কলেজ পাড়ায় অপরাহ্ণ | দেবাশিস ভট্টাচার্য
একটি বালক হাওয়া এসে কিশোরী মেঘটিকে উড়িয়ে নিয়ে চলল
সেই পথে যেখানে একদিন আমার পরলোকগত পিতৃদেব
একটি পথের ধারের বাড়িতে বসেছিলেন
অবশ্যই এটি আমার স্বপ্নের একটি দৃশ্য-
পাজামা পাঞ্জাবি গায়ে, ঠিক আগের মত, তাঁকে বলতে শুনেছিলাম, এই হল আকাশগঙ্গা
কলেজ স্ট্রিট আর আগের মত নেই, কে-ই বা থাকে, তবু কলেজ স্ট্রিট কলেজ স্ট্রিটেই আছে
একদিকে আমাদের প্রিয় কফি হাউস, অন্যদিকে বসন্ত কেবিন।
এই তো যেখানে সেদিন মাত্র কুড়ি বছর বয়সে
আমি হিন্দু হস্টেলের হয়ে হার্ডিঞ্জের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলতে গেলাম
প্রেসিডেন্সির ক্লাস শেষ হতে চলল, সবাই যে যার প্রেমিকার সঙ্গে
আমি পুরনো বইয়ের দোকানের সারির সামনে দিয়ে
একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের মিটিং না করেই বেরিয়ে এসেছি
এত ছেলে মেয়ে, উত্তাল কলরোল মুখর কলেজ স্ট্রিট, তবু আমি ভীষণ একা ছিলাম
আমার প্রেমিকা কবিতা কিছুদিন হল কথা বলছে না আমার সঙ্গে
মেয়েদের যা হয়ে থাকে, অকারণেই তার মন খারাপ
সে আছে জানতাম কিন্তু কোন ঠিকানায় জানা নেই
বাল্মীকি থেকে রবি ঠাকুর, শঙ্খ ঘোষ থেকে জয় গোস্বামী কেউ কি জানে?
আমার পুরনো স্কুলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা ও কাহিনী, কবিতার বই দেখা,
পুরনো শিক্ষকদের কাউকে হয়তো দেখি, হিন্দু স্কুল থেকে বেরুচ্ছেন,
আমি বললুম- স্যার, কেমন আছেন?
অজিত ঘটক স্যার তাঁর সেই চমৎকার মিষ্টি হেসে বললেন, কেমন আছ দেবাশিস, কোথায় চললে ?
আমি বলতে পারি না, আমি বড় কষ্টে আছি স্যার
সেই ক্লাস এইটের বা টেনের দিনগুলো আর নেই
এক্ষুনি এক বালক হাওয়া কিশোরী মেঘকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হল
আমার বাবা বিষাদ রোগে কাতর, তখনো আকাশগঙ্গা দূরে
তিনি একটা গভীর কুয়োর মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন
কলকাতার সব বিখ্যাত মনরোগ বিশেষজ্ঞ তাঁকে দেখেছেন, কিন্তু সারাতে পারেন নি
বাবা তলিয়ে থাকেন বিষাদে, কেননা তিনি জীবনের মানে বুঝতে পারেন না
চাকরি করেন, কিন্তু লম্বা ছুটি নেন, রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েড ইউং অ্যাডলার ঘুরে ঘুরে পথের শেষ কোথায়
অথচ তিনি কাজ করেন পুলিশে, যেখানে বাহাত্তর তিয়াত্তরে
তাঁকে নরখাদকদের সঙ্গ দিতে হয়, টালিগঞ্জের গলিতে কোনও মধ্যরাতে
তিনি দেখেন তাঁর সঙ্গীরা সত্তর বছরের বৃদ্ধকে নগ্ন করে উৎসব করছে
যেহেতু বৃদ্ধর বড় ছেলে নকশাল, পলাতক
আমার বাবা আমাদের জন্য চাকরি ছাড়তে পারেন না, কিন্তু তাঁর কর্মশক্তি ধ্বংস হয়ে যায়,
তিনি বেলুড় শান্তিনিকেতন ন্যাশানাল লাইব্রেরি করে বেড়ান, অপিস মুখো হন না ।
কত বছর কতগুলো দশক কাটে, আবার এক চৈত্রের বিকেলে ভুল করে কলেজ স্ট্রিটে এসে দেখি
একটি বালক হাওয়া এসে কিশোরী মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে যায় দূর দিগন্তে
একটি সদ্য যুবক দাঁড়িয়ে বই দেখে, পুরনো বইয়ের দোকানে
তার কোনও সময়ের জ্ঞান নেই, তার কোনও প্রেমিকাও নেই নাকি ?
অথবা যে ছিল সে কিশোরী মেঘের মতনই পলাতক
ছেলেটির বন্ধুরা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কাছাকাছি
ক্যান্টিনে বা কফি হাউসে কোথাও, কেউ বা অধৈর্য হয়ে গান ধরেছে
একটা মেয়ে বোধহয় সিগারেটও ধরাল, একটি ছন্নছাড়া দেখতে ছোঁড়া
খাতা খুলে লিখে যাচ্ছে অখাদ্য ছড়া যার বাপও নেই মাও নেই, মাথা মুণ্ডু কিছুই নেই,
যেটা আছে তা হল সেই একই আগুন, একই যৌবন, একই অভিমান, সেই বৃষ্টির কল্পনা ও আকাঙ্ক্ষা
একটা ঝড় হলে ভাল হয় এরকম কিছু।
বৃষ্টি হলে জানেন তো? পুরো কলেজ স্ট্রিট ভেসে যাবে
উলটোডাঙ্গা আগরপাড়া কোন্নগর গড়িয়া যেখানে যে থাকে ফিরতে অনেক দেরি হবে
পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বিপর্যস্ত, কেউ পড়াতে যেতে পারবে না
কারোর মাকে ডাক্তার খানা নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল
কোনও কথাই রাখা যাবে না
শুধু, এইসবের মধ্যে, মাথায় ঘুরছে
কেউ কি ফিরে আসছে, কারুর কি ফেরার কথা ছিল?
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন