চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

রঙ ও শূন্যতার দর্শন

রঙ ও শূন্যতার দর্শন | মীর রবি


চোখ বুজে মুঠোয় পুরে নাও হাত। এবার হাত খুলে ফুঁ মেরে দাও আকাশের দিকে। দ্যাখো- উড়ে যাচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। প্রজাপতির রঙ মেখে নাও গায়ে, উড়াল দাও মহাশূন্যে। ভেবে দ্যাখো- প্রতিনিয়তই উড়ছি আমরা, ভাসছি বাতাসের সাগরে। প্রজাপতির মতই উড়ছি নিজের অজান্তে। প্রজাপতির মতই বৈচিত্রে ভাস্বর আমাদের জীবন। এই মেঘ, এই রোদ, হাসি-কান্না ছড়াচ্ছে কত রঙ! আমরা ধরতে পারছি না। দেখতে পাচ্ছি না তার সব। যার কল্পনার প্রখর শক্তি আছে, সে-ই দেখছে সেই রঙ। কত বর্ণিল! সাতরঙা রামধনুর মতই উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বল রঙগুলোও মাঝে মাঝে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। হয়ে ওঠে ধূসর। ছাই রাঙা মেঘে ঢেকে দ্যায় আকাশ- আমরা বেদনাহত হই, হতাশায় ভুগি। খেই হারিয়ে কতকটা সময় মৃত্যুকে ডাকি।

সৃষ্টির দোলাচলে নানারূপ, নানারঙ। আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢঙ করে প্রকৃতি। সঙ সাজে, ভেঙচি কাটে। আমরা বুঝতে পাইনা, তার রূপ রঙ, রসের মায়ার পিছে ছলনা থাকে। কোনো এক ছলনাময়ী মায়াবতীর মতই প্রতি মূহুর্তে ছলনা করছে বিশ্ব প্রকৃতি। যে এই ছলনার প্রেমে পড়েছে, মায়ায় জড়িয়েছে, সে-ই ডুবছে-ভাসছে অথৈ সাগরে পড়া সাঁতার না জানা মানুষের মত। বেঁচে থাকার তীব্র আর্তি নিয়ে লড়ছে প্রকৃতির সঙ্গে জীবন সংগ্রামে। আবার ভাঙা-গড়ার খেলায় সঁপে দিচ্ছে নিজেকে। মায়া-ছায়ায় যার প্রেম নাই, সে  ভাবলেশহীন ঘুরছে। এলোমেলো ছুটছে বিশ্ব প্রকৃতির ছায়াপথে- তার গন্তব্য জানা নেই, যাত্রার কোনো পথ নেই। থামার গতি ক্ষীণ! ‘যেখানে রাত, সেখানেই কাত’ এই তার জীবনের প্রতিপাদ্য। বিশ্বযাত্রায় এ-এক ঘুরপাক। বাউ কুরানির মত ঘুরাচ্ছে আমাদের সবাইকে। এর মাঝে সবাই পাগল। বদ্ধ পাগল। পাগলের জমজমাট হাট বসেছে- পৃথিবীর প্রান্ত জুড়ে।

পাগল কে পাগল বলা যায় না, তাহলে সে ক্ষেপে যায়। সবাইকে পাগল বলছি। ক্ষেপে যাচ্ছেন হয়তো। ক্ষুব্ধ হতে পারেন। হোন, তাতে দোষ নেই। পাগলই তো নিজেকে পাগল মানতে নারাজ। এই যে আমি সবাইকে পাগল বলছি- সেই পাগলের দলের আমিও একজন। ভেবে দেখুন, সবাই কোনো না কোনো ভাবেই পাগল। বিশ্ব প্রকৃতিই আমাদের পাগল করেছে। এই পাগলদের যে যখন খেই হারিয়ে ফেলছে, সর্বহারা হচ্ছে, সে-ই হচ্ছে দানব। উলট-পালট করছে সব। তা ওই যে বেঁচে থাকারই লড়াই ভাবছে সে! কিন্তু, এটা তার হারিয়ে যাওয়ার খেলা, সে বুঝছে না। না বুঝেই হারিয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু গ্রাস করছে তাকে।

ধরুন, ডানা খসে যাচ্ছে কোনো ফড়িংয়ের। ডানা খসা ফড়িং উড়তে জানে না। তেমনি দানবের খন্ড-খন্ড ইচ্ছাগুলো ও হারিয়ে যায়, মুখ থুবরে পড়ে ডানা খসা ফড়িংয়ের মত। আমরা হয়তো জানি না, এই দানবেরও কিছু ভাল স্বপ্ন ছিল। যা সে পায়নি। তারই শোকে সে দানব হয়ে উঠছে। বঙ্কিম বাবু হয়তো ভাল করেই জানতেন এটা। কমলাকান্তের দপ্তরে গেলেই আপনি পাবেন- চোর এমনি চুরি করে না। চোরকে চুরি করার জন্য সমাজই দায়ি। এই দায় সমাজ এড়াতে পারেনা। মানুষতো অভাববোধ থেকেই বিপথে যায়, বেঁচে থাকার তাগিদে। তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার কথা কজন ভাবে? আমরা তাকে আইন দেখাই, শাস্তি দেই। সমস্যার কোনো চিরন্তন সমাধান দেই না! দেই না জীবিকার পথ।

শুরুতে প্রজাপতির কথা বলছিলাম। প্রজাপতির বর্ণিল ডানায় এই যে এত রঙ, এই রঙের মাঝে কালো রঙে- যে ডুবে আছে, আমরা কি তার কথা ভাবছি? ভাবছি না। আমরা সফলতার গল্প শুনি, ব্যর্থতাকে ঘৃণা করি। কিন্তু ভাবি না, সে কেনো ব্যর্থ হল। এ পথ নয়, অন্য পথে তো ওর সফলতা থাকতে পারে। আমরা সে পথে তাকে এগুতে দেই না। এখানেও আমরা পাগল। আমরা আমাদের উত্তরণের পথ জানি না। যারা উত্তরণের পথ দেখান- আমরা তাদের মানি না। সনাতন কাসুন্দি ঘেটেই সুখি থাকি। নতুনের স্বপ্ন দেখি না। বিজ্ঞানের পথ বুঝি না। এখানেই আমরা বেকুব! গ্রামের একুব-বেকুব দুভাইয়ের গল্প বলছি না। একুব বেকুবরাও মানুষ। তাদের কথাই বলছি। তাদের জীবনের রঙের কথা বলছি। এ কথাগুলোয় হয়তো কোনো দর্শন পাচ্ছেন না আপনি। কিন্তু আমি ভাবি- পৃথিবীর সব কিছুতেই দর্শন আছে। আমরা যেমন বাতাসে ডুবে থেকেও জানি না-বাতাসে ডুবে আছি। তেমনি দর্শনে ডুবে থেকেও জানি না, দর্শনে বেঁচে আছি। দর্শন আছে বলেই শেকসপিয়ার বলতে পেরেছেন- ‘এই পৃথিবী বিরাট নাট্যমঞ্চ, আমরা তার অভিনেতা।‘ ঠিক তাই। বঙ্কিম-শেকসপিয়ারের মতই আমি ভাবতে শিখি। ঘটনা দেখে অভিভূত হই না, ঘটনা পরম্পরা দর্শন আমাকে অভিভূত করে। মুগ্ধ করে, ক্ষিপ্ত করে, আবার লজ্জিত করে! বিশ্ব নাট্যমঞ্চে এই যে সব পাগল অভিনেতা! এই সব পাগল অভিনেতাদেরই মাঝে কত রঙ! যে রঙগুলো আমরা চিনি, ততোদূরই আমাদের জ্ঞান। এর বাহিরে আমরা ভাবতে পারিনা। পরিধি এখানে ছোট হয়ে এসেছে। আমরা কেউ কেউ এই পরিধির বাইরে বেরুতে চাই। মনে হয় পৃথিবী জুড়েই অজ্ঞাত রঙের খেলা। হোলি খেলার মতই রঙ নিয়ে খেলছে বিশ্বকর্তা! বিশ্বকর্তা কে! এই ভাবনাতেও রঙ মিশে আছে, যে রঙ আমরা দেখি না, ছুঁতে পারি না। আমাদের গন্ডির বাইরে। যা আমাদের গন্ডির বাইরে তা মানবো কেন! এই বললেন তো মুশকিল! ছোটখাটো বড় পুরোহিত-মোল্লারা আপনাকে তুলোধনা করে ছাড়বে, মেরে ফেলতেও পারে কেউ- স্বর্গ লাভের আশায়। সাধারনের মাঝে কীট্-কীট্ করে আপনাকে কামড়িয়ে তুলবে। এই যে কামড়ানোর কথা বলছি- পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবেই আমরা প্রত্যেকটা দিন কোনো না কোনো কামড়ের ভিতর দিয়েই যাচ্ছি।

নষ্ট রাজনীতির কামড়, বিপদগামী সমাজ-সমাজপতিদের কামড়, ধর্মব্যবসায়ীর কামড়, স্বার্থান্বেষী মোড়ল-মোল্লাদের কামড়, সমাজ-সংস্কৃতির স্তরগুলোর ধ্বসজনিত কামড়সহ বিভিন্ন জ্ঞাত-অজ্ঞাত কামড়ের ভিতর দিয়েই আমরা চলছি। এই কামড়গুলোর রঙও আছে। এই সবের রঙ থেকে রক্তারক্তি এলে আমরা রক্তের রঙ দেখি- লালে লাল হয় সব। অন্য রঙগুলো আমাদের চোখে ধরে না। এই যে এত এত রঙের খেলা, এর মাঝে শাশ্বত রঙ কোনটা? কালো না সাদা? মৃত্যু শাশ্বত। শোক- কালো বর্ণের। তাহলে শাশ্বত রঙ কালো! অন্ধকারের মত কালো। কালো রঙ মানেই রাতের রঙ, অন্ধকারের রঙ। আমাদের খুব কাছের রঙ। আমাদের সব ক্রিয়া-কার্য বন্ধ হয়ে গেলে আমরা এই রঙেই মিলিয়ে যাই! ডুবে যাই অন্ধকারের ভিতর! অন্ধকারের ভিতর- কবর বলতে পারেন। কবর বলতে গর্ত, এই গর্তেই ভরপুর কালো রঙের খেলা। মৃত্যুর পর যাদের পুড়িয়ে ফেলা হল- তারা কোন রঙে মিশে যায়? আগুনের লেলিহান হলুদাভ লাল শিখায়? আপাত দৃষ্টিতে তাই। কিন্তু এর গভীরেই অন্ধকার লুকিয়ে আছে। চোখ বুজলেই তো অন্ধকার নেমে আসে। এই অন্ধকার আলো দিয়ে ভেদ করা যায় না। অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে আমাদের যাপিত রহস্য। সমগ্র রহস্য অন্ধকারেই বাস করে! অন্ধকারের ওপার থেকেই হয়তো সৈয়দ শামসুল হক সুর তুলেছেন- ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস/রঙ ফুরালেই ঠুস।’

রঙ ফুরিয়ে যায়? হয়তো কবিই জানেন, রঙ-ও মিলিয়ে যায়, পরে থাকে শূন্যতা । তার মানে শূন্যতাই শাশ্বত? এই শূন্যতার পথেই হয়তো আমাদের মহাশূন্যের যাত্রা!


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই