একটি আঙুলের গল্প | মনসুর আলী
রূহানের বয়স সবে আড়াই পূর্ণ হলো। সব কথা অকপটে বলতে পারে। কথার পিঠে কথাও বলতে পারে। তবে র-ঘাটতি আছে বেশ। যেমন ভাত গ’অম বেশি, আমাল আ’আম লাগে ইত্যাদি। তার এরকম কথাগুলো শুনতে বেশ ভাল লাগে। আনন্দ লাগে। তার মা মজা পাওয়ার জন্য বলে- ‘আব্বু একটা রাজার গল্প বলোতো।’ তখন সে বলবে- ‘এক ছিল আজা, এক ছিল নাণী...’ এর পর খিল খিল করে হাসতে থাকবে। কারণ সে বুঝে যে, রাজা-রাণী সে স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। অবশ্য আর একটা কারণ গল্পটা তাকে নিয়ে তার মা বানিয়েছে। এটা সে বুঝে। এর মধ্যে সে হাতের পাঁচটি আঙুলের নামও গড়গড় করে বলতে পারে। একটা একটা আঙুল ধরে নামগুলো যথাক্রমে বলবে- বৃ-দ্ধা, তজ্জনী, মধ্য-মা, অনা-মিকা, কনিষ----ঠা...... বলেই হাসিতে গড়াগড়ি। বলবে ‘আব্বু আবার বলি?’ আমি না বললেও সে বলবে ‘আবার বলি না আব্বু! কী হবে!’ তার আনন্দ মাখানো আকুতি শুনে আমি বলি- ‘আচ্ছা বলো।’ তখন মুখে হাসি-হাসি ভাব দিয়ে আবার নামগুলো বলবে আর বলেই হাসবে।
আজ দুপুরটা শুক্রবারের হওয়াতে বাড়ির সব সদস্য বাড়িতেই আছে। জুমার নামায, দুপুরের ভাত খেয়ে দুই ছেলে সহ আমরা চারজনই বিছানার ওপর বসে আছি। আমাকে রূহান জোর করেই তার বাম হাতের আঙুল গুলো ধরে ধরে নামগুলো শুনালো। বিরক্ত হয়েই কয়েকবার শুনলাম। তারপর ‘আব্বু আমি নিচে যাব।’ বলেই অস্থির করে তুললো। নিচে মানে দোতলার নিচে এক টুকরো উঠানে। পাশে থাকে রূহানের ছোট দাদা। এখন ছোট দাদার কাছেই যাওয়ার জন্য অস্থির করে তুলেছে। আর না পেরে অনুমতি দিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। সাথে বড় ছেলেকেও পাঠালাম।
নিচে নেমেই ছোট দাদার কাছে বায়না ধরলো ‘চিপস্ কিনে দাও।’ ছোট দাদা ঘরে গিয়ে টাকা দিয়ে রূহানের বড় ভাইয়া রৌদ্রকে দোকানে যেতে বললো, আর রূহানও বায়না ধরলো তাকে দোকানে নিয়ে যেতে হবে। তার ছোট দাদা তাকে দোকানে যেতে দেবে না কারণ বাড়ির রাস্তায় এখন রিকশা, সাইকেল, মোটর সাইকেল, টমটম বেপরোয়া চলাচল করে। কখন কী দূর্ঘটনা ঘটে! ডেকে রূহানকে ছোট দাদা শোয়াতে চাইল, নিজেও শুয়ে পড়লো মেঝেতে পাতানো পাটিতে। কিন্তু রূহান মানার ছেলে না। সে যাবেই। বিছানা থেকে ওঠে দৌঁড় দিল। রৌদ্র তাকে বাধা দেওয়ার জন্য দরজা বন্ধ করে দিতে চেষ্টা করতেই রূহানের হাতটা দরজার একপাশে চাপা পড়লো। প্রচন্ড চিৎকারে কান্নার শব্দে উপর থেকে নেমে পড়লো রূহানের ছোট চাচা। আমরা পেছনের ঘরে থাকায় শুনতে পায়নি। পরে ঘরে যখন নিয়ে এসেছে তখন দেখতে পেলাম হাতের একটি আঙুলের ওপরের অংশ থেঁতলে গিয়েছে। পুরো নখ উঠে গিয়ে একটুখানি অংশ আঙুলের সাথে লেগে আছে। আমার মনে হতে লাগলো এই দূর্ঘটনাটি ঘটবে বলেই সে আমাকে আঙুলের নাম গুলো আজ বারবার শুনিয়েছে।
দুটি এন্টিবায়োটিক সহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়ার ফলে মোটামুটি এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে উঠলো। নখের অংশটি অনেকটা পুড়ে যাওয়া কিংবা শুকিয়ে যাওয়া কাঠের মতো দেখতে লাগলো। আর রূহান এটাকে বললো, ‘আব্বু ফেরাউনের মতো না!’ ফেরাউনের মতো বলার কারণ হচ্ছে সে ফেরাউনের মৃত দেহের ভিডিওটি কয়েকদিন আগে দেখেছিল। আর তার রংটা ব্যথা পাওয়া আঙুলের মতোই মনে হলো। আজ রূহান আমাকে তার আঙুল ধরে ধরে নাম শুনায় এভাবে- বৃ-দ্ধা, তজ্জনী, মধ্যমা না, না ফেরা-উন, অনামিকা, কনিষ---ঠা.... বলেই সেই আগের হাসিটা দেয়। আমার চোখ দুটো তার হাসির আঘাতেই হয়তো ভিজে ওঠে। আমি রূহানকে বুকে চেপে নিলাম প্রচন্ড ভালোবাসায়, সে তখনো হাসছিল।
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com, chilekothasahittobd@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন