিঁধে যাচ্ছে। প্রায় নিস্তব্ধ পাড়া, ঘুমের ঘুম ভাঙতে তো দেরীই ছিলো তখনো। আর একটু এগোলেই যেখানে মহীনপুর ফিরদৌসি ক্লাবের রাস্তাটা বামহাতি ভেঙে যায়, ওর কাছাকাছি এসেছি, সামনের ক্যানেল সেতু পেরোলেই চক থেকে রিক্সা পাবো। ব্যাগটা হাতবদল করে ডানদিকে চাই, গোটা জলাসবুজ মাঠেজুড়ে প্রোমোটারি খুঁটি পোতা, এখানে সেখানে দুয়েকটা করে গ্র্যাবেল্সবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বছর দুই পরে এখানে আর হাওয়া বইবে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে হাজারটা যুযুৎসু ঘুড়িকে একসাথে আর দেখতে পাওয়া যাবে না। বুকের কোনো সুড়ঙ্গ ছুঁয়ে একটা প্রেতকায় দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো যেই, তখনই অদূরে কোথাও কোনো শিশুর মিষ্টি উল্লাসী চিৎকার..না, ঠিক চিৎকার নয়, কোনো সুরেলা প্রলাপের মতো মুখস্থ কিছু আপনমনে বলে চলেছে মনে হল, সামনের দিক থেকেই আসছে, কাজেই এগোলাম। একটা বাড়ি পের করতেই, অস্পষ্ট সিলেবলগুলো অল্প অল্প বুঝতে পারলাম, বোধয় কোনো টিভি অ্যাড্ ফিল্মের ভাষ্য। আর দুটো বাড়ি ডানদিকে ফেলে, বামদিকের দোতালা ব্যালকনিতেই তাকে পেলাম একা। "ঢিস্যুম্..ঢিস্যুম্..ঢিস্যুম্" বলে ডানহাতের মুঠোয় ঘুষি ছুঁড়ছে হাওয়ায়, নাহ্, ভুল হোলো, ঘুষি নয়, মুঠোর ভেতর ট্যুথব্রাশ্, অ্যাখনও মুখে দেওয়া হয়নি, সবুজাভ নীল পেস্ট তখনও সাজানো রয়েছে সুন্দর। আমি দাঁড়িয়ে আছি নীচে দেখেই হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো, বারান্দার ধারে এগিয়ে এসে রেলিঙের উপর থুতনি রেখে দাঁড়ায়, হাত দুটো ঝুলিয়ে দেয় বাইরে, আমার দিকে তাকাচ্ছেনা সরাসরি, বুঝতে পারছি, সে অল্প দ্বিধায়, পথিক অপরিচিত..কাজেই কথা বলা চলে না, আবার কৌতূহলও কিছু..অ্যাতো সকালে কি খুঁজছি বা চাইছি এখানে..? বাইরের ভাবটা তাই এমন দেখায়, যেন কোনো উৎসাহ নেই তার..; নিজের কাজে মন দিচ্ছে সে, এমনি অভিনয়ে বামহাত দিয়ে মাথা থেকে পাতলা হেয়ারব্যান্ডটা খুলে তাই দিয়ে পাশের লতাগাছে খুনসুটি করে। ঝুরো ঝুরো কার্লি চুল চোখের উপর ফুরফুর উড়ে যায়, উঁ উঁ করে কোনো অচেনা শিশুসুলভ সুর ভাঁজছে সে..; দুই গালে অসামান্য দুটো অগভীর টোল খেলে যায়। তার হাতের দোলুনিতেই উপর থেকে ঝুলে পড়া একঝাড় মানি প্ল্যান্ট দোল খায় নিচে, ফটকের ভেতরটা তাই দেখা যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। নেমপ্লেটটাও..! তাতে লেখা দ্বিতীয় নামটাও..! ……….!!! থেমে গেলো শ্বাস, কষ্ট হচ্ছে খুব, গোটা রক্তে যেন রগরগে স্মৃতির গরল.., তলপেটে টান পড়ছে কোথাও, আইঢাই করছে কন্ঠ, শুষ্ক তালু, একি সকাল, না কাঠফাটা দুপুর..! সময় শুধু জেনেছিলো সেইদিন, এক বেলোয়ারি সবুজের নীচে খুন হয়ে গেলো এক পর্ণমোচী চিতচোর..! উপরের কোনো ঘরভিতর থেকে বহু পুরোনো পরিচিত এক মেয়েলি কন্ঠস্বর পেলাম.."কিরে, ব্রুশ্ করা হোলো..?" আমি ত্রস্ত হয়ে তড়িঘড়ি উপরে তাকালাম..; তোমার মেয়ে তখন চোখ বুজে পেস্ট শুঁকছে ব্রাশের রোমে..! ওকে আরও কিছুটা সময় দাও। পিছু ফিরলাম.., ঠোঁট শীৎকারে শুশ্রূষা দিয়ে বললো.."ছোঁয়াচে..!"
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com










মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন