চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ঋতু

ঋতু | ঈশ্বরী মহতাব


ঋতু বসে থাকত তাদের মস্ত বড় পুরনো বাড়ির বারান্দায়। আমরা তার থেকে বছর তিন চারের ছোট। তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ইশকুল যেতাম। তার বয়েস কত হবে তখন, চোদ্দ কি পনেরো? একটি ছায়ামূর্তির মত কৃশাঙ্গী মেয়ে। দেবীর মত মুখশ্রী। কিন্তু বেদনাময়। তাকে কোন কথা বলতে কেউ শোনেনি বা দেখেনি। লম্বা ঝুলের এক ফ্রক পরা, মুখে কি এক অদ্ভুত রকমের হাসি, ব্যঙ্গ না সত্যিকারের হাসি তাও বুঝি নি। তখন অত বোঝার বয়েসও হয়েছে নাকি?

ইশকুলের দলটা দূর থেকে তাকে দেখত। মল্লিক বাড়ির মেয়ে বলে কথা। দু একটি বিচ্ছু হঠাতি হেঁকে উঠত পাগলি বলে। তাতে ঋতুর কিছু এসে যেত বলে বুঝি নি কখনো। আমাদের বাড়ির লোকেরা বলত ভুল চিকিৎসায় মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এদিকে ওদিকে কি একটা ফিস ফাস চলত বুঝতে না পারলেও এটা ধরতে পারতাম যে একটা কিছু আছে। যা আমাদের বলা যায় না।

আমার কাকারা দেখেছে দুএক বছর আগেও ঋতু দারুণ দেমাকি ছিল। অসাধারণ ছবি আঁকত। জিমন্যাস্টিকসেও দারুণ ছিল। এগারো বারোতে সে নাকি কোন বিয়ে বাড়ি গিয়েছিল সেখানে তাকে দেখে ঢাকার প্রাচীন একটি হিন্দু পরিবারের কর্ত্রী তাকে ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চান। তিনি ভেবেছিলেন তার অন্তত ষোল সতেরো বছর বয়স।

আমি মুসলমানের মেয়ে বলে ওদের সাথে বেশি আসা যাওয়া ছিল না। কিন্তু মল্লিকরা মস্ত জমিদার ও ব্যাবসায়ী ওদের প্রতিপত্তি দেশ ভাগের পর কমলেও একেবারে মুছে যায় নি। আমি বড় হয়ে পড়াশোনার জন্য বিদেশ চলে গেলাম। বাইরে বাইরে থাকি। ঋতুর কথা মনেই নেই। বহু বছর পর চাচার মেয়ের বিয়েতে এসেছি। বিয়েটা মল্লিকবাড়িতে হচ্ছে। ওরা বাড়ি বিক্কিরি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। বাড়িটা বিয়ে শাদিতে ভাড়া দেয়া হয়।

বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আমি বাড়িটা ঘুরে দেখছিলাম। ঋতুকে মনে পড়ল। কেন ও বসে থাকত ছবির মত? সত্যি কি মাথা খারাপ ছিল? এসব ভাবতে ভাবতে ছাদে একটা তালা বন্ধ ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকল। ওই ঘরে মেইন সুইচ না কি আছে, ঠিক করতে হবে। আমি তার সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়লাম। একটা গুদাম ঘর বললেই হয়। বহু বাতিল জিনিস পত্তর আছে সেখানে। আমার ছোট থেকে ঘাঁটাঘাঁটি করার শখ। এটা সেটা হাবি জাবির মধ্যে থেকে হঠাৎ দেখি একটা বিবর্ণ মলিন ডায়রি। ধুলো সরিয়ে খুলে পাতা ওলটাই, পাতার পর পাতা শূন্য একটা আঁচড়ও নেই। একদম শেষ পাতায় দুটি লাইন লেখা ছিল।

আখতারদা আপনাকে কতদিন দেখি নি। আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে।  

আমি বাড়ি ফিরে আখতার সম্পর্কে অনেক খোঁজ খবর করেও কিছু পাই না। সম্প্রতি কানাডায় একটা সেমিনারে গেছি, সেখানে আমার অধ্যাপক এক মেমসাহেব আমার কনুই ধরে বলেন ঈশ্বরী তোমার সঙ্গে তোমার দেশের এক বিজ্ঞানীর আলাপ করাব চল।

সৈয়দ রহমান নামক এই বৈজ্ঞানিক প্রায় এক যুগ ধরে বিদেশে পরমাণু গবেষণায় রত। খান দশেক বই ও অসংখ্য পেপার লিখেছেন। আমি সাহিত্যের ছাত্রী, মাস্টারিও করি, আমার সঙ্গে এঁর আলাপ করানোর কারণটা কি?

আমার অধ্যাপিকা নেলি বললেন তোমার বাড়ি ময়মনসিংহ শহরে শুনে রহমান তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। আমি দেখলাম ভদ্রলোকের বয়স আমার চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের বড়। খুব ছোট করে ছাঁটা কাঁচা পাকা চুল, গৌরবর্ণ, খুবই সুদর্শন, লম্বা ও একহারা চোখদুটি দেখলে বার বার তাকাতে ইচ্ছা করে। আমরা একটি কোণে সোফায় বসে টুকটাক আলাপ করছি। হঠাৎ আমার পাড়ার নাম শুনে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, মল্লিকবাড়ি চেনেন?

চিনি না আবার? আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি উনিও একই শহর সম্ভবত একই পাড়ার লোক। আঠার কুড়ি বছরেই দেশ ছেড়ে এসেছেন। উনি একটু গলা পরিষ্কার করে বললেন, জানেন আমি আপনাদের পাড়ায় মানে মল্লিকবাড়ির একটি মেয়েকে অঙ্ক শেখাতে যেতাম।

আমি বললাম, সে তো বহুদিন আগের কথা, আপনার মনে আছে?

তিনি বললেন, মাঝে মাঝে একবার যাব ভাবি, আর হয়ে ওঠে নি। দেখি এবার...

আমি বলি ছাত্রীর সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ হতে পারে তো?

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, সে নিশ্চয়ই এখন বিয়ে টিয়ে হয়ে কোথাও চলে গেছে, দারুণ দেখতে ছিল, অঙ্কের মাথা অবশ্য একদম ছিল না বলে হঠাৎ অপ্রতিভ ভাবে হেসে ফেললেন। আমি ভদ্রলোককে পছন্দ করে ফেললাম।

আমি গুগল করে ওঁর পুরো নাম বের করে ফেলেছি। সৈয়দ আখতার রহমান। সারা বাংলাদেশে ম্যাট্রিকে তৃতীয়। পোস্ট গ্রাজুয়েট করতে বাইশ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়া চলে যান। বাবা ইশকুল মাস্টার ছিলেন। সম্ভবত দরিদ্র।

চ্যাটে দেশের একটি সাংবাদিক বন্ধুকে লাগিয়ে দেখি আখতার ও ঋতুকে নিয়ে পাড়ায় একটা জটিলতা হয়। মেয়েটিকে এক সপ্তাহ ছাদের ঘরে বন্ধ করে রাখা হয় নামমাত্র খাবার দেয়া হয় এমন মারধোর করা হয় যে তার কণ্ঠার হাড় ভেঙ্গে যায়। আখতারকে বাধ্য করা হয় দূরে চলে যেতে।

আমার স্বস্তি হল ভেবে যে আখতার জানে না ঋতুর পরিণতি। সে ইন্ডিয়ায় যায় নি। আমি শুনেছি ওরা চলে যাবার আগেই তার শেষ নিশ্বাস পড়ে ময়মনসিংহেই।


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই