চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

কিস্তি কাৎ

কিস্তি কাৎ । মনসুর আলী


 রাশেদের বাবা ইসলাম সাহেব সবার কাছে একজন খুব হিসাবি মানুষ এবং একজন সৎ মানুষ হিসাবে পরিচিত। ওয়াসাতে চাকরি করেন। ছেলে মেয়ে স্ত্রী নিয়ে ছয় জনের পরিবার। বেতন তেমন একটা ভাল নয়। ঘুষের ধারে কাছেও নেই। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন। এলাকাতে সবাই সমীহ করে চলে।
ইসলাম সাহেব গত কয়েকদিন যাবৎ ছেলে মেয়েদের একটি আবদার নিয়ে মহা সমস্যায় পড়েছেন। কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। ছেলে মেয়ে সবাই পড়ালেখা করে। পঞ্চম শ্রেণী, সপ্তম শ্রেণী, নবম শ্রেণী এবং দশম শ্রেণী- এই চার শ্রেণীতে চারজন। তাদের সবাই এক আবদার নিয়ে বাবাকে গত কয়েক দিন ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করেছে। সবার এক আবদার একটা ‘রঙিন টিভি’ কিনতে হবে। তারা আর পাশের চাচার ঘরে গিয়ে টিভি দেখবে না। তারা এখন সবাই বড় হয়েছে। অন্যের ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে তাদের ভাল লাগে না। তাছাড়া চাচি তাদের ভালো চোখে দেখে না।

 
নাবিলা সাফ সাফ বাবাকে বলে দিয়েছে যে, ‘‘আমি টিভি না আনা পর্যন্ত স্কুলে যাবো না।’’
আজ সে স্কুলে যায়নি। বন্ধ পালন করছে!


গতকাল ছোট মেয়ে নাবিলার কাছ থেকে বসার পিঁড়ি নিয়ে নিয়েছে বলে তার খুব গায়ে লেগেছে। নাবিলার এটি খুব খারাপ লেগেছে। খুব অপমান বোধ করেছে সে এবং সবাই। সবাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা আর চাচার ঘরে যাবে না এবং নাবিলা সাফ সাফ বাবাকে বলে দিয়েছে যে, ‘‘আমি টিভি না আনা পর্যন্ত স্কুলে যাবো না।’’
আজ সে স্কুলে যায়নি। বন্ধ পালন করছে! তার বাবা বিষয়টি নিয়ে যেমন একদিকে কষ্ট পেয়েছে অন্যদিকে ছোট মেয়ের বন্ধ পালন দেখে মজা পেয়েছে। কিন্তু এ মুহূর্তে তার কাছে নগদ টাকা নেই যে হুট করে গিয়ে টিভি কিনে নিয়ে আসবে। সরকারি চাকুরের ঘুষ না খাওয়া এই মানুষটির পক্ষে এখন তা সম্ভব নয়। কী করতে পারে তা ভাবতে গিয়ে তার মাথা ঘুরছে। রাশেদের মাকে একবার সাহস করে বলেই ফেললেন, ‘‘তোমার চুড়ি দুটো বিক্রি করে দাও। তাতে টিভিটা কেনা হয়ে যাবে। ছেলে মেয়েদের প্যানর-প্যানর ভাল লাগছে না।’’ রাশেদের মা তেলে-বেগুনে শুধু জ্বলে ওঠেনি, জ্বলে পুড়ে যাওয়ার যোগান হয়েছে। রাশেদের বাবা আর বাক্য রচনা করার সাহস পাননি। তাতেই ক্ষান্ত হতে হয়েছে।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। ইসলাম সাহেব ফজরের নামায পড়তে মসজিদে বেরিয়ে আর ঘরে ঢুকেননি। সোজা চলে গেলেন বেড়ি বাঁধের ওপর হাঁটতে। সকাল বেলার হাঁটা (মর্নিং ওয়াক)। যদিও তিনি সকাল বেলা হাঁটেন না। আজ বের হয়েছেন। ছেলে মেয়েদের ফাঁকি দিতে। হাঁটাহাঁটি সেরে অন্য আর একটি কাজ সেরে জুমা’র নামাজ সেরে একবারে ঘরে এসেছেন। দিনের তখন দেড়টা বেজে গেছে। অনেকক্ষণ ঘরে বাবাকে ছুটির দিনে না পেয়ে মেয়ে দুটি বেশ ভয় পেয়েছিল। আর সেই ভয়ে টিভি কেনার কথাও বলে নি। ইসলাম সাহেব মেয়েদের মনের অবস্থা বুঝে নিলেন। কিছু বললেন না। চুপচাপ ভাত খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। মনের ভেতরে একটি কষ্ট নড়াচড়া করছে। কাউকে কিছু বলতে পারছে না।
সন্ধ্যা বেলা বন্দর টিলার একটি ইলেক্ট্রনিক্স মার্কেটে রাশেদের বাবা ঢুকলেন। কয়েক দোকানে কথা বলে দেখলেন একটি চৌদ্দ ইঞ্চি রঙিন টিভির দাম বারো হাজার টাকা। এত টাকা পাবেন কোথায়! তারপরও দোকানের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। হঠাৎ একটি কোণার দোকানের দিকে চোখ পড়লো। ‘এখানে কিস্তিতে টিভি বিক্রি করা হয়’। আস্তে আস্তে ঢুকলেন। মধ্য বয়স্ক দোকানি সালাম দিলেন ইসলাম সাহেবকে। ‘‘কী চায় চাচা?” দোকানি প্রশ্ন করলেন। ইসলাম সাহেব ধীরে জানতে চাইলেন টিভি কীভাবে কিস্তিতে বিক্রি করা হয়। দোকানি শর্ত বললেন- ‘‘শক্ত চাকরি থাকতে হবে, আইডি কার্ডের কপি দিতে হবে, দুই জন চেনা জানা লোকের স্বাক্ষর সহ আমাদের ফর্ম পূরণ করতে হবে, একজন টাকার গ্যারান্টার লাগবে, ইত্যাদি ’’ ইসলাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘চৌদ্দ ইঞ্চির দাম কত পড়বে’’। ‘‘ছয় কিস্তিতে নিলে পনের হাজার টাকা মোট পড়বে। সমান ছয় ভাগে দিতে হবে।’’ দোকানির কাছ থেকে পরে এসে এক সময় নিয়ে যাবে বলে বিদায় নেন ।
তিন দিনের মধ্যে সকল শর্ত পূরণ করার জন্যে রাশেদের বাবা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কাগজ- পত্র, গ্যারান্টার, স্বাক্ষী সব কিছু একপ্রকার প্রস্তুত করে নিলেন। মাটির ব্যাংকে জমা টাকা হবে হাজার দেড়েক মতো। ভেঙ্গে ফেললেন। সতের’শ টাকা পেলেন। বাকি টাকা পরদিন অফিসের সহকর্মীর কাছ থেকে চাইলেন। সহকর্মী বাচ্চাদের আবদারের কথা শুনে পরদিন টাকা দিলেন।
ইসলাম সাহেব আজ মহা খুশি। তার ছেলে মেয়ের আবদার মেটাতে পারবেন। যেভাবে হোক কিস্তির টাকা তিনি মাসে মাসে শোধ করবেন। প্রয়োজনের খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড় ছয় মাসের জন্য দেখে শুনে চলবেন। অফিস থেকে ফিরতি পথেই ইসলাম সাহেব কিস্তিতে টিভি কিনতে দোকানটিতে গেলেন। গ্যারান্টার তার সহকর্মী কমল বাবু, যিনি টাকা ধার দিয়েছেন। সবকিছু মিটমাট করে অবশেষে ছয় কিস্তিতে টিভি কিনে বাড়ি ফিরলেন। বাড়িতে পড়ে গেল হৈ হৈ রৈ রৈ কান্ড। সে এক আনন্দের মহাপ্লাবণ। এরকম আনন্দ ইসলাম সাহেব তার ছেলেমেয়েদের কখনো দিতে পারেন নি। আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেল, গলাটাও কেমন যেন ধরে এলো। হাতের ওপরের অংশ দিয়ে চোখ মুছলেন।
টিভি কেনার পরদিন ছোট মেয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করলো, পড়ায় মন দিল। অন্যের ঘরে টিভি দেখার দিন যেন তাদের শেষ হলো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাদের এই আনন্দ যেন সইলেন না। নিয়তি তাদের সাথে যেন পরিহাস করলো। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ঘটে গেল অনাকাঙ্খিত এক দুর্ঘটনা। কারো কাছে কিছুই যেন বিশ্বাস হতে চাইলো না পুরো ঘটনা। যেন স্বপ্নের ঘোরে ঘটে গেছে এই ঘটনা।
সকাল বেলা, শুক্রবার। সকাল বেলার অনুষ্ঠান দেখার জন্যে ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল নাবিলা। কিন্তু এ কি ! শো-কেস এর উপরই তো টিভি টা ছিল রাতে। ভোরে ওঠতেই এখন কোথায় গেল ! যাদু না তো ! স্বপ্ন না তো! ডাকা ডাকি করে সবাইকে এক ঘরে আনলো নাবিলা। কারো মাথায় কাজ করছে না। এ কী বিষয়! নাবিলা সবার আগে লক্ষ্য করেছিল ঘরের পেছনের দরজা ভোর বেলা খোলা দেখেছে। ভেবেছিল হয়তো কেউ ওঠে আর বন্ধ করেনি। বিষয়টি নাবিলা বললে বোঝার আর বাকি থাকলো না যে যখন গভীর ঘুমে সবাই আচছন্ন তখনই টিভিটা চুরি গেছে।
রাশেদের মা হৈ চৈ শুরু করে পুরো বাড়ি মাথায় নিলেন। ‘আয়না-পড়া’ আনতে বললেন। আয়নায় না-কি চোরকে দেখা যায়। নাবিলার বাবার মাথায় যেন শুধু আকাশ না, পুরো পৃথিবীটাই ভেঙ্গে পড়লো। ঘরের এক কোণায় গিয়ে মোড়ায় বসে নিজের চুল টানতে শুরু করলেন। নিজে নিজে বললেন, ‘‘যা চুরি গেছে তা আর পাওয়া তো যাবেই না। শুধু ছয় কিস্তির টাকা গুলো পরিশোধ করে যেতে হবে!’’

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই