চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

নসুয়ার কান্না

নসুয়ার কান্না | এনামুল রেজা   


আমিই সে, যে তখনই মরবে যখন সময় আসবে। যতক্ষণ বেঁচে আছি, আমায় নিজের মত বাঁচতে দাও।
-জিমি হেন্ড্রিক্স
জন্ম থেকে হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে ভুগতে থাকা মহল্লার সমবয়সি ছেলেটা আজ সকালে মারা গেছে, তার মায়ের অবস্থা মাথা খারাপের মত, বন্ধুরা শোকে আপ্লুত। ছেলেটা গিটার ভালবাসতো, রাউটার দিয়ে ব্রডব্যান্ড নেট চালাতো কিংবা আড্ডায় ছিল প্রাণখোলা- এইছাড়া তাকে নিয়ে আমার বড় একটা ধারণা নেই। শুধু জানতাম, তার শারিরীক অবস্থা ভয়ানক খারাপ, স্বাভাবিক চলতে ফিরতেই যেকোন দিন সে মারা যেতে পারে। তরুণ কোনো প্রাণ ঝরে গেলে সারা মহল্লায় সেই ঝরে যাওয়ার বিষাদ সঙ্গীত বাজতে থাকে অথচ আমার নিষ্ঠুর মস্তিষ্কে শোকের বদলে জায়গা করে নিল গাঢ় মৃত্যুচিন্তা।
নসুয়া ছিল কাফন চোর, গ্রামের যে-ই মারা যেত নসুয়া তার কবর খুঁড়ে কাফন চুরি করবে। ব্যাপারটা সারা গ্রামে চাউর ছিল অথচ কখনও তাকে হাতেনাতে কেউ ধরতে পারতোনা। একবার এক বুড়ি তাকে পথে আঁটকালো।
ছোটবেলায় আমার শিশুমন মৃত্যু ব্যাপারটিকে নিত স্মৃতিসমাপ্তির বেদনা স্বরুপ। পঁয়ষট্টিতে পৌছে আমার জিলাপি দাদা যেদিন মারা গেলেন, স্মরণ হচ্ছে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল। সারা বছর মাঝেমধ্যে দাদীর এই বড়ভাই খুলনায় আমাদের বাসায় আসতেন। দাদী যে ঘরে ঘুমাতেন, আমরা সেটিকে বলতাম বড় ঘর। রাত নামলে বড়ঘরে দাদার হাতে বানানো প্রাচীন পালংকে ঘুমুতেন দাদী, জিলাপি দাদা আর আমি বিছানা করতাম মেঝেতে। তখন শুরু হত ভুতের গল্প, মাঝেমধ্যে দাদী যোগ দিতেন সেই গুজুর গুজুর রকমের গল্প আসরে। শুক্রবার রাত সাড়ে দশটায় বিটিভিতে তখন এক্স ফাইলস হত, জিলাপি দাদা আর আমি রাত জেগে সেই টিভি শো দেখতাম আতংক নিয়ে। তিনি যখন মারা গেলেন, আমি ভাবলাম, একসাথে কাটানো ওইসব গল্পময় রাত্রিগুলো আমার জীবনে আর ফিরে আসবেনা, চাইলেও জিলাপি দাদা আমাকে শুনাতে পারবেন না কোন রহস্যময় কাহিনী কিংবা আমি জিলাপি দাদা বলে আর কাউকে ডাকবোনা। বড় হবার পরেও মৃত্যু নিয়ে এই স্মৃতির বিলাপ কমলোনা। পরিচিত গন্ডীর যেই মারা যায়, আমি ভাবতে শুরু করি তার সাথে কী কী স্মৃতি আমার ছিল? স্মৃতিটাই আদতে শোক, এই তথ্য জানলাম আরও বহুপরে, কিন্তু এই শোক ভাবনাতেই কি আমার মৃত্যু চিন্তা থেমে ছিল? শোকের সাথে যোগ হত ভয়। স্মরণ হত নসুয়ার গল্প।
নসুয়া ছিল কাফন চোর, গ্রামের যে-ই মারা যেত নসুয়া তার কবর খুঁড়ে কাফন চুরি করবে। ব্যাপারটা সারা গ্রামে চাউর ছিল অথচ কখনও তাকে হাতেনাতে কেউ ধরতে পারতোনা। একবার এক বুড়ি তাকে পথে আঁটকালো। লাঠিতে ভর দিয়ে কোন রকম দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধার দিকে কাফন চোর নসুয়া তাকালো অবজ্ঞার চোখে।
পথ আঁটকালি কেন রে বুড়ি?
বাপধন, তোকে একটা অনুরোধ কত্তি চাই।
এক পা দিয়ে ফেলিচিশ কব্বরে, একোন আবার কিসের অনুরোদ?
একটা ছোটো কাপড়ের পুঁটুলি নসুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বুড়ি বলল- একেনে আমার জমানো কিচু পয়সা আচে। তুই রেকে দে, শুদু কতা দে আমার কব্বর হলে পরে কাফন তুই চুরি করবিনে?
বুড়ি মারা গেল, তার কবর হল। রাতের মধ্যপ্রহরে নসুয়া ঠিক চলে আসলো তার কাজ উদ্ধার করতে। বুড়িকে কি সে কথা দিয়েছিল? কী আসে যায়। সিঁধ কেটে সে কবরে ঢুকলো, বুড়ির গা থেকে খুলে নিল কাফন কিন্তু বেরুবার সময় দেখলো মৃত বুড়ির শীর্ণকায় একটি হাত জাপটে ধরেছে তার পা! আমার দাদী বলতেন- নসুয়া সারা রাত কেঁদেছিল, রাত পেরিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল দিন। কবর ঘিরে লোকজন জড়ো হয়ে গেল, ভিতর থেকে আসছিল কান্নার শব্দ। কাঁদতে কাঁদতে ভিজে চলেছিল কবরের মাটি, একসময় সেই ভিজে মাটির করুণা হল নসুয়ার উপর, মাটির করুণা মানে স্রষ্টারও করুণা। নসুয়া অবশেষে কবর থেকে মুক্তি পেল, কিংবদন্তি হয়ে গেল তার কান্না। লোকে বলতো- কিছু পাওয়ার জন্য কাঁদতেই যদি হয়, নসুয়ার মত কাঁদো।
মৃতকে দাফনের পর জীবিতরা চল্লিশ কদম এগিয়ে গেলেই শুরু হয়ে যাবে কবর আযাব, শৈশবে কারও জানাজায় গেলে এই ভয় আমাকে জাপটে ধরতো। একেকবার মনে হত, যাকে কবর দেওয়া হল, তার কবরের পাশে আমি একলা যদি বসে থাকি, তাহলে হয়তো লোকটার শাস্তি একটু দেরিতে শুরু হবে। মৃত্যু মানেই যে নিঃসঙ্গতা, সেটি তখন আষ্টেপৃষ্টে জাপটে ধরতো আমাকে। মনের গহীন স্বত্তায় নিঃসঙ্গতার বিপুল ভাঁড়ার থাকার কারণে মানুষ একাকিত্বকে ভয় পায়, শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই।
আজকাল চারপাশে মৃত্যু সংবাদের এত আধিক্য, আলাদা করে ভাববার ফুরসৎ মেলেনা কিংবা ফুরসৎ হয়তো আমাদের কখনই ছিলনা। মৃত্যু নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা কেবল স্মৃতি। আমার খুব প্রিয় উপন্যাস দ্যা বুক থিফ-এ মৃত্যুর যবানীতে অদ্ভুত এক আক্ষেপ আছে। মৃত্যু বলছে- মাঝে মাঝে আমার নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে করে যখন দেখি কত বিচিত্র ভাবেই না মরতে পারে মানুষ! শুভ্র নামের যে ছেলেটা আজ মারা গেল, তার একটা সুবিধা ছিল। মৃত্যুর জন্য চিকিৎসক তাকে বেঁধে দিয়েছিল সংকেতধ্বনি। আমরা যারা নিজেদের সুস্থ স্বাভাবিক দাবি করি, তাদের কিন্তু সে সুবিধা নেই। এই বিচিত্র দেশে আপনি আপনি এমন কী কথা বলবার অপরাধেও মারা যেতে পারেন কিংবা আঁৎকা কারো বিনোদনের জন্যেও!

লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই