ইদানিং মানে দুয়েকদিন ধরেই ভুলটা হচ্ছে রাইসার। গত পরশু দিন ভুলটা হল, গতকাল ঠিক ছিল এবং আজও যখন একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হল তার মনে এ বিশ্বাস প্রকট হল যে, কিছু একটা হচ্ছে অথবা দ্বিধার সাগরে এখন সে পতিত। অথচ তার বাইশ-চব্বিশ বছরের এ ছোট্ট জীবন হলেও অভিজ্ঞতা একেবারে কম নয়। এবং এ অভিজ্ঞতায় শেষ পর্যন্ত তার দ্বিধাগুলোকে খুন করে মায়া দিয়ে; শব্দহীন চাকুতে শেষ দেখে দ্বিধা, মুক্ত হয় রাইসা। অবশ্য এ ভুলের জন্য সে নিজেও খুব বেশি দায়ী তা কিন্তু নয়। অপরিসর কর্মজীবি হোস্টেলের একটা টেবিল আর খাটের আভিজাত্যের আয়তনই বা আর কত? টেবিলের উপরে কয়েকটা পাঠ্য বই, পুরনো খাতা- যেটার বয়স কম করে হলেও ছয় মাস! বয়সের ভারে সে ন্যুজ তবে ভেতরে যে জীবনে ভরা; তার অর্ধেকের বেশি পৃষ্ঠা এখনো অক্ষত, কালো দাগ পড়েনি। পাশে গন্ডা মতো ম্যাগাজিন যা বন্ধু তন্বী দিয়েছিল; তার সাহিত্যচর্চার বাতিক আছে কি না!
রাইসা ভেবে পায়না, তন্বী যে মেয়েটি কলেজে যায় নিয়মিত; যাওয়া-আসা করে বাসা থেকে, তার ভেতরে এত ভাব আসে কোত্থেকে! লেখার উপকরণ পায় কোথায়? খাটে একটা বালিশ, তেল চিটচিটে না হলেও খুব বেশি পরিষ্কার নয়। বেডসিটটি মায়ের যুগের! সে যখনি ঘুমাতে যায় মনে হয় মায়ের আঁচলে ঘুমাচ্ছে; বেডসিটটা বড় বেশি মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। টেবিলের এই এক ড্রয়ারই তার সিন্দুক! বিত্তবানদের কত সিকিউরেট বাক্স-পেটরা থাকে, যেখানে নিরাপদে রাখে অর্থ-দলিল। এর বাইরে আছে ব্যাংক, যদিও বা ব্যাংকের নিরাপত্তাও এখন অনেকটা নড়বড়ে। রাইসার এ শহরযাপনের যাবতীয় সম্পদ এ এক ড্রয়ারেই সীমাবদ্ধ। সম্পদ কম হলেও স্থানের গরীবিপনায় তালগোল পাকিয়ে যায় অনেক সময়। গত পরশু হল, আজও! মোবাইলে এলার্মের বিকট চিৎকারে যখন রাইসার ঘুম ভাঙ্গে অন্যান্যদের মতো, তখনো চোখজোড়া লোভী অস্তিত্ব নিয়ে জানিয়ে দেয় বিদ্রোহের কথা। কে শোনে কার কথা! সে প্রবল প্রতিবাদে উঠে বিছানা থেকে এবং সোজা বাথরুম। যেহেতু এক বাধরুম পুরো আট-দশ জন মেয়েকে দৈনন্দিন প্রয়োজন সারতে হয় তাই সেখানে খুব বেশি সময় ব্যয় করার সুযোগ নেই রাইসার, কারোরই। বাথরুম ফেরত সে ব্রাশ হাতে নেয় এবং এ ব্রাশ মুখে দিয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা হচ্ছে। ব্রাশে টুথপেষ্টের বদলে সে কিনা লাগালো ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী! ড্রয়ারে না হয় স্থানাভাবে দুটো জিনিসই এক সাথে রাখে তাই বলে পরশুর ভুলটা আজও? মুখে দিয়ে যখন ভিন্ন স্বাদের সন্ধান দেয় জিহ্বা, তখনই সে শিওর হয় উপরের ক্রিম ভেতরে এসেছে! খাটে বসে সে অবগাহন করে ক্লিনিকে, তার নির্ধারিত কেবিনে।
সাত নম্বর কেবিনের রোগীটার অবস্থা কোন রকম। রোগীর গড়পড়তা হিসেবে বৃদ্ধের তালিকায় পড়ে। বয়সজনিত যে সমস্যাগুলো প্রকট হয় তার অনেক কিছুই এ রোগীর মাঝে বিদ্যমান। তার সাথে আত্মীয়-স্বজন ও তাদের পোশাক-আশাকে বলে দেয় তার বনেদি ঘরের সদস্য। বনেদিপনার চুড়ান্ত পর্যায়ে না থাকলেও বংশ পরম্পরায় তা ধরে রেখেছেন এ রোগী। তার তাছাড়া কেবিন তো সব রোগীই নিতে পারেন না। যাদের পকেট ঔষুধ পথ্যের পেছনে খরচ করার পরেও, অসংখ্য দরকারি-বেদরকারি টেস্টের পেছনে বেশুমার উড়িয়ে দেয়ার পরেও বাড়তি টাকা ঢালতে পারেন তারা অবশ্য সামর্থ্যবান, সেই সাথে চিত্তবানও। আমাদের সমাজে জন্মে উৎসব হয়, মৃত্যুতেও থাকে আয়োজন। যদিও কেবিনে থাকা সব রোগী মৃত্যু যাত্রী নয়; তবুও মৃত্যু দেখে আসা দুর্বল পথিক তো বটে। এ কারণেই রোগীর খাওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও আত্মীয়-স্বজনেরা রোগীকে দেখতে সাথে আনেন বিদেশি ফ্রুট আর দুধ-জুস। সাত নম্বর কেবিনের এ রোগীকে রাইসার কেবল তার দাদার চেহারাই যেন ঘুরে ফিরে আসে। তার দাদা যখন মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করছিল তখন সে পাশেই ছিল, আর ছিল আত্মীয়-স্বজন। শিয়রে ঔষধ, আপেল-আঙ্গুরের প্যাকেট! ফলে অলিখিত এক শ্রদ্ধাবোধ নুয়ে আসে সাত নম্বর কেবিনে। তার দায়িত্বে পাঁচ-পাঁচটা কেবিন। সাত থেকে এগার পর্যন্ত। এখানে আবার সাত সংখ্যাটিই তার প্রিয়। সুতারাং প্রিয় নম্বরের কেবিনে যখন প্রিয়যোগ একজন রোগি আসলেন সে আরো দায়িত্ববান হয়ে ওঠে। যদিওবা সব রোগীই সমান তার চোখে; দায়ভার যেহেতু আছে তাই হালকা করার যাবতীয় আয়োজন সে করেই যায় এবং প্রতিনিয়ত।
সেবা দেয়ার পর যখন কোন রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যায় কেবিন-ক্লিনিকের এসময়কে বিদায় দিয়ে তখন রাইসাও খানিক আবেগজড়িত হয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামনে নেয়, পেটের দোহাই দেয়-এতো তার পেশা! এবং এ কারণে কাদের চাচাকে বড় একটা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। এছাড়া তার আর আছেই বা কি! সে যখন জীবন নামক অথৈ সাগরের কোন কূলই নির্ণয় করতে ব্যর্থ, বিশেষত মা মরা মেয়ের আর থাকে কিছু? বাবা আরো একটা বিয়ে করেছেন এবং দিব্যি মজে আছেন নতুন বৌয়ের শাড়ির তলে। পুরনো বউ কবরস্থ হয়ে বেঁচে গেলেও তিন তিনটে মেয়ে রেখে গেছেন সংসারে। খেটে খাওয়া, মৌসুমী পেশায় পেট চালানো রাইসা বাপের উদাসিন বড় মেয়ে হিসেবে রাইসাকেও বেশ চেপে ধরেছিল। অথচ তার নামটা শুনে যে কেউই ভাববে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। মা হয়তো মেয়ের নাম দিয়েই ঢাকতে চেয়েছিলেন সাংসারিক দৈন্যতা। মেয়েকে ভর্তি করালেন স্কুলে। এস.এস.সি.পাশ দিয়ে রাইসা পা ছুঁয়ে সালাম করতে গিয়ে সবার পা জোড়া পেলেও কেবল পায়নি মায়েরটা। ভাইয়ের মেয়ে মেট্রিক পাশ করল, তারপরে যে দুটো বোন আছে তাদের দায়িত্ব যে রাইসাকেই নিতে হবে তা কাদের ভালই বুঝলেন, সিদ্ধান্তেও এলেন মোটামুটি। মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিলেন নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্সে। গতানুগতিক শিক্ষায় সার্টিফিকেট আসলেও সময় যে চাকরি দিতে পারেনা তা তো দেখা যায় প্রতি মুহূর্তেই। রাইসা সময়কে মূল্য দিলো ডিপ্লোমা কোর্স দিয়েই।
রাইসা এখন বেসরকারী ক্লিনিকের গুরুত্বপূর্ণ নার্স। সেবা দিয়ে বেতন যেমন আসছে, তেমনি তার বোন দুটোও গ্রামের স্কুলে পড়ছে সুন্দরভাবে। যদিও রাইসার তারুণ্যমাখা হৃদয়টায় পলে পলে মিস হয় হ্নীলার ঘরবাড়ি, বেড়ে উঠা, মায়ের কবর, যা ঘাসের চাদরে আশ্রিত, মোলায়িত। বাবাসহ অন্যান্য কুটুম্বদের চেহারা-সুরতও মাঝে মাঝে ভেসে উঠে মনের পর্দায়। তবুও জীবনের বক্সে জ্বালানি দিতে তাকে থাকতে হয় চট্টগ্রাম শহরে। কঠিন হলেও রুটি রুজির নিরাপত্তার মত বড় নিয়ামক যে এ পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই তা খুব করে জানে সে এখন। ধীরে ধীরে বড় একটা নিঃশ্বাস চলে যায় হ্নীলার দিকে।
সেদিন সাত নম্বর কেবিনের রোগীকে দেখতে আসা যুবক, যে কিনা রোগীর নাতি; রাইসার হাতে গুজে দেয় একশ টাকার মাঝবয়সী একটা নোট। বলে- দাদাকে একটু দেখবেন, কোন সমস্যা হলে জানাবেন, আমি তো আছি। রাইসা প্রথম প্রথম উপরি নিত না; প্রথমত লজ্জায় এবং মাসিক যন্ত্রণায়। ক্লিনিক তো আমাকে বেতন দিচ্ছে, রোগীকে সেবা দেয়াই আমার দায়িত্ব, সুতারাং উপরি আশা করব কেন? বিশেষত রাইসার সহকর্মী যারা আছেন তারা নেয়, না দিলে বরং সেবার মান হয়ে যায় নিম্নমুখী। তাদের যুক্তি বেতন কম, ওটা দিয়ে চলা যায় না। চলাটাকে একটু মজবুত করার জন্য রাইসাও এখন উপরি নেয় এবং তা স্বাচ্ছন্দ্যেই। রোগীর নাতি মজলিশি মানুষ, যতক্ষণ কেবিনে ছিল রাইসার সাথে হাসাহাসি করছে, দাদার সেবা-শুশ্রুষা করেছে। সে পদ্মা না যমুনা কোন একটা তেল কোম্পানীতে চাকরি করে। পড়ালেখা খুব করেনি, বুঝা যায় কথা বার্তায়। কখনো সখনো অসামঞ্জস্য ইংরেজী শব্দও বলে বেড়ায়। এভাবে হয়তো সে বুঝাতে চায় শিক্ষিত! পদ্মার তেলে পাওয়া অবৈধ টাকায় কত কিছু মনে হয় মানুষের। রাইসাও টাকাটা নিয়ে হাসিমুখে বলে- চিন্তা করবেন না।
রাইসার রাতে যখন কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলের কক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করে কর্মব্যস্ত একটা দিনের সমাপ্তিতে, তার কলার টোন বেজে ওঠে। অপরিচিত নাম্বার, একটু দ্বিধা নিয়ে কলটা রিসিভড করে সে। ওপ্রান্ত থেকে পরিচয় দেয়- আমি ফজল, সাত নম্বর কেবিনের রোগীর নাতি, আপনি কি ক্লিনিকে আছেন? রাইসা জানায়- তার ডিউটি শেষ। ফজল বলে- তাহলে সে এ বেলা ক্লিনিকে আসছে না। কথার মাথামুন্ডু না পেয়ে লাইন কেটে দেয়। সে ভাবনায় পড়ে- তার নাম্বার কোথায় পেল ফজল? অন্যান্য বিষয়ে খুব স্মার্ট না হলেও মেয়েলি ব্যাপারে ছেলেটি ওভারস্মার্ট! এখন অনেক কিছুই হয়, সুতারাং ওসব নিয়ে ভাবতে নেই। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেয় রাইসা।
পরের দিন ডিউটিতে আসে রাইসা। বৃদ্ধের অবস্থা প্রায় ভালোর দিকে। চার পাঁচ দিন এ ক্লিনিক যাপনে বৃদ্ধ সুস্থের পথে, আজই রিলিজ হতে পারে। আট আর এগার নম্বর কেবিনে এসেছে নতুন রোগী। একজন মহিলা- দুই সন্তানের জননী, স্বামী প্রবাসে থাকে। অন্যজন বৃদ্ধ। বিকেলের দিকে ফজল আসে দাদাকে নিয়ে যেতে। এই মানুষটি যে গত সন্ধ্যায় যাচিত হয়ে ফোন দিয়েছিল তার কোন রেখাপাত নেই এই চেহারায়। যাওয়ার সময় বলে- অনেক কষ্ট দিলাম, ভাল থাকবেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাইসার হাতে গুজে দেয় দুটা নোট, সম্ভবত একশ টাকার। রাইসা মৃদু আপত্তি তোলে; পরক্ষণে টাকার অলৌকিক পাওয়ারে সম্মতি জানিয়ে বলে- এটা আমার দায়িত্ব। ফজল মুখের কথা একপ্রকার কেড়ে নিয়ে বলে- না, না আপনি যা করেছেন, খুব বেশি করেছেন। নিচু গলায় সে আরো যোগ করে- কথা হবে! রাইসার মুখের কথা আর ফিরে না আসলেও তাদের বিদায় জানায় কোনমতে।
এভাবে চলে যায় রাইসার। মাস শেষে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়, নিজের যে পড়ালেখা সেখানেও খরচ আছে টুকটাক। হোস্টেলের বিল পরিশোধ করতে হয় নির্দিষ্ট সময়ান্তে। তবুও কিছু থাকে সঞ্চয়ে, ওই উপরি নেয়ার বদৌলতে। আজ সন্ধ্যায় আবারও ফোন আসে; ফজলের। একটু সৌজন্য বিনিময়ের পর ফজল বলেই দেয়- চলেন না একদিন ঘুরে আসি... নিশ্চুপ রাইসার কি বলার থাকে? এ তো দেখি বসতে বললে শুতে চায়! অবশ্য এ ব্যাপারটা নতুন নয়। এ ক্লিনিকে সেবা দেয়ার পর থেকে অনেক প্রস্তাব সে পেয়েছে। কেউ বউ হিসেবে তাকে, কেউ বা নিতে চায় বিছানায়। এগুলো শুনতে শুনতে সে অভ্যস্ত। ওরা হয়তো সুযোগ নিতে চায় সুশ্রী একজন তরুণীর সেবা দেয়ার বদলে যে পেট চালানো তাতে। রাইসা কানকে বলে- নিচু হয়ে যাও।
শুয়ে শুয়ে ভাবে বিষয়টা। সে যখন ক্লাস টেনের মধ্য মানের ছাত্রী, তখন ক্লাসমেট সুজনের সাথে কিছুুটা ভাব হয়েছিল। কয়েকদিনের অদর্শন ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে সুজন খবর পাঠায়- বাঁশ বাগানের দিকে এসো বিকেলে। প্রেমিক পুরুষের টানকে প্রশ্রয় দিতে কত জোড়া চোখ যে ফাঁকি দিতে হল রাইসাকে তা সে-ই জানে। অথচ সুজন কিনা দেখা করতে ডাকে নি, কিশোরী প্রেমিকার মুখ দেখতে ডাকে নি, ডেকেছে জোরাজুরি করতে! পালিয়ে বাঁচল রাইসা। এরপর অনেক আবেদন আসলেও প্রেম নামক মোহে সে আর পা দেয়নি; রোগী- সেবা আর বোন-বাবা নিয়ে এখনকার ভাবনা। ফজল কী চায়? রাইসা খুব করে ভাবে আর অস্ফুট স্বরে যেন বলে- আমাদের জীবনে প্রেম নেই!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন