একটি রঙ্গীন চিঠি । মোঃ আবদুল সবুর
শুক্রবার দিনটি আশীর্বাদ হয়ে আসে নীরার জন্য। সব রকমের ব্যক্তিগত কাজ এই দিনে শেষ করতে হয়। সপ্তাহে একটি দিন সে নিজের মত করে কাটায়। আজও তেমনি করে কাটানোর ইচ্ছেয় সেল ফোনে হাল্কা ভলিউমে গান ছেড়ে দিল। শ্রীকান্তের গান “আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি যেন মনে হয় এ যেন গো কিছুই নয়....” গানটি নীরার খুব প্রিয়। তাই গানটি মনোযোগ দিয়ে শোনে। আর ভাবতে থাকে যেন অনেক দূরে চলে যাওয়া কেউ একজনকে, যার কেবল হৃদয়েই অবস্থান শত কষ্টেও!
সে জানালার পাশে বসা ছিল। বাইরে স্নিগ্ধ মেঘভেজা বাতাস মন কে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মেঘলা আকাশ, নীরাকে প্রচন্ড আবেগী করে তোলে। সে মেঘলা আকাশে তাকিয়ে বারে বারে বিষণ্ন হয়। এই মুহূর্তেই তাদের বাসার সামনে ডাকপিয়ন দেখতে পেল সে, পিয়ন ভিতরের দিকে এগিয়ে এসে বলল- এখানে নীরা নামে কাউকে থাকেন?
কেন?
ওনার নামে একটা চিঠি আছে।
আমিই নীরা।
নীরা অবাক হয়ে গেল, তাকে কে চিঠি পাঠাবে!! সে বিস্ময় কাটিয়ে পিয়ন থেকে খামটি বুঝে নিল। একটি রঙ্গীন চিঠি। চিঠিতে প্রেরকের কোন নাম ঠিকানা নেই। অফিস থেকে আসলে ঠিকানা থাকতো। সে অনেক বছর ধরে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে। কখনো কেউ এই ঠিকানায় চিঠি পাঠায়নি। এই মোবাইল যুগে কে পাঠাবে চিঠি?? কৌতুহল নিয়ে রীনা চিঠি খুলল।
নীরা শোনো...
তোমার চোখে চোখ রেখে না বলার সাহস আমার নেই। কেননা তোমার চোখে তাকালেই, আমি বুঝতে পারি, শুদ্ধতা কী। এমন শুদ্ধ মন যার তাকে সামনা সামনি ফেরানোর মত শক্তি আমার নেই। জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে যা মুখে বলা যায় না। তাই চিঠির আশ্রয় নিলাম। ভেবো না আমি কাপুরুষ। আমি অনেকবার অনেকভাবে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি, আমি তোমাকে নিয়ে অনেক অনেক ভেবেছি। ভালবাসার মত সৎ সাহস আমার নেই, আর তুমি আমার নষ্ট অতীত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানো না। আমি অনেকদূরে, পেছনে, আমার সুখগুলো ফেলে এসেছি। নিছক অবহেলায় সুখগুলো কুড়িয়ে নেওয়া হয়নি। আকাশের স্বার্থকতা- আকাশ কাঁদতে পারে, অঝোর ধারায় ঝরে ঝরে নিজের মনে পাথর চাপা কষ্টগুলোকে পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু আমি তো আকাশ নই, তাই আকাশের মত অঝোর ধারায় কাঁদতে পারিনা। মনের কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারিনা। আমি শুধু পারি গভীর রাতে দুঃখগুলো রোমন্থন করে দু’চোখের বৃষ্টি দিয়ে বালিশ ভেজাতে। নীরা, জীবনকে স্বপ্ন দিয়ে সাজানোর স্বপ্ন যে ছিল না তা নয়, আমার ও খুব ইচ্ছে করে প্রেমের সাধ পেতে। কিন্তু, আমার মত মানুষকে শুধু করুণা করা যায়, ভালবাসা যায় না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমি তোমার ডাকে সাড়া দিতে পারলাম না। তাই চাকুরিটা ছাড়লাম বাধ্য হয়েই। আমার অপারগতা হয়তো দুর্বোধ্য মনে হতে পারে তোমার, তবু নিজের জীবন -গল্প খুলে বলার মত সহজ আমি হতে পারি না। কিংবা আমার জীবনটাই সহজ নয়। ভালো থাকা হোক তোমার চিরন্তন সঙ্গী। সুখ হোক তোমার ছায়া। ক্ষমা কোরো আমাকে।
ইতি..............
চিঠি পড়ে রীনার চোখ দিয়ে কষ্ট জল ঝরে ঝরে পড়ছে। তার বুঝতে বাকী রইল না চিঠিটা কে পাঠিয়েছে। সোহান। তার অফিসের নতুন কলিগ। মাস সাতেক আগে অফিসে জয়েন করেছিল। সোহান অল্প কয়েক দিনে অফিসের সবার প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল, এমনকি তারও! পাশাপাশি কাজ করতো দুজনে। পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তার চোখে নারী দেহের প্রতি লোভ টের পায়নি সে। বিষয়টা নারীদের জন্যে সহজাত। তারা সহজেই বুঝতে পারে, কে দেহ চাইছে, কে হৃদয়।
সোহানের চারিত্রিক দৃঢ়তা আর সততা মুগ্ধ করেছিল ওকে। আর এক সাথে কাজ করতো বলে নীরা সোহানের প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়াটা ঠেকাতে পারেনি। বাঁধভাঙা সেই দুর্বলতা সোহানকে না জানিয়েও থাকতে পারেনি সে। তবে এরপরই হুট করে সোহান চাকরি ছেড়ে দিল। সবাই, এমনকি নীরা ও ভেবেছিল এসব ছেলেটার খামখেয়ালীপনা। কিন্তু নীরা ভাবতেও পারেনি, তার জন্যে চাকরি ছেড়েছে পাগলটা। যে পাগল ছেলেটাকে নিয়ে জীবনের ছোট ছোট কিছু স্বপ্নের জাল বুনেছিল সে, ছোট্ট মিষ্টি স্বপ্ন। সে স্ব্প্নরা স্বপ্নই রয়ে গেল। চোখে জল নিয়ে কষ্টের সমুদ্রে অধরা স্বপ্ন চেয়ে চেয়ে দেখে নীরা, আর ভাবতে চেষ্টা করে সোহান কখনো বাস্তব ছিল না। সে একটা ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন ছিল কেবল। কেবলই স্বপ্ন।
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন