পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ কোলাহলে (উপন্যাস)। আখতার মাহমুদ
কোলাহলে পড়তে পড়তে বার বার খোয়াবনামার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। খোয়াবনামা পড়ার সময় যে আবহে ঢুকে পড়ছিলাম ক্রমশ ঠিক সেই আবহটা টের পাচ্ছিলাম। আবহটা চিরন্তন জীবন-যাপনের উৎসব শব্দে দেখে নেয়ার, বুঝে নেয়ার। তবে খোয়াবনামায় রাজনীতি এবং ধর্মের যে প্রভাব ছিল কোলাহলে তা অনুপস্থিত। তবে কুসংস্কার সেই আদিম মহিমায় বেশ কয়েকবার উঁকি দিয়েছে উপন্যাসের বিভিন্ন অংশে। আধুনিক যুগে গ্রামীণ জীবনধারা অদ্ভুত মায়ায় এঁকে ফেলেছেন ঔপন্যাসিক এনামুল রেজা। যে জীবনধারায় নিজের মত করে জীবন যাপনই মুখ্য। যে জীবনে রাজনীতি-ধর্ম বা ভিন্ন চেতনা কোন অর্থ বহন করে না। আসলে গ্রামীণ মানুষের নিজ নিজ চাওয়া-পাওয়ার হিসেবের কোলাহলে ওসব উটকো বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ হয় না কারোই। ওসব শহুরে কারবার। উপন্যাসে নতুন কোন গল্প নেই। এই গল্প হাজারবার লেখা হয়ে গেছে। টানটান উত্তেজনাও নেই। রগরগে চরিত্র নেই। তবে আছে মায়াময় বর্ণনা। সাধারণ মানুষের, সাধারণ জীবনের।
কোলাহলে উপন্যাসে সুখি মুখ ছিলো না একটিও। সফুর শেখ সুখি, তবে তাঁকে কাঁটার মত খোঁচায় রোকেয়াকে কামরুলের কাছ থেকে কুসংস্কার বশবর্তী হয়ে আলাদা করে ফেলাটা। তাকে অসুখী দেখায় তখনও যখন কামরুল চলে যেতে চায় সুন্দরবনে।
প্রধান চরিত্র কামরুল দিশাহীন। তার যে আসলে কী ইচ্ছে সে নিজেই জানে না। জীবন নিয়ে ভাবনারও অবকাশ যেন তার নেই। প্রেম না পাওয়ার তীব্র হতাশা তার না থাকলেও এক অপূর্ণতা নিয়ে সে ঘোরে ফেরে আর একসময় হয়তো সে অপূর্ণতার হাহাকারে সিদ্ধান্ত নেয় সুন্দরবন চলে যাবে কাজ নিয়ে। এতে যদি কখনো সে বাঘের পেটেও চলে যায় তাতেও তার খুব একটা আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।
অদ্ভুতভাবে পুরো উপন্যাস খুঁজে টুজে একটি চরিত্রও পেলাম না যে নিশ্চিতভাবে সুখি! জানি না এটা লেখক সচেতন ভাবেই করেছেন কি না। একটি সুখি চরিত্রের অনুপস্থিতি বেশ পীড়া দিয়েছে আমাকে। বার বার তাই একটা মিষ্টি হতাশা আমাকে ছুঁয়ে গেছে। হতাশাটা মিষ্টি কেন? পাঠক যা চায় তা যদি অধরা রেখে দেয়া যায়, তাহলে একটা অতৃপ্তি থাকে। যে অতৃপ্তিটা দীর্ঘদিন পাঠককে মনে করিয়ে দেয় লেখকের কথা। হয়তো কেউ কেউ আমারই মতো গালি দেয় লেখককে- এই বদ লোকটা লেখায় কী একটা যেন দিয়েও দেয়নি! এক নাম্বারের বদের হাড্ডি কোত্থাকার।
এই কী-টা যে আসলে কী বস্তু তা পাঠক নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারেন না। লেখকের তৃপ্তিটাও পাঠকের এই অতৃপ্তি থেকেই আসে। কারণ পাঠকের অতৃপ্তি মানেই একজন লেখককে আবারো পড়ে দেখার গোপন ইচ্ছে। কোলাহলে পড়ে ফেলার পর এই গোপন ইচ্ছে আমারও। যদিও এনামুল রেজার লেখা পড়ে আসছি আরো অনেকদিন আগে থেকেই। তাই আমার জানা আছে, সামনের দিনগুলোতে যে ক’টা মানুষ বাংলাদেশের সাহিত্যের হাল ধরবে, তাদের অন্যতম হবেন এই কোলাহলে লিখে ফেলা এনামুল রেজা।
আগেই বলেছি, চিরন্তন জীবন-যাপনের উৎসব শব্দে এঁকে নিয়েছেন লেখক। কোন জীবন সমাধান দেয়া লেখকের কাজ নয়, সেই চেষ্টাও লেখক করেননি । লেখক যাপিত জীবনের রূপ নিজ ভাষায়, নিজ অভিজ্ঞতায়, কল্পনায় সাজিয়ে তুলে এনেছেন। তার সেই তুলে আনার চেষ্টায় ফাঁকি ছিল না, ছিল অসীম মায়া। যে মায়ায় ভাসবেন পাঠক।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন