পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ (উপন্যাস)। আখতার মাহমুদ
(“আমি পাঠক বলছি” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে আমার পড়া বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমি একজন সর্বভুক পাঠক। যা পাই তাই গিলি। আমার কাছে মূল বিষয়- কোন একটি বই সুখপাঠ্য কিনা। সুখপাঠ্য হলে লেখক আস্তিক না নাস্তিক, মোল্লা না ব্রাহ্মন, দেশি না বিদেশি, নতুন না পুরাতন, লেখায় গভীরতা আছে কি নেই এসব বাছবিচার এ যাই না। লেখাটা পড়ে ফেলি। কখনো কখনো মতামত ও দেয়ার চেষ্টা করি। পাঠক হিসেবে আমার এই কখনো কখনো দেয়া বক্তব্য হয়ত লেখকের মনঃপূত না-ও হতে পারে। লেখার বিচারিক ক্ষমতা কখনোই একজন পাঠক আর লেখকের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। তবু পাঠক হিসেবে ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ থাকায় কলম হাতে নেয়ার দুঃসাহস করলাম। আশা করছি, লেখকগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আমার এই দুঃসাহস!)
অনেকদিন আগে, ডিসি হিলে (চট্টগ্রাম) একটা সাহিত্য আড্ডায় যোগ দেবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে পরিচিত-অপরিচিত অনেক লেখক এবং গুণীজন উপস্থিত ছিলেন। সেদিন প্রাথমিক পরিচয় পর্বে একজন লেখক বলেছিলেন, তিনি অনেকদিন ধরেই লিখছেন আর বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে তার প্রায় শ’খানেকের-ও বেশি লেখা ছাপানো হয়েছে। দুখানা বই-ও প্রকাশিত হয়েছে। এতগুলো লেখা ছাপা হওয়ার মানে, তিনি সাহিত্য অঙ্গনে মোটামুটি পরিচিত মুখ আর প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। আমিও বিভিন্ন সময় তার লেখা পড়েছি পত্রিকায়- সাহিত্য পাতায় কিংবা পাঠক পাতায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার নাম মনে থাকলেও তার কোন লেখার কথাই আজ এই মুহূর্তে অনর্থক বকবক করতে বসে মনে পড়ছে না। এজন্যে আমি আন্তরিকভাবে লজ্জিত এবং দুঃখিত। হয়তো মনে পড়া উচিত ছিল, কিন্তু পড়ছে না। তার মানে কোথাও কিছু ঘাটতি থেকে গেছে হয়তো পাঠক হিসেবে আমার অথবা লেখকের। এই জায়গায় আমি লেখকের উপর দায়টা চাপাব। একজন লেখকের কাজই হলো লেখার বিষয়বস্তু পাঠকের মনে খোঁদাই করে করে দেয়া, যাতে সময়ের ছাপ মনে-শরীরে পড়লেও পাঠক লেখাটির কথা স্মরণ করেন ঘৃণায় বা ভালবাসায়, প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে। প্রিয় লেখক, আপনি কি কখনো ভেবেছেন বিষয়টা নিয়ে? পাঠক কি মনে রাখছে আপনার লেখা?একটু বকবক বেশিই করছি বোধহয়। সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণের পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখব বলে বসেছিলাম। পাঠ প্রতিক্রিয়া দুরকম হয় আসলে। পাঠ পূর্ব প্রতিক্রিয়া এবং পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া। সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ পড়ার আগেই বইটির কিছু রিভিউ পড়েছিলাম অনলাইনে। রিভিউ পড়েই মূলত আগ্রহী হয়েছিলাম বইটি পড়তে। পাঠপূর্ব প্রতিক্রিয়া ছিলো- হয়তো লেখক মোটামুটি ভালই লিখেন। পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া- লেখক অবশ্যই ভালো লিখেন এবং বাংলা সাহিত্যে নিজের নাম স্পষ্টাক্ষরে চিরস্থায়ী করে যাবেন বলেই তিনি লিখেন।
ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে বইটি পড়তে শুরু করে শেষতক পেয়েছি একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, চৌকস, পরিশ্রমী এবং সৎ রাজনীতিবিদের জীবন-মৃত্যুর গল্প। যে গল্প তুলে ধরেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অস্থির সময়টি। যে অস্থির সময়ে দিশাহীন নৌকার পাল ধরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে মানুষগুলো, এতে তাদের গল্পই রয়েছে। এতে আছে দুমুখো সাপের গল্প, যে সাপটির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে শহীদ হয়েছিলেন বাংলার সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র- শেখ মুজিবুর রহমান আর জাতীয় চার নেতা। এতে আছে শূন্য সম্পদের একটি দেশের টিকে যাবার গল্প। যে গল্প আসলে গল্প নয়। ঘটে যাওয়া বিস্ময়ের চমৎকার বিবরণ।
‘‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’’ মোটামুটি বড়সড় একটি উপন্যাস (ঐতিহাসিক)। নিশ্চিত করে বলতে পারি, পড়তে শুরু করে শেষ না করে উঠতে ইচ্ছে করবে না পাঠকের (এটি সার্থক লেখার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য)। যদিও গল্পটা আপনি-আমি সবাই জানি। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? যে গল্প আমি জানি, সে গল্প আবার পড়ার কী প্রয়োজন! সুহান রিজওয়ান লেখক হিসেবে সার্থক এখানেই। তিনি একটি জানা গল্প আবারো জানতে বাধ্য করেন পাঠককে। পাঠককে আঁটকে রেখে নিয়ে যান গল্পের শেষ পর্যন্ত।
ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে এটি কতটা ত্রুটিমুক্ত বা কতটা ইতিহাসের খেলাপ বা রক্ষা এতে হয়েছে এটা বলার দায়িত্ব ঐতিহাসিকের। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি শুধু এর গল্পটা নিয়েই বলছি। সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ বইটিকে দুইভাগে ভাগ করেছেন লেখক। পূর্বখন্ড এবং উত্তর খন্ড। পূর্বখন্ড কিছুটা এলোমেলো মনে হয়েছে। যে কয়টা রিভিউ আমি পড়েছি তাতে এ বিষয়টা প্রায় সকলেই উল্লেখ করেছেন। তবে এখানে আমি বলব এলোমেলো মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ তখন সময়টা ছিল অদ্ভুত রকম অস্থির আর বিশৃঙ্খল। ওই বিশৃঙ্খল সময়ের বর্ণনা একটু এলোমেলো হতেই পারে। তবে এলোমেলো মনে হবার আরেকটি কারণ হিসেবে বলা যায়, একটি অধ্যায়ে হুট করে অন্য কারো প্রসঙ্গ বা বিষয় নিয়ে গল্প বলতে শুরু করার ব্যাপারটা। এরকম বেশ কয়েকবার ঘটেছে বইটিতে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- অমলিন এক গোলাপ অধ্যায়টা। যেখানে প্রথমে বলা হচ্ছিল শৈশবেই তাজউদ্দীনের দেশচিন্তার কথা। বত্রিশ পৃষ্ঠায় হুট করেই তাজউদ্দীনের শৈশব ছেড়ে বর্তমানে চলে এসেছেন লেখক। এটা না করে বরং অধ্যায়টাকে একটু টেনে বড় করে, বর্তমান সময়ের গল্পটা (প্রতিবেশি সেলিম সাহেবের বিদায় সংক্রান্ত গল্প) নতুন অধ্যায় দিয়ে শুরু করা যেত। এছাড়াও এলোমেলো গল্প কথন উত্তরখন্ডেও রয়েছে। অপপ্রচারের অস্ত্র, অসন্তোষের আগুন পর্বে ছিল বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের নামে অপপ্রচারের কথা এবং শেখ মুজিবের উভয়সংকট সংক্রান্ত গল্প। সেখান থেকে হুট করে চলে আসা হল জাহানারা ইমামের ভাবনায়। এখানে জাহানারা ইমাম প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় দিয়ে শুরু করা যেত।
কিছু কিছু বর্ণনায় সম্ভবত প্রুফ রিডিংয়ে ভুল ধরা পড়েনি বলেই এলোমেলো মনে হয়েছে। সেক্ষেত্রে কিছু অসমাপ্ত শব্দ আর অপরিকল্পিত বাক্য গঠন সংশোধন করে নিলে বোধহয় অনেকাংশে পরিপূর্ণতা আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আলো অন্ধকারের কূটনীতি অধ্যায়ের কথা। একশত পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় একটি লাইন আছে এরকম- .....মইদুলের মুখের একরাশ দুশ্চিন্তার ব্রণ দেখা পাওয়া যাচ্ছে । লাইনটা এরকম হওয়ার কথা বোধহয়- ......মইদুলের মুখে একরাশ দুশ্চিন্তার ব্রণ দেখা যাচ্ছে।...... আরেক লাইনে আছে- ‘না! রমানাথ কাউ আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনলেন....’ এখানে কাউ বলতে সম্ভবত কাউন্সিলে বলা হচ্ছিল যা প্রুফ রিডিংয়ে ধরা পড়েনি। একই পৃষ্ঠায় আরেকটি লাইনে আছে- ‘র ডিরেক্টর রমানাথের সাথে নিষ্ফ মিটিং করেছিলেন...’ এখানে নিষ্ফল হওয়ার কথা বোধহয়। এধরণের ভুলগুলো আরো কয়েকবার চোখে পড়েছে বইটিতে। ভাল প্রুফ রিডারের সাহায্য নিয়ে এ ধরণের ভুল শুধরে নেয়া কঠিন ব্যাপার না।
কিছু অধ্যায় অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। ওসব না থাকলে মূল গল্পের কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হত না। যেমন- পূর্ব খন্ডে নীলাভ চোখের যুবক (সায়মন ড্রিং এর কথা প্রসঙ্গক্রমে কোথাও দু-এক লাইনে জানালেও চলত), আকাশের কাছে। আর উত্তরখন্ডে শিরস্ত্রাণের সাক্ষ্য, ইতিহাসের কাটাকুটি, দন্ডিত বকুলের দিন, অপেক্ষা । উপন্যাসটি শেষ করা উচিত ছিল নক্ষত্র পতন অধ্যায়টা দিয়ে। কেননা এতে করে একটি করুণ আবহের মধ্যে পাঠককে রেখে দেয়া যেত। নক্ষত্র পতন অধ্যায়ের পর অন্য অধ্যায়গুলো গল্পের আমেজ নষ্ট করেছে। কারণ এর পরের অধ্যায়গুলোতে মনে হয়েছে লেখক গল্প কথক হওয়ার বদলে ইতিহাসবিদ হয়ে উঠছেন। এরপরের ঘটনাবলী পরিশিষ্টে সংক্ষেপে বলা যেত, এতে করে মূল গল্পের কোন ক্ষতি হত না।
তবে মূলকথা হলো ‘‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’’ পড়তে পড়তে একদম সেই সময়ে চলে গিয়েছিলাম। কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আর স্বাধীন হবার পর দেশি-বিদেশি অসহযোগিতা পেয়েও কেমন করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও দেশ এগিয়েছে গুটিকয়েক মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দৃঢ়তায়। সেসব চিন্তা করলেও দিশেহারা লাগে। কী করে সম্ভব ছিলো সেই টিকে যাওয়া? আজ আমরা খুব সহজেই দেশ-সরকারের দোষারোপ করে ফেলি। অথচ কতটা নির্মমতা, উপেক্ষা আর বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে এসে দেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর পাশাপাশি এটা আমরা কখনো ভাবি না। কখনোই ভাবি না একটি স্বাধীন দেশে জন্ম নিয়েছি, হেসে-খেলে বেড়াচ্ছি আমরা। অথচ এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন করাটা কেবল কঠিনই নয় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা কেবলই নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে অস্থির নাগরিক। আমরা বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতায়ও স্বরণ করি না সেইসব মানুষদের যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে মিলে-মিশে আছেন। যারা না থাকলে হয়তো স্বাধীনতা দূরের বাতিঘর হয়ে থাকতো দীর্ঘদিন।
সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ সেইসব সোনার মানুষদের গল্প তুলে ধরেছে। যারা শুধু দেশকে ভালোবেসেই বেঁচে ছিলেন, দেশকে ভালোবেসেই মারা গেছেন। অতুলনীয় সেইসব সোনার মানুষদের তীব্র সংগ্রামের দিনগুলোকে জানতে ‘‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’’ পড়া উচিত সকলের। হয়তো এই একটি বই দেশপ্রেমে আকুল-ব্যাকুল করে তুলতে পারবে না কাউকে। তবে নিঃসন্দেহে এটি একজন পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে সেই সময়ে। যে সময়ে কিছু সোনার মানুষ দেশকে ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন জীবন দিয়ে।
লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন