চিলেকোঠা | শাদ ইরশাদ
এক.
ঘুম ভাঙলো তখন, যখন একটি গোলাপ আর একটি নীল খাম আমার সামনে এসে পড়লো। অবাক আমি যখনি খামের দিকে হাত বাড়ালাম ঠিক তখনি শুননাম স্বর্গীয় কন্ঠস্বর- প্লিজ এখন খুলবেন না। আমি চলে যাওয়ার পর দেখবেন। কন্ঠস্বরের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক থেকে নির্বাক হয়ে কতক্ষণ ছিলাম তা খেয়াল নেই। এবার আমার মুগ্ধতা ভাঙলো সেই কন্ঠ- কি লিখছিলেন?
:স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্নগুলো আমি প্রতিদিন বুনি।
:স্বপ্নতো ভেঙে যায় বাস্তবতার কঠিন আঘাতে।
:যায় তাতে কি? সুমন্ত কি বলে জানেন?- “স্বপ্নতো ভেঙে যাওয়ার জন্য। একটি স্বপ্ন যদি না ভাঙে তবে অন্য একটি স্বপ্ন দেখবেন কিভাবে?
:তা অবশ্যই ঠিক। তা আজ এমনি দিনে ঘরে যে!
:আজ কেমন দিন?(আমি অবাক হয়ে যায়)
:এত জানি না, আজ কোন দিন তা জানেন না? আজ বন্ধু দিবস।
:যাদের বন্ধু আছে তাদের জন্য হয়তো।আমার আমি ছাড়া কেউ নেই। তাই এত দিবস-টিবস মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না।
:সত্যিই কোন বন্ধু নেই?
:না।
নীল চলে গেল চুপচাপ। কিন্তু আমাকে এক সাগর ভাবনার মধ্যে ফেলে স্বপ্নালু করেই নীল গেল।
দুই.
আমি শ্রাবন। আমার পিতামহ কবি মনের মানুষ ছিলেন। তাই বৃষ্টির দিনে জন্মেছি বলে নাম দিলেন শ্রাবন। বাবা নেই। অনেক আগেই আমাদের দুই বোন এক ভাইয়ের সংসারটা দুঃখিনী মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বাবাটা পার পেয়ে গেলেন। বাবার পেনশনের টাকা আর মায়ের টুকটাক সেলাইয়ের টাকায় সংসার চলে কোনমতে। টিউশানি করে করে বড় বোন ডিগ্রীতে পড়ছে। আমি মফস্বলে এইচ এস সি পাশ করে শহরে এলাম মানুষ হতে। ছোটটা এবার ক্লাস এইটে। মায়ের ঘুম নেই বোনদের চিন্তায়। তিন তলা বিল্ডিংয়ের ছাদে ছোট্ট একটা রুম। আমি বলি চিলেকোঠা । এক বন্ধূর কল্যাণে নীলদের এই চিলেকোঠায় আমার ঠাঁই। নাম মাত্র মূল্যে ভাড়া থাকি। সেই সাথে নীলদের সাথে টুকটাক দেখা। আজ হঠাৎ এমন করে নীল এল যা কখনো আমি কল্পনা করিনি। আসলে কল্পনা করার সাহস, সুযোগ, সময়, সামর্থ্য কোনটাই ছিলো না আমার। তবে ডায়েরী লেখার এই বদ অভ্যাসটা আমার ছোটকাল থেকেই ছিল। আজ থেকে হয়তো লিখতে হবে অন্যরকমভাবে।
তিন.
শত ঘাত প্রতিঘাতে বড় হয়েছি বলে অত দিবস টিবস মনে থাকে না। কিন্তু নীল তো আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে চলে গেলো। আমি এখন নিজের মধ্যে ভাঙছি আর গড়ছি। এ ভাঙা গড়ায় শক্ত হচ্ছি কেবল। অনেক সাহস করে চিঠিটা খুললাম। সেই স্বর্গীয় বর্ণমালা আমি বারবার পড়তে থাকি- “প্রিয় শ্রাবন, সমস্ত কষ্ট, একাকীত্ব, দুঃখ ভুলে গিয়ে কি নীলকে ছুঁতে পারো না? নীলের সমস্ত শূন্যতা কি ভরিয়ে দিতে পারো না। ভালোবাসা দিয়ে? আমি জানতাম আমার ছোট এই জীবনে একজন শ্রাবন আসবে। আমার জীবনকে উথাল-পাথাল সুখে ভরিয়ে দিবে। ভালোবাসি ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস আমাকে তুমি ফেরাবে না। শ্রাবন, আমার বিশ্বাসটা ভেঙে দিও না। বন্ধু দিবসে তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা। -তোমারই ভালোবাসার নীল” এমন পাগল করা আহবান কি কেউ উপেক্ষা করতে পারে? কিন্তু সীমাবদ্ধতার শেকলে যে আমার পা বন্দি! সে কথা কিভাবে আমি নীলকে বুঝাবো। তাই একা একা এই বিষণ্ন সন্ধ্যাবেলা আমি রক্তাক্ত হতে থাকি। ভাঙতে থাকি।
চার.
প্রতিদিন বিকেলে আমি ছাদে হাঁটি। ফুল গাছে পানি দিই। কিন্তু আজ কিছু মনে ছিলো না। একটি চিঠি এমনভাবে ভুলিয়ে দিলো আমার প্র্যাতাহিক জীবন! সারা বিকেল -সন্ধ্যা রুমেই বসে ছিলাম। সেটা হয়তো নীল খেয়াল করেছে। প্রতিদিন সেও ছাদে ওঠে। আজ নামার আগে আমার জানালায় এলো। আমি তখনো চিঠি নিয়ে ঠাই বসে আছি। জানালায় উঁকি দিয়ে সেই স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর আবারো বেজে উঠলো- :কি হলো আজ ছাদে আসেন নি যে?
:এমনি, ভালো লাগছিলো না তাই।
:মন খারাপ করে দিলাম?
:না, না। তা বলি নি। এখনো ঘোরের মধ্যে আছি তো তাই।
:আমি কিন্তু অনেক বিশ্বাস নিয়ে চিঠিটা লিখেছি।আমার সমস্ত আশা ভেঙে দেবেন না প্লিজ।
:কিন্তু তুমি তো জানো আমার সীমাবদ্ধতার কথা! তারপরও কেন এত অবুঝ হচ্ছ।
:তুমি শুধু আমায় একটু ভালোবাসা দাও শ্রাবন। দেখো সব সীমাবদ্বতার দেয়াল আমি ভেঙে দিতে পারবো। তুমি আমার পাশে থাকলে দেখো কোন কিছুই আমাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। প্লিজ শ্রাবন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না। প্লি-জ। প্লি-জ।
এমনতর অনুরোধ করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নীল চলে গেলো। ভালোবাসায় ডুবিয়ে দিয়ে, ভালোবাসায় ভাসিয়ে দিয়ে নীল চলে গেল! এখন আর পথ নেই এমন তীব্র ভালোবাসা থেকে পালাবার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন