ইলিশ | জুয়েল বড়ুয়া বাপ্পু
নদীর জলে শরীর ডুবিয়ে বসে আছে কয়েকটি সাদা বক। জলের শীতলতায় ক্লান্ত ডানাদুটো একটু ভিজিয়ে নিচ্ছে। একটু পর পর মাথাটা জলের নিচে ডুবিয়ে দিচ্ছে আবার জলের উপরে তুলে চারিদিকে তাকাচ্ছে। অল্প কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে খেজুর গাছের বাঁধানো ঘাটে বসে সেই সাদা বকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে নবারন। উদোম শরীর। পিঠের মধ্যে রং জ্বলা পুরনো একটা গামছা ঝুলছে। মুখে লম্বা দাড়ি। মাথায় অগোছালো এলোমেলো চুল। লুঙিটা হাঁটু পর্যন্ত পড়া। হাতের মধ্যে একটা বিড়ি। কিছুক্ষণ পর পর মুখের মধ্যে নিয়ে বিড়িটাতে টান দিচ্ছে। বিড়ি টানতে টানতে নবারন ভাবছে- ভাটির টানে কোনবেলা নদীর জল শুকাইবো। জল নাইমা গেলে চরের জমিনে লাঙল দিইয়া বীজ বুনন যাইবো। আর হেই বীজের ফলন দিয়া বউ পোলা লইয়া পেট ভইরা কবেলা ভাত খাওন যাইবো। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজে নবারনের ভাবনার মধ্যে ছেদ পড়লো।
: কি হে নবারন পানিতে ভাটির টান লাগছে নি?
বিড়িতে টান দিতে দিতে নবারন ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাতেই হাত জোড় করে প্রনামের ভঙ্গিতেই বলে উঠলো-
:আজ্ঞে কর্তাবাবু যে! নমস্কার কর্তাবাবু। আপনি এইখানে?
(কর্তাবাবু ওরফে বিজন মজুমদার।স্বপ্নাপুর গাও গ্রামের বড় কর্তা।গাঁয়ের প্রভাবশালী মোড়ল)
নবারনের মুখের দিকে তাকিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে পান চিবোতে চিবোতে কর্তাবাবু বলে উঠলো-
:দুপুরে আইজ ভাত ঘুম দিতে ইচ্ছে করলো না। চৈত্রের গরমখান যেন আইজ আরো ক্ষেইপা নামতাছে। ভাবলাম যাই একটুখান নদীর পাড় থেইকা ঘুইরা আসি। বাতাসে শরীরখান একটু জুড়াইবো। তা কি বুজতাছোস নবারন পানি কমবো নি?
:আজ্ঞে কর্তাবাবু আরো দুই একদিন লাগবো মনে হয়।
:ভাটিতে টান পইড়া গেলে জমিনে চাষ দিবি নি?
:চাষ তো দেওন লাগবো কর্তাবাবু। নইলে তো না খাইয়া মরণ লাগবো।
:মরবি কেন নবারন। তোদের এই কর্তাবাবু থাকতে...(বিজন মজুমদার মুখ থেকে পানের পিরিক বের করে মাটিতে ফেললো) জল নাইমা গেলে বীজ বপনের সময় বসুর দোকান থেইকা বীজ লইয়া যাইস, আমি কইয়া রাখুম। ফলন দেওনের কালে তোর কর্তাবাবুরে একটু দেইখা দিবি আর কি!
:এইডা কি কইলেন কর্তাবাবু। ভগবানের পর আপনি হইলেন আমাগো ভগবান। আপনার কথার বাইরে এই গাও গেরামে কেউ কথা কইবো এই কথা ভাবলে যে পাপ কর্তাবাবু।
:নবারন নদীর ধারে বইসা থাইকা কি করবি। চল একটু গঞ্জের দিকে যাই। বাজার বসতে বসতে পৌঁছামু নি?
:চলেন কর্তাবাবু। বেলা একটু পড়তে পড়তে বাজার বসবো, এহন রওনা দিলে সময়মতো পৌঁছাইয়া যামু।
নবারন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
নদীর পাড় ছেড়ে নবারন আর বিজন মজুমদার গঞ্জের দিকে হাঁটতে লাগলো। সামনে সাদা পাঞ্জাবি আর ধবধবে ধূতি আর পায়ে কালো রংয়ের চটি পরা বিজন মজুমদার আর পিছু পিছু হাঁটছে উদোম শরীরটায় গামছায় পেছিয়ে হাড়লিকলিকে শরীরের নবারন।
চৈত্রের রোদগুলো যেন ঝিম ধরে বসে আছে পুরোটা মেঠো পথ জুড়ে। রোদের বিপরীতে গাছ গাছালির ছায়াগুলো যেন মাটির বুকে শুয়ে পড়েছে। সেই ছায়াতে কয়েকজোড়া কাক নির্লিপ্ত ভঙিতে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বিজন মজুমদার আর নবারন পথের ধুলো এড়িয়ে রাস্তার একপাশে হেঁটে চলছে।
:নবারন।
:আজ্ঞে কর্তা।
:চৈত্রের খরতাপটা দেখছোস নি। কেমুন যেন ভ্যাপসা ভ্যাপসা পুড়িয়ে যাচ্ছে সব। সামনে তো বৈশাখ জেষ্ঠ্য পইড়া রইছে।
সাদা পাঞ্জাবি আর ধবধবে ধূতি পরিহিত বিজন মজুমদার গলাটাকে সামান্য আকাশের দিকে হেলে ডাবের পানি খাচ্ছে। নবারন সেই দৃশ্যটার দিকে আনমনে তাকিয়ে রইলো। ডাবের ছিদ্র দিয়ে ডাবের পানিগুলো নেমে এসে বিজন মজুমদারের গলা হয়ে কন্ঠনালী হয়ে শরীরের ভিতর ডুকে যাচ্ছে। নবারনের মনে হলো এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এইভাবে ডাবের পানি খাওয়া শুধূমাত্র তাদের কর্তাবাবু বিজন মজুমদারকেই মানায়।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন