সাম্যবাদ গণতন্ত্র ও কিছু প্রাসঙ্গিক চিন্তা | দেবাশিস ভট্টাচার্য
যা কিছু সবচেয়ে মূল্যবান তা উঠে এসেছে খোলামেলা মানসিকতা থেকে। রেনেসাঁর দর্শনও একই কথা বলে, একই ঐতিহাসিক সত্যের সাক্ষ্য দান করে। মধ্যযুগ তো শুধু একটা কালক্রম নয়, তার চাইতে অনেক বেশি একটা মানসিকতা, একটা অবস্থান কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। রোগ নির্ণয়ে নির্ভুল না হলে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। ব্যাধি যদি ইসলাম বা মৌলবাদ হয় তবে এক কথা কিন্তু বিশ্বের লড়াইটাকে মেরুকরণ করলে মৌলবাদ বনাম সংস্কারমুক্ত মন এ কথা মানতে পারি না। লড়াইটা মূলত বাঁচার লড়াই। যার মুলে ধর্ম বিশ্বাস বা মৌলবাদ নয় ক্ষুধা আছে। পুঁজিবাদ বনাম সাম্যবাদী গণতন্ত্রের লড়াই চলছে চলবে। সমাজ ও অর্থনীতি জটিল হতে শুরু করার সময় থেকে এই দ্বন্দ্ব অব্যাহত আছে।
আমেরিকার স্বাধীনতা ( ১৭৬৫-১৭৮৩ ) যুদ্ধ করেছিলেন যারা তাঁরা ফরাসি বিপ্লবের “সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতার” মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। আবার তাঁরাই ব্যক্তিগত জীবনে বিত্ত ও দাসপ্রথার সমর্থক ও পূজারী ছিলেন। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাঁরা দেশের বা সমাজের স্বাধীনতা না, তাঁদের শ্রেণীগত সুবিধা সুযোগের বৃদ্ধি চেয়েছিলেন। ধর্ম বিশ্বাসের একটা গোঁড়া একমুখী ধারা তাঁদের বিবেকের তৃপ্তিসাধন করেছিল, তাঁরা বিশ্বাস করতেন ধর্ম তাঁদের সহায়। সেই কুরুক্ষেত্র থেকেই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি চলেছে রেকারিং ডেসিমেলের মত। অথচ এই ধর্মযোদ্ধারা আদিবাসী ভারতীয় প্রজাতিগুলির বিনাশে তৎপর ও বিন্দুমাত্র মায়ামোহবিহীন। নিগ্রো দাস দাসীও ভোগ করেছেন অন্য সম্পত্তির মতন করে, দাসীদের গর্ভে আরও দাস সন্তান সৃষ্টি করে কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধিও করেছেন বুদ্ধি করে। এঁরাই হলেন আজকের রোমের প্রবৃদ্ধ পিতামহ ও আদি ব্রহ্মা।
১৮৪৮ সালে লন্ডন শহরে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্তো প্রকাশিত হল। লেখক কার্ল মার্ক্স ( ১৮১৮ - ১৮৮৩) ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ( ১৮২০-১৮৯৫), দুই জার্মান চিন্তাজীবি। আমেরিকার জন যুদ্ধ ( ১৮৬১ - ১৮৬৫) শুরু হতে তখনো তেরো বছর বাকি। একই বছর ১৮৪৮ জুড়ে চলল বিদ্রোহ ও বৈপ্লবিক সংগ্রাম। সমগ্র ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে নানা দেশে জ্বলে উঠল প্রতিবাদের আগুন। সেই আগুন নেভাতে পুরাতনপন্থী ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দল একজোট হল। পঞ্চাশটি দেশে পরিবর্তন এল, তার মধ্যে অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরিতে ভুমিদাস প্রথার অবসান ও ডেনমার্কে চরম ক্ষমতাপন্ন রাজতন্ত্রের সমাধি উল্লেখযোগ্য। পঞ্চাশের দশকে মার্ক্স তাঁর ভাবনা চিন্তার সম্প্রসারণ করছেন। নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউনের ইউরোপীয় সংবাদদাতা হিসেবে তিনি লিখছেন তাছাড়া অন্য আরও কিছু বুর্জোয়া কাগজে তিনি সাম্যবাদ প্রচার করছেন।
মানবতা নিয়ে যারা উৎসাহী তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন শ্রেণী বৈষম্য দূর না হলে মানুষের মুক্তি কিভাবে সম্ভব? ধর্ম জাত পাত সাম্প্রদায়িক বিচার এসব নিয়ে প্রমত্ত তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি আজও ক্ষমতাভোগীদের যন্ত্রমাত্র। অর্থনৈতিক মুক্তি না এলে কোনদিনই গণতন্ত্র আসবে না। বৃহৎ পুঁজি তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছে করবে। এখন উপায়?
মার্ক্স শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেন নেতৃত্বও দেন। তবে তাঁর চিন্তার প্রয়োগ সর্বপ্রথম হয় লেনিনের ( ১৮৭০-১৯২৪) মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ( ১৯১৪ - ১৯১৮) শেষ হবার আগেই লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় জারের অপসারণ ও সোভিয়েত শাসন আরম্ভ হয়। এমন এক ব্যবস্থা যা সমাজতান্ত্রিক, পুঁজি ও বিত্ত যৌথ ও জাতীয় মালিকানার অধীন। এটা একটা রাজনীতির চাল না, একটা দর্শন যা শ্রেণী সংগ্রাম ও দ্বন্দবাদী বস্তুবাদ ভিত্তিক ও তৃণমূল স্তরে সব নাগরিকের খাওয়া পরা জীবিকা চিকিৎসা শিক্ষা প্রভৃতির ভার গ্রহণ করেছিল। বিলেত আমেরিকার লোক বরাবর মুখ কুঁচকে থেকেছে রাশিয়ার পণ্য দ্রব্যের নিম্ন মান ও মোটা দাগের মোড়কে, কিন্তু তারাই এ কথা মেনে নিয়েছে যে রাশিয়ায় ভাত কাপড়ের অভাব ঘুচিয়ে দেয়া হয়েছে, কর্মহীনতা নেই, শিক্ষা সর্বাত্মক, এত বৃহৎ একটা দেশে কয়েক দশকের মধ্যে সাধারণ মানুষের বাঁচাটা অনেক সুখের অনেক নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
স্তালিনের ( ১৮৭৮ - ১৯৫৩) আমলে সোভিয়েত রাশিয়া ব্যাপক পরিকল্পনা ও সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ শক্তি হয়ে উঠল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া, দুই চরম শক্তির মধ্যে বিশ্বের রাজনৈতিক মেরুকরণ হল, যার বিভাজন চার্চিলের ভাষায় লৌহ যবনিকা হিসেবে আখ্যাত হয়। এরই মধ্যে ঘটে গেল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ( ১৯৩৯ - ১৯৪৫) ও তারপর বিশ্বের মেরুকরণ। মাও সে তুঙের সাম্যবাদী চীন উঠে এল ১৯৪৯তে হ চি মিনের উত্তর ভিয়েতনাম স্বাধীন সাম্যবাদী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ এ, ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় সাম্যবাদ আনেন ১৯৫৯ এ । এছাড়া পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রপুঞ্জ কোরিয়ার একাংশ অনেকখানি জনগোষ্ঠী জুড়ে মারক্সিয় আদর্শ মানুষের জীবনকে পরিচালনা করেছে। মার্কিন পুঁজিবাদ তাঁর অক্টোপাসের মত শত শত সন্ত্রাস ও অপপ্রচারের শুঁড় দিয়েও এই আদর্শকে মুছে দিতে পারে নি। ১৯৯১ তে গরবাচভের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে খণ্ড খণ্ড হয়ে গেল, অর্থনীতি রাজনীতি সমাজনীতি সব দিক দিয়ে “ মুক্ত পৃথিবীর” জয় ঘোষিত হল, মার্কিন গুপ্তচর ও পুঁজি মিলে একটা প্রবল অট্টহাসি হাসল।
আদর্শ মরে না। তার ক্রম বিবর্তন হয়। প্রতিক্রিয়া ও ভুল ভ্রান্তিগুলি শুধরে নিতে নানা রকম পরীক্ষা দিতে হয়। কারণ এটা সমাজের সর্বাঙ্গীণ প্রক্রিয়া। মানুষের যেমন আদর্শ নিষ্ঠা স্বপ্ন থাকে তেমনি ত্রুটি বিচ্যুতি স্খলন পতন থাকে। রাশিয়ার মাটি থেকে সমাজতন্ত্রের দুঃস্বপ্ন ও বিচ্যুতিপূর্ণ স্মৃতি দূর হয়েছে সাম্যবাদ দূর হয় নি। মাও একবার বলেছিলেন, আমার ছেলেরা আমার আদর্শ থেকে সরে যেতে পারে, নাতিরা আবার সেই স্বপ্নকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করবে। ভাববাদী নেতাদের বা আদর্শের ক্ষেত্রেও এরকম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। গান্ধীর আদর্শ যতই অবাস্তব হোক না কেন সেই আদর্শে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ আত্মনিবেদন করেছিলেন। কারাবরণ দারিদ্র্য অত্যাচারীর অত্যাচার কিছুই তাঁদের আদর্শ বা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। জয় প্রকাশ নারায়ণের ইন্দিরা বিরোধী আন্দোলন এরকম একটি আদর্শের বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা মাত্র।
টনি জুডের লেখা পোস্ট ওয়ার ( যুদ্ধোত্তর ) গ্রন্থটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের ইউরোপীয় ইতিহাস কাহিনী ও বিশ্লেষণ নয় এক রোমাঞ্চকর বীরত্বগাথাও বটে। জুড মারক্সিয় পণ্ডিত নন, তিনি দেখিয়েছেন এক অন্য সত্যকে। কেমন করে বিশ্বযুদ্ধের পর রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির সম্মিলিত প্রভাবে সমগ্র ইউরোপে এক জনহিতৈষী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হল, পর্যায়ে পর্যায়ে হলেও অবধারিত ও নির্ভুলভাবে একমুখী। বৃহৎ পুঁজি ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব আপন কর্তৃত্ব ভাগ করে নিতে বাধ্য হল সাধারণ মানুষের সঙ্গে। এমনই করে ওয়েলফেয়ার স্টেট বা জনহিতৈষী রাষ্ট্র উঠে এল যেখানে শিক্ষা খাদ্য চিকিৎসা অনেকাংশে সমাজের দায়িত্ব। অর্থাৎ মার্ক্স লেনিন ছদ্মবেশে ঢুকে এলেন প্রাক্তন পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সেখানে আধুনিকীকরণ ও রাজনীতির ছদ্মবেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুরু হয়ে গেল।
আজ মার্কিন রাষ্ট্র ব্যবস্থা তালি মারা কাপড়ের মত জীর্ণ, মলিন, ধূসর। সাধারণ মানুষের অতৃপ্তি বেড়েই চলেছে। তারা তাদের মুখোশধারী নেতাদের দেখে বলতে ভয় পায় না, রাজা ন্যাংটা কেন! ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে মার্কিন রাষ্ট্র ক্ষমতার উলঙ্গ চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ল।
গণতন্ত্র বললে আজও আমেরিকা বুঝি আমরা তবে সেটা রাজনীতি আর ভোট যন্ত্রের জন্য নয়। আমেরিকার তৃণমূল জনগোষ্ঠী এই গণতন্ত্রের পতাকার বাহক। বিপ্লব আগেও হয়েছে, পড়েও হবে। মার্ক্সের আগে কেউ আমাদের বলেনি সমাজ শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী বিন্যাস অনুযায়ী চলে। ব্যক্তিগত বিত্ত ও মুনাফার চাহিদা কমিয়ে যৌথ উন্নতি সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে যাত্রা করা প্রয়োজন। রাশিয়া বা চীন কমিউনিজম থেকে সরে এসেছে সুতরাং আদর্শটাই মিথ্যে ছিল এটা কোন দেশের যুক্তি মশাই?
তৃতীয় বিশ্বের দিকে তাকান। বহু যুগের উপনিবেশিক বঞ্চনায় শোষণে মরুভূমি হয়ে যাওয়া কতগুলি সমাজ। আফ্রিকায় কি ভয়াবহ জন যুদ্ধ চলছে। এছাড়াও তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে যা চলছে তার নাম কি গণতন্ত্র? সরকার বৃহৎ পুঁজির সেবক মাত্র।
মানবতা নিয়ে যারা উৎসাহী তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন শ্রেণী বৈষম্য দূর না হলে মানুষের মুক্তি কিভাবে সম্ভব? ধর্ম জাত পাত সাম্প্রদায়িক বিচার এসব নিয়ে প্রমত্ত তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি আজও ক্ষমতাভোগীদের যন্ত্রমাত্র। অর্থনৈতিক মুক্তি না এলে কোনদিনই গণতন্ত্র আসবে না। বৃহৎ পুঁজি তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছে করবে। এখন উপায়?
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন