চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

এই ছেলেটি কার.....

এই ছেলেটি কার..... | রাজীব রাহুল


ট্রেন চলছে ধান ক্ষেতের মাঝখানে বয়ে যাওয়া আঁকা বাঁকা রেল লাইন ধরে। সবুজের হাতছানি দেওয়া সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা গাছ, বসতবাড়ি, সবজি বাগান আরো কতো কি পেছনে ফেলেছি মনে নেই। ঢাকার আগারগাঁও পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে প্রতিষ্ঠানের কাজ সেরে ফিরছিলাম। ব্যস্ত শহর থেকে পালিয়ে কোনমতে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই শহরে অনেকটা যান্ত্রিক বনে যাওয়া মানুষগুলো ও যানজটের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে স্বস্তি ফিরে পেলাম নিজের ভেতর। যখন চট্টগ্রাম নতুন রেলষ্টেশনে এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুইঁ ছুঁই। কনকনে শীতের রাতে চারপাশের মানুষগুলোর বেশবুশা দেখে মনে হল শীতকে জয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে সবাই। টিকিট কাউন্টারের সামনে ওয়েটিং রুমে এসে এক কাপ কফি নিয়ে চেয়ারে বসে গিলছি আর নিজেকে যতটা সম্ভব গরম রাখার চেষ্টা করছি।
এই সময় পকেটের ভেতরে মোবাইলটা গেয়ে উঠলো- তুমি কি দেখেছ কভু ...। কাগজের ফাইলটা পাশের চেয়ারে রেখে কলটা রিসিভ করলাম। অপর প্রান্ত থেকে মায়ের কণ্ঠ ভেসে এলো। মায়ের সাথে কথা বলছি এমন সময় কে যেন পেছন থেকে গায়ে হাত দিল। আমি বিরক্ত হয়ে পেছনে তাকাতে গিয়ে কিছু কফি প্যান্টে ছিঁটকে পড়লো। একটা ছেলে, বয়স আনুমানিক বার তের বছরের কাছকাছি। গায়ে একটা ছেঁড়া সেন্ডো গেঞ্জি পরনে ময়লা হাফ প্যান্ট। আমি কথা বলা অবস্থায় তার দিকে চোখ লাল করে তাকালাম। কিন্তু সে গেল না, ঠান্ডায় তার পা গুলো টক টক করে কাঁপছিল। কথা শেষ করতেই সে আবার গায়ে হাত দিয়ে বলল, “স্যার কিছু টাকা দেবেন ভাত খাব।”
ইচ্ছে করলো কষে একটা চড় মারি গালে। কিন্তু কি যেন চিন্তা করে দমে গেলাম। মলিন চেহাড়াটা দেখে মনে হল, কয়েকদিন পেটে দানা পানি পড়েনি। আমি পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ষ্টেশন ছেড়ে একটা মোটর রিক্সায় চেপে বসলাম। গন্তব্য, বহদ্দার হাটের এক লেখক বন্ধুর বাসা। বছর খানেক ধরে কোথাও তার নতুন কোন লেখা পাচ্ছি না বলে, বন্ধুটির উপর রাগ জমে আছে মনের কোণে। এত রাতে গ্রামের বাড়িতে ফেরা সম্ভব নয় বলে তার বাসায় ওঠার মনস্থির করলাম।
রিক্সাটা নিউ মার্কেট ক্রস করে জিপিও এর সামনে এলেই মোবাইলটা আবারও বেজে উঠে পরিচিত সুরে। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমে রিসিভ করতে মন না চাইলেও অনেকটা বিরক্তি নিয়েই রিসিভ করলাম। অপর প্রান্ত থেকে একটি ছেলের কণ্ঠ ভেসে উঠলো- স্যার আপনার কাগজের ফাইলটা ফেলে গেছেন।
সত্যিই তো আমি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের নবায়ন ফাইলটা ফেলে এসেছি। ফিরতি পথে যখন ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছালাম ছেলেটিকে পাওয়া গেল ইজি লোডের দোকানের সামনে। তাকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। খাওয়ার সময় হোটেলে বয় ও চারপাশের লোকগুলো আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছিল। আমি তাদের চোখের ভাষা বুঝিনি তবে ছেলেটির বুকের গহিনে চাপা কষ্টের ভাষা বুঝেছিলাম।
জন্মের পর তার মা নাকি ফেলে গিয়েছিলেন পুরাতন রেল ষ্টেশনের পূর্বের দিকে ডাস্টবিনটার পাশে। সেখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে লালন পালন করেছিল সন্তানহীন ভবঘুরে এক ভিখারি। কাজীর দেউরি স্টেডিয়ামের পাশে পলিথিন দিয়ে ছাউনি আর বেড় বানিয়ে বড় করেছিল পথিককে। দিনভর ভিক্ষা করে যা ঝুটতো তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছিল ওরা। পথিক নামটা সে ভিখারী মহিলার দেওয়া। ছোট বেলা থেকেই ছেলেটা তাকে মা বলে জানতো। পথে যাকে কুড়িয়ে পেয়েছে সেই জন্ম পরিচয়হীন ছেলেটির নাম কি মনে করে পথিক রাখলো তার জানা নেই।
পথিকের যখন বুদ্ধি হল সে জানতে চায় তার বাবা কে তখন খুব বেশি রেগে যেত মহিলাটি। বলত আমি জানিনা। সে থেকে মায়ের সম্পর্কে খারাপ ধারণা জন্ম নেয় তার মনে। এক বর্ষা কালের প্রচন্ড জ্বরে স্নেহের মায়াজাল ছেড়ে পথিককে একা করে ওপারে পাড়ি জমায় মহিলা। যাওয়ার সময় পথিককে কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনাটি বলে যায়। সেই থেকে ষ্টেশনে দিন রাত কাটে তার। নিজের মাকে ফিরে পাবে বলে প্রতিদিন আশায় বুক বাঁধে, অপেক্ষার প্রহর গুণে। সত্যিই কোন দিন যদি সেই মা-টি ফিরে আসে ফেলে যাওয়া সন্তানটির খোঁজে। হয়তো বাবা নামের অমানুষটি অসভ্যতার ফসল হিসাবে পরিচয় দিতে পারবে না বলে বুকে পাথর চেপে ফেলে গিয়েছিলেন গর্ভধারিণী।
কনকনে শীতের রাতে খুব বেশি রাগ জমে পথিকের সৃষ্টিকর্তার প্রতি- এত শীত কেন দাও তুমি? ভাতের অভাবে যাদের দিন যায়, কাপড় পাবে কোথায় তারা। যদিও পথিকের কোন ধর্ম নেই, জাত নেই, কারণ সে জানে না তার ধর্ম কি? সে হিন্দু, নাকি মুসলিম অথবা বৌদ্ধ কি না? শুক্রবার এলেই মানুষ দল বেঁধে মসজিদে যায় নামাজ আদায় করে। পথিক ভাবে আমারও যাওয়া উচিত। আল্লাহর কাছে মাথা নত করে চাইলেই হয়তো তার দু:খ কষ্ট মুছে যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবে। সে যদি হিন্দু হয়?
‘‘স্ব-ধর্মে নিধনং শ্রেয়” ফিশারি ঘাটের জেলে পাড়ার সম বয়সী বন্ধু সুজিতের কথাটি মনে পড়ে তার। গায়ে মশা বসলেও হাত দিয়ে মারতে বুক কাঁপে তার। ভগবান বৌদ্ধই নাকি বলেছিলেন- জীব হত্যা মহা পাপ। এতসব ভেবে ভেবে দিন যায় রাত আসে। কিন্তু সভ্যতার সভ্য মানুষগুলোকে খুব বেশি ঘৃণা করে পথিক। যেদিন ষ্টেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে অপরের দান করা একটি কম্বল পেয়েছিল পথিক। রাতের বেলায় সেটি কেড়ে নেওয়ার জন্য টহল দেওয়া পুলিশটি চোর বলে অনেক মেরে সেটিও ছিনিয়ে নিয়ে যায়। অসভ্য কুকুর গুলো-ও কোনদিন তার সাথে এরকম আচরণ করেন নি।
যখন ক্ষুধার জ্বালায় পথিক ফলমন্ডির আড়তদারদের পঁঁচে যাওয়া ফলগুলো বিআরটিসি’র সামনে ডাস্টবিন থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে খায়। পাশে বাসি রুটিগুলোও কুকুররা খুঁজে খায়। কিন্তু কোন সময় তার প্রতি রাগে ঘেউ করে ওঠেনি। চারপাশের শিশুদের দেখলে পথিকের মনের ভিতর কালবৈশাখির ঝড় উঠে। তার যদি বাবা মা থাকত তাহলে সে-ও সুন্দর জামা কাপড় পরে স্কুলে যেতে পারত। কিন্তু তার তো বাবা নেই। সে জানে না তার বাবা কে। এরকম মানুষদের সভ্য সমাজে জারজ বলে কটুক্তি করে। হ্যাঁ, সত্যিই সে জারজ সন্তান। আর সেই জারজই সভ্য সমাজের অসভ্যতার ফসল। কিন্তু সেই সমাজ তা মানতে নারাজ। পথিকের কথাগুলো শুনে সেদিন আমার চোখে জল গড়িয়েছিল। এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও পথিককে ভুলিনি। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে প্রায়ই ষ্টেশনে গিয়ে এদিক সেদিক হাঁটতাম। কিন্তু পথিকের দেখা পাইনি। ছেলেটির কথা ভাবলে এখনো বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন ব্যথা করে।

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই