চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

আমি পাঠক বলছি (২)

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ কোলাহলে (উপন্যাস)। আখতার মাহমুদ
(“আমি পাঠক বলছি” শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে আমার পড়া বই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমি একজন সর্বভুক পাঠক। যা পাই তাই গিলি। আমার কাছে মূল বিষয়- কোন একটি বই সুখপাঠ্য কিনা। সুখপাঠ্য হলে লেখক আস্তিক না নাস্তিক, মোল্লা না ব্রাহ্মন, দেশি না বিদেশি, নতুন না পুরাতন, লেখায় গভীরতা আছে কি নেই এসব বাছবিচার এ যাই না। লেখাটা পড়ে ফেলি। কখনো কখনো মতামত ও দেয়ার চেষ্টা করি। পাঠক হিসেবে আমার এই কখনো কখনো দেয়া বক্তব্য হয়ত লেখকের মনঃপূত না-ও হতে পারে কেননা লেখার বিচারিক ক্ষমতা কখনোই একজন পাঠক আর লেখকের মধ্যে সমানভাবে থাকে না। তবু পাঠক হিসেবে ভাবনা তুলে ধরার সুযোগ থাকায় কলম হাতে নেয়ার দুঃসাহস করলাম। আশা করছি, লেখকগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আমার এই দুঃসাহস!)

কোলাহলের গল্প প্রসঙ্গ

কোলাহলে পড়তে পড়তে বার বার খোয়াবনামার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। খোয়াবনামা পড়ার সময় যে আবহে ঢুকে পড়ছিলাম ক্রমশ ঠিক সেই আবহটা টের পাচ্ছিলাম। আবহটা চিরন্তন জীবন-যাপনের উৎসব শব্দে দেখে নেয়ার, বুঝে নেয়ার। তবে খোয়াবনামায় রাজনীতি এবং ধর্মের যে প্রভাব ছিল কোলাহলে তা অনুপস্থিত। তবে কুসংস্কার সেই আদিম মহিমায় বেশ কয়েকবার উঁকি দিয়েছে উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে।  আধুনিক যুগে গ্রামীণ জীবনধারা অদ্ভুত মায়ায় এঁকে ফেলেছেন ঔপন্যাসিক এনামুল রেজা। যে জীবনধারায় নিজের মত করে জীবন যাপনই মুখ্য। যে জীবনে রাজনীতি-ধর্ম বা ভিন্ন চেতনা কোন অর্থ বহন করে না। আসলে গ্রামীণ মানুষের নিজ নিজ চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের কোলাহলে ওসব উটকো বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ হয় না কারোই। ওসব শহুরে কারবার। উপন্যাসে নতুন কোন গল্প নেই। এই গল্প হাজারবার লেখা হয়ে গেছে। টানটান উত্তেজনাও নেই। রগরগে চরিত্র নেই। তবে আছে মায়াময় বর্ণনা। সাধারণ মানুষের, সাধারণ জীবনের।

কোলাহলে উপন্যাসে সুখি মুখ ছিলো না একটিও। সফুর শেখ সুখি, তবে তাঁকে কাঁটার মত খোঁচায় রোকেয়াকে কামরুলের কাছ থেকে কুসংস্কার বশবর্তী হয়ে আলাদা করে ফেলাটা। তাকে অসুখী দেখায় তখনও যখন কামরুল চলে যেতে চায় সুন্দরবনে।

সংসার ধর্ম মেনে নেয়া রোকেয়ার বুক জুড়ে ছটফটানি, সে-তো পুরো উপন্যাস জুড়েই।

প্রধান চরিত্র কামরুল দিশাহীন। তার যে আসলে কী ইচ্ছে সে নিজেই জানে না। জীবন নিয়ে ভাবনারও অবকাশ যেন তার নেই। প্রেম না পাওয়ার তীব্র হতাশা তার না থাকলেও এক অপূর্ণতা নিয়ে সে ঘোরে ফেরে আর একসময় হয়তো সে অপূর্ণতার হাহাকারে সিদ্ধান্ত নেয় সুন্দরবন চলে যাবে কাজ নিয়ে। এতে যদি কখনো সে বাঘের পেটেও চলে যায় তাতেও তার খুব একটা আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।

এছাড়া আজমত, মনোয়ারা, মনি, জহিরুল, রাবেয়া, আলাল শেখ, জয়নাল এসব চরিত্রগুলোও যে যার মত করে অসুখি আর অস্থির। তৃপ্ত নয়। যদিও কেবলমাত্র মুন্ডুহীন লাশের আবির্ভাবই কারো কারো জীবন এলোমেলো করে দেয়। জীবনের স্বাভাবিক গতিতে ছন্দপতন আনে।

উপন্যাসে ওসি জহুর আলীর মৃত্যু অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। তার কাছে আলাল শেখ স্বীকারোক্তি দিলে অসুবিধে কী ছিল? আর ছোট আকারের উপন্যাসটিতে চরিত্র সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এটাও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। আকারে আরো বড় হলে ঠিক ছিল। ছোট আকারের উপন্যাসে লেখকের মূল চরিত্রগুলোর আশেপাশেই থাকা উচিত বারবার। কামরুলকে আরো বিশদ পরিসরে দেখানো যেত, কেননা চরিত্রটি টানবে পাঠককে।

অদ্ভুতভাবে পুরো উপন্যাস খুঁজে টুজে একটি চরিত্রও পেলাম না যে নিশ্চিতভাবে সুখি! জানি না এটা লেখক সচেতন ভাবেই করেছেন কি না। একটি সুখি চরিত্রের অনুপস্থিতি বেশ পীড়া দিয়েছে আমাকে। বার বার তাই একটা মিষ্টি হতাশা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। হতাশাটা মিষ্টি কেন? পাঠক যা চায় তা যদি অধরা রেখে দেয়া যায়, তাহলে একটা অতৃপ্তি থাকে। যে অতৃপ্তিটা দীর্ঘদিন পাঠককে মনে করিয়ে দেয় লেখকের কথা। হয়তো কেউ কেউ আমারই মতো গালি দেয় লেখককে- এই বদ লোকটা লেখায় কী একটা যেন দিয়েও দেয়নি! এক নাম্বারের বদের হাড্ডি কোত্থাকার।

এই কী-টা যে আসলে কী বস্তু তা পাঠক নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারেন না। লেখকের তৃপ্তিটাও পাঠকের এই অতৃপ্তি থেকেই আসে। কারণ পাঠকের অতৃপ্তি মানেই একজন লেখককে আবারো পড়ে দেখার গোপন ইচ্ছে। কোলাহলে পড়ে ফেলার পর এই গোপন ইচ্ছে আমারও। যদিও এনামুল রেজার লেখা পড়ে আসছি আরো অনেকদিন আগে থেকেই। তাই আমার জানা আছে, সামনের দিনগুলোতে যে ক’টা মানুষ বাংলাদেশের সাহিত্যের হাল ধরবে, তাদের অন্যতম হবেন এই কোলাহলে লিখে ফেলা এনামুল রেজা।

প্রচ্ছদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

প্রচ্ছদটা সুন্দর কোন সন্দেহ নেই, প্রশ্ন নেই। কিন্তু ব্লাড এন্ড চারকোল অবলম্বনে করা প্রচ্ছদ কোলাহলে গল্পের সাথে মোটেই যায় না। গল্পের প্রথমে রক্তঝরা মুন্ডুহীন লাশের প্রসঙ্গ এলেও উপন্যাসের বিষয়বস্তু তা ছিল না। এখানেই প্রশ্ন আসে মনে, কোলাহলের জন্যে ইউনিক একটি প্রচ্ছদ কেন করেন নি প্রচ্ছদ শিল্পী? নাকি লেখক-ই এমনটি চেয়েছেন? তবে আমার বিনীত মতামত- কোলাহলের জন্যে গণ্পের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি প্রচ্ছদ করাটাই হতো সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত।

উপন্যাসের সবখানেই ‘জায়গা’ বানানটা ‘যায়গা’ দেখেছি। ডায়ালগে বোধহয় যায়গা চলতে পারে কিন্তু অন্য কোথাও নয়। যদিও লেখক আমার চেয়ে বেশি বুঝবেন। কোনো একখানে চেয়েও না লিখে লিখা হয়েছে চেও, দায়িত্ব লেখা হয়েছে দ্বায়িত্ব, আবার ব্যথা লেখা হয়েছে ব্যাথা..... এরকম ছোট-খাট কিছু বানান খেয়ালে রাখা উচিত। যখন আমার মত এলেবেলে পাঠক পড়বে তখন হয়তো চোখেই পড়বে না। কিন্তু বিদগ্ধ পাঠক দু’পাতা উল্টেই যদি ভুল-টুল দেখেন, বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে বুকশেল্ফে সাজিয়ে রাখতে পারেন না পড়েই।

একটি অভিযোগ

বইয়ের কাগজের মান ভালো মনে হয়নি। যদিও লেখকের চেয়ে দায় এখানে প্রকাশকের বেশি।

শেষ কথা

আগেই বলেছি, চিরন্তন জীবন-যাপনের উৎসব শব্দে এঁকে নিয়েছেন লেখক। কোন জীবন সমাধান দেয়া লেখকের কাজ নয়, সেই চেষ্টাও লেখক করেননি । লেখক যাপিত জীবনের রূপ নিজ ভাষায়, নিজ অভিজ্ঞতায়, কল্পনায় সাজিয়ে তুলে এনেছেন। তার সেই তুলে আনার চেষ্টায় ফাঁকি ছিল না, ছিল অসীম মায়া। যে মায়ায় ভাসবেন পাঠক।


 লেখা পাঠান ই-মেইলেঃ chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই