চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অবিশ্বাসীর মনস্তত্ত্ব: প্রথম পরিচ্ছেদ

[শুরুতেই বলে রাখা যাক, আমার লেখনির প্রচেষ্টা কখনোই কারো প্রতি ব্যক্তিগত আঘাত নয়। আবেগের প্রকাশ নয়। “যুক্তিই হোক শেষ কথা, আবেগ নয়।”[1] -আমি এই নীতিতে বিশ্বাসী। এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থের বিশ্লেষণ। সেক্ষেত্রে, একটা নির্দিষ্ট গন্ডী ছাড়িয়ে হয়তো সবকিছু নিয়ে আলোচনা করা যাবে না। তবু আমরা আলোচনাক্রমে ঠিক সেখানেই পৌঁছানোর চেষ্টা করব, যেখানে যুক্তি এবং বাস্তব জ্ঞান আমাদের নিয়ে যাবে। এখন হয়তো আপনি, বিশেষ করে যদি আপনি অবিশ্বাসী হয়ে থাকেন; বাঁকা হাসছেন এই ভেবে যে, যেখানে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ মানুষ দিতে পারেনি, সে আসছে যুক্তি দেখাতে। আমিও এই প্যারাটি লিখতে লিখতে মুচকি হাসছি এই ভেবে যে, যেখানে স্রষ্টার অনস্তিত্বের প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি সেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই আপনি ভাবছেন স্রষ্টা নেই! যুক্তিতে আপনি বলবেন- বিগ ব্যাং, বিবর্তনবাদের কথা; আমি বলব ল অব নেচার, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন, নিউটনের প্রথম গতিসূত্রের কথা......... যুক্তি-প্রতিযুক্তি আছেই এবং থাকবে। যুক্তি-প্রতিযুক্তিই পৃথিবীকে এগিয়ে নেয়। আর, দুই পক্ষের যুক্তি ঠিক যেসব জায়গায় এসে এক প্লাটফর্মে দাঁড়াবে তাকেই সত্যিকারের স্ট্যান্ডপয়েন্ট বিবেচনায় অর্জন ভেবে নেয়া যেতে পারে। বিতর্কে বা তর্কে জয় বা পরাজয় বলে কিছু নেই। বিতর্কে জয় পরাজয়ের ব্যাপারটা এসেছে মুনাফাগিরির মানসিকতা থেকে, পাবলিসিটির অথর্ব মানসিকতা থেকে, নিজেকে বা কোনো গোষ্ঠীকে বড় প্রমাণের ভাওতাবাজি থেকে। বিতর্কে কেবল একটা বিষয়ই ধ্রুব বলে মানি আমি, তা হল দু’পক্ষের যে কোনো বিষয়ে একমত হওয়া এবং যে বিষয়গুলো নিয়ে একমত হওয়া যায়নি তা নিয়ে ভুল-টুল শুধরে পুনরায় আলোচনা করা।- লেখক]

আপনার ইন্দ্রিয়সুখঃ আ জাজমেন্ট অব এরর, দ্যাট মে পুশ্ ইউ টু এ্যাথেইজম। আখতার মাহমুদ


স্রষ্টায় বিশ্বাস সুখের পথে বাঁধা?

স্রষ্টায় বিশ্বাস আপনাকে বাধা দেয় কোথায়? পিছিয়ে দেয় কোথায়? কোন জায়গায় বিশ্বাস আপনাকে বলছে- কোনো ভোগ নেই, সুখ নেই, মাথা উঁচু করে বাঁচা নেই, নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করতে নেই, ফুল-পাখি-নদী-পাহাড়-সবুজ দেখে মুগ্ধ হতে নেই? ইন্দ্রিয়কে মেরে কেটে চেপে চুপে দমন করতে হবে? বঞ্চিত করতে হবে নিজেকে ইন্দ্রিয়সুখ হতে? কখন কোথায় কিভাবে কোন বিশ্বাস বোঝায় বা শেখায় আপনি সুখি হয়ে বাঁচতে পারবেন না? পছন্দমত স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন না? কিভাবে বিশ্বাস আপনাকে নিষেধ করে যে, জল-নদী ছুঁয়ে একবুক সুখ নিয়ে আপনি ভাবুক কবি হতে পারবেন না। সমস্ত শরীরে জল মেখে শিহরিত হতে পারবেন না। প্রিয় মানুষটিকে বারবার ছুঁয়ে দেখতে পারবেন না?
সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হলে সব সুখ-আহ্লাদ জলাঞ্জলী দিতে হবে -এই ভাবনা হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী আর সঠিক জ্ঞানের অভাব। কোথাও কোথাও এটা ধর্ম নিয়ে নিজস্বার্থে বাড়াবাড়ি করা মানুষদের কার্যকলাপের নেতিবাচক প্রভাব। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস বরং মানুষকে পরিতৃপ্ত করে এবং হৃদয়ের গহীনে মানুষ নিজেকে একা ভাবে না কখনো। বিশ্বাস তাকে জানায়, যা-ই ঘটুক, যত সুখ-অসুখই আসুক জীবনে, শেষ ঠিকানা- স্রষ্টা। উত্তম প্রতিদান দেবেন স্রষ্টা। সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে যেতে হবে শেষতক। এ বিশ্বাস, এ বোধ, এ প্রজ্ঞা অথবা সংস্কার মানুষকে বরং পরিণত-সহনশীল করে তোলে। যে মানুষ পরিণত নয়, সহনশীল নয় তার সত্যিকারভাবে স্রষ্টায় বিশ্বাস নেই। সুতরাং এমন মানুষদের উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে, আপনি স্রষ্টায় বিশ্বাসিদের বিচার করতে পারবেন না। করলে সেটা আপনার একচোখা দৃষ্টিভঙ্গী বলেই বিবেচিত হবে। যাই হোক, মানুষের মনের আশ্চর্য প্রশান্তি এক দারুণ একাত্মতা; মানুষের মনন এবং স্রষ্টায় বিশ্বাসের।
এ বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে পড়াশোনা করতে গিয়ে চমকপ্রদ যে তথ্য পেয়েছি বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে। তাঁর একমাত্র মেয়ে ক্যাথরিন টেইট তাঁকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য মন্তব্যটি করেছেন কোনো এক স্মৃতিকথায়- “I believe myself that his whole life was a search for God…Somewhere at the back of my father’s mind, at the bottom of his heart, in the depths of his soul, there was an empty space that had once been filled by God, and he never found anything else to put it in. He wrote of it in letters during the First World War, and once he said that human affection was to him ‘at bottom an attempt to escape from the vain search for God.’ After the war, finding his life more satisfying, he stopped talking that way; nostalgia for religion was quite absent from our home. Nevertheless, I picked up the yearning from him, together with his ghostlike feeling of not belonging, of having no home in this world,”
উল্লেখিত মন্তব্যটির সমর্থনেই যেন রাসেল কোনো একসময় বলেছিলেন “Nothing can penetrate the loneliness of the human heart except the highest intensity of the sort of love the religious teachers have preached.” ― The Autobiography of Bertrand Russell
অধিকাংশ মানুষ ঠিক তখনই স্রষ্টায় এবং অবিশ্বাসের পথে পা বাড়ায় যখন ধর্মবিশ্বাস মূলত ব্যক্তিগত ভোগ-উপভোগ-স্বস্তি-আরাম-উপলব্দি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতার পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। এটা সম্ভবত প্রথম  ব্যক্তিগত কারণ মানুষের অবিশ্বাসের। দ্বিতীয় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কারণ হিসেবে হয়তো অবিশ্বাসীরা বিবেচনা করে, ধর্মকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা মানুষদের। আর বক্তব্যে-বিবৃতিতে তারা খুব সম্ভবত কারণগুলোর পর্যায়ক্রম বদলে ফেলে দ্বিতীয় কারণকে প্রথম এবং ফলপ্রসু কারণ বলে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমি আগেই বলেছি, বিপদগামীদের উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে না। এটা যুক্তিযুক্ত নয়। আর তবুও যদি কেউ তাদের উদাহরণে অটল থেকেই সৃষ্টিকর্তায়-ধর্মে বিশ্বাসের অসারতা তুলে ধরেন, তবে খুব সম্ভবত তিনি কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation Bias)[2] নামে সমস্যায় ভুগছেন। যে সমস্যা পরবর্তী ধাপে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস সংক্রান্ত আলাপে তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তি নিয়ে থিয়োরী সর্বস্ব আলোচনায় উজ্জীবিত করে।
বার্ট্রান্ড রাসেল, একাকী হৃদয়ের ধ্রুব সত্যটা বুঝতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি অবিশ্বাসিই ছিলেন। তবু স্বীকার করেছেন, মানুষের হৃদয় গহীনে তীব্র যে একাকীত্ব শূন্যতা তৈরি করে, তা কেবলমাত্র স্রষ্টার প্রতি ভালবাসাই পূরণ করতে পারে। আর স্রষ্টায় বিশ্বাসী মানুষ সেই ভালবাসা উপলব্দি করে অবিশ্বাসীর চেয়ে বেশি স্থির, পরিতৃপ্ত হতে পারে।

শরীর সংক্রান্ত অবসেশন, ভ্রান্ত যুক্তি/আবেগ

“ওষ্ঠ দিয়ে ছোঁয়া নিবিড়তম ছোঁয়া, আমি যা কিছু ওষ্ঠ দিয়ে ছুঁয়েছি, তারাই আমাকে সুখী করেছে সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে ছোঁয়া খুবই নিষিদ্ধ ব্যাপার; আমরা খুব কম মানুষকেই ছুঁতে পারি। খুব কম মানুষকেই ছোঁয়ার অধিকার আছে আমাদের। ছোঁয়া এখানে পাপ; কোনো নারী যদি কোনো পুরুষকে ছোঁয়, কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীকে ছোঁয়, তাতে সূর্য খ’সে পড়ে না, আকাশে হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায় না. কিন্তু আমরা মনে করি মহাজগত তাতে খেপে উঠছে। শরীর খুবই আপত্তিকর আমাদের কাছে, একে অজস্র পাপের উৎস ভেবে আমরা ভয় পাই; পবিত্র বইগুলো সব সময় মনে করিয়ে দেয় যে আমরা পাপী, তাই আমাদের সুখ নয়, শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু আমি ছুঁয়েছি, ছোঁয়া পেয়েছি, তাতে চাঁদতারা খ’সে পড়ে নি।”- প্রথম পরিচ্ছেদ, আমার অবিশ্বাস/হুমায়ুন আজাদ।
উপরোক্ত বক্তব্য যখন পড়ি, তার কাছাকাছি কোনো এক সময়ে ‘শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ পড়ছিলাম। বইটির একটানা সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে আমার পরম কৌতুহলী মনের মনে হয়েছে ভদ্রলোক বোধহয় শরীর নিয়ে খুব বেশি অবসেস্ড ছিলেন। ক্রমাগত নারী শরীর এবং নারী শরীর ছোঁয়ার প্রসঙ্গ এসেছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে। তবে এ থেকে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি যে, হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগতভাবে যথেচ্ছা ছোঁয়াছুঁয়ি শুদ্ধ মনে করতেন। রুচিশীল এবং সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষ হয়ে সব ছোঁয়াছুঁয়ি নিশ্চয়ই তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অন্তত তাঁর সম্পর্কে এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
শরীর ছুঁয়ে দেখলে চাঁদ-তারা খসে পড়বে ব্যাপারটা এমন নয়। খসে পড়ার কিছু থেকে থাকলে তা- নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ। আপনি কোন শরীর ছুঁয়ে দেখছেন এটাই ব্যাপার। আপনি বন্ধুর নারীটিকে ছুঁয়ে দেখছেন না নিজ ভাইয়ের নারীটিকে ছুঁয়ে দেখছেন, না মেয়ের বান্ধবীকে ছুঁয়ে দেখছেন বারবার, নাকি আপনি কারো নারী নয় এমন কাউকে ছুঁয়ে দেখছেন, ব্যাপার হচ্ছে এটা।
ধরা যাক, একজন মধ্যবয়স্ক মানুষের একটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে আছে। সে স্বাধীনচেতা। মানুষটিও মেয়ের ব্যক্তিস্বাধীনতায় আস্থা রাখেন। এখন লোকটির সমবয়সী একজন বন্ধু আছে, যার সমবয়স্ক একজন স্ত্রী আছে এবং বন্ধুটির লোকটির মেয়ের বয়সী সন্তান আছে। এমতাবস্থায়, কোনো একদিন সেই লোক দেখল- তার বন্ধু ভদ্রলোক তার মেয়েকে ছুঁয়ে দেখছে, তার মেয়ে আপত্তি করছে না, জেনে-শুনে তিনিও আপত্তি করলেন না। কেননা তিনি নিশ্চিতভাবেই জেনে ফেলেছেন যে, এতে চাঁদ-তারা খসে পড়ে না। ভাল কথা। এটা তার রুচিবোধ বা সংস্কৃতি বা বিশ্বাস বা উদারমনের পরিচয়।
কিন্তু সেই মানুষটির ভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেউ স্রষ্টায় বিশ্বাস করে অনৈতিক ভেবে এসব ছোঁয়াছুয়ি থেকে নিজেকে, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যদের বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা যদি করে, সেই মানুষটির এতে আপত্তি থাকাটা শোভন নয়। তিনি এতে আপত্তি যদি করেন তবে কিসে তার মত মানুষ আপত্তি করবেন না সেটাই ভাবনার বিষয়। পবিত্র গ্রন্থগুলো শরীর ছোঁয়া পাপ এটা বলেনি। শরীর ছুঁয়ে দেয়ার নিয়ম বলে দিয়েছে কেবল। কাকে আপনি ছুঁয়ে দেখবেন এটা বলে দিয়েছে। কেননা এতে করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ থাকে না।
আপনি কাউকে ছুঁয়ে দেখতে চাইবেন বারবার অথচ সামাজিকভাবে তাকে স্বীকৃতি দেবেন না, অধিকার দেবেন না। স্রেফ ভোগ করবেন আর নিরুদ্বেগ থাকবেন? কেউ আপনাকে নিষেধ করলে বলবেন- এই-ই প্রেম! এই-ই সহজাত জৈবিক অনুভূতি! যে অনুভূতি এবং প্রেম নৈতিকতা বা স্রষ্টার দেখানো পথ অনুসরণ করে না, দায়িত্ব নেয় না; তাতে আর যাইহোক ঘাপলা আছে! ধর্মবিশ্বাস মূলত এই ঘাপলার বিষয়টাই সমর্থন করে না।
এবার আপনি হয়তো ভাবছেন, উত্তম চরিত্র, নৈতিকতা -সব ধর্মের সৃষ্টি। এগুলো মনের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। মানবধর্মকে অস্বীকার করে। এসবের আসলে ভিত্তি নেই। আসলেই, আপনার কথা যদি মেনে নেই; তাহলে নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, সহানুভূতি, আশাবাদ, মহত্ত্ব, উত্তম চরিত্র, বিবেক -এসবের ভিত্তি থাকে না। কেননা এসব নির্দিষ্ট করে দেয় ধর্ম। এসব মানতে মানুষকে উপদেশ দেয় ধর্ম। এসব না মানলে শাস্তি হবে মৃত্যুর পরে, এটা বোঝায় ধর্ম। ধরা যাক, আপনি ভাবলেন বা বললেন বা শেখাতে চাইলেন আমাকে যে- বিবেক, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, উত্তম চরিত্র -এসব আসলে মানবধর্ম। এগুলো সহজাত। এগুলো শেখানোর প্রয়োজন পড়ে না, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে এসব বিল্ট ইন থাকে, কেউ কেউ অবশ্য উচ্চতর শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করে এসবকে জাগ্রত করে, ক্ষুরধার করে। যদি আপনার কথা মেনে নিই, তাহলে আমাকে বলুন, এসবের সার্বজনীন মানদন্ড কে ঠিক করবে?
আপনি? সমাজের অধিপতিরা? ক্ষমতাবানরা? কে? আর যে-ই ঠিক করে দিক সে-যে ঠিক তা মাপবে কে? ব্যাপারটা এভাবে চলতে থাকবে। ধর্ম যদি না থাকে আর যদি প্রত্যেকটি সৎগুণের সংজ্ঞা কোনো মানুষ-জাতি-সমাজ ঠিক করে দেয়, তবে সেটা সার্বজনীন হবে না, সাধারণ মানুষ মানবে না। একটু ভাবুন তো- আপনার বিবেক বলছে, চুরি করা অনুচিত। কিন্তু চোরের বিবেক বলছে- এই ভদ্রলোকের জিনিস চুরি না করলে আমার পেট চলবে কী করে! একজন দুর্নীতিবাজের বিবেক বলছে, আশে-পাশের সবাই তো লুটে-পুটে খাচ্ছে, তো আমিও একটু খেলে অসুবিধা কি? আর যদি ধরা না পড়ি তাহলে তো কিছু হচ্ছে না। কেননা মরে গেলেই সব শেষ, গলে-পঁচে মাটিতে মিশে যাব। তার আগে যতটা সম্ভব ভোগ করে নেয়া যাক, টাকা বানানো যাক। বুদ্ধিমানের কাজ এটাই। মূলকথা, স্রষ্টা এবং ধর্ম যদি না থাকত তাহলে পৃথিবীতে মানুষের জীবন-যাপন অসম্ভব হয়ে যেত। কেননা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী নিয়ম এবং গুণ তৈরী করে দিত। আর গোটা পৃথিবী জুড়ে চলতো কল্পনাতীত বিশৃঙ্খলা। কেউ কেউ ব্যাপারটা উপলব্দি করতে না পেরে, হয়তো সেই বিশৃঙ্খলাই চাইছেন!
ধর্ম অশ্লীলতাকে নিষেধ করে, অনৈতিক আচরণ-সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার আহবান জানায়। ধর্ম বলে দেয়, মানুষ কামনায় কোন নারীকে ছুঁয়ে দেখবে, স্নেহে-মমতায়-শ্রদ্ধায় কোন নারীকে ছুঁয়ে দেখবে। এর ফলে যা আসে তা শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও নৈতিক আচরণ। আর এ সবকিছুই আসে, এসেছে এবং আসবে স্রষ্টায় বিশ্বাস থেকে। বিশৃঙ্খলা, অপরাধ, অনৈতিকতা, হানাহানি, কাটাকাটি আসেই অধর্ম থেকে। ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা যারা তৈরী করে তারা যে আসলে স্রষ্টার ওপর বিশ্বাস করে বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে তা নয়। তারা নিজেদের বিশ্বাস করে। নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী স্বার্থ উদ্ধারে ধর্মকে বর্ম করে নিজেকে বিশ্বাসী বলে প্রচার করে। আদতে স্রষ্টায় বিশ্বাস থাকলে কখনোই মানুষ বিশৃঙ্খলা তৈরী করবে না, অন্যায়-অনৈতিক পদক্ষেপ নেবে না। কেননা স্রষ্টা জানেন, মানুষ বিশৃঙ্খলাপ্রিয় এবং অস্থির। তাই, এদের সরল ও সঠিক পথে চালনার নিমিত্তে ধর্মের মত আশীর্বাদ, শান্তি মানুষকে দিয়েছেন। সে শান্তিকে যদিও কোনো কোনো মানুষ অভিশাপ-অশান্তিতে রুপান্তরিত করে ফেলে। ফলে, আলবেয়ার কামু থেকে হয়তো আপনি পর্যন্ত ওইসব নষ্টদের আচরণে ভেবে বসে আছেন স্রষ্টায় বিশ্বাস জীবনকে কেবল নিরর্থক করে তোলে।
এ ভাবনা যদি আপনার মধ্যে চলেই আসে, দয়া করে নোট করুন; আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বলে- অধিকাংশ মানুষ ঠিক তখনই স্রষ্টায় এবং অবিশ্বাসের পথে পা বাড়ায় যখন ধর্মবিশ্বাস মূলত ব্যক্তিগত ভোগ-উপভোগ-স্বস্তি-আরাম-উপলব্দি-অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলতার পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। এটা সম্ভবত প্রথম ব্যক্তিগত কারণ মানুষের অবিশ্বাসের। দ্বিতীয় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কারণ হিসেবে হয়তো অবিশ্বাসীরা বিবেচনা করে, ধর্মকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা তৈরী করা মানুষদের। আর বক্তব্যে-বিবৃতিতে তারা খুব সম্ভবত কারণগুলোর পর্যায়ক্রম বদলে ফেলে দ্বিতীয় কারণকে প্রথম এবং ফলপ্রসু কারণ বলে প্রতিষ্ঠিত করেন। আমি আগেই বলেছি, বিপদগামীদের উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে না। এটা যুক্তিযুক্ত নয়। আর তবুও যদি কেউ তাদের উদাহরণে অটল থেকেই সৃষ্টিকর্তায়-ধর্মে বিশ্বাসের অসারতা তুলে ধরেন, তবে খুব সম্ভবত তিনি কনফার্মেশন বায়াস (Confirmation Bias)[2] নামে সমস্যায় ভুগছেন। যে সমস্যা পরবর্তী ধাপে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস সংক্রান্ত আলাপে তাকে বিজ্ঞান ও যুক্তি নিয়ে থিয়োরী সর্বস্ব আলোচনায় উজ্জীবিত করে।
কিন্তু সরল কথা হল যখনই ধর্ম মানুষকে অনৈতিক ইচ্ছা-কাজ থেকে দূরে থাকতে বলেছে, শৃঙ্খলা মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে, ভোগের চেয়ে ত্যাগে গুরুত্ব দিতে বলেছে, বেশি বেশি পরোপকার করতে বলেছে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছে, অন্যায়-অবৈধ সম্পদ অর্জন নিষিদ্ধ করেছে, তখনই কেউ কেউ বিদ্রোহ করেছে। কেননা যখনই কেউ অন্যায় ভোগ ও লালসা চরিতার্থ করতে চায় তখনই, ধর্মবিশ্বাস তাকে নিষেধ করে। যখনই কেউ বিশৃঙ্খল হতে চায় তখনই ধর্ম বাঁধা দেয়। আর তাই, চোখ বুজে অন্তরে দৃষ্টি ফেলে কেউ কেউ হয়তো বুঝতে চায় বা বোঝাতে চায়, স্বাভাবিক ভোগ-উপভোগ আর কামনায় যা বাঁধা দেয় তা সৃষ্টিকর্তার নয়, হিংসুক মানুষের সৃষ্টি। স্বর্গ-নরক বলে যৌক্তিক কিছু নেই। সব শিশুতোষ রূপকথা মাত্র। এর স্বপক্ষে কেউ কেউ কৌশলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানকে ধর্মের মুখোমুখি।[3] এভাবে পুরো ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। যে পথে হেঁটে চলছেন হয়তো আপনি এবং অনেকে। যে পথে আপনাদের নিয়ে এসেছে সম্ভবত- ইন্দ্রিয়সুখ। কেননা স্রষ্টায় বিশ্বাস, ইন্দ্রিয়সুখকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই নিয়ন্ত্রণের সত্যিকার মহৎ কারণ বুঝতে না পেরেই হয়তো অনেকেই বেছে নিয়েছেন অবিশ্বাসের পথ। যাকে আমি বলি-  আ জাজমেন্ট অব এরর।
আপনি অবিশ্বাসি হয়ে এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে উপরের আলোচনা পড়ে থাকলে আমার কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আর নিজেকেই আমার ব্যাপক কৌতুহলী কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন- আপনি কতটা সেক্যুলার? আপনি কতটা সচেতন? আপনি আপনার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা মতবাদের কতটা মেনে চলেন? নাকি সবটাই মুখে মুখে? আপনি কি নিজের মতবাদ মানেন কেবল ফেসবুক স্ট্যাটাসে, লেখালেখির খাতায়, মদ-গাঁজা টানার বেলায়, শরীর সম্ভোগ, মুরুব্বিদের তাচ্ছিল্য করা এবং সামাজিকতা বর্জনের বেলায়? নাকি আপনার মূল্যবান জীবনের মৌলিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এলেও আপনি সেক্যুলারিজম, প্রথাবিরোধী মনোভাব বজায় রাখবেন? যদি রাখেন তবে প্রকারান্তরে আপনাকে সৎ বলা যায়।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলতে ধরা যাক- বিয়ে, সন্তান, মৃত্যু। প্রথাবিরোধী হয়েও আপনি কি বিয়ে করবেন বাপ-দাদার ধর্মেরই কোন মেয়েকে বা পুরুষকে ধর্মমতে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তীব্র সমালোচক হয়েও আপনি পুরুষ হলে কি আপনার সন্তানের নামের শেষাংশে নিজের নাম বসাবেন? আপনার মৃত্যুর পর, আপনার দেহের সৎকার কি বাপ-দাদার ধর্মমতে হবে?
যদি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে আপনি বিশৃঙ্খলাপ্রিয় কপটাচারী। যেসব তরুণরা হুমায়ুন আজাদকে অবিশ্বাসীদের আইকন ধরে নিয়ে অনুসরণ করে থাকেন, তারা ব্যথিত হয়ে লক্ষ্য করতে পারেন যে, হুমায়ুন আজাদ বিয়ে-সন্তান-মৃত্যু এই তিন মৌলিক বিষয়েই সেক্যুলার এবং প্রথাবিরোধী থাকতে পারেন নি বা থাকেন নি। কোথাও তিনি বাপ-দাদার ধর্ম অনুসরণ করেছেন, কোথাও তিনি অনুসরণ করেছেন প্রথা। তবে এইজন্য তাঁকে আমি কপট বলবো না। হয়তো তিনি অতটা ভাবেন নি।

চলবে......


  1. বাক্যটি ‘স্বপ্নবন্দী’ উপন্যাসের মূল চরিত্রের উল্লেখযোগ্য একটি উদ্ধৃতি
  2. Confirmation bias, also called confirmatory bias or myside bias, is the tendency to search for, interpret, favor, and recall information in a way that confirms one's preexisting beliefs or hypotheses, while giving disproportionately less consideration to alternative possibilities. [Source: Wikipedia]
  3. উল্লেখ্য বিষয়ে পরবর্তীতে যে কোনো পর্বে/অধ্যায়ে ক্রমানুসারে বিশদ আলাপ থাকবে বলে আশা রাখছি

 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই