যাপিত বিভ্রম | হামিদ আহসান
১.
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যে একেবারে সেই কাকভোরে মাথার ওপরে একটা ছাতা ঘুরাতে ঘুরাতে উদাসী ভঙ্গিতে আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে নুরা পুলিশ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা চোখে বৃষ্টি দেখছে। সেই রাত থেকে টিপ টিপ ঝির ঝির বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। থামার কোনো নাম নেই। কে জানে হয়ত ঐ আকাশটার বুকেও জমে আছে এক পাহাড় বেদনা! কেঁদে কেঁদে সেও কি বুক হালকা করছে! আরও কতো কষ্ট জমে আছে ঐ আকাশটার বুকে কে জানে! আজ আবার শনিবার। সরকারি ছুটির দিন। তাই লোকজনের আনাগোনা এই মুহূর্তে এতোটা ভোরে তেমন একটা না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে মিরপুরগামী একটি বাস এসে দাঁড়ায়। কোনো মানুষজন নেই তারপরও বাসের হেলপার তারস্বরে চেঁচাতে থাকে- মিপ্পুর, মিপ্পুর.... দশ এগারো বারো মিপ্পুর... শেওরা পারা কাজি পারা দশ এগারো বারো....
‘এই ড্রাইভার! কী হলো যাচ্ছো না কেন?’ বাসের ভেতরের অল্প কয়েকজন যাত্রী চিৎকার শুরু করে দিলে বাসটি চলে যায়।
বাসটি চলে যাওয়ার পরও হেলপারের ঐকথাগুলো থেকে যায় নুরা পুলিশের মাথায়। কথাগুলো কিছুক্ষণ ঘুরপাক খায় তার মাথার ভেতরে। তারপর দেখা গেল এই বৃদ্ধ মানুষটি নিজেই চেচাতে আরম্ভ করেছে, ‘মিপ্পুর, মিপ্পুর.... দশ এগারো বারো মিপ্পুর... শেওরা পারা কাজি পারা দশ এগারো বারো....’
২.দেশ সেবার মহান ব্রত নিয়েই পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল নুরুল হক নামের বি.কম পাশ এক টগবগে জোয়ান ছেলে। চোখে-মুখে যার দেশ গড়ার স্বপ্ন। সেই থেকে এলাকার মানুষের কাছে নুরুল হক হয়ে গেলেন নুরা পুলিশ। এখন পুলিশের চাকরি না থাকলেও নুরা পুলিশ নামটি রয়েই গেছে।
তার বড় মামা শহিদুল হক ছিলেন একজন পুলিশ, একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিলেন এবং পঁচিশে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেদিন হয়ত তাঁর বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। অনেকটা অলৌকিকভাবেই তিনি সেদিন বেঁচে যান এবং পরবর্তীতে ভারত চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মূলত শৈশবে তার বড় মামার কাছ থেকে পুলিশের নানা গল্প শুনতে শুনতেই তার মনে পুলিশে যোগ দেওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ছোট ছিলেন নুরুল হক। পরবর্তীতে মামার কাছ থেকে শুনেছিল:
১৯৭১ সালের ২৫ র্মার্চ কাল রাতে ট্যাংক ও আধুনিক অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত পাক হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর নির্মম ও নৃশংস গণহত্যা শুরু করে তখন বাঙালীর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ধাপ সূচিত হয়েছিল পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমেই। তৎকালীন পাকিস্তান পুলিশের বাঙ্গালী সদস্যগণ সামান্য ৩০৩ রাইফেল নিয়ে হানাদার বাহিনীর ট্যাংকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বীরের মতো লড়াই করেছিলেন শরীরে শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত। এজন্য শুধুমাত্র দেশপ্রেম ছাড়া তাদের আর কোন অস্ত্র-শস্ত্র ছিল না।
পুলিশ বাহিনীর এই গৌরবগাঁথা বালক নুরুল হকের মনে দাগ কেটেছিল। তাই সেই শৈশব থেকেই নুরুল হকের ইচ্ছে ছিল এমন গৌরবের পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের সেবা করবে। কিন্তু নুরুল হকের দেশ সেবার অভিজ্ঞতা সুখকর হয় নি। অনেক ঝড় ঝাপ্টার পর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছিল। মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ দেখিয়ে তাকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়। কিন্তু নুরুল হক ওরফে নুরা পুলিশ এটা মানতে নারাজ। তার কথা হল, ‘সমস্যাটা মস্তিষ্কে না। সমস্যাটা বরং আমার দিলে। নানান কিসিমের অন্যায় আর অন্যায্য কাজ কারবার দেখে দেখে দিলটা আমার ছিন্নভিন্ন যায়। না পারি এসব জুলুম অন্যায় সহ্য করতে আবার না পারি কিছু করতে। মাথার ভেতর তখনই এক ধরনের যন্ত্রণা শুরু হয় আর সেখান থেকেই সব সমস্যার সৃষ্টি।’
৩.‘আর বেতন! বাড়িওয়ালা দুই মাসের ভাড়া পাইব। মুদি দোকানে দেড় হাজার টাকা বাকি। শখ করে দশ টাকা দামের একটা নেইল পালিশ, হাতের দুইটা ইমিটিশনের চুড়ি আর একটা মিল্লাত ঘামাচি পাউডার বাকিতে কিনছিলাম লেইসফিতা অলার কাছ থেইকা। সেই টাকাটা গত মাসে দিতে পারি নাই। এই মাসে না দিলে আর চলে না। মা একটা ভিটামিন সিরাপ খাওয়ার বায়না ধরছে গত মাস থেইকা। তার নাকি শরীরটা বেশ দুর্বল লাগে। মহল্লার শাহিন ডাক্তার কইছে একটা ভিটামিন সিরাপ খাইতে। এইমাসে কিন্না দিমু ভাবতাছি। বাসার সিলিং ফ্যানটা ঘুরে না ঠিক মতো, বাতাস লাগে না। মিস্ত্রী বলছে একটা ক্যাপসিটার লাগাইলে নাকি ঘুরব। কবে কিনতে পারুম কে জানে! নিজের কাপড়চোপড় সব ছিইড়া গেছে। সিলাই কইরা পিন্দি। মায়েরও একটা ভাল কাপড় নাই। এসব চিন্তা মাথায় আইলে আর ছাতা কিনা হয় না। এর মধ্যে বৃষ্টির দিন চইলা যায়। ছাতার কথা ভুইলা যাই।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন