চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

একদিন রাস্তায়

একদিন রাস্তায় | এম কে ইসলাম (মাটির ময়না)      


বাসে হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা। সেই জন্যই দুসিট দখল করে বসা। সবে মাত্র বাসটা এ১৩ দিয়ে মটরওয়েতে উঠার জন্য তড়িঘড়ি করছে। না, ঘুমানোর সময় হয়নি এখনো। সবচেয়ে বড় কথা হলো ঘুম অবশ্য তেমন করে আসেনি এখনো। না আসার হেতুটা বুঝতে পারছিনা। নরমাল সময়ে সারা রাত কাজ শেষ করে বাসা এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সাত সমুদ্দুর তের নদী পারি দিতে ২ সেকেন্ড সময় লাগেনা আর এখন কি হয়েছে আল্লাহ জানে। সারা রাত চাকুরী শেষ করে এখন যাচ্ছি ৮ ঘন্টার বাস ভ্রমন করে গ্লাসগো। আর কি আজব ব্যাপার আমার চোখে ক্লান্তির ছায়াটুকু নেই। শুনেছি মানুষ যখন চাপের মুখে থাকে তখন তার স্নায়ুগুলো তাড়িত হয় খুব বেশী। তাই শারীরিক ক্লান্তিটা খানিকটা সময়ের জন্য বোধ করেনা। কিন্তু যখনই চাপ কমতে থাকে তখনই ক্লান্তি জিনিসটা ভর করতে থাকে ভুতের মত। আমার বেলায় হয়তো তাই হয়েছে এখন। ঘুম আসবে হয়তো একটূ পর সদলবলে। আমার অবশ্য তাতে কোন আপত্তি নেই আমি তো বসেই আছি তাদের আপ্যায়নে।

- আপনি এখন আর দুনিয়াতে নেই। আপনি গত হয়েছেন ১১ বছর হলো। জি না এটা পরপার না। এটা মধ্যপার। দুনিয়া পার করার পর পরপারে যাবার আগে এই অংশটা হচ্ছে মধ্যপার। এখানে আমরা মানুষের তিনটে করে অপূর্ণ স্বপ্ন পুরণ করে থাকি।

পেটে কেমন যেন গুর গুর করে আওয়াজ হলো দুবার। এটা হলো আমার ক্ষিদার অশনি সংকেত। অশনি সংকেত নামটা বললেই ঠাস করেই ববিতা ম্যাডামের চেহারা ভেসে আসার কথা কিন্তু কি আজব আমার মনের আয়নায় এখন ববিতা ম্যাডাম ঠাই পাচ্ছেন না। অনেক ঠেলে ঠুলে ম্যাডামকে জায়গা করতে পারছি না। আসলে দোষটা ম্যাডামের না- দোষ আমার ডানপাশে বসা ঐ বিশাল সাইজের দৈত্যটার। মানুষ নাকি দৈত্য আল্লাহই জানে। এতো বড় একটা মানুষ চোখের সামনে থাকলে কল্পনায় ববিতা ম্যাডামের জায়গা কি করে হবে?? ঐ দৈত্যটা সম্পর্কে পরে বলবো। দেখতে দৈত্যের মত হলেও মানুষটা খারাপ ছিলনা। ব্যাগ থেকে কাস্টার্ড বিস্কিটের পোটলাটা বের করলাম আর সাথে তো লোকোজেড আছেই। লোকোজেড কেনার সময় ছোট্ট একটা ঘটনা হয়েছিলো। সেলফ থেকে যখন লোকোজেড নিচ্ছিলাম তখন কেন যেন মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপেছিলো। ভাবলাম আমাকেও এমন বিপাকে অনেক বার পড়তে হয়েছে। দেখিনা কেমন লাগে অন্যেরা এমন বিপাকে পড়লে। একটা বোতল নিয়ে ইচ্ছেমত ঝাকিয়ে আবার সামনেই রেখে দিলাম। বেশী দেরী হলনা। আমি শপিং শেষ করাই আগেই অভাগা এক লোকের সারা প্যান্টের উপর লোকোজেড বিসর্জন। না, ভালো লাগেনি তখন। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হয়েছিলো। কেন জানি তখন মনে হয়েছিলো আমি মানুষ হিসেবে এতোটা খারাপ না। হাহাহাহহাহা। আমার মনে হয় ভালো মানুষ হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে -- নিজের সত্ত্বার ভালো দিকগুলো আবিষ্কার করা।

প্রতি সপ্তাহে আমরা আবিষ্কার করি একজন নতুন মানুষকে। আজ আমাদের সাথে আছেন আমাদের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক প্রয়াত মাটিরময়না। আমার সামনে বসা ভদ্রলোক আমাকে প্রয়াত কেন বলছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে ভদ্রলোক বুঝে গেলেন আমার জিজ্ঞাসা।

- আপনি এখন আর দুনিয়াতে নেই। আপনি গত হয়েছেন ১১ বছর হলো। জি না এটা পরপার না। এটা মধ্যপার। দুনিয়া পার করার পর পরপারে যাবার আগে এই অংশটা হচ্ছে মধ্যপার। এখানে আমরা মানুষের তিনটে করে অপূর্ণ স্বপ্ন পুরণ করে থাকি। আপনি এখন আছেন খোলাশ্মশান টিভি চ্যানেলে । আপনার সাক্ষাতকার নেয়া হবে এখন। এটা আপনার তিনটে স্বপ্নের একটি। ফোনটা তখন বেজে উঠলো। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে দিল আপনার হাতে সময় আছে ৬ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড। ফোন ঊঠাতেই- ওপার থেকে কর্কশ একজন মেয়ের আওয়াজ শোনা গেল- কি রে হারামী, দুইটা বাচ্চা পয়দা কইরা দিয়া শুধু ......লের কবিতা, গল্প আর টিভি রেডিও নিয়া পইড়া থাকলে তোরে ভাত দিব কে?? আমি ভয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে দিল - জি, ওখানেই আপনার বাকী দুটো স্বপ্ন। আপনার স্ত্রী- মানসী, আপনার প্রথম স্বপ্ন আর আপনার একটা ফুটফুটে সুন্দর ছেলে আর একটা পরীর মত মেয়ে- আপনার দ্বিতীয় সপ্ন। আর এখন আপনার তৃতীয় স্বপ্ন পুরণ হবে। চলুন শুরু করা যাক।

প্রশ্নঃ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করবো না কারণ এখানে কেউ খারাপ থাকেনা, তাই সরাসরি আসল প্রশ্নে, আপনি কি খেতে ভালোবাসেন?
উত্তরঃ জি আমি সর্বভুক। ক্ষিদে পেলে সব কিছু খাই। তবে জাবর কাটা জন্তু না আমি। আসলে হয়েছে কি, আমি যদি বলি এটা পছন্দ করি তাহলে হয়তো অন্য খাবাররা রাগ হতে পারে আবার রেগে গিয়ে আমার বিরুদ্ধে অনশন করতে পারে তখন না খেয়ে থাকা লাগতে পারে তাই কিছুটা সেইফ সাইডে থাকা আর কি।

প্রশ্নঃ আচ্ছা আপনাকে যদি এখন একটি কবিতা লিখতে দেয়া হয় কিংবা একটি জোক বলতে বলা হয় তাহলে কি করবেন?
উত্তরঃ জি জোক বলবো। কারণ কবিতা লিখার জন্য মুহুর্ত প্রয়োজন আর সাথে আবেগ। আর প্রয়াতদের আবেগ থাকেনা।

প্রশ্নঃ হুম, ভালোই উত্তর করেছেন আপনি। তো কি জোক বলবেন মাটিরময়না?
উত্তরঃ বাচ্চারা কি দেখছে এই অনুষ্ঠান?
- না দেখছে না। আচ্ছা তাহলে বলা যায়- তো হলো কি- মৃত্যুর পর সবাই লাইন ধরে আছে। সবাই পাপী। সবাইকে এক এক করে নিক্ষেপ করা হচ্ছে আগুনে। হঠাত করেই অনেক দূরে দেখা গেল একটা সবুজ মাঠ আর একটা বিশাল বট গাছ। তার নিচেই বসে আছেন বিল গেটস একটা টেবিল নিয়ে। তাতে তার সেই চিরাচরিত কম্পিউটার আর তার সামনে বসে আছেন খুব সুন্দর একটা মেয়ে। তো হলো কি, একজন পাপী বলে উঠলো, একি অবিচার আমরা দুনিয়াতেও কিছু পাই নাই এখানে আইসাও জাহান্নাম আর ঐ বেটায় দুনিয়াতেও সব পাইলো আর এখানে আইসাও সব পাইলো- একি বিচার তার। তখন জাহান্নামের পাহাড়াদার বলে উঠলেন- আরে কি বলিস বোকার হদ্দ- এই কম্পিউটারে কোন কন্ট্রোল, অলটার, ডিলিট বাটন নেই আর ঐ যে মেয়েটা, তার শরীরে কোন প্রকার ফুটো নেই। হাহাহাহহাহাহা....

প্রশ্নঃ আপনি তো খুব অসভ্য একটা লোক।
প্রশ্নঃ যতদুর মনে পরে জীবদ্দশায় ভদ্র ছিলাম বলেই হয়তো কোন স্বপ্নই পুরণ হয়নি তাই এখন একটো মজা করলাম। আর আপনি আমাকে ভুল কমপ্লিমেন্ট দিলেন এখন। আমি অসভ্য না, আমি প্রাপ্ত বয়স্ক। আমার স্ত্রী আর দুটো সন্তান আছে।

প্রশ্নঃ তো আপনার সময়কার কোন লেখকের লিখা আপনার পড়তে ভাল লাগতো?
উত্তরঃ এটার উত্তর না করাই ভাল কি বলেন? একজনের নাম বলে আরেকজনকে কষ্ট দেয়া আমার স্বভাববিরুদ্ধ।

প্রশ্নঃ আপনার শার্টের বোতামগুলো এমন কেন?
উত্তরঃ জি আমি শার্টে টিম বোতাম পড়ি। তাই এগুলো দেখতে এমন। সংসারে ঝগড়া হলে বোতাম ছেড়ার রিস্ক নেই। টানলে খুলে যাবে কিন্তু ছিঁড়বে না। বোতাম ছিড়ে গেলে লাগানো অনেক বিরক্তিকর একটা কাজ।

প্রশ্নঃ এবার একটা ভিন্ন প্রশ্ন করি। দুটো জিনিসের নাম বলেন যা আপনি ঘৃণা করেন।
উত্তরঃ চাঁদ আর জোছনা। কেন করি তাও বলে দেই না হয় নইলে আবার প্রশ্ন করবেন কেন ঘৃণা করি। জীবদ্দশায় দুটো জিনিসকেই প্রচন্ড রকম ভালোবেসেছি কিন্তু তার বদৌলতে পেয়েছিলাম অখন্ড অবসর।

প্রশ্নঃ আপনার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কি তা জানতে চাইবো না তবে বলুন তো কাকে ভালোবাসা যায়?
উত্তরঃ আমরা এখন আছি মধ্যপারে তাইনা? মধ্যপারের মানুষেরা তো ঘৃণা করতে জানেনা। এখানে শুধুই ভালোবাসা। ঘৃণা জিনিসটা ভালোবাসার জন্য অনেক জরুরী একটা ঔষধ। ভালোবাসা যায় যার উপর লিমিট ছাড়াই অধিকার খাটানো যায় তাকে। আর, এক মুহুর্তে যাকে ঘৃণা করা যায় তাকে আবার এক মুহুর্তে ভালোও বাসা যায়। ঘৃণা আর ভালোবাসা হলো মুদ্রার এপিট ওপিট।

প্রশ্নঃ টের পাচ্ছি আপনার শ্বাস ভারি হয়ে আসছে। তাহলে কি এখন একটা কবিতা শুনাবেন আমাদের?
উত্তরঃ
যে শহরে আমি থাকবো না
সে শহরে বেঁচে থাকবে তুমি খাচায় আটকে রাখা টিয়া পাখিটার মত।
সব সময় তোমার মনে ঘিরে থাকবে বিড়ালের একটা হিংস্র থাবা।
তুমি ভয়ে কাতরাবে, পালাতে চাইবে, কিন্তু পারবে না।
যে শহরে আমি থাকবো না
সেখানে তোমার প্রতিদিন শেষ হবে একটি করে আত্মহত্যা দিয়ে।
তোমার সাজের টেবিলের সামনে টিপ খুলে রাখতেই
তোমার কপাল চিরে বের হবে কালো রক্ত।
তুমি কপাল চেপে ধরবে, বীভৎস চিতকারে তুমি জ্ঞান হারাবে।
তারপর ক্লান্ত শরীরে যখন তুমি উঠে দাঁড়াবে
তখন চারপাশে দেখবে শুধুই সাদা কাপড়।
যে শহরে আমি থাকবো না
সেখানে তোমায় ভালোবাসার কেউ থাকবে না।
কামুক আর উৎসুক চোখ খুবলে খাবে তোমার শরীর।
অদৃশ্য হাতে ছাড়াতে গিয়েও তুমি ব্যর্থ হবে।
তুমি আমার নাম ধরে চিৎকার করবে,
তোমার চিৎকারে ভেঙ্গে যাবে সাজের টেবিলের আয়না।
টুকরো আয়নার প্রতিবিম্বে তুমি টের পাবে
যে শহরে আমি নেই
সেখানে তোমাকে ভালোবাসার কেউ নেই।
……………
…………...
……………
যে শহরে আমি নেই
সেখানে শব্দের সঙ্গমে হবেনা কোন কবিতা।
এটাকেই কবিতা হিসেবে ধরে নিন।

প্রশ্নঃ স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এবার একটা অন্যরকম প্রশ্ন। আপনাকে যদি এখন বলা হয় আপনার যত ইচ্ছে টাকা চাইবেন ততই পাবেন তাহলে কি করবেন?
উত্তরঃ আমার হৃদরোগ নেই এবং ছিলোওনা তখন কিন্তু এখন হয়ে যাবে নিশ্চিত। এতো বেশী দরকার নেই। ফিউদস নামে একটা জায়গা আছে, অনেক সুন্দর, সেখানে একটা সন্ধ্যা আমার স্ত্রী মানসীকে নিয়ে বসে থাকতে চাই। হাজার পাচেক এ হয়ে যাবে। আপনিই কিন্তু বলেছেন, এখন মানসী আমার স্ত্রী।

প্রশ্নঃ ধরুন আপনাকে যদি আরেকবার জন্ম নেবার সুযোগ করে দেয়া হয় তাহলে কি করবেন?
উত্তরঃ আপনি বলেছেন মানসীকে আমি পাইনি দুনিয়াতে। তাই আরেকবার সুযোগ পেলে মানসী হয়ে জন্মাতে চাই। শুধু দেখতে চাই তার মনে আমার জন্য আসলে কোন ভালোবাসা ছিলো কিনা আর দেখতে চাই তার কষ্টগুলো অনুভব দিয়ে। আর মেয়েদের এমন কিছু কথা থাকে যে, কোন ছেলে মানুষকে দেখলেই মুখ বন্ধ করে রাখে। সেগুলো কি তাও জানা হয়ে গেল। আরেকটা কারণ আছে- আপনাকে বলা যাবেনা।

প্রশ্নঃ আপনি পারেনও বটে। আমাকে বললে হয়তো আমি বলতাম পুরুষ হয়েই জন্মাবো। যাই হোক শেষ একটা প্রশ্ন -- আপনাকে যদি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাহলে কি করবেন?

বাসের ব্রেকের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল আমার। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই। লোকোজেডের বোটলটা পরে গিয়ে ভিজে গেছে আমার প্যান্ট। অপরাধবোধটা এখন আর নেই। শাস্তি আমার হয়ে গেছে। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অপুর্ব সেই প্রকৃতি। মনে মনে হাসিই পেল। এসব কি দেখলাম আমি -- কিছুটা পুর্ণতা আর কিছুটা অপুর্ণতার অনুভব নিয়ে গুণগুণ করতে লাগলাম -

ঘাসফুলের মালা পড়ামু তোমার অঙ্গে
দেখুম তোমারে আমি সাদা পরীর ঢঙ্গে
কথা দাও সখী আমার যাইবা না ছাড়িয়া।
ও সখী গো,
পুর্ণিমার চান্দ তোমায় রুপ দিব
কোকিলের গান তোমায় সুর দিব
তোমার সেই গান শুনুম পরান ভইরা
কথা দাও সখী আমার যাইবা না ছাড়িয়া।


মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই