চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া

দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া | রহমান মিজান


কথায় আছে, “মক্কার লোক হজ্ব পায় না”। আর চাঁটগার ভাষায় যদি বলি, “ঘরর গরু ঘাড়ার ঘাস ন খায়”। আমরা ক’জন, আমি, অনিমেষদা, হুমায়ুন ভাই এবং মিজান ভাই চাঁটগার বাসিন্দা। চাঁটগার বাসিন্দা হলেও বৃহত্তর চাঁটগার অনেক আনাচ-কানাচ আমাদের দেখা হয়নি। অন্যদিকে আলীম ভাই এবং তার পরিবার সিরাজগঞ্জের মানুষ। বৃহত্তর চাঁটগা না দেখাটা তার জন্য স্বাভাবিক। ইতোপূর্বে আমি, হুমায়ুন ভাই এবং মিজান ভাই আলাদা আলাদাভাবে বান্দরবানের আশপাশ দেখে আসলেও নীলগিরি পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।
অনিমেষদারতো কথা একটাই, বেঁচে থাকলে এই ঈদের বন্ধে বান্দরবান অবশ্যই দেখে আসব। ঈদের বন্ধের আগেই আমরা পরিকল্পনা করে নিয়েছি কিভাবে বান্দরবান যাব। পরিকল্পনা অনুযায়ী ০৯/১০/১৪ইং তাং আমি বহদ্দার হাট বাস স্টেশন থেকে পূরবী পরিবহনের ৫টি সিট বুকিং করলাম বান্দরবান শহর পর্যন্ত। অন্যান্য সময় প্রতি সিট ভাড়া ৮০ থেকে ৯০ এর মধ্যে হলেও ঈদের ছুটিতে ভাড়া দিতে হল ১১০ টাকা। আমি, আলীম ভাই এবং উনার পরিবার বাস স্টেশন থেকে সাড়ে ৪টায় রওয়ানা দিলাম। অনিমেষদা এবং হুমায়ুন ভাই গাড়িতে উঠলেন পটিয়া সদর থেকে সন্ধ্যা ৬টায়। আমরা যখন সাতকানিয়া কেরানীহাট পার হয়ে বাজালিয়া পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে প্রায় ৭.৩০ টা। মিজান ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বাজালিয়া বাস স্টেশনে। গাড়ি থেকে নেমে একটি টম টম এ করে আমরা সোজা গিয়ে পৌঁছলাম মিজান ভাইদের বাড়ি।
চারদিকে গাছ-গাছালিতে ভরা, মাঝে ছোট্ট মাটির ঘর। বাড়িটি সাঙ্গু নদীর পাড়েই। সাঙ্গু নদীর পাড়ের রাস্তাটি একেবারে পিচ ঢালা। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর গিয়ে নেমে পড়লাম নদীতে। নদীতে পানি নেই। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি তেমন থাকে না। বর্ষা মৌসুমে পানি থৈ থৈ করে। নদীতে দাঁড়িয়ে আমরা অনেকক্ষণ জোছনার আলো গায়ে মাখালাম আর সেই সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলল আলাপ-আলোচনা। মিজান ভাই এবং তার ফুফাত ভাই তসলিম বললেন, নদীর ওপারে প্রায়ই বন্য হাতি দলবেঁধে চলে আসে। এসে মানুষের ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা সব লন্ড-ভন্ড করে দিয়ে যায়। ০৯/১০/১৪ইং তাং রাতটা আমরা মিজান ভাইদের বাড়িতে কাটিয়েছি যাতে পরদিন বান্দবানের সব দর্শনীয় জায়গা সুন্দর ভাবে দেখে আসা যায়। এক কথায় যদি বলি মিজান ভাই, উনার বাবা-মা এবং দুই বোনের আথিতেয়তা ছিল সত্যি প্রশংসা করার মতো। অথিতির যাতে কোন প্রকার সমস্যা না হয় সে চেষ্টাই যেন করেছিলেন সবাই।
পরদিন আমাদের রিজার্ভ করা নোআ গাড়িটি সকাল ৭.৩০ টায় ঘরের দুয়ারে এসে হাজির। সকাল বেলায় হালকা নাস্তা করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবানের দর্শনীয় স্থান দর্শন করার জন্য। প্রথমে আমরা সরাসরি রওয়ানা দিলাম পর্যটন কেন্দ্র নীলগিরি দেখার উদ্দেশ্যে। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি ৫২ কিমি দূরে আর উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ২শ ফুট। এ পর্যটন কেন্দ্রটি সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত। এখানে বেশ কিছু ভালো মানের কটেজ তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে। কেউ ইচ্ছে করলে এখানে রাত্রি যাপনের জন্য কটেজগুলোতে কক্ষ ভাড়া নিতে পারেন। নীলগিরিতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে মেঘের মিতালী। আকাশের মেঘ একেবারে হাতের নাগালে। যেন কাশফুলের নরম ছোঁয়া। গাড়ি থেকে নেমেে সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। প্রকৃতিতে রোদের তেজ একটু বেশি ছিল কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। সবাই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত।
তখন বেলা ১১ টা। সবারই কিছু খাওয়া দরকার। কিন্তু খাওয়ার কথা কারোই মনে নেই। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সবাই খাওয়ার কথা ভুলে গেলেন কিন্তু একমাত্র অনিমেষদা ছাড়া। উনি বেশ কিছুক্ষণ খাই খাই করেই গেলেন। নীলগিরি দর্শন করে বেরিয়ে পড়লাম চিম্বুক পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের কূলে নেমে আমরা কিছু খেয়েনিলাম। তারপর উঠে পড়লাম পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে দেখা যায় সবুজ পাহাড় আর পাহাড়। চিম্বুক পাহাড় পর্ব শেষ করে শুরু করলাম শৈলপ্রপাত পর্ব। চিম্বুক পাহাড় থেকে শৈল প্রপাতের দূরত্ব ১৮কিমি। শৈল প্রপাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সড়কপথ থেকে সিড়ি বেয়ে নিচের দিকে নামতে হয়। নামার পথে রয়েছে স্থানীয় আদিবাসীদের একটি ভ্রাম্যমান বাজার। তাদের তৈরী চাদর আর পাহাড়ী ফলমূল কেনা যায় এ বাজার থেকে। তবে এখানে তুলনামূলক দাম একটু বেশি। শৈল প্রপাতের আশে পাশের গ্রামটি বম আদিবাসীদের।
শৈল প্রপাতের হিম-শীতল ঝর্ণাধারা সারা বছরজুড়েই বহমান। শৈল প্রপাতের অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে আমাদের হুমায়ুন ভাই হারিয়ে গিয়েছিলেন অনেকক্ষণ। পরে উনাকে খুঁজে বের করে আনতে হয়েছিল। বান্দরবান শহরের কাছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম নীলাচল। শহর থেকে প্রায় ৮কিমি দূরে টাইগার পাড়ায় এ পাহাড়টির উচ্চতা এক হাজার ফুট। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বান্দরবান শহরসহ নানা সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে মেঘের লুকোচুরি খেলা। নীলগিরির উষ্ণ আবহাওয়া নীলাচলে এসে শীতল হয়ে গেল। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার স্বাদ আমাদের মাঝে তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।
আলীম ভাই, পরিবার আর প্রকৃতিকে একের পর এক ক্যামেরাবন্দী করতে লাগলেন। নীলাচল থেকে বেরিয়ে বান্দরবান চন্দ্রঘোনা সড়কের পুল পাড়ার জাদির পাহাড়ে গেলাম আমরা। এ পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্বর্ণ মন্দির। এ মন্দিরকে বুদ্ধধাতু জাদি নামে অবহিত করা হয়। পটাপট কিছু ছবি তুরে নিলাম আমরা। স্বর্ণ মন্দির দর্শন শেষে আমরা হাজির হলাম চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কের পাশেই মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্সে। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে লেক, দুটি ঝুলন্ত ব্রীজ, চিড়িয়াখানা, ক্যাবল কার। একটি ঝুলন্ত ব্রীজ দিয়ে ওপারে পার হয়ে আমরা চারপাশ ঘুরে, চিড়িয়াখানার মায়া হরিণ, অজগর, নেকড়ে বাঘ, বানর, সজারু ইত্যাদি দেখেশুনে অন্য ব্রীজটি দিয়ে এ পাড়ে পার হয়ে আসলাম।
মেঘলা দর্শন যখন আমাদের শেষ হয় তখন ঘড়িতে সময় প্রায় সন্ধ্যা ৬.০০ টা। হাতে সময় আর নেই। বান্দরবানের অপরূপ সৌন্দর্যকে পিছনে ফেলে আজই ফিরতে হবে ইট, বালি, সিমেন্টের জঙ্গলে ভরা শহুরে পরিবেশে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ন্যাচারাল পার্ক আর ছোট্ট শহর বান্দরবানের পাশে অবস্থিত বোমাং রাজার রাজ বাড়িটি দেখা হলো না। সারাদিন ছোটাছুটি করে সবাই ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, তারপরও সবাই যেন প্রাণবন্ত। ফেরার পথে বান্দরবানের অপরূপ সৌন্দর্য যেন বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তাই মনটি নিজের অজান্তেই বলে উঠল, “আবার আসিব ফিরে বান্দরবানের তীরে, হয়ত আজ নয়, অন্য কোন সময়, অন্য কোন রূপে”।

 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই