চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

অবিশ্বাসীর মনস্তত্ত্ব: সপ্তম পরিচ্ছেদ (১)

অবিশ্বাসের মনস্তত্ত্ব | আখতার মাহমুদ


ডোভার সৈকত ও অবিশ্বাসের দর্শন

সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি কোনো সত্য বা নিশ্চিত জ্ঞান অথবা বিশ্বাস প্রচার করা? উত্তর হচ্ছে না। সাহিত্য ওই অর্থে কোনো ভাব প্রচার করে না যে, নিশ্চিতভাবেই আপনি কিছু একটা ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বা বিশ্লেষণ করবেন। সাহিত্য নিশ্চিত মতবাদ প্রচারের মাধ্যমও নয়। তবে সাহিত্য কী? আমার মতে সাহিত্য- একজন লেখকের নিজ জীবন ঘেঁটে-ঘুটে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে কল্পিত অভিজ্ঞতার-দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ মাত্র। সেটা কখনো কবিতায়, কখনো গদ্যে ও সাহিত্যের নানা মাধ্যমে।
যে অভিজ্ঞতার-দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ কখনো কখনো আমাদের ভাবিয়ে তোলে, কখনো নিরাশ করে, কখনো দার্শনিক উপলব্দিতে পৌঁছে দেয় আমাদের। আবার কখনো লেখকের অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের নিজস্ব ভাবনাকে লেখকের ভাবনার সাথে মিলে গেছে বলে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এবং যখনই এটা ঘটে তখনই আমরা এক মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে গেছি বলে ভাবতে শুরু করি। আর এমনতর ভাবনা সংকীর্ণ করে আমাদের জগত-দৃষ্টিভঙ্গী। আমরা এসব ক্ষেত্রে কখনোই ভাবি না যে, আমি যেমনটা ভাবছি, তেমনটা অন্যে না-ও ভাবতে পারে।
সাহিত্য পাঠে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা-উপলব্দি কখনোই একমাত্র সত্য হতে পারে না; কারণ, অন্যের কাছে হয়তো ব্যাখ্যা-উপলব্দিটা অন্যরকম, আলাদা। আর যদি কোনো সাহিত্যরচনা পাঠ মাত্রই ধরে নিই আমার ভাবনা চরম সত্যে উপনীত; তবে আমার ভাবনা সংকীর্ণ এবং যে সাহিত্যরচনা নিয়ে ভাবনা চলছে তা গভীর পর্যবেক্ষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের দাবি রাখে। কেননা যে কোনো রচিত সাহিত্যেরই হাজারটা অর্থ-ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারে।
বিদগ্ধ সাহিত্যিক হয়েও হুমায়ুন আজাদ বিষয়টা উপলব্দি করেন নি। লাটিমের মত নিজ মতাদর্শের চার পাশেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর অবিশ্বাসী ভক্তরা তো আরো এক কাঠি সরেস। তারা তাঁর ঘুরে বেড়ানো এলাকার চারপাশে শক্ত প্রাচীর তুলে দিয়ে অতটুকুকেই মহাসত্য ধরে নিয়ে একইভাবে ঘুরপাক খেয়ে বাঁচতে চাইছে। অথচ কিছু একটা চিরসত্য হিসেবে ধরে নেবার পূর্বে সতর্ক বিচার-বিশ্লেষণ যে প্রয়োজন এটা কখনোই তারা বুঝে উঠতে পারেনি কিংবা বুঝে ওঠার প্রচেষ্টা কিছু আন্তরিক পরিশ্রম দাবি করে বলে তারা তা এড়িয়ে থেকেছে।
‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থের সপ্তম পরিচ্ছেদের একদম শুরুতেই হুমায়ুন আজাদ উল্লেখ করেছেন ‘ডোবার বীচ’ কবিতাটিতে ম্যাথিউ আরনল্ড ধর্মীয় বিশ্বাসের অবসানের রূপক এঁকেছেন। আর আপনি আজাদ স্যারের অন্ধভক্ত হয়ে থাকলে উচ্ছাসে বলে উঠবেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো। একদম! সেটাই ম্যাথিউ আর্নল্ড বুঝিয়েছেন। কবিতায় অবিশ্বাসের জয়গান ধারণ করেছেন। আর অবিশ্বাসী হলে এটুকু বুঝে ফেলেই আপনি জ্ঞানগম্ভীর মুচকি হাসবেন। আসলে আরনল্ড কী বলেছেন, কেন বলেছেন সেটার ব্যাখ্যা আগ বাড়িয়ে দিতে যাবেন না। পরিশ্রম করে ভিন্ন কিছু বুঝতে চাইবেন না।
চলুন আমি আপনাকে দেখাই কবিতাটির সেই বিশেষ লাইনগুলোর কেমন কেমন অর্থ হতে পারে। যা অবিশ্বাসীদের প্রিয় এবং যে লাইনগুলো আমার প্রিয় অবিশ্বাসী বন্ধুরা বার বার আওড়ান সেই লাইনগুলোর একটি ভিন্ন ব্যাখ্যার সামনে আমি আপনাদের দাঁড় করাই। লাইনগুলো হল-
The Sea of Faith
Was once, too, at the full, and round earth's shore
Lay like the folds of a bright girdle furl'd.
But now I only hear
Its melancholy, long, withdrawing roar,
Retreating, to the breath
Of the night-wind, down the vast edges drear
And naked shingles of the world.
আমি যদি লাইনগুলো স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দাঁড়াবে- খুব ক্ষুদ্র পরিসরে ম্যাথিউ আর্নল্ড দেখেছেন ধর্ম বিশ্বাসের (খ্রিস্ট ধর্ম) অবক্ষয়। ডোবার সৈকত কবিকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, আধ্যাত্মিকতায় সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কথা, যা বিদ্যমান ছিল তার সময়ে। তিনি তৎকালীন বিজ্ঞানের অগ্রগতিকেও মাথায় রেখেছিলেন- যা ক্রমেই সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছিল বিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিয়ে। যাইহোক, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা কিছু মানুষকে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়ে এক পরিবর্তন আনছিল সমাজে। যে পরিবর্তন কবির কাছে মনে হয়েছে নগ্ন সমুদ্র তটের মত নিরানন্দ।
একজন যৌক্তিক সাহিত্যিকের কাছে ভ্রান্তির ভেতর, ভ্রান্তির ঘোরের ভেতর বেঁচে থাকার চেষ্টা, নিজের চারপাশে এক সুবিশাল প্রাচীর তুলে দিয়ে ভ্রান্তিগুলোকে সযত্নে লালন করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তত যৌক্তিক বিচারে এটা উচিত নয়। উচিত যা, তা হল- চরম কোনো সত্যে উপনীত হয়ে গেছি না ভেবে; নিজের মত করে ভেবে নেয়া, আপন করে নেয়া প্রতিটা সত্যকে নির্মমভাবে পরখ করতে থাকা আমৃত্যু। একমাত্র এ উপায়েই সম্ভব সত্যের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া। এ কারণে আমি প্রতিদিন ভুলগুলো শুধরে নিই। কেউ আমাকে আমার ভাবনার যৌক্তিক ভুল ধরিয়ে দিলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে হাসতে হাসতে ভুল শুধরে নিই। কেননা আমি বিশ্বাস করি, ভ্রান্তিতে যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে সে নিছক প্রাণীমাত্র, মানুষ নয়।
বিশ্বাসকে ভরাট সমুদ্র বিবেচনায় কবি একে ধরে নিয়েছেন পৃথিবীর শরীরের উজ্জল অলংকার বিশেষ। যা পরিপূর্ণ-সম্পূর্ণ ছিল একসময়। কদর্যতাকে সরিয়ে রেখেছিল, দমিয়ে রেখেছিল একসময়। এখন কেবলই বিশ্বাসের বিষাদের সুর শুনতে পান কবি। কেননা বিশ্বাসের সমুদ্র সরে গিয়ে সামনে এসে পড়ছে নৈতিকতার অবক্ষয়। অনাবৃত হয়ে পড়ছে মানুষের কদর্যতা। যা নগ্ন শরীরে কোঁচদাদের মতন অসুন্দর।
আমি জানি, এখানে ‘কোঁচদাদ’ শব্দটা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আপনি সামান্য পড়াশুনা করলেই জানবেন ক্যামব্রীজ ডিকশনারী “shingles” শব্দটির অর্থ এরকমই বলছে- ‘A disease caused by a virus that infects particular nerves and that produces a line or lines of painful red spots, especially around the waist.’
কবি যদি নুড়ি পাথরই বোঝাতে চাইতেন তবে স্পষ্ট করেই লিখতেন ‘shingle’। বাড়তি ‘s’ অক্ষরটি যুক্ত করতেন না। অথবা ব্যবহার করতেন- ‘gravel’, ‘pebbles’ ইত্যাদি শব্দ। কিন্তু ‘shingle’ কেবল মাত্র ‘কোঁচদাদ’-ই বোঝায়। শব্দটা অস্বস্তিকর বলেই হয়তো অনুবাদকরা কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের বিশ্লেষকরা এর অর্থ ‘নুড়ি পাথরসমূহ’, ‘নুড়িপাথরগুলি’ ইত্যাদি অর্থ করে থাকেন। অথবা না জেনেই করেন। আর যদি কেউ বলতে চান নুড়ির বহুবচন বোঝাতেই ‘shingle’ সাথে ‘s’ যুক্ত করা হয়েছে তাহলে বলব, এ যুক্তিও ধোপে টেকে না। কারণ, ‘shingle’ শব্দটি Uncountable Noun হিসেবে বিবেচিত হয়। সেক্ষেত্রে এটির বহুবচন হয় না।
সুতরাং আমার বিশ্লেষণ বলে- ম্যাথিউ আর্নল্ড কবিতায় বিশ্বাসকে তুলনা করেছেন ভরাট ও পরিপূর্ণ সমুদ্রের সাথে। যা পৃথিবীর উজ্জল অলংকার সদৃশ। অপরদিকে অবিশ্বাসকে তুলনা করেছেন নগ্ন শরীরে কোঁচদাদের সাথে। যা বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর, অসুন্দর এবং অবশ্যই অপছন্দনীয়।
কবিতাটির উল্লেখ্য অংশগুলো ইন্দ্রাণী সরকার অল্প কথায় সহজে অত প্যাঁচের মধ্যে না গিয়ে অনুবাদ করেছেন এভাবে-
“বিশ্বাসের সমুদ্র এককালে যা পরিপূর্ণ ঢেউ হয়ে
মানুষকে ছুঁয়ে থাকত তা এখন বিষাদময়
সঙ্গীতের মত মিলিয়ে যায়।”
সৈয়দ তারিক লাইনগুলো অনুবাদ করেছেন এভাবে-
“বিশ্বাসের পারাবার
সে-ও পূর্ণ ছিলো একদিন, পৃথিবীর উপকূল জুড়ে
কুণ্ডলিত মেখলার মতো ছিলো শুয়ে,
অথচ এখন শুধু শুনি
এর বিষণ্ণতা, দীর্ঘ বিমুখ গর্জন,
পলায়নমান প্রতিটি নিঃশ্বাসে
নৈশ বাতাসের, পৃথিবীর বিপুল বিষণ্ণ তট
আর ক্ষয়ে যাওয়া নগ্ন নুড়ি পাথর অবধি।”
আর হুমায়ুন আজাদ অনুবাদ করেছেন এভাবে-
বিশ্বাসের সমুদ্রও
একদিন ছিলো ভরপুর, এবং পৃথিবীর তটদেশ ঘিরে
ছিলো উজ্জ্বল মেখলার মতো ভাঁজেভাঁজে ৷
কিন্তু এখন আমি শুধু শুনি
তার বিষন্ন, সুদীর্ঘ, স’রে - যাওয়ার শব্দ ,
স’রে যাচ্ছে, রাত্রির বাতাসের শ্বাস, বিশাল বিষণ্ন সমুদ্রতীর,
আর বিশ্বের নগ্ন পাথরখন্ডরাশি থেকে ৷
একই কবিতার অংশবিশেষ বিভিন্ন রূপে আপনার সামনে। পাঠক হিসেবে আপনি কোন যৌক্তিক অর্থটা গ্রহণ করবেন সেটা নিতান্তই আপনার বিষয়। তবে যদি আমার করা অর্থটি গ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে আমি আবার পছন্দ করব না যে আপনি আমার করা অর্থটিকেই একমাত্র সত্য হিসেবে ধরে নেবেন। কেননা আমি আগেই বলেছি কোনো সাহিত্য রচনার এটা উদ্দেশ্য নয় যে, কোনো একটিমাত্র সত্যকে তুলে ধরা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য বহুমাত্রিক। এর অর্থও বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ভাল। আর অনুবাদ সাহিত্যে তো হাজারো কথা-সুর উহ্য থেকে যায়!
সাহিত্য রচনা কিংবা রচয়িতাকে আবশ্যিকভাবে এক বা একাধিক ব্যক্তিগত-পারিবারিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-জাতিগত কিংবা ধর্মীয় মূল্যবোধ স্থির করতে হয়। কে কোন মূল্যবোধ ধারণ করবেন সেটা তার ব্যাপার। তবে একজন যৌক্তিক সাহিত্যিকের কাছে ভ্রান্তির ভেতর, ভ্রান্তির ঘোরের ভেতর বেঁচে থাকার চেষ্টা, নিজের চারপাশে এক সুবিশাল প্রাচীর তুলে দিয়ে ভ্রান্তিগুলোকে সযত্নে লালন করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তত যৌক্তিক বিচারে এটা উচিত নয়। উচিত যা, তা হল- চরম কোনো সত্যে উপনীত হয়ে গেছি না ভেবে; নিজের মত করে ভেবে নেয়া, আপন করে নেয়া প্রতিটা সত্যকে নির্মমভাবে পরখ করতে থাকা আমৃত্যু। একমাত্র এ উপায়েই সম্ভব সত্যের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া। এ কারণে আমি প্রতিদিন ভুলগুলো শুধরে নিই। কেউ আমাকে আমার ভাবনার যৌক্তিক ভুল ধরিয়ে দিলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে হাসতে হাসতে ভুল শুধরে নিই। কেননা আমি বিশ্বাস করি, ভ্রান্তিতে যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে সে নিছক প্রাণীমাত্র, মানুষ নয়। ইচ্ছেভ্রান্তিতে জীবন যাপন মানেই বোধহীনতা। আর বোধহীনতা প্রাণীর গুণ হতে পারে, মানুষের নয়।
যাইহোক, ‘ডোভার সৈকত’ কবিতাটির শেষ লাইনগুলো কবির দৃঢ় বিশ্বাস ধারণ করেছে- বিশ্বাস ছাড়া জীবনে সান্ত্বনা পাবার উপায় নেই। বিশ্বাস ছাড়া আলো নেই, ভালবাসা নেই, আনন্দ নেই, শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। আর মানুষ ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। কে কোথায় কেন কিভাবে কার সাথে লড়ছে জানে না। কেন যুদ্ধ, কেন সংঘর্ষ মানুষ জানে না। তবু মানুষ তীব্র সংঘর্ষে নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছে অজ্ঞতাবশত। চিরন্তন সত্যটা কারো জানা নেই সংশয়ে কবি মানুষকে ধরে নিয়েছেন ‘অজ্ঞ’। এখানে উল্লেখ্য যে, ম্যাথিউ আর্নল্ড Agnostic ছিলেন। কবিতার শেষ স্তবক হয়তো তার বিশ্বাসের, মতবাদেরই ধারক।
যথারীতি হুমায়ুন আজাদ শেষ স্তবককে একদম নিজ বিশ্বাসের সাথে মিলিয়ে অনুবাদ করেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। শেষ লাইনে যে আঁধারের কথা বলা হয়েছে সেটাকে তিনি ধরে নিয়েছেন বিশ্বাস। যেটাকে আমি ধরছি সংশয়। আমরা উভয়েই হয়তো ঠিক, অথবা হয়তো আমরা উভয়েই ভুল। ‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থ পর্যালোচনায় আমি বারবার হয়ে উঠতে চেয়েছি যৌক্তিক। আর হুমায়ুন আজাদ বইটির লাইনে লাইনে হয়ে উঠতে চেয়েছেন দার্শনিক। তবে কি তিনি অবিশ্বাসকে এক দর্শন ভেবে নিয়েছিলেন? অবিশ্বাস কি তবে জীবন দর্শন? সব অবিশ্বাসীই কি অবিশ্বাসকে দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় রত? কে জানে!
তবে এই জন্যেই বোধহয় কোয়ান্টাম ফিজিক্সের খ্যাতনামা প্রফেসর রবার্ট গ্রিফিথ্স বলেছিলেন, ‘যদি বিতর্কের জন্যে আমাদের একজন নাস্তিকের দরকার পড়ে, তবে আমরা দর্শন বিভাগে যাই। পদার্থ বিভাগ এ বিষয়ে কোনো উপকারে আসে না।’
উক্তিটি রসাত্মক হলেও এর গভীর অন্তর্নিহিত অর্থ আমাকে বেশ চমকে দিয়েছে। আমি দীর্ঘসময় ভেবেছি উক্তিটি নিয়ে। দর্শন মানেই তত্ত্ব, ধারণা, আন্দাজ, নিজ নিজ ঘেরাটোপে আঁটকে থাকা সংস্কার। দর্শন প্রমাণিত জ্ঞান নয়। এটি কখনো কখনো মানুষের নিজেকে আলাদা করার নিষ্ফল চেষ্টা, ভাবনাকে আলাদা করে তোলার অর্থহীন ছুটোছুটি। দর্শন মানুষকে বলে দেয় কেমন করে বাঁচতে হবে, কেমন করে ভাবতে হবে। স্বাধীন ভাবনার লোভ দেখিয়ে মানুষকে পরাধীন করে দর্শন। আপনি দেখবেন, অজস্র মানুষ দর্শনের কারাগারে বেঁচে থেকে খুশি। যেমনটা খুশি ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। আমার দেখা প্রতিজন অবিশ্বাসীই নিজ দর্শনের কারাগারে আবদ্ধ থেকে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করে খুশি এবং আহ্লাদিত। এবং তাদের জীবন দর্শনে শতভাগ প্রাধান্য পেয়ে থাকে ভোগবাদ।
অবিশ্বাসী হয়েও হকিং দর্শনের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, "Most of us do not spend most of our time worrying about [the big] questions, but almost all of us worry about them some of the time. Traditionally these are questions for philosophy, but philosophy is dead. Philosophy has not kept up with modern developments in science, particularly physics. Scientists have become the bearers of the torch of discovery in our quest for knowledge."
সার্বিকভাবে দর্শন বোধহয় অর্থহীনতাকেই প্রকাশ করে । জীবনকে অর্থহীন-তাৎপর্যহীন ধরে নেয়াটাও বোধহয় অবিশ্বাসীদের দার্শনিক বোধ। হয়তো এই বোধকে চূড়ান্তভাবে সমর্থন করেই দার্শনিক হয়ে উঠতে চেয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন- “আমি বারবার বলেছি- ‘জীবন তাৎপর্যহীন’; এটা ভীতিকর মনে হবে অনেকের; আবার কেউ কেউ বলতে পারেন- তাৎপর্য? তাৎপর্য থাকতে হবে কেনো জীবনের? আমার জীবন আছে, একদিন থাকবে না। এই তো সব।”
জীবন তাৎপর্যহীন নয়। মানুষ গরু-ছাগল-ভেড়া নয় যে তাকে কেবল প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় বেঁচে থাকতে হবে, তার জীবনের তাৎপর্য থাকবে না। আজ জীবন আছে, কাল নেই -এতটুকুতেই ভাবনা বেঁধে ফেলাটা ভোগবাদীর সাজে, অবিশ্বাসীর সাজে। স্রষ্টায় বিশ্বাসীর সাজে না। জীবনের অবশ্যই একটি তাৎপর্য আছে। আমরা বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করি প্রত্যেকের জীবন একটি মহৎ পরিকল্পনার অংশ। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে সমাজ-রাষ্ট্র-দেশ-জাতি-বিশ্বকে। আমাদের বেঁচে থাকার দারুণ একটি অর্থ আছে। মৃত্যুরও। আমরা বিশ্বাস করি মৃত্যুতেই সব শেষ নয়। মৃত্যু বরং এক অমোঘ-চূড়ান্ত-ভাগ্যনির্ধারণী মহাযাত্রা। যে যাত্রা প্রকৃত বিশ্বাসীদের সুখি করবে, পূর্ণতা দেবে। সে সুখ, সে পূর্ণতা থাকবে অনন্তকাল।

চলবে......


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই