চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আমি পাঠক বলছি (৪)


(“আমি পাঠক বলছি” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে আমার পড়া বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমি একজন সর্বভুক পাঠক। যা পাই তাই গিলি। আমার কাছে মূল বিষয়- কোন একটি বই সুখপাঠ্য কিনা। সুখপাঠ্য হলে লেখক আস্তিক না নাস্তিক, মোল্লা না ব্রাহ্মন, দেশি না বিদেশি, নতুন না পুরাতন, লেখায় গভীরতা আছে কি নেই এসব বাছবিচার এ যাই না। লেখাটা পড়ে ফেলি। কখনো কখনো মতামত ও দেয়ার চেষ্টা করি। পাঠক হিসেবে আমার এই কখনো কখনো দেয়া বক্তব্য হয়ত লেখকের মনঃপূত না-ও হতে পারে কেননা লেখার বিচারিক ক্ষমতা কখনোই একজন পাঠক আর লেখকের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। তবু পাঠক হিসেবে ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ থাকায় কলম হাতে নেয়ার দুঃসাহস করলাম। আশা করছি, লেখকগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আমার এই দুঃসাহস!)

নিয়মিত বই পড়ছি। হার্ডকপি-সফটকপি, যখন যেভাবে পাচ্ছি পড়ছি। পড়তে পড়তে দিন-মাস-বছর পার করে দিচ্ছি, তবু আমার খিদেটা যেন ক্রমশ বাড়ছে। সর্বগ্রাসী আমি আজকাল প্রতিষ্ঠিত লেখকদের একপাশে ঠেলে রেখে পড়ছি তরুণদের। পড়ছি পড়ছি পড়ছি..... কত পড়ব? বাংলার সীমাহীন সাহিত্য একজীবনে পড়ে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম একসময়। এখন জানি প্রতিজ্ঞাটা কত হাস্যকর ছিল। কয়েকটা জীবনেও তো বাংলা সাহিত্যের সব পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়!

পড়ছিলাম বারুদের মুখোশ, এটা পড়তে পড়তেই উপরোক্ত ভাবনা ঝিলিক দিয়ে গেল মনে। কারণ, এমন দারুণ লেখার হাত অসংখ্য তরুণের। যারা দুর্দান্ত সব লেখা লিখছেন আমাদের জন্যে। আমরা ক’জন পড়ছি সেসব? ক’জন?

বারুদের মুখোশ গল্পগ্রন্থটি আমার মত সাধারণ পাঠকের বোধ বুদ্ধির জন্যে ভীষণ একটা চ্যালেঞ্জ। বইয়ের গল্পগুলো পড়তে শুরু করলে বোঝা যায় লেখক অসাধারণ পরিশ্রম করেছেন প্রতিটা গল্প নিয়ে। গল্প মানে প্লট নিয়ে নয় শুধু। মনে হয়েছে প্রতিটা লাইন লেখকের অনেক যত্ন ও পরিশ্রমের ফসল। ফলে প্রতি পাতাতেই লেখককে মনে হয়েছে তার সমসাময়িকদের চেয়ে আলাদা এবং বিপুল শব্দসম্ভারে বৈচিত্র্যময়। লেখার ঢঙ, গল্পের বুনন এই লেখককে আলাদা করে পড়তে-জানতে বাধ্য করবে পাঠককে।

কথা হচ্ছিল পাঠকের বোধ বুদ্ধির জন্যে ভীষণ চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সেটা কেমন? বইটির গল্পগুলো লেখকের নিজস্ব ঢঙে কঠিন বর্ণনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। যার ফলে গল্পের মর্মার্থ বুঝে নিয়ে গল্প পড়া যাকে বলে সেটা হয়ে ওঠে না। যেমন মা ও তার হলুদ বোরকা, মঙ্গলহস্তীর ডানা, বারুদের মুখোশ, কালো পিঁপড়া- গল্পগুলোর আসল গল্পটা যে কি সেটা বুঝে উঠতে পারিনি।

মঙ্গলহস্তীর ডানা পড়েতো আমার দাঁত-টাত ভেঙে যাবার যোগাড়। লেখক অনেক জানেন, বোঝেন এবং পড়েন এটা বোঝা যায়। এই গল্পের অনেক শব্দই বুঝিনি। যেমন- ফানেকটার, য়েনাম, খেদা, লাইহারাওবা (আদিনৃত্য), লাইনুরা, পেনা, খাম্বাথোইবী (নৃত্য), মাইখুম, খাওন, খাংনপ ইত্যাদি শব্দ মাথার ওপর দিয়ে গেছে। আর সাথে সাথেই একটা খটকা, একটা প্রশ্ন বারবার চিন্তায় ফেলে দিচ্ছিল আমাকে। লেখকের অনেক জানার ছাপ যখন লেখায় থাকে তখন পাঠককে সেটা অস্বস্তিতে ফেলে। আমার মতই কোনো কোনো  পাঠক হয়তো ভেবেও বসতে পারে লেখক নিজেকে সুপিরিয়র প্রমাণ করতে চাইছেন। সেক্ষেত্রে এই ভাবনাও পাঠকের মনে আসা অস্বাভাবিক না যে, লেখক নির্দিষ্ট কিছু পাঠকের জন্যই লিখছেন কেবল। আর সাধারণ পাঠকের কাছে লেখক পৌঁছাতে চান না বলেই জটিল শব্দ এবং গল্পের সম্ভার তৈরী করছেন।

লেখকের উচিত হবে পরবর্তী সংস্করণে উল্লিখিত শব্দগুলো পাদটীকার মাধ্যমে পাঠককে বুঝিয়ে দেয়া। এতে করে হয়তো পাঠকের শব্দসম্ভারও সমৃদ্ধ হবে।

পাঠক হিসেবে আমি মনে করি, একজন লেখক লিখতে বসেন সর্বাগ্রে নিজের আত্মতৃপ্তির আশায়, নিজের ভাবনাগুলো ফুটিয়ে তোলার এবং তা অন্যের মনে ছড়িয়ে দেবার আশায়। এছাড়াও পাঠকের মনে ঠাঁই পাবার একটা তাগিদও থাকে হয়তো। আর এসবের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো সহজতর ভাষা (কারো কারো ভিন্নমত থাকতে পারে)। জটিল-কুটিল, শব্দধাঁধার জট মেশানো কোন গল্প বা প্রবন্ধ যখন পড়ি আমি দাঁতে দাঁত ঘষি, আমার গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। যেমনটা হয়েছে মা ও তার হলুদ বোরকা এবং মঙ্গলহস্তীর ডানা পড়ে। গল্পগুলোতে লেখক কি বলতে চেয়েছেন? মা ও তার হলুদ বোরকা গল্পে, গল্প কথক কুকুর হয়ে গেল? এটা কি কোন রূপক গল্প? কোনো গোপন অর্থ বহন করছে? আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার মঙ্গলহস্তীর ডানা গল্পে কি বোঝানো হয়েছে? উপজাতিদের সাধারণ, স্বাভাবিক আত্মিক আচার অনুষ্ঠানে অস্বাভাবিকতা নিয়ে আসে সাংসদ বা গুরুত্বপূর্ণ মানুষের উপস্থিতি, যাদের জন্যে তটস্থ-আড়ষ্ট হয়ে উপজাতিদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়? আর একদম শেষে মঙ্গলহস্তী “জয়শা”র কথা কেন আসলো? ওটা কী অর্থ বহন করে?

এরকম হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে, উত্তর পাইনি কোনো। যদিও উত্তর দেয়ার দায় কোনো ভাবেই লেখকের উপর বর্তায় না। সেক্ষেত্রে বলা যায়, পাঠক হিসেবে আমিই ব্যর্থ।

বারুদের মুখোশ গল্পে প্রথা ভাঙার, প্রতিবাদের একটা সুর আছে, তবু পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে এখানে গল্পটা কোথায়?

কালো পিঁপড়া গল্পটা পড়তে পড়তে কিছু জায়গায় মনে হয়েছে পিঁপড়ার জীবনচক্র বোঝানো হচ্ছে! এর কি প্রয়োজন ছিলো? ধরা যাক, গল্পে শাহবাগে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে উপস্থিত হাজারে হাজারে মানুষকে ভেবে নেয়া হচ্ছে পিঁপড়ে। যে মানুষটা বৈষয়িক এবং নিজ চাওয়া-পাওয়া নিয়ে যথেষ্ট সচেতন সে ব্যাপারটাকে অপছন্দ করছে এবং সে-ই মূলত আন্দোলনকারীদের পিঁপড়ের মত ছোট ভেবেছে। আবার একসময় কোনো সবল প্রতিপক্ষের হুমকি বা হুংকারে অথবা বিশাল জনস্রোতে প্রভাবান্বিত হয়ে সে-ও নিজেকে পিঁপড়ে দলের একজন হিসেবেই আবিষ্কার করে ইচ্ছা-বা অনিচ্ছায়। তো এখানে সব সুন্দর ভাবেই এগোচ্ছিল; পিঁপড়ের জীবনপ্রণালী- মানে রাণী পিঁপড়া, সৈনিক পিঁপড়া, শ্রমিক পিঁপড়া এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থা আনার দরকার ছিল না বোধহয়।

মগজের নাটাই এবং দাগ গল্পদুটো চমৎকার লেগেছে। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যা ঘটছে সব চোখের সামনেই দেখছি।

মগজের নাটাই যুবকটির ঘুড়ি ওড়ানো যেমনটা চোখের সামনে ভেসেছে, তেমনি স্পষ্ট যেন দেখেছি সে তার ভাই বা বোন-কে মেরে মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে। আবার ঘুড়ির নিয়ন্ত্রণ করতে করতে অন্যান্য ছেলেদের সাথে কথোপকথন বেশ আনন্দ এবং ভাবনার খোরাক দিয়েছে। আসলে যে জীবনটা এঁকে নেয়া হয়েছে গল্পে সে জীবনটা এতই সাধারণ আর পরিচিত যে আমরা পথে চলতে ফিরতে গিয়ে দেখেও কিছু ভাবি না। এই গল্পটা পড়ার পর মনে হয়েছে, এরপর রাস্তায় বেরুলেই আমার চোখ খুঁজবে একদল উদ্দেশ্যহীন টোকাই বা শরতের আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টারত কোনো যুবক। এরপর নিশ্চিত আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই যুবক বা সেই টোকাইদের মন পড়ার চেষ্টা করবো!

দাগ গল্পে মায়ের সাথে ছেলের কাল্পনিক আলাপ ভালো লেগেছে। পুরো গল্পটাই ভালো লেগেছে তবে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিনি, গল্পের শেষে কি ছেলেটাও মারা যাচ্ছে?

যাই হোক, মারা যাক বা বেঁচে থাকুক গল্প পড়ে মজা পেয়েছি সেটাই আসল কথা।

লেখক ফজলুল কবিরী অন্যদের চেয়ে আলাদা লিখেন বলেই তাকে আমার মনে থাকবে দীর্ঘদিন, বিশেষ করে বারুদের মুখোশ গল্প গ্রন্থের কথা আমি ভুলব না। যদিও বইটা পড়তে পড়তে অনবরত মনে হয়েছে- আমার মত সাধারণ পাঠকের জন্যে তিনি লেখেন না। তবু তাকে মনে থাকবে আমার, কারণ তিনি বারুদের মুখোশের মত একটি গল্পগ্রন্থের জনক!


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই