চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

নিষিদ্ধ ফেসবুক

নিষিদ্ধ ফেসবুক । রাজিব রাহুল


সকাল বেলায় চিৎকার চেচামেচিতে আচমকা ঘুম ভাঙ্গে রাহুলের। সারা পাড়ায় মুখে মুখে রটে গেছে রমিজ ডাক্তারের মেয়ে পিংকিকে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতে শীতের সকালে কম্বলের মায়া ছাড়তেই চায় না সে। যদিও পাশের ঘরে রহিত আর আমেনার ঝগড়া প্রতিদিন ভোরের পাখির মতো ঘুম ভাঙ্গায় তার। তবে আজ একটু ব্যতিক্রম। দাঁত ব্রাশ করতে করতে উঠোনে পা রাখলো সে। রাহুলের বাড়িটা দেখতে স্কুলের মতো লম্বা। মাটির এই দু-তলা বাড়ীতে দশটি পরিবারের বসবাস। দক্ষিণ দিকের বাড়ীটা মুন্সি বাড়ী। যদিও এ বাড়ীতে কেউ আজ মুন্সিগিরি করে না। প্রায় পরিবারে উপার্জনের উৎস প্রবাসী স্বামী অথবা ছেলেদের পাঠানো টাকা। বিগত বছর দশকে এ বাড়ীতে কাঁচা ঘর গুলো পাকা বাড়ীতে রূপ নিয়েছে প্রবাসীদের টাকায়। যদিও এখনো গায়ের প্রায় রাস্তা কাঁচা, বর্ষা কালে হাঁটু পরিমাণ কাদা হয়। কয়েকটা ইটের রাস্তা আছে সেগুলোর অবস্থাও কাহিল।

পশ্চিমের বাড়িটা ডাক্তারের বাড়ী। এ বাড়ীতে তিনটি পরিবার বাস করে- ডাক্তার রমিজ আলী ও তার দুই ভাই জহির মন্ডল এবং মনছুর মন্ডল। মূলত জহির ও মনছুর মন্ডল রমিজ ডাক্তারের সৎ ভাই। মনছুর নিরীহ ও শান্তশিষ্ট হলেও জহির মন্ডল অত্যন্ত কুচক্রী লোক। একাত্তরে তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলে গায়ের মানুষগুলো। কেমন করে রমিজ আলীকে ভিঠে ছাড়া করে তার অংশটুকু দখল করবে তার জন্য ওৎ পেতে থাকে জহির মন্ডল। রমিজ আলীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে ছেলেটিকে এমবিবিএস পড়াতে নিজের জমি জায়গা সব বিক্রি করেছেন একে একে। এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি জহির মন্ডল। এক সময়ে সুদী ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে কলা গাছ হলেও কয়েক বছর আগে হজ্ব করে এসে তওবা করে ইস্তফা দেন এ ব্যবসায়। যদিও এরা আগে সুদের টাকা দিতে না পারায় কতো মানুষের জমি, পুকুর, ভিটে জোর করে লিখে নিয়েছেন তার হিসেব নেই। বিশেষ করে দাশ পাড়ায় নিরিহ লোকগুলো থেকে, যারা রাতের আঁধারে সব লিখে দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে পাশের দেশে। বিশাল দাশ পাড়ায় শত খানেক পরিবারের মধ্যে প্রায় চল্লিশের মতো পরিবার নিরবে উধাও হয়েছে জহির মন্ডলের অত্যাচারে।

চট্টগ্রাম শহরে থেকে ত্রিশ মাইল দূরে এই অজ পাড়া গায়ের আইন বলেন আর আদালত বলেন সবই জহির মন্ডল। তিন তিনবার নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তিনি। তবুও তার বাড়ীটি গায়ের লোক ডাক্তার বাড়ী কেন বলে এ নিয়ে কম দুঃখ নয় তার মনে। যার কারণে নিজের সৎ ভাই রমিজ আলীর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যতো আপত্তি জহির মল্ডলের। বিশেষ করে মেয়েটিকে নিয়ে। সে গাঁয়ের লোকদের বলে বেড়ায়- আমার ভাই রমিজ্জারে বললাম তোর মাইয়ারে মাদ্রাসায় পড়া লেখা করা কাজে আসবে, কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কথা, সে মাইয়ারে কলেজে ভর্তি করাইছে, বলে- উকিল হইবো আমার মাইয়া। মাইয়া লোক পড়া লেখা করি কি হইবো? ঠিকই তো স্বামীর ঘরে চুলা গুতাইতে হয়। বলি মুসলিম পরিবারের মাইয়াগো পর্দা মেনে চলতে হয়। আইন আদালত পাড়ায় ব্যাটা লোকের সাথে ঢলাঢলি করা নয় ..... নাউজুবিল্লাহ।

রাহুল দাঁত ব্রাশ করতে করতে যখন রমিজ চাচার বাড়ীতে এসে ঢুকলো। তখন পাড়ার লোকজনের জটলা চোখে পড়ল। রাহুল ভীড় ঠেলে ভীতরে ঢুকলো। দেখা গেলো এমন শীতের দিনে ও রমিজ আলীর মাথায় মগে মগে পানি ঢালছে ফেরদৈাসী বেগম আর নিজের মেয়েকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে- দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছিলাম আজ সেই কাল নাগিন মেয়েটা মান ইজ্জতের গুষ্ঠি মারলো। এই মেয়ের জন্য কাঁদি কি লাভ? বড় আশা করে একখানি মেয়ে চাইছিলাম খোদার কাছে। কিন্তু এমন মাইয়া হইবো জানলে জন্মের পর গলা টিপে থুইতাম। সারাদিন মোবাইল নিয়ে টেপাটেপি ....... মরার ফেসবুক আমার জাত মারার লাইন কইরা দিচ্ছে ........।

ফেসবুকের কথা শুনে গা শিউরে উঠলো রাহুলের, এ গ্রামে ফেসবুক অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ । তার জ্বলন্ত উদাহরণ গায়ের নিখিল দাশের বাড়ীটা। যেখানে এখনো পোড়া কয়লা পড়ে আছে। এখনো ভয়ে দিন কাটায় দাশ পাড়ার মানুষগুলো।

ফেসবুকের কথা শুনে গা শিউরে উঠলো রাহুলের, এ গ্রামে ফেসবুক অলিখিত ভাবে নিষিদ্ধ । তার জ্বলন্ত উদাহরণ গায়ের নিখিল দাশের বাড়ীটা। যেখানে এখনো পোড়া কয়লা পড়ে আছে। এখনো ভয়ে দিন কাটায় দাশ পাড়ার মানুষগুলো। নিখিল দাশের কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি ফেসবুকে তর্কের খাতিরে লিখেছিলেন-
‘‘যদি ছবির প্রাণ নাই বিধায় ছবি তোলা হারাম হয়, তাহলে ফেসবুকে যে ছবি লোড দেওয়া হয় সে গুলোরও তো প্রাণ নাই তাহলে ফেসবুকও ব্যবহার করা হারাম”।

এই মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় উঠে গায়ের বাজারের মোবাইল দোকান থেকে। তারপর জহির মন্ডলের নেতৃত্বে হামলা হয় নিখিলের বাড়ীতে। সেদিন ছেলেটিকে না পেলেও পঙ্গু হয়ে যায় নিখিল দাশ। হাত পা ভেঙ্গে দেয় উপস্থিত জনতা। বাড়ি-ঘর পুড়ে গেলেও প্রাণ নিয়ে কোনমতে শহরে পালিয়েছে নিখিলরা। কিন্তু পিংকি কেন পালালো? দু’দিন পর যার বিয়ে সে এমনভাবে কেন পালালো? পরিবারের কথা একটি বারও ভাবলো না?

বিয়েতে মত না থাকলে সে আগেই জানাতে পারতো। তবে ফেসবুকের পরিচয়ে কারো সাথে পালানোর মেয়ে পিংকি নয়। মেয়েটিকে সপ্তম শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত প্রাইভেট পড়িয়েছে সে।
হ্যাঁ মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। গায়ের রং দুধে আলতা, হরিণীর মতো কাজল কালো চোখে যার দিকে তাকাবে ঠিকই কামনার ঝড় তুলবে বুকে। রাহুলের বুকেও তুলতো, মেয়েটি হাসলে গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটি মুক্তো ছড়াতো চারপাশে। এমন মেয়ে নিয়ে যে কেউ পালাতে চাইবে। মনের সুখের কাছে তুচ্ছ পৃথিবীর সবকিছু। সুখ তো টাকা নয় যে ব্যাংকে ডিপোজিট করলে পরিমাণে বাড়বে। সুখ- সময় আর বয়সের মধ্যেও সীমাবদ্ধ। সময় থাকতে লুফে নিতে হয়। চাইলেই অনেক ভাবেই এগুতে পারতো রাহুল, কিন্তু তার ছাত্রী ছিল বলে বিবেক সায় দেয়নি।

সেই রাতের বেলায় সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে বৈঠক বসল জহির মন্ডলের উঠোনে। রমিজ আলীকে হাজির করা হলো সেখানে। জহির মল্ডল বললো- আগেই বলেছিলাম দু-আনা শিক্ষিত মেয়েটারে মোবাইল দিও না, কলেজে দিও না, মাদ্রারাসায় দাও। কথা শুনলা না, আজ এই মাইয়া তোমার তো বটে সমাজের সম্মানও ডুবাইছে। তোমার এমন মেয়ের জন্য যে ছেলেটির সাথে দু-দিন পর বিয়ের কথা তার পুরো পরিবার গ্রামের মেয়েদের উপর আস্থা হারিয়েছে। এ গ্রামের সকল মেয়েদের কালিমা লাগাইলো তোমার মেয়ে। এর শাস্তি তোমাকেই বহন করতে হবে। তোমাকে একঘরে করা হল।

ভাই হয়েও ভাইয়ের প্রতি এমন অবিচারের কোন প্রতিবাদ করেনি রমিজ আলী কারণ একাত্তরে রমিজ আলী মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলেও জহির মন্ডল পাক সেনাদের সহায়তা করেছিলো তা কারো অজানা নয়। রমিজ আলী একাত্তরে একবারই জিতেছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই পরাজিত হয় কোন না কোনভাবে জহির মন্ডলের কাছে।

তারপর দিন যায় মাস আসে রমিজের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠে। গায়ের মানুষের এমন অবজ্ঞা আত্মসম্মানে লাগে তার। সংসারে অভাব নামে দিনের পর দিন। শেষমেষ ছেলের সাথে পরামর্শ করে রাতের আঁধারে বাপ দাদার ভিটে ছাড়ে রমিজ আলী স্ত্রীকে নিয়ে। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পথে দাশ পাড়ার নিখিল দাশের পোড়া বাড়িটির দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। একদিন নিজেই তাদের সাহস দিতো- কেন যাইবা নিজের ভিটে ছেড়ে? আজ তার উত্তর খুব করে জানা হয়েছে তার .........।

বিলের সোনালী ধান, পুকুরের পদ্মফুল, নদীর ধারের কাঁশবন, গাঁয়ের নির্মল হাওয়া, প্রতিবেশী ও গায়ের লোকদের কষ্টমাখা হাসিমুখগুলো খুব বেশি নাড়া দিচ্ছিলো রমিজকে। রিকশাটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় প্রিয় গ্রামটিকে ছেড়ে।



মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই