চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

স্বাক্ষী

স্বাক্ষী। ইলিয়াস বাবর



মাজারের মোজাইক করা সিঁড়িতে মাথা টুকে টুকে কাঁদছে মমতাজ বেগম কান্নার মাত্রা বাড়ছে আর নামছে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মতো বেঘোরে মাথার ক্রমাগত আঘাতে লাল হয়ে উঠে শাড়ির আঁচল লাল পেড়ের নীল শাড়িতে ঝিলমিল খেয়ে যায় তাজা রক্ত নগরীর যোগাযোগ সুবিধাবহুল স্থান হওয়ায় প্রতিনিয়তই দর্শনার্থীরা আসে মাজারে শোয়া মকবুল আউলিয়ার সান্নিধ্য পেতে গোলাপজল আর গাঁদার ছেঁড়া ছেঁড়া পাপড়ী ছুড়ে দেয় মাজার শরীফে গিলাপ ধরে চুমু খায় যদি বাবার দয়া হয়! পাশে রাখা কলসীর পবিত্র পানি গেলাসে বরে পান করে বিভিন্ন নিয়তে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আশেকে আউলিয়ারা যখন যিয়ারত শেষ করে তখন ডান হাতে অতি আদবের সাথে নজরানা দিয়ে থাকে দান বক্সে রশিদ পত্র হাতে নিয়ে দান বাক্সের পাশেই বসে আছেন বাবাজানের বিভিন্ন বয়সী খাদেমেরা তাদের গায়ে সাদা ফিনপিনে পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি, আতরের তীব্র সুবাস, কারও কারও মুখে দাড়ি, ঠোঁট গুলো পানের রসে সিক্ত ভক্তরা সালাম দিতেই আদবের সাথে সে লাল ঠোঁট গুলো নড়ে উঠে, ডান হাতটা উর্ধ্বে তুলে যেন বলে- “মুশকিল আসান হবে ইনশা আল্লাহ

মাজারের পবিত্র সীমানা ঘেঁষে জামে মসজিদের সিঁড়িতে লেখাজুতা চোর হতে সাবধান পাশেই সমাধানের সুনিপুন উপায় প্রতিজোড়া জুতার হেফাজত বিনিময় পাঁচ টাকা! আসার সময় তাদের দেয়া টিকেট ফেরত দিলে জুতা জোড়া সহি সালামতে পাওয়া যায়। অবশ্য অনেকেই বলে থাকে টিকেটবিহীন জুতা চুরির ব্যাপারটা ওদেরই এবং চুরি যাওয়া জুতা বিকেলেই নিউ মার্কেট এলাকায় সস্তায় পাওয়া যায়। মমতাজ বেগমের কপাল ভাঙ্গার দিকে কারও নজর নেই। বিশেষত সবাই তো আসে নজরানা দিতেই। দানবাক্স নিয়ে বসা বয়স্ক মোতয়াল্লি গোছের একজন এসে নরম সুরে বললেন- ‘কাঁদছ কেন মা? রিযিক-হায়াত, বিয়া শাদি সবই উপরওয়ালার ইচ্ছায়, বাবা কেবল উছিলা মাত্র। ঘরে চলে যাও, কেউ আসেনি সাথে?’

নিরুত্তর আঁচল ডাকা মমতাজের কান্নার মর্ম তখনো কেউ বুঝেনি, বুঝবেওনা। কি জানি মকবুল আউলিয়া বুঝেছেন কিনা.... সে রিক্সায় চাপে বস্তির উদ্দেশ্য। ভাবতে চেষ্ঠা করে তারও আছে একটা ইতিহাস

মমতাজ যখন তার বাবার ভাঙ্গা ঘরে ভূমিষ্ট হয়ে পৃথিবীর সাথে খাপ খাওয়াতে ওয়্যা, ওয়্যা কান্নায় ব্যস্ত, তখন জনক জব্বার মিয়া দারুণ বিষন্নতায় ডুব দেয়। তার ঘরে যে নতুন অতিথি এসে হৈ-চৈ শুরু করে দিয়েছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। মেয়ে জন্ম নেয়ার কথা শুনে বারে বারে মনে পড়ে যায় প্রথম পক্ষের স্ত্রীর কথা। আহা বেচারি খুব লক্ষী ছিল। বিনা দোষে কত পিটিয়েছিটুশব্দটি করেনি। কিন্তু কপাল পোড়া! শত চেষ্টায়ও একটি সন্তান এনে দিতে পারেনি। মাজার-তাবিজ-কবজ-পানি পড়া কিছুই ধরেনি তাকে। শেষে সন্তানের মুখ না দেখায় তিন বছরের সাংসারিক জীবনে যতি বসায় জব্বার মিয়া। সন্তানের মোহে বাড়ি ফেরত রাবেয়া কাঁদলো বটে তাতে সমাজের মন গলেনি। কারণ সে অপরাধী

যে নারী সন্তান দিতে পারে না স্বামীর ঘর তার জন্য হারাম। মাস তিনেক মাথায় নতুন বউ ঘরে তোলে জব্বার মিয়া। গোঁফে তা দিতে দিতে নতুন বউকে বলেশুধু সন্তান চাই-’

বেচারা রিক্সা চালালেও দারুন শখ ছেলে পুলে ভরপুর থাকবে ঘর। দুপুরে গোসল করতে গেলে ঘাটের উপরে গামছা লুুঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ছেলে কি দারুণ দৃশ্য! সে দৃশ্য অবতারণা হওয়ার জন্যেই নতুন বিয়ের বয়স বছরের মাথায় যখন ঠেকে, তখন দুনিয়ার আসে মমতাজ। মেয়ে এসেছে শুনে দারুণ ব্যথা পেয়েছে জব্বার মিয়া। সে সন্তান চেয়েছে, তাই বলে মেয়ে ? এক প্রকার তাড়িয়ে দেয়া রাবেয়ার অভিশাপ বলেই মনে হয় জব্বারের। তা না হলে কন্যা হওয়ার শুভদিনে অলক্ষুনে বন্ধ্যাকে মনে পড়বে কেন? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গামছাটি নিয়ে উঠে যায় জব্বার মিয়া। না, সে মেয়ের মুখ দেখবেনা বেলা। দু-চারটা খেপ মারাই সুবিধের ঠেকে তার বিবেকের কাছে

বাবার অনাদর-অবহেলায় মমতাজ বেড়ে উঠে মায়ের কোলে। অবশ্য অনাদরের বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে তার শারীরিক সমস্যা। মমতাজের মাথায় প্রায় অর্ধেক অংশে চুল নেই! ছেলে হলে কোন রকমে চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু যে মেয়ে ? কি হবে মেয়ের ? ছাগলের মুখ দেয়া চারণভূমির মতো মাথার মেয়ে নিয়ে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার উপসর্গ বেশ আগেই দেখা যায় জব্বার মিয়ার মুখরেখায়। বয়স বাড়ার সাথে গরিবী সাধ্যের মধ্যে জোঁকের তেল, কবিরাজের দাওয়া জাতীয় অনেক জিনিস মাথায় উঠেছে চুল গজানোর আশায়। মেয়ের মাথা যদি কালো চুলে ভরে যেত! দিন বাড়ে। বাড়ে টেনশন, চুলের হয় না গতি। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ায় এক ঝামেলা, তার উপর মাথায় টাক! এজন্য মমতাজের মা আম্বিয়ারও কথা কম শুনতে হয়নি-স্বামী এবং শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পক্ষ থেকে। সব দোষই তার, মেয়ে জন্ম দেয়াও!

প্রথম পক্ষের স্ত্রীর অভাব আম্বিয়া বেগম বেশ ভালো ভাবেই পুষিয়ে দিচ্ছে জব্বার মিয়ার সংসারে। বলা যায় আম্বিয়া বছরি পোয়াতি। বছর শেষত জব্বার মিয়ার ঘরে আসে নতুন মুখ। জব্বার মিয়ার প্রাণের আকুতি হোক আর আম্বিয়ার সৌভাগ্য হোক আধ-টাক মমতাজের পরের চারজনেই ছেলে। ফি বছর ছেলে সন্তানের মুখ দেখে জব্বারের ইচ্ছে হয়- আম্বিয়াকে মাথায় রাখে, কিন্তু পারেনা অভাবের তাড়নায়। সারাক্ষণ বউ নিয়ে পড়ে থাকলে খাওয়াবেটা কে? বিয়ের পরে অবশ্য অনেক সময় দুপুর বেলায়, যখন সবাই ঘুমিয়ে একটু শান্তি খুঁজত, তখন জব্বারও নিরবতার সুযোগে উপভোগ করতে চাইতো নতুন বউয়ের কাঁচা রস। এখন ছেলে মেয়ে হয়ে যাওয়ায় ওই সুযোগটা পায় না কিংবা দেয়ও না। এখন জব্বার আশান্বিত হয় এই ভেবে -ছেলেরা বড় হলে ইনকাম তুলে দেবে বাবার হাতে। আম্বিয়া জব্বার শুধু তছবি হাতে আল্লাহ আল্লাহ করবে। নাতি নাতনীতে ঘর থাকবে ভরাট। বেয়াই বাড়ীর লোকজনও আসবে; কত স্বপ্ন! এসব খেটে খাওয়া মানুষদের আর আছেই বা কি! স্বপ্নেই বাঁচিয়ে রাখে তাদের। আনমনা হয়ে ভাবতে ভাবতে চলে যায় রিক্সার দিকে। পেছন থেকে মমতাজের ডাকে ফিরে তাকায় সে। বড় মেয়ে মমতাজ এগিয়ে আসছে তার বহুদিনের পুরনো গামছাটা নিয়ে যা দিয়ে সে যাত্রী থেকে ভাড়া বুঝে নেয়ার পর তৃপ্তি সহকারে ঘাম মুছে নেয়। আহা, কত অনাদরে বেড়ে উঠেছে মেয়েটা। মাথার চুলও পরিপূর্ণ উঠেনি। বয়স তো বারোতে পড়লো।হায় আল্লাহ, কি আছে এই মাইয়্যার কপালে!’ বলে গরম শ্বাস ছেড়ে দেয় সে। গামছাটা নিয়ে খুব অচেনা ভঙ্গিতে দেখে ভালোবাসার প্রথম সন্তান মমতাজের দিকে। এই প্রথম মমতাজের জন্য মনে হয় পরানটা কেঁপে উঠে জব্বারের। অবহেলার উল্টো পিঠে জন্ম নেয় ভালোবাসা। গভীর ভালোবাসা

জব্বার মিয়া দায়িত্ববান বাবার দৃষ্টিতে বুঝতে পেরেছে মমতাজের রোগ গরিবের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রোগ বাড়ে বৈ কমে না। মেয়ের বয়স বারো পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর অন্য উপায়ে মন দেয় সে। বেশ ভালো উপায়ও পেয়ে যায় জব্বার মিয়া। সেদিন চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই, যিনি শহরে বড় ব্যাংকের ম্যানেজার আফসার সাহেব গ্রামে আসলে বাড়ি হতে বাজার পর্যন্ত জব্বারের রিক্সায় গিয়েছিলেন। পথিমধ্যে চালক-যাত্রীর মধ্যে এলাকার পরিচয়ের সূত্রে টুকটাক কথাও হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা, স্ত্রীর জন্ম নিয়ন্ত্রণ, ময়-মুরব্বি ইত্যাদি। সাথে বলেছেন সমস্যার কথাও। শহরে বাসায় কাজের মেয়ে দরকার। আগের বুয়াটা মোবাইল মেরে দিয়ে পালিয়েছে। কাজ বেশি না। কাপড় কাঁচা, ঝাড়-মোচ আর ছোট মেয়েটাকে স্কুলে আনা নেয়া করা। জব্বার মিয়াও আধো লজ্জায় বলে ফেলেছে তার বড় মেয়ে মমতাজ এসব কাজ ভালোই পারে

যদিও বাবা হিসেবে কোনদিনই খবর রাখেনি মেয়ে কি খায়, কি পরে। এমন একটা সুযোগ পাওয়ায় আফসার সাহেবও দারুণ খুশি। যাক্ দেশের মেয়ে পাওয়া গেল। আফসার সাহেব খুশি কাজের মেয়ে পেয়ে, জব্বার মিয়া খুশি নিজের ঘরে বোঝা সাময়িক হলেও অন্যের ঘাড়ে দিতে পেরেছে বলে। দুদিন পরেই আফসার সাহেবের সাথে শহরে বাস ধরে দূর্বাঘাসের মতো অনাদরে অথচ শিশির ভেজায় বেড়ে উঠা মমতাজ। জব্বার-আম্বিয়ার ভালোবাসা আর গভীর অনুরাগের ফসল। দুরন্ত বকুল ফুলটি চোখের পানি ফেলে, মা-দাদীর পা ছুঁয়ে সালাম করে সে। কারও প্রতি অভিযোগ নেই, নেই আবদার চাহিদা। কাপড়ের ব্যাগটি হাতে নিয়ে মা- ভাইদের আগে পা পা করে এগিয়ে যায় সামনে

আম্বিয়ার চোখের জল আঁচল ঢাকা হলেও মমতাজের অশ্রু টুপ করে পরে সদ্য পিচ হওয়া গ্রাম্য রাস্তায়। পেছন থেকে চেয়ে আছে মা দাদীরা। জব্বার পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় মমতাজের মাথায়, তার বুকেও শুরু হয়েছে অন্য রকম অনুভূতি। জব্বারের হৃদয় বিদায় দিতে চাইলেওপিতার হৃদয়টেনে রাখতে চায় মেয়েকে; কিন্তু পারে না

প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধা হলেও মমতাজ শহরে বেশ মানিয়েই নিয়েছে। বাসার ভেতর বাথরুম, ফ্রিজের টাটকা মাছ-মাংস-ফ্রুট, ডাইনিংয়ে খাওয়া, টুকুকে স্কুলে আনা নেয়া আর কি! ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শহর দেখার চেষ্টা করে সে, কিন্তু দেখে নাগরিক জ্যাম, ইট-পাথরে দালান আর মানুষ। কোথাও চোখে পড়ে না আম সুপারির বাগান কিংবা ধানক্ষেত। মমতাজের মাথায় টাক যতই ওড়না পেছানো থাক্ তা আবৃত হয়ে যায় আফসার সাহেবের পরিবারে। স্বভাব-চরিত্র ভালো হওয়ায় টাক মাথার মমতাজ তাদের মাথার তাজ! আফসার সাহেবের স্ত্রী নার্গিস খানমও বেশ দেখতে পারে তাকে। যদিও বা প্রথমে শংকিত ছিল-‘ মেয়ে দিয়ে কি হবে!’ অনেকটা নতুনত্ব আর উৎসাহের কারণেই মমতাজ সারাক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে এর মধ্যে হারবাল চিকিৎসার বদৌলতে মমতাজের মাথায় কালো চুল! এর পুরো কৃতিত্ব নার্গিস খানমের। নিজের টাকা খরচ করে অন্যের মেয়ের জন্য কে বা কি করে ? মমতাজের শ্যামলা বরণ ফর্সায় হামলে পড়ছে বহুদিন হচ্ছে, তার উপর ঈষৎ উন্নত বুক দেখে যে কারও অসুবিধায় পড়তে হবে মেয়ে চারমাস আগেও গ্রামে ছিল। স্টারপ্লাস আর জলসার নাটক দেখে টুকটাক হিন্দি শব্দও শিখেছে সে। কোন্ অনুষ্ঠানে কি কাপড় পরে যেতে হয় তাও মমতাজের নখর্দপনে। মমতাজ বেগম কে বাইরের কারো সামনে মমতাজ খানম বললেও আপত্তি থাকার কথা নয়

প্রথম প্রথম মাস তিনেক অন্তর যাওয়া-আসা হলেও এখন গ্রামে যাওয়ার তেমন উৎসাহ জাগে না মমতাজের। তার ভেতরে বাইরে ঢেউ বয়ে দেয় অন্যরকম হাওয়া! বয়সের হিসেবে পনের, মানে ষোড়শীর প্রাক প্রস্তুতি! আনচান উচাটন ভাব তো বয়সেরই লক্ষণ। স্কুলে টুকুকে নেয়া-আনার সময় কতজনেই তার বুকের দিকে তাকায়। বিশ্রিরকম দৃষ্টিতে বিরক্তি ফুটে উঠলেও মুখে বলতে পারে না কিছু

যাওয়া আসার গল্পে মমতাজের জীবনে জুড়ে যায় গার্মেন্টস কর্মী সাইদুর। এরমধ্যেই নারগিজ খানমের মাতৃস্নেহে মমতাজ আরবী- বাংলা উভয় পড়ায় বেশ দখলও দিয়ে রেখেছে। কোন রাকাতে কোন সূরা তাও তার আত্মস্থ। বাংলা পড়া তো লে হালুয়া, এমনকি বিস্কুটের প্যাকের গায়ে লেখা ইংরেজিও পড়তে পারে অনায়াসে। বিভিন্ন সময়ে পাওয়া হাত খরচা আর বাজার খরচের এদিক ওদিকে বেশ কিছু টাকাও জমা পড়েছে মমতাজের। এতসব সঞ্চয়ে তার বুক কেঁপে উঠে। কাছে পেতে চায় সাইদুরকে ভেতর থেকে বলে উঠে আর কত বান্ধবীর জীবন, এবার বউ হওয়া চাই !

প্রথমে আপত্তিটা আসে নারগিজ খানমের পক্ষ থেকেওসব ছেলেরা মায়া দেখিয়ে কেটে পড়ে মমতাজ যুক্তি দেখায় মাসের মধ্যে ওরকম কোন কিছুই দেখেনি সাইদুরের মধ্যে। তবুও নারগিজ খানম আশ্রয়ের দাবী নিয়ে বলেতোর বিয়ের ব্যাপারটা আমরা দেখব গ্রামের চেনা-জানা হলেও অবাক হয়নি শিক্ষিত রমনী নারগিজ খানম। মমতাজের ইচ্ছাকে মূল্য দিতে যা করার করবে, তবে বলেছে মা-বাবার কানে যাতে বিষয়টি তোলে। সেদিকে খেয়াল নেই মমতাজের। সাইদুরের সাথে মোবাইলে কথাও হয় নিয়মিত, এটা -সেটা দেয়া-নেয়া অনেক আগে থেকেই। নারগিজ খানমের অলক্ষ্যে শারিরীক লেনদেন হয়েছে কিনা তা অবশ্য বলা যায় না

*** *** ***

সকালে বের হয়ে সাইদুর-মমতাজ দুজনেরই গার্মেন্টস থেকে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। সারাদিনের টানা শ্রম তাদের দাম্পত্য জীবন তেমনটা উপভোগ্য করার মতো রাখে না। রাতের খাবার শেষে গা এলিয়ে দিতেই ঘুম, অথচ মমতাজ ভেবেছিল- সাইদুরের কোলে মাথা রেখে গল্প শুনবে, গল্প শুনাবে। বাস্তব কত কষ্টের, কত সংগ্রামের তা বিবাহিত জীবনের চারমাসের মাথায় বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে মমতাজ। সাইদুরেরনাসত্ত্বেও গার্মেন্টসে ডুকতে হলো একটু স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। চাহিদা পূরণ না হলেও যাতে অধিকাংশই ভোগ করা যায়। কিছুটা হলেও সঞ্চিত থাকে। নারগিজ খানম মমতাজের বিয়ের সময় অধিকাংশ প্রয়োজনীয় সাংসারিক তৈযজ পত্র উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। স্বপ্নের মত শুরু না হলেও খারাপ হয়নি। এখন ব্যস্ত সময় তাদের, বাসা-গার্মেন্টস। ভোর সকালে মমতাজকে চুলায় পাতিল চাপিয়ে দিয়ে গোসল সারতে হয়। তৈরি করতে হয় দুজনের দুটা টিফিন। সামনে হয়তো আরও একটা মুখ আসতে পারে, যার সম্ভাবনা ইতিমধ্যে তার শরীরে দেখা দিয়েছে

ঘুম থেকে উঠে দেখে সাইদুর নাই। মমতাজ মনে করেছিল সে বাইরে গেছে। মাঝে-মধ্যে যেমনি যায়। একি, তার নাক-কানের দুলও নেই! যা সে নারগিজ খানমের টাকায় কিনেছিল। গত রাতে সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল সাইদুরে সাথে। তার দাবী মা হওয়ার সময় সে শ্বশুর বাড়ীতেই থাকবে। তার সন্তান বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবে বাবার উত্তরাধিকারী হিসেবে। সাইদুর বলে উঠে কিসের শ্বশুর বাড়ি ? বস্তিতেই সন্তান হবে। তখনো মমতাজ জানে না তার শ্বশুর বাড়ি কোথায় ? কি তার বরের সম্পূর্ণ পরিচয় ? অবশ্য বিশ্বাস আর ভালোবাসার গভীরতায় সে প্রশ্ন কোন দিনই উত্থিত হয়নি তার মনে। খোঁজ নিয়ে দেখে সাইদুর পরিচয় পত্র জমা দিয়ে বেতন-হিসাব সব আগেই চুকে ফেলেছে। তখনো তার হাতে সাইদুরের জন্য আনা আলাদা টিফিন!

মাজারের সিঁড়িতে মাথা ভাঙ্গছে মমতাজ। অথচ মাজার সাক্ষী রেখেই মা-বাবার কথার অবাধ্য হয়ে, নারগিজ খানমের মতামতকে অগ্রাহ্য করে সাইদুরের হাত ধরে বিশ্বাসের বন্ধনে জড়িয়েছিল। ভালোবাসার পানসি বেয়ে সাইদুরের কাবিনবিহীন হাত দুটি এগিয়ে দিয়ে সহাস্য বলেছিল কবুল! ‘গাঙয়ের ঢেউয়ের মতোউচ্ছ্বাসিত আবেগে মমতাজও বলেছিল -বু-! পাশে বসা নারগিজ খানম আর মাজারের খাদেম বলেছিল- আলহামদুলিল্লাহ! কত স্বপ্নের ইন্দ্রজাল সেদিন মমতাজের বুকে ভর করেছিল তা আজ মনে করতে পারছে না। তার কপাল ফাঁটা রক্ত কঠিন সিঁড়ি কোমল করতে পারে না, পারে না নাগরিক স্বার্থপরতা এড়াতে। রক্তের ফোয়ারা খুঁজে বেড়ায় বাবাজানের দোয়া, বিয়ের সে সাক্ষীকে। মন খোঁজে সাইদুরকে, পেটের বাচ্চা... ?



লেখা পাঠান ই-মেইলে- chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই