শিশু ও সংস্কৃতি | তাকিয়া সুলতানা
আজকের শিশুরা নাকি জাতির আগামী দিনের ভবিষৎ। তাই যদি হয় তবে আজকের শিশুরা কেন বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভাষা -সবকিছু থেকে বিচ্যুত? কেন তারা বাংলার প্রতিটি ঐতিহ্যগত বিষয় থেকে পিছু হটছে? এখন প্রতিটি ঘরে গেলেই দেখা যায়, সে ঘরের শিশুটি টিভিতে দেখছে নিনজা হাটুরি বা মোটু পাতলু। কার্টুনগুলো সত্যিই চমৎকার। সময় কাটানোর জন্য অন্যতম ভাল বিষয়। তার মানে তো এটা না যে প্রত্যেক দিন প্রত্যেক ঘন্টা এগুলো নিয়ে বসে থাকতে হবে। কোনো কিছু লক্ষ করেই একটি শিশু তা গ্রহণ করে, শিখে। শিশু মাত্রই অনুকরণকারী। কেন না সে যা দেখে তা-ই অনুকরণ করে। ইতিবাচক অনুকরণকে সাধুবাদ। কিন্তু শিশু যদি সঠিক কিছু অনুকরণের পরিবর্তে এমন কিছু অনুকরণ করে যাতে কোন লাভ-ই নেই। তবে সে অনুকরণের মূল্য কোথায়?
একটা সময় ছিল ঘরে বসেই বাইরের শিশুদের চিৎকার-চেচামেচি, খেলাধুলা করার আওয়াজ শোনা যেত। কিন্তু এখন কারো ঘরে যে একটি শিশু আছে তা বোঝা মুশকিল। কেননা শিশুটি থাকে টিভি রুমে, টিভির একদম সামনে। এমনভাবে সে টিভি দেখে যেন সে যাদুকরের যাদু দেখছে। একটি শিশু তার পারিপার্শিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে। তার জন্য একটি সঠিক ও সুষ্ঠু পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই সুষ্ঠু পরিবেশ কি সে পাচ্ছে? এখন প্রায় শিশুর সাথে কথা বললে বোঝা যায় কেমন সংস্কৃতি সে লালন করছে। তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেমন আছো বাবু? সে উত্তর দেবে- ম্যা আচ্ছি হু। তুম কেসি হো? এটি শোনার পর সত্যিই ভাষা হারিয়ে ফেলা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এখন প্রশ্ন কি এটা নয় যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কেন শহীদ হয়েছে এ দেশের এত সন্তান শুধুমাত্র মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে? তাহলে কি তাদের ওই রক্তের কোন মূল্য নেই যে এদেশের একটি শিশু বাসায় হিন্দি বলছে মাতৃভাষা বাংলা বাদ দিয়ে?
এক্ষেত্রে যদি দোষ শিশুর কাঁধে দেয়া হয় তাহলে ব্যর্থতা-ভুলের পরিমাণ আরো বাড়বেই। কেননা শিশুটির প্রথম শিক্ষক তার মা। বর্তমানে বেশিরভাগ বাবা-মা কে দেখা যায় তাদের ব্যস্ততম জীবনে তাদের শিশুকে টিভির সামনে বসিয়ে রাখাটাই নিরাপদ ভাবে। এর উপকারও নাকি আছে! কেননা এর ফলে বাবা-মা তাদের কাজগুলো করে রাখতে পারে কোন চিন্তা ছাড়া। কিন্তু একটানা টিভি দেখতে দেখতে সে যে কেবল হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করছে এতে লাভটা কার আসলে? টিভি দেখাটা হয়তো ভালো হত যদি এটা তাকে তার দেশ, ভাষা সংস্কৃতি-এতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিত। কিন্তু কয়জন বাবা-মা এটা ভাবেন? বরং তাদের বাচ্চারা যখন হিন্দি বলে তখন বোধহয় তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েন। খুশির সীমানা তাদের থাকে না হয়তো এই ভেবে যে- ওয়াও, আমাদের বাচ্চা কী মজা করে হিন্দি বলছে!
এই যদি অবস্থা হয় বাংলাদেশের ঘরগুলোর তাহলে বাচ্চারা কী করে শিখবে এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি? একটি পরিবারই তো একটি শিশুর প্রথম শিক্ষা কেন্দ্র, যেখানে সে সঠিক কিছু শিখতে ও অনুকরণ করতে পারবে। অথচ যা সে অনুকরণ করছে তা আদৌ সঠিক কি-না তা ভাবার বিষয়। উদাহরণস্বরূপ একটি শিশুকে যদি বলা হয়- তোমার জামাটা খুব সুন্দর। শিশুটি তখন গর্বভরে বলবে এটা বাবা থাইল্যান্ড থেকে এনেছে। যদি থাইল্যান্ডের পোশাকের এত গর্ব হয় তবে এদেশের পোশাক শ্রমিকদের কি কোন মূল্য নেই?
আজকাল মার্কেটে গেলে একটি শিশু প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে এ পোশাকের নাম কি? যদি বলা হয় এর নাম নেই, তবে সে ওটা ধরেও দেখবে না। কিন্তু যদি বলা হয় এর নাম কিরণমালা বা পাখি, তখন তা যেমনই হোক তা কিনে দেবার আবদার সে করবে। দুর্ভাগ্য বাবা-মার তারা তাকে তা কিনেও দিচ্ছে। দুর্ভাগ্য সন্তানের এটা তাকে নিজের সংস্কৃতি থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য ব্যবসায়ির তারা অন্য দেশের সংস্কৃতির লালন করে মুনাফা করছে। কিন্তু কেন? আমাদের দেশে কি একটিও পোষাক নেই যে বাইরের পাখি বা কিরণমালাকে ডেকে আনতে হচ্ছে পোশাকেও? দুর্ভাগ্য এই, আমাদের দেশের পোশাকের চাহিদা বাইরে অনেক। আমাদের দেশের যে পোশাকের জন্য বিশ্বের মানুষ তাকিয়ে থাকে, অথচ সেই দেশি পোশাকের মূল্য নেই আমাদের দেশেই। এর থেকে তো ভালোই হতো যদি আমরা সংস্কৃতিহীন থাকতাম। হতো না?
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন