চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

পাপের প্রায়শ্চিত্ত


শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বলেছিলেন, “বড় শিল্পী হতে হলে তিনটি জিনিসের কাছে বারবার যেতে হবে। এক: মা, দুই: মাটি, তিন: মানুষ। মানুষ যে কত বিচিত্র এক জীব তা মানুষের সাথে না মিশলে বুঝা সম্ভব নয়। রাগের বশবর্তী হয়ে যেমন সে অনেক কিছু করে ফেলে তেমনি আবেগ, দুঃখ, ক্ষোভ ইত্যাদির কারণেও সে করে ফেলে অনেক কিছু। আমার সাথে এক লোকের পরিচয় আছে তার নাম মিরাজ। যখনই তার সাথে দেখা হয় এবং কথা হয়, সবসময় তাকে কেমন উদাসী উদাসী মনে হয়। একদিন তাকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা মিরাজ সাহেব আপনি সারাদিন কি যেন ভাবেন! কি এমন ভাবেন, একটু কি জানতে পারি?”

মিরাজ সাহেব আমার কথায় একটু যেন সিরিয়াস হলেন! বললেন, “পৃথিবীতে এমন কিছু কথা আছে যা কাউকে বলা যায় না, এমন কিছু ভুল আছে যা কখনো শোধরানো যায় না, এমন কিছু অপরাধ আছে যার কখনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না। জীবনে আমি যা অপরাধ করেছি তার কোন ক্ষমা নেই, প্রায়শ্চিত্ত নেই। লজ্জার কথা আপনাকে কি আর বলব। তবুও যখন জানতে চেয়েছেন শুনুন তাহলে। তখন আমি মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। আমার এক বন্ধুর দুঃসম্পর্কের আত্মীয় (ভাগনী) সবেমাত্র ভর্তি হয়েছে (একই কলেজে) এইচ,এস,সি ১ম বর্ষে। নাম, সোহানা। বন্ধুর মাধ্যমে সোহানার সাথে পরিচয়। কলেজে প্রায় দেখা হতো, কথা হতো। একসময় দুজনার সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। সোহানা দেখতে আহামরি সুন্দরী ছিল না। কিন্তু চেহারা ছিল মায়াভরা। মেয়েটির কথা, আচার ব্যবহার ছিল খুবই অমায়িক। আসলে ওর আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাই ভালোবেসেছিলাম তাকে। মাস্টার্স শেষ করে আমি একটি ভালো চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলাম। বেতনও ছিল ভালো। বলতে দ্বিধা নেই আমি আমার বেতনের সিংহভাগ ব্যয় করতাম সোহানার পিছনে। কারণ ওদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল খুব করুণ। খুব কষ্ট করে ও পড়াশোনা করতো।

আমি যখন টাকা আয় করা শুরু করি তখন ভাবলাম, ওর কষ্টের বোঝা আমি কাঁধে নিব। আর তাই আয় করা টাকা নিজের বাবা-মাকে না দিয়ে দিতাম সোহানাকে। যদিও আমাদের পরিবারে আমার বেতনের টাকা না হলেও চলত। সেসময় আমাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। মাথায় সবসময় ঘুর পাক খেতো কখন তার পড়াশোনা শেষ হবে। তাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসব। ওর কোন আবদার আমি অপূর্ণ রাখিনি। শুধু চাইতাম ওর যাতে কোন কষ্ট না হয়। কয়েক বছর চাকরি করার পর চাকরি আর ভালো লাগলো না। চিন্তা করলাম ব্যবসা করব। স্বাধীন কাজ। তাই চাকরি ছেড়ে কাঠের ব্যবসা শুরু করলাম। এর মাঝে সোহানার জন্য ব্যাংক-এ একটা চাকরি ঠিক করে দিলাম। আমি পুরোদমে শুরু করলাম আমার ব্যবসা আর সোহানা তার চাকরি।

এদিকে সোহানার সাথে সম্পর্ক আমার পরিবার মেনে নিতে পারেনি। পরিবারের সবাই চাইছিল মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি বাবা-মার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করি। কিন্তু সেটাতো হয় না। অন্যদিকে বাবা-মা আমার অমতে আমার জন্য পাত্রী ঠিক করে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন এবং সাফ জানিয়ে দিলেন যদি এ বিয়েতে আমি অমত করি তাহলে পরিবারের কারো সাথে আমার সম্পর্ক থাকবে না! উভয় সংকটে পড়ে আমি কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদিকে বাবা-মা আর অন্যদিকে সোহানা। শেষ পর্যন্ত বাবা-মায়ের কথা মেনে নিয়ে বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলাম। সোহানাও আমার এ ব্যাপারটি মেনে নিল। কিন্তু সোহানা আমার সাথে সম্পর্ক শেষ করলো না। নির্দিষ্ট দিনক্ষণ অনুযায়ী বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ে করলেও তাকে আমি বউ হিসেবে মেনে নিতে পারিনি। একই রুমে থাকলেও দুজন থাকতাম দুদিকে। এভাবে চললেও ব্যাপারটি পরিবারের কাউকে বুঝতে দিতাম না আমরা। সবাই জানত সবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সোহানাকে বিয়ে করার জন্য মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলাম। সোহানা আমাকে বুদ্ধি দিল বউকে ডিভোর্স দিয়ে সোহানার সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে। সোহানার বুদ্ধিমত আমি একসময় বউকে ডিভোর্স দিয়ে দিলাম। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল সে ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। তার মা-বাবা আমাকে পছন্দ করেই একমাত্র মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ডিভোর্স দেওয়ার আগে আমার বউ আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল। সে বলেছিল তার বাবা-মা অনেক আশা নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। যদি এ বিয়ে ভেঙ্গে যায় তাহলে তার বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে। তাই অন্তত বাবা-মার জন্য হলেও যাতে বিয়েটা টিকে থাকে। ডিভোর্স দেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আমার হাতে পায়ে ধরেছিল। কিন্তু আমি তার কথা রাখিনি। তাই এ পাপের শাস্তি আমি আজ হাড়ে হাড়ে পাচ্ছি।"

“শাস্তি পাচ্ছেন! কি রকম?”

“বিয়ে করা বউটাকে ডিভোর্স দেওয়ার পর সোহানা আর আমার সাথে সম্পর্ক রাখেনি। সোহানা আসলে আমার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে!”

“কি রকম?”

“বুঝলেন না? বিয়ে করার জন্য বাবা-মা যখন আমাকে চাপ দিয়েছিলেন সোহানা তখন আমাকে বলেছিল, আমরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসি, এখন যদি তুমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে আরেকটি মেয়েকে বিয়ে কর তাহলে তিনজনের জীবনই নষ্ট হবে। সুতরাং বুঝে শুনে তুমি এ কাজটি করো না। একদিকে আমি বাবা-মার কথা রেখেছি, রেখেছি সোহানার কথা। অন্যদিকে কষ্ট দিয়েছি বাবা-মাকে, কষ্ট দিয়েছি সোহানাকে। আর যাকে বিয়ে করে ডিভোর্স দিলাম সে-তো আছেই। বুঝলেন এখন, আমি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। পাপের প্রায়শ্চিত্ত! হ্যাঁ এ প্রায়শ্চিত্ত কখনো শেষ হবে না।”

“শেষ হবে না কেন, সোহানার কথায় আপনি যাকে ডিভোর্স দিলেন, তাকে খুঁজে বের করুণ তারপর তার কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চান, আশাকরি তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন।”

“দেখি খোদা কপালে আর কি কি রেখেছেন। তবে আমি আরেকটা পাপ করব যদি সুযোগ পাই।”

“কি সেটা।” “জীবনেতো আর কখনো বিয়ে করব না! আর যদি করতেই হয় তাহলে সোহানার রক্তে হাত রাঙিয়ে করব, তার আগে নয়।”

“কি বলেন?!”

“হ্যাঁ”।


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই