কত কথা যে বলার ছিল | ইফতেখার জামিল
মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কে? কেন ও কীভাবে বেঁচে আছি নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করি। নানা উত্তর সাজাই। ভাষা সাহায্য করে না। ভাষা ও সময়ের সীমাবদ্ধতায় সাজিয়ে কথাগুলো বলে উঠতে পারি না।যদিও ভাষার মাধ্যমেই মানুষ নিজের প্রতিনিধিত্ব করে। করতে পারে। ভাষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, এটা ভাষাহীন না হলে বা ভাষা-অক্ষমতা না থাকলে বুঝা কঠিন। দুইজনের মধ্যে ঝগড়া। মনোমালিন্য। সামনে দাঁড়িয়ে দুটি কথা বললেই সব মিটে যায়। আমারই ভুল ছিল বললেই মুখভরা হাসি দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আবার ঠিকঠাক হয়ে যায়।
ভাষার আবার নিজস্ব চালচলন আছে। আপনি একটা ফল খেতে চান, এটা আপনার মনের মধ্যে আসলো। আপনি দোকানে গেলেন। ইচ্ছাটা স্মরণ করে বললেন, ভাই, আম কত করে কেজি? এক কেজি দিবেন।দোকানদার দাম বলে আপনাকে এক কেজি আম দিলেন, এবার আপনি আম খেতে পারবেন। ধরা যাক, আপনি ইচ্ছার কথা ভুলে গেলেন। কোন ফল খেতে ইচ্ছে করেছেন মনে করতে পারছেন না। বিস্মৃতি।অথবা ইচ্ছার কথা তো মনে আছে তবে ফলটার নাম মনে নেই। ডিসনোমিয়া। তাহলেও আপনি ফল খেতে পারবেন না। জটিল অংক। একটু ওদিক হলেই ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন না।
ভাষা নিয়ে অন্য আরেকটা ভয় আমার মধ্যে কাজ করে। এখন তো মানুষের অনেক কর্ম-ক্ষমতার কোড বের হয়ে যাচ্ছে। কোড পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কাজও চলছে। মানুষ যেসব কোডের মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, ভাষা ব্যবহার করতে পারে, যদি কখনো সেই কোড চুরি হয়ে যায় বা নিজেদের অজান্তেই আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে কি হবে? তখন তো ধান বা বেগুনের বীজ কেনার মতো বা মোবাইলে টাকা ঢুকানোর মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভাষার কোড কিনে নিতে হবে।
মাঝে মাঝে গুগল ট্রান্সলেটে একটা সাধারণ বাক্য অনুবাদ করতে দেই। ভুলভাল অনুবাদ করে দেয়।শব্দার্থ বলতে পারে ঠিকমত। তবে বাক্যের ধারাবাহিকটা ঠিক রাখতে পারেনা। 'আমাকে ভাত খেয়েছে' , 'চাঁদ আকাশে দেখেছে' এর মত অনুবাদ আসে। হাসতে হাসতেই বিস্মিত হয়ে যাই। যদি কখনো মনের ইচ্ছার কথা ভুলে যাই অথবা ইচ্ছার কথা ভাষায় প্রকাশ না করতে পারি অথবা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ না করতে পেরে ' আমাকে ভাত খেয়েছে' এর মতো বাক্য বলি, তাহলে তো কারো সাথে কথাই বলতে পারবো না।
মাঝে মাঝে আকুল হয়ে ভাবি, আমি বাজারে বাজারে ঘুরছি, কোন ফলটা খেতে চাই ভুলে গেছি। অথবা ভুলে গেছি নাম। ঐ যে ইয়ে, ঐ যে গোল গোল মিষ্টি ফল আমতা করতে করতে বলতে পারলাম না নাম। অথবা বাক্যের ধারাবাহিকতা ভুলে গেলাম।' আমাকে আম খায়' এর মত বাক্য বলে ফেললাম। তখন তো কেউ আমার কথা বুঝবে না।কাজী নজরুলের মত বা কারী উবাইদুল্লাহের মত ভাষার যোগাযোগহীন বেঁচে থাকতে হবে।অসুস্থ হবার পর কারী উবাইদুল্লাহ সাহেব মাঝে মাঝে বাবার কাছে আসতেন। বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। হয়তো অনেক কিছু বলতে চাইতেন। পারতেন না। অক্ষমতায় ঝরঝর করে কেঁদে দিতেন। কী যে করুণ ও অসহায় ছিল দৃশ্যগুলো।
ভাষা নিয়ে অন্য আরেকটা ভয় আমার মধ্যে কাজ করে। এখন তো মানুষের অনেক কর্ম-ক্ষমতার কোড বের হয়ে যাচ্ছে। কোড পরিবর্তন-পরিবর্ধনের কাজও চলছে। মানুষ যেসব কোডের মধ্য দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, ভাষা ব্যবহার করতে পারে, যদি কখনো সেই কোড চুরি হয়ে যায় বা নিজেদের অজান্তেই আক্রান্ত হয়ে যায়, তাহলে কি হবে? তখন তো ধান বা বেগুনের বীজ কেনার মতো বা মোবাইলে টাকা ঢুকানোর মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ভাষার কোড কিনে নিতে হবে। পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে হয়তো আপনি এক ঘণ্টা কথা বলার কোড কিনে নিতে পারবেন। এরপর আবার ভাষাহীন হয়ে যেতে হবে।এই কল্পনা হয়তো সত্য না। তবে একাডেমিক পর্যায়ে এসব প্রশ্ন চলে এসেছে। ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহকে সামনে রেখে আকুল ভাবতে থাকি, যদি কোনোদিন আমার ভাষার-কোড চুরি হয়ে যায়?
সে যাই হোক, ভাষিক অক্ষমতা সবার মধ্যেই কমবেশী থাকে। তাইতো ভাষার পৃথিবীর চাইতে মাথার ভেতরের পৃথিবী অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়। মানুষ নিজের কথা, নিজের স্বপ্নের কথা ও কল্পনার কথা আকুল হয়ে বলতে চায়। কতদূর আর বলতে পারে। শেষবার সাক্ষাতে প্রিয় মানুষকে বলতে হয়, কত সময় কষ্ট দিয়েছি, মাফ করে দিও। কত কথা বলার ছিল, বলতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মানুষ হিসেবে মানবজনমের ক্ষুদ্রতায় অযথাই কান্না আসে। কত কিছু করার ছিল, কত কিছু বলার ছিল করার আগে বা বলার আগেই হুরহুর করে বরফের মত জীবনটা গলে যায়।
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন