চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

বর্ষার চোখে জল

বর্ষার চোখে জল | মইনুদ্দীন শফি মাস্টার (বড়দা)      


বর্ষার চোখ এখন জলভরা। বর্ষায় লেখা এবারের চিঠির শেষ প্রান্তেও লেখা ছিল- “দাদা আমি আর পারি নে, যে ডাল ধরি সে ডাল ভাঙে, তাই আমি অন্য ডাল ধরি। আমার এই মন যন্ত্রণার সাথী আপনি ছাড়া আর কেউ তো নেই। কুলটা, দ্বিচারিণী, অপয়া, বেশ্যা যে নামে ডাকুন না কেন, আপনার সকল অভিশাপ আমি- বর্ষার কপালে আশীর্বাদ হয়ে উঠুক।”
বর্ষা নামে একটি মেয়ে এখনো আমাকে চিঠি লেখে। গাঁয়ের ঝোঁপ-ঝাড়, লতা-পাতা ঘেরা কুঁড়ে ঘরে বেড়ে ওঠা যুবতী বর্ষার চিঠি পড়ে মনে মনে বলি, মনের পুরোনো জ্বালা কেন নতুন করে জ্বালিয়ে দিস? ঘন ঘোর মেঘে ছাওয়া আকাশ কেঁপে বৃষ্টি না হলে বর্ষার মন ভরে না। চিন্তা চেতনায় উষ্ণতা আসে না। এবারের চিঠি লেখার আগে ভরা বর্ষার অপেক্ষায় ছিল মেয়েটি। কালো মেঘে ছাওয়া আকাশ ছাপিয়ে যখন বৃষ্টি এলো, ঠিক তেমনি এক মাহেন্দ্রক্ষণে বর্ষা আমায় চিঠি লিখেছে। তবে চোখের জলে ভেজা চিঠি।
বর্ষার চিঠিখানা পাঠকের সামনে তুলে ধরার আগে বৈচিত্রপ্রিয় স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েটির খানিক পরিচয় দিই। প্রতারক আদম বেপারির ফাঁদে পড়ে গাঁয়ের কিশোরী বর্ষা শহরে এসেছিলো জীবিকার সন্ধানে, রাজপথে গুন্ডা-ষন্ডার কবল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে পালিয়ে এসে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলো আমার কুটির আঙিনায়। বৃষ্টি ভেজা অপরূপ বর্ষার কাতর চাহনী আর কাহিনী শুনে বলেছিলাম, ‘কাল সকালে তোকে গাড়িতে উঠিয়ে দেবো। তুই গাঁয়ে ফিরে যা। এই শহর থেকে অনেক আগে সুখ পাখি উড়ে গেছে।’
গাঁয়ে ফিরে বর্ষা ওর সুখী দাম্পত্য জীবনের অনেক কথাই লিখেছে আমায়। গাঁয়ের তাগড়া যুবক সৌরভের প্রেমডোরে বাঁধা পড়ে বর্ষা টানা তিন বছর তার দেহ মন আর মাতাল যৌবনের সবটুকু সমর্পণ করেছে স্বামী সৌরভের কাছে। কিন্তু বর্ষা মা হতে পারেনি। অজ পাড়া-গাঁয়ের কবিরাজ, তাবিজ-কবচ কিছুই বাদ রাখেনি। পরে পাশের বাড়ির বান্ধবীর পরামর্শে ডাক্তারি পরীক্ষায় বর্ষা নিশ্চিত হলো সে মা হতে পারবে তবে সৌরভ কখনো বাবা হবে না। পরের চিঠিতে বর্ষা লিখেছে, ‘দাদা, এই সমাজ বড় কঠিন। কথায় কথায় শাশুড়ির খোঁচা, পাড়ায় কথা ওঠে আমি অপয়া, বন্ধ্যা, অলক্ষী। একদিন বর্ষা-দুপুরে ঢেঁকিতে পা দেওয়ার কালে শাশুড়ির খোঁচা খেলাম।- বলল, আচ্ছা বৌমা, টানা তিন বছর পার হলো, আমি কি নাতি-নাতনির মুখ দেখব না?- সেদিন রাতভর কেঁদেছি। স্বামীর বাহুডোরে নিজেকে সমর্পণ করেছি। কিন্তু না, আমি মা হতে পারিনি। সৌরভ আমাকে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে।’
তার পরের চিঠির বিশেষ দ্রষ্টব্যতে বর্ষা লিখেছে সৌরভের বন্ধু অনীকের কথা। ‘সাঁঝ বেলার আলো-আঁধারে অনেকটা ছোঁ মেরে অনীকের বাহলগ্না হয়ে সেই যে এলাম, সেই আসায় আমি মা হয়েছি। গাঁয়ের যাত্রাপালার তরুণ নায়ক অনীক এখন আমার স্বামী। কোলে আমার ফুটফুটে পুত্র সন্তান। সকালে অনীককে বলে রেখেছি, কাগজ আর খাম নিয়ে এসো, দাদাকে চিঠি লিখব। কাগজ আর খাম এনে দিয়ে অনীক বলল, ইচ্ছেমত চিঠি লিখো। দাদাকে আমার সালাম দিয়ো।”
প্রিয় দাদা, আজ তারা ভরা রাত। শর্মিলাকে বলেছি, চল আজ রাতে আকাশ দেখব প্রাণভরে।
শর্মিলার হাত ধরে হেঁটে চলছি গাঁয়ের প্রান্তসীমায়, কোত্থেকে হঠাৎ পলাশ এসে দাঁড়ালো সামনে। বলল- চলো বর্ষা, তুমি আবারো মা হবে....
মূল চিঠিখানা ছিল এরকম-
প্রিয় দাদা,
সালাম-আদাব আর শ্রদ্ধা নেবেন। আজ কদিন ধরেই ভাবছি আপনাকে আরো একটা চিঠি লিখবো। তাই জলভরা মেঘের অপেক্ষায় ছিলাম। তারপরও মনে একটা শংকা ছিলো আমাকে খারাপ ভাববেন, আমি স্বামী বদল করেছি মাতৃত্বের তীব্র আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্যে। পিতৃত্বের ক্ষমতা বঞ্চিত সৌরভকে ছেড়ে আমি এখন অনীকের বধূ হয়েছি। সেও একজন সুপুরুষ, তাগড়া যুবক। সে আমাকে মা হবার সুযোগ দিয়েছে, এই তো আমার পরম পাওয়া। সুখের ব্যাপার হলো সৌরভ আর অনীকের বন্ধুত্বে এখনো চির ধরেনি। গাঁয়ের যাত্রাপালায় ওরা একনো যৌথভাবে অভিনয় করে। সেদিন যাত্রাপালায় দুজনের যৌথ অভিনয় দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছি বৈকি। দৃশ্যটা ছিল- সেনাপতি সৌরভের অসির প্রচন্ড আঘাতে ধরাশায়ী হলো প্রতিপক্ষ অনীক। ওহ! ডর হয় দাদা, যদি ওদের মাঝে এমন কিছু ঘটে যায়? স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, ওদের বন্ধুত্ব টিকে থাক চিরকাল। এ যাত্রা নাটকে গাঁয়ের কিশোর-কিশোরী ছেলে-বুড়ো গাঁয়ের বধূরা বেঁধে যায় আবার রাত হলেই ফিরে আসে। আমি যাই আমার সই শর্মিলীর সাথে। ফিরেও আসি ওর সাথে।
ঘনঘোর বর্ষা-দুপুরে কাঁথা বালিশ বিছিয়ে আপনাকে চিঠি লিখছি, আজ দুপুরে বৃষ্টি বিরতির ফাঁকে সূর্যটা দারুণভাবে হেসেছিল। সূর্যের এই হাসি যেন আমার মন-জানালা নতুন এক রোমান্টিকতায় ভরিয়ে দিল। মনে মনে মুচকি হেসে ভাবলাম, আমিতো প্রেম দিতে জানি, তাহলে কেউ চাইলে প্রেম দিতে আপত্তি হবে কেন? প্রিয় দাদা, আমার এই পত্রের শেষাংশের লাইনগুলো আপনার মর্মপীড়ার কারণ হবে সন্দেহ নেই। তবুও আপনাকে না লিখে পারি নে। শুনেছি যাত্রার নর্তকীর সাথে অনীক নাকি চুটিয়ে প্রেম করছে। যাকগে বাবা, এ আমার শোনা কথা। বিশ্বাস করুন দাদা, অনীকের পা ছুঁয়ে বলেছি- প্রিয়তম, তুমি আমাকে গৃহছাড়া করো না। যা শুনেছি তা যেন মিথ্যা হয়।
সেদিন গাঁয়ের ধানকাটা বিলে ছিলো অনুষ্ঠান, সন্তানের অসুস্থতার ভান করে বলেছি- পালা শেষে বাড়ি ফিরে এসে তাড়াতাড়ি। তাই হবে।- বলে অনীক যে গেল, সে রাতে আর ফিরেনি। শর্মিলাকে বলেছি, চল আজ যাত্রায় যাব।
মাঠের একপাশে বসে দুই বান্ধবীর অধীর অপেক্ষা! রাতের শেষ প্রহর। যাত্রার শেষ পর্ব যখন শেষ হলো, তখন আলো-আঁধারির লুকোচুরি। ঘোমটা দিয়ে দুজনই এগিয়ে যাই মঞ্চের পাশে। তারপর দাদা যা দেখলাম, তা আমি আপনাকে কী করে লিখি? তারপরও লিখছি এই কারণে যে, পুরুষ শাসিত সমাজে আমার মত বর্ষা বেগমরা বার বার পরাজিত হয়। কুলটা, দ্বিচারিণী, ব্যভিচারী ইত্যাদি শব্দের কশাঘাতে আমরা যখন সমাজে কখনো একঘরে কখনো সমাজচ্যুত হয়ে নষ্ট জীবনে অভ্যস্ত হই, তখন কি পুরুষ সমাজ একটিবার ফিরে তাকায়? যাত্রার নর্তকী অনীকের মন কেড়েছে, ওরা দুজনে দুজনার হয়েছে।
এবার আসি পলাশ প্রসঙ্গে। পলাশ অনীকের বন্ধু। পলাশের সৎ পরামর্শ অনীক উড়িয়ে দিয়েছে। চুটিয়ে চলছে নর্তকী আর অনীকের পরকীয়া। প্রিয় দাদা, আজ তারা ভরা রাত। শর্মিলাকে বলেছি, চল আজ রাতে আকাশ দেখব প্রাণভরে।
শর্মিলার হাত ধরে হেঁটে চলছি গাঁয়ের প্রান্তসীমায়, কোত্থেকে হঠাৎ পলাশ এসে দাঁড়ালো সামনে। বলল- চলো বর্ষা, তুমি আবারো মা হবে....
আমার মনে হল নিঝুম প্রকৃতি যেন বলছে- নদী বয়ে যায়, তরঙ্গ জানে না সমুদ্র মিলায় কোথায়....
ভালো থাকবেন দাদা। আবারো সালাম ও শুভেচ্ছা নেবেন।
আপনার ছোট বোন
বর্ষা...

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই