অবিশ্বাসের মনস্তত্ত্ব | আখতার মাহমুদ
ডোভার সৈকত ও অবিশ্বাসের দর্শন
সাহিত্যের উদ্দেশ্য কি কোনো সত্য বা নিশ্চিত জ্ঞান অথবা বিশ্বাস প্রচার করা? উত্তর হচ্ছে না। সাহিত্য ওই অর্থে কোনো ভাব প্রচার করে না যে, নিশ্চিতভাবেই আপনি কিছু একটা ধরে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন বা বিশ্লেষণ করবেন। সাহিত্য নিশ্চিত মতবাদ প্রচারের মাধ্যমও নয়। তবে সাহিত্য কী? আমার মতে সাহিত্য- একজন লেখকের নিজ জীবন ঘেঁটে-ঘুটে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে কল্পিত অভিজ্ঞতার-দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ মাত্র। সেটা কখনো কবিতায়, কখনো গদ্যে ও সাহিত্যের নানা মাধ্যমে।
যে অভিজ্ঞতার-দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ কখনো কখনো আমাদের ভাবিয়ে তোলে, কখনো নিরাশ করে, কখনো দার্শনিক উপলব্দিতে পৌঁছে দেয় আমাদের। আবার কখনো লেখকের অভিজ্ঞতা-দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের নিজস্ব ভাবনাকে লেখকের ভাবনার সাথে মিলে গেছে বলে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। এবং যখনই এটা ঘটে তখনই আমরা এক মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে গেছি বলে ভাবতে শুরু করি। আর এমনতর ভাবনা সংকীর্ণ করে আমাদের জগত-দৃষ্টিভঙ্গী। আমরা এসব ক্ষেত্রে কখনোই ভাবি না যে, আমি যেমনটা ভাবছি, তেমনটা অন্যে না-ও ভাবতে পারে।
সাহিত্য পাঠে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা-উপলব্দি কখনোই একমাত্র সত্য হতে পারে না; কারণ, অন্যের কাছে হয়তো ব্যাখ্যা-উপলব্দিটা অন্যরকম, আলাদা। আর যদি কোনো সাহিত্যরচনা পাঠ মাত্রই ধরে নিই আমার ভাবনা চরম সত্যে উপনীত; তবে আমার ভাবনা সংকীর্ণ এবং যে সাহিত্যরচনা নিয়ে ভাবনা চলছে তা গভীর পর্যবেক্ষণ ও যাচাই-বাছাইয়ের দাবি রাখে। কেননা যে কোনো রচিত সাহিত্যেরই হাজারটা অর্থ-ব্যাখ্যা দাঁড়াতে পারে।
বিদগ্ধ সাহিত্যিক হয়েও হুমায়ুন আজাদ বিষয়টা উপলব্দি করেন নি। লাটিমের মত নিজ মতাদর্শের চার পাশেই ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর অবিশ্বাসী ভক্তরা তো আরো এক কাঠি সরেস। তারা তাঁর ঘুরে বেড়ানো এলাকার চারপাশে শক্ত প্রাচীর তুলে দিয়ে অতটুকুকেই মহাসত্য ধরে নিয়ে একইভাবে ঘুরপাক খেয়ে বাঁচতে চাইছে। অথচ কিছু একটা চিরসত্য হিসেবে ধরে নেবার পূর্বে সতর্ক বিচার-বিশ্লেষণ যে প্রয়োজন এটা কখনোই তারা বুঝে উঠতে পারেনি কিংবা বুঝে ওঠার প্রচেষ্টা কিছু আন্তরিক পরিশ্রম দাবি করে বলে তারা তা এড়িয়ে থেকেছে।
‘আমার অবিশ্বাস’ গ্রন্থের সপ্তম পরিচ্ছেদের একদম শুরুতেই হুমায়ুন আজাদ উল্লেখ করেছেন ‘ডোবার বীচ’ কবিতাটিতে ম্যাথিউ আরনল্ড ধর্মীয় বিশ্বাসের অবসানের রূপক এঁকেছেন। আর আপনি আজাদ স্যারের অন্ধভক্ত হয়ে থাকলে উচ্ছাসে বলে উঠবেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো। একদম! সেটাই ম্যাথিউ আর্নল্ড বুঝিয়েছেন। কবিতায় অবিশ্বাসের জয়গান ধারণ করেছেন। আর অবিশ্বাসী হলে এটুকু বুঝে ফেলেই আপনি জ্ঞানগম্ভীর মুচকি হাসবেন। আসলে আরনল্ড কী বলেছেন, কেন বলেছেন সেটার ব্যাখ্যা আগ বাড়িয়ে দিতে যাবেন না। পরিশ্রম করে ভিন্ন কিছু বুঝতে চাইবেন না।
চলুন আমি আপনাকে দেখাই কবিতাটির সেই বিশেষ লাইনগুলোর কেমন কেমন অর্থ হতে পারে। যা অবিশ্বাসীদের প্রিয় এবং যে লাইনগুলো আমার প্রিয় অবিশ্বাসী বন্ধুরা বার বার আওড়ান সেই লাইনগুলোর একটি ভিন্ন ব্যাখ্যার সামনে আমি আপনাদের দাঁড় করাই। লাইনগুলো হল-
The Sea of Faith
Was once, too, at the full, and round earth's shore
Lay like the folds of a bright girdle furl'd.
But now I only hear
Its melancholy, long, withdrawing roar,
Retreating, to the breath
Of the night-wind, down the vast edges drear
And naked shingles of the world.
আমি যদি লাইনগুলো স্বাধীনভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে দাঁড়াবে- খুব ক্ষুদ্র পরিসরে ম্যাথিউ আর্নল্ড দেখেছেন ধর্ম বিশ্বাসের (খ্রিস্ট ধর্ম) অবক্ষয়। ডোবার সৈকত কবিকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, আধ্যাত্মিকতায় সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কথা, যা বিদ্যমান ছিল তার সময়ে। তিনি তৎকালীন বিজ্ঞানের অগ্রগতিকেও মাথায় রেখেছিলেন- যা ক্রমেই সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছিল বিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিয়ে। যাইহোক, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা কিছু মানুষকে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়ে এক পরিবর্তন আনছিল সমাজে। যে পরিবর্তন কবির কাছে মনে হয়েছে নগ্ন সমুদ্র তটের মত নিরানন্দ।
একজন যৌক্তিক সাহিত্যিকের কাছে ভ্রান্তির ভেতর, ভ্রান্তির ঘোরের ভেতর বেঁচে থাকার চেষ্টা, নিজের চারপাশে এক সুবিশাল প্রাচীর তুলে দিয়ে ভ্রান্তিগুলোকে সযত্নে লালন করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তত যৌক্তিক বিচারে এটা উচিত নয়। উচিত যা, তা হল- চরম কোনো সত্যে উপনীত হয়ে গেছি না ভেবে; নিজের মত করে ভেবে নেয়া, আপন করে নেয়া প্রতিটা সত্যকে নির্মমভাবে পরখ করতে থাকা আমৃত্যু। একমাত্র এ উপায়েই সম্ভব সত্যের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া। এ কারণে আমি প্রতিদিন ভুলগুলো শুধরে নিই। কেউ আমাকে আমার ভাবনার যৌক্তিক ভুল ধরিয়ে দিলে আমি কৃতার্থ হয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে হাসতে হাসতে ভুল শুধরে নিই। কেননা আমি বিশ্বাস করি, ভ্রান্তিতে যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে সে নিছক প্রাণীমাত্র, মানুষ নয়।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন