অ্যানোনিমাস | লুৎফুন নেছা শান্তনা
ভাটি অঞ্চলের কইন্যা অনেকদিন পর আয়নায় নিজের মুখ দেখল অনেকক্ষণ খুঁটে খুঁটে। অথচ সহস্রবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পরিপাটি করার পরও আজ তার মনে হল নিজেকে দেখছে। কয়েকটা পাকা চুল আর বেশিরকম কুঁচকে যাওয়া চোখ দেখল খুঁটিয়ে। আজ সব খুঁটিয়ে দেখার দিন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, ময়লা লুঙ্গি পরা এক যুবক এবং পরিপাটি পোশাকের এক যুবক পাশাপাশি হেঁটে গেল, দুটো কাক ডাস্টবিনের সামনে গম্ভীর মুখে বসে থাকল কিছুক্ষণ আর একটি রিকশা দু’জন মানুষ নিয়ে বেশিরকম শব্দ তুলে চলে গেল যে কোন দিকে। জোড়াময় ক্লান্তি তাকে আবার ফিরিয়ে আনল ঘরে আয়নায় আবার নিজেকে দেখল, চামড়াময় মুখ, নাক, আহা ভেতরটা যদি দেখা যেত! কী আছে সেখানে! একটি প্রকান্ড মাঠ? একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা একটি একা গাছ? যার ডালে বসে একটি অচেনা পাখি করুণ সুর ছড়িয়ে দেয় দিগন্ত পর্যন্ত ! অায়না থেকে ফিরে বিছানায় বসল, ঘুম নয় ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে দিল।
একটা বন বাদাড়ের পথে যেতে যেতে এক শিয়ালের সাথে দেখা হল, “ফিনিক্স পাখিকে দেখেছ?”
শিয়াল ঘাড় উঁচু করে বলল, “এইয়া”। “এইয়া” মানে “না”, বাবা বলেছিলেন। একগাদা চিনা উপাখ্যানের মালিক রুমকি বড় বড় চোখে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল। “না” মানে “এইয়া”?? কি অবাক করা কথা!
বাবা বলেছিলেন সব পশু একই ভাষায় কথা বলে। সোঁদা গন্ধে মিশে যাওয়া বাবার জন্য বুকটা ব্যথা করে উঠল। পৃথিবীতে দরকারী মানুষগুলো তাড়াতাড়ি চলে যান। আর যন্ত্রণায় কঁকিয়ে দেওয়ার মানুষ বেড়েই চলে। ফ্রক পরা রুমকি দুপদাপ হেঁটে এগুতে লাগল। শেষে লেজঝোলা এসে খবর দিল- ফিনিক্স বনে লাগা আগুনে পুড়ে গেছে। রুমকি অবাক হল! মরে যাওয়ার জন্য কত কেউ আছে, ফিনিক্সকে কেন মরতে হল! লেজঝোলা বলল, মন খারাপ করো না, প্রার্থনা কর, ফিনিক্সের ছাই থেকে ফিনিক্স হয় জানো না?
রুমকি প্রার্থনা করতে বসল কোন ভঙ্গিতে প্রার্থনা করবে না বুঝতে পেরে শুধু বলল, “ফিনিক্স ফিরে এস।” কান্নার দমকে এর বেশি কিছু বলা গেল না ।
তন্দ্রা মিলিয়ে গেল, একালে জেগে উঠা রুমকির পা পায়চারী করল কিছুক্ষণ। সেলফের কাছে গিয়ে টেনে নিল “এ ব্রিফ হিস্টোরী অব টাইম” । পড়ে গেল, মাথায় কিছু ঢুকল না, প্রতিদিনকার ক্লেদে মাথার ভিতরটা যেন জমে গেছে, আবার তাকাল বইয়ের দিকে, কয়েকটা পিঁপড়ে জেগে উঠল, সার বাঁধল, তারপর আরও আরও…। একটা পৃষ্ঠার সবগুলো অক্ষর পিঁপড়ে হয়ে গেল । রুমকি জোরে ছুঁড়ে দিল বইটা । গা ঘেমে নেয়ে একাকার ।
জহিরুলের সাথে বিবাহিত জীবন কেমন অনায়াসে অস্বস্তিকর মেঘ হয়ে ঝুলে আছে, গুমোট, বৃষ্টি নেই! কোথায় যেন শুনেছিল, বিয়ে টিয়ে স্বর্গীয় ব্যাপার। এত অসুখী মানুষগুলো কীভাবে তাহলে দিনের পর দিন শুধু কাটিয়ে দেয় । রুমকি অনেকদিন হল জহিরুলের বউ হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে । সবাইকে স্যাক্রিফাইস করতে হয় তা সে জানে। তবে এই ইভ বা হাওয়ার উত্তরসূরিরাই কেবল নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিয়ে আদমের উত্তরসূরিদের উজ্জ্বল করে দেয়। দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে। রুমকি মাখা চেপে ধরে। রুমকি লিখতে পারত, রুমকি ভুলে গেছে। আজ হঠাৎ অনেকদিন আগের একটা লেখা গোচর হল তার। এগুলো সত্যিই সে লিখেছিল! জহিরুলের দোষ নেই, হয়তো বা কারুরই দোষ নেই। তবে প্রতিদিনের জীবন গোছাতে গোছাতে কখন এসব লেখালেখির দিন, বিশ্লেষণের দিন সুদূর হয়ে গেছে রুমকি জানে না। প্রত্যেকদিন সাধারণ ভীড়ে হেঁটে যাওয়া হাওয়ার উত্তরসূরিরা নিজের ভেতরটায় পর্দা টেনে কী সাধারণ হয়ে থাকে, পর্দা সরলেই হয়তো দেখা যেত সৃষ্টির আকুলতা লুকিয়ে আছে! কিন্তু অন্যের লেখা বইয়ে নিজের সংজ্ঞা পড়ে পড়ে সবাই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। আদি পাপ আদম করেছিল, হাওয়া তার অনুষঙ্গ মাত্র!
রুমকি পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ে, খুট করে দরজা খুলে যায়, একজন দাঁড়িয়ে আছে, কে সে! ভালো করে তাকিয়ে দেখল, লিলিথ! হাওয়ার আগের জন। আদমের শ্রেষ্ঠ্ত্ব মানতে চায় নি বলে ইশ্বর গোস্বা করে হাওয়াকে বানিয়েছিলেন। আর লিলিথের কথা গোপন করে ফেলেন। লিলিখ এগিয়ে এসে রুমকির পাশে বসে। রুমকির ঘুম পায়, শান্তি! লিলিথ জেগে খাকে পাশে। রুমকি হাওয়ার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, কারা যেন দুয়ো দেয় রুমকিকে। তাদের সব কন্ঠস্বর অস্পষ্টতর হয়ে উঠে। হাওয়া বাড়তে থাকে, হাওয়ারা কেবল বাড়তেই থাকে আকার আকৃতি ছাড়া ।
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন