চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

“আশীষ কান্তি মুহুরী”- একজন সাদা মনের মানুষ

“আশীষ কান্তি মুহুরী”- একজন সাদা মনের মানুষ | রহমান মিজান


গভীর সমুদ্রে দিক হারা নাবিক যখন দ্বীপের সন্ধান পায় তখন তার সব ক্লান্তি মুছে যায়। মাটির সন্ধান পেয়ে তার মন প্রাণ খুশিতে নেচে উঠে। সমাজে স্বার্থপর মানুষদের ভিড়ে দেহ মনে যখন ক্লান্তি ভর করে তখন কিছু নিঃস্বার্থ মানুষের কর্মকান্ড দেখে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। যারা নিজের স্বার্থের কথা ভুলে পরের মঙ্গল সাধনায় নীরবে কাজ করে যায়। তেমনি একজন মানুষ আশীষ কান্তি মুহুরী। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বিদ্যগ্রামের মৃত মনোরঞ্জন মুহুরীর ছেলে আশীষ কান্তি মুহুরী। তার মায়ের নাম কল্যানী মুহুরী। ১৯৭৩ সালের ২২ আগস্ট, আশীষ মুহুরীর বয়স ছিল ৭ মাস। তার মা কল্যাণী মুহুরী একদিন হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো তাকে। ডাক্তার বললেন, তাকে বাঁচাতে হলে রক্তের প্রয়োজন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও প্রয়োজনানুযায়ী রক্ত পাওয়া গেল না । রক্তের অভাবে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেন আশীষের মা। মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলেন তিনি। ৭ মাস বয়সী ছেলের লালন-পালনের দায়িত্ব পড়লো আত্মীয়-স্বজনের উপর। ধীরে ধীরে বড় হলেন আশীষ। বড় হয়ে জানতে পারলেন তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে রক্তের অভাবে। মায়ের এই অকাল মৃত্যু প্রতিনিয়ত তাকে নাড়া দিত। তাই প্রায়ই তিনি ভাবতেন রক্তের অভাবে যাতে আর কোন মায়ের মৃত্যু না হয় সে ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা। ১৯৯৪ সালে বন্ধুদের এক আড্ডায় তিনি বিষয়টি উত্থাপন করলেন। বন্ধুরাও তার সাথে একমত হয়ে গড়ে তুললেন ২১ সদস্য বিশিষ্ট ‘স্বেচ্ছা’ নামক রক্তদান ফোরাম। এভাবেই শুরু। তারপর আর থেমে থাকেননি। নিঃস্বার্থভাবে করে যাচ্ছেন স্বেচ্ছা রক্তদানের বিরল এক মহৎ কাজ। যখন যার রক্তের প্রয়োজন তখন রক্তের সন্ধান নিয়ে তিনি মুমূর্ষু রোগির পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এর বিনিময়ে তাকে কিছুই দিতে হয় না। মৃত্যু পথযাত্রী কোন রোগিকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই যেন দুনিয়ার সকল শান্তি এসে ভর করে তার অন্তরে। আশীষ মুহুরীর এই মহৎ কাজ দেখে তার সংগঠনের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। বর্তমানে তার সংগঠনের সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২শ। এই ১২শ জন সদস্য ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮ হাজারেরও বেশি ব্যাগ নিরাপদ রক্ত স্বেচ্ছায় দান করেছেন এবং করে যাচ্ছেন।
মহৎ এ মানুষটির সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে অনেকদিনের। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। একদিন সময় করে ১/২, চট্টগ্রাম বন্দর স্টেডিয়াম মার্কেটে তার ঔষধের দোকানে গেলাম তার সাথে দেখা করার জন্য। নাম জিজ্ঞেস করতেই হাসিমুখে বললেন আমি আশীষ কান্তি মুহুরী। তার দোকানে বসে চা পান করতে করতে আলাপ করলাম অনেকক্ষণ। আলাপের মাধ্যমে জানতে পারলাম, বন্দর এলাকার বিশিষ্ট সামাজিক সংগঠক মরহুম হেদায়েত উল্লাহ বাটুলের সহযোগিতায় ১৯৯৪ সালে ‘স্বেচ্ছা’ নামক সংগঠনটি গড়ে তুলেন। সংগঠনের কোন কমিটি নেই। সবাই সংগঠনের সদস্য। সব সদস্যই নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। তবে তিনি এবং সংগঠনের দুই সদস্য (রাসেল এবং জুয়েল) সংগঠনের মূল দায়িত্ব পালন করেন। সংগঠনের সদস্য হতে হলে শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় রক্তদানের মানসিকতা থাকতে হবে। এই সংগঠনের মূল স্লোগান হচ্ছে, “এসো রক্তের বন্ধনে বাঁধি প্রাণ, স্বেচ্ছায় করি রক্তদান, করিলে রক্তদান বাঁচবে বহুপ্রাণ।” তিনি জানান, সংগঠনের সকল সদস্যের নাম, ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও ফোন নম্বর লিপিবদ্ধ রয়েছে। যখন যার যে গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন, সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে সে গ্রুপের রক্তের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থাৎ সকল গ্রুপের রক্তের সন্ধান তাদের কাছে রয়েছে। দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কেউ ডাকলে তারা সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়ে রক্তের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তারা রক্ত দান করে থাকলেও সবচেয়ে বেশি রক্ত দান করেছেন চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে। সারাদেশে এ পর্যন্ত তাদের দান করা ১৮ হাজার ব্যাগ রক্তের মধ্যে ৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দান করা হয়েছে বন্দর হাসপাতালে। তাদের কাছে রক্ত চেয়ে কেউ কখনো খালি হাতে ফিরে যায়নি। স্বেচ্ছা সংগঠনের প্রতিটি সদস্য সুস্থ থাকলে বছরে তিনবার রক্তদান করেন। বন্দর এলাকায় এবং বন্দর হাসপাতালে কখনো কারো রক্তের প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ে আশীষের। আশীষও মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়ে মানুষের ডাকে সাড়া দেন। আশীষের কাছ থেকে জানা গেল, স্বেচ্ছা সংগঠনের কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালের চীফ মেডিকেল অফিসার ডাঃ মীর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ ও বন্দর হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের টেকনিশিয়ান ওয়াসিম উদ্দিনের। এ ছাড়াও বন্দর হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সহযোগিতা রয়েছে এর পেছনে। আশীষের এই মহৎ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে ২০০৫ সালে বন্দর দিবসে সংবর্ধিত করেছে এবং বন্দর এলাকার সামাজিক সংগঠন শার্প মুভমেন্ট ২০০৫ সালে শার্প পার্সোনালিটি অব দ্যা ইয়ার ঘোষণা করেছে। এ মহৎ কাজের বিনিময়ে তার আর কি চাওয়ার আছে জানতে চাইলে বলেন, পূর্বেও কিছু চাওয়ার ছিল না, এখনো নেই। তারপরও চবক ও শার্প মুভমেন্ট আমাকে সম্মানিত করেছে, এজন্য ধন্যবাদ। আমি চাই রক্তের অভাবে যেন কোন মানুষ মারা না যায়। আমাদের রক্তে যদি মৃত্যু পথযাত্রী কোন মানুষ সুস্থ হয়ে উঠে সেটাই আমাদের পরম পাওয়া। যখন দেখি আমাদের রক্তে কারো মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে, তখন সেই মায়ের মাঝে আমার মাকে খুঁজে পাই, এর চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু হতে পারে না। ভবিষ্যৎ চিন্তাধারা জানতে চাইলে বলেন, রক্তদান কার্যক্রমে আজীবন নিজেকে নিয়োজিত রাখা এবং অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করা। পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে মানুষকে সংগঠিত করা। আশীষ নিজেও ২০০০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মরণোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে সন্ধানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। মানুষকে রক্তদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হলে কি করতে হবে জানতে চাইলে বলেন, ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী একজন সুস্থ মানুষ বছরে ২/৩ বার রক্ত দান করতে পারেন। তাতে শরীরের কোন ক্ষতিতো হয়ইনা বরং রক্তদানে শরীরের উপকার হয়। এ দেশে ১৮-৫০ বছর বয়সী মানুষ রয়েছে ৩ কোটি। এদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ৪ জনও যদি বছরে একবার রক্তদান করেন তাহলে আমরা বাৎসরিক মোট চাহিদার তিনগুণ রক্ত পাব। তাই রক্ত দানের ব্যাপারে উৎসাহিত বা সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণার বিকল্প নেই।
আশীষ কান্তি মুহুরীরা ২ ভাই, ২ বোন। বড় ভাই শংকর মুহুরী বন্দরের পরিবহন বিভাগের কর্মচারী। আশীষ নিজে আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় ১/২ বন্দর স্টেডিয়াম মার্কেটে একটি ঔষধের দোকান পরিচালনা করেন। দুই বোন কৃষ্ণা রায় ও স্বপ্না মজুমদার নিজেদের সংসার গোছাতে ব্যস্ত।
গত ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ আশীষ কান্তি মুহুরীর মহৎ কাজকে আরো শক্তিশালী করতে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন কৃষ্ণা মুহুরী। ইচ্ছে আজীবন তার পাশে থেকে মহৎ কাজে সহযোগিতা করে যাওয়া। এ মানুষটিকে খুঁজে পাবেন, বাসা নং- ৭৬/ডি, রোড নং: ৪, চট্টগ্রাম বন্দর উত্তর আবাসিক এলাকা এই ঠিকানায় অথবা আলাপ: ০১১৯৯ ২৮৫৯৯৯। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে মহৎ এ মানুষটির সাথে যোগাযোগ করে দেখতে পারেন তাহলে হয়তো খোদার কৃপায়, মানুষটির উসিলায় আপনি বা আপনার কোন আত্মীয় ফিরে পেতে পারেন মহামূল্যবান এ জীবন।

লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই