চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

সার্ত্র বিষয়ক ভূমিকা, অস্তিত্ববাদ, আমাদের ভূগর্ভবাসের বয়ান


সার্ত্র বিষয়ক ভূমিকা, অস্তিত্ববাদ, আমাদের ভূগর্ভবাসের বয়ান।এনামুল রেজা

স্তিত্ববাদ আমাদের বলে, ঘটনার চেয়ে মুখ্য ব্যক্তি মানুষ, সামাজিক সংকটের প্রথম গৃহ ব্যক্তি মানুষের মন। যে কারণে একজন মানবতাবাদি লেখক প্রথমে যদি সামাজিক সংকট এড়িয়ে ঢুকে যেতে চান সোজাসুজি মানুষের মনের অলিগলিতে, তার আপন দুঃখ-দুর্দশায়, তখন সেই আখ্যানটি হয়ে উঠতে পারে আমাদের অতি আপন, নিকটস্থ বয়ান। আজ থেকে বহুদিন আগে যখন ফিওদর দস্তয়েভস্কির নোটস ফ্রম দা আন্ডারগ্রাউন্ড পড়েছিলাম, উত্তেজনা বশত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার মগজ থেকে হারিয়ে যায়।
নিরন্তর অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে, এই ধরণের মানুষ আমাদের চারপাশে মেলা আছে। দোকানে সদাই কিনতে গেলে যে লোকটার মনে হয়, দোকানি তাকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য ক্রেতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা রাস্তায় হাঁটার সময় মনে একটা শংকা কাজ করে, “সবাই কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে, নিশ্চয়ই বাজে দেখাচ্ছে আমাকে!”
আজকের সকালটি যখন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে জ্যাঁ পল সার্ত্রের কাছে, মনে হচ্ছে তাকে নিয়ে লিখবার সময় হয়েছে আমার, বহুদিন পূর্বে লেখা পূর্বোক্ত উপন্যাসের আলোচনাটিকে আমি নিতে পারছি ভূমিকা হিসেবে। সুতরাং লেখাটি ঘষামাজাও হল, আরেকবার পাঠের আস্বাদে নিজেকে আনন্দদানও করা গেল।
নিরন্তর অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে, এই ধরণের মানুষ আমাদের চারপাশে মেলা আছে। দোকানে সদাই কিনতে গেলে যে লোকটার মনে হয়, দোকানি তাকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্য ক্রেতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা রাস্তায় হাঁটার সময় মনে একটা শংকা কাজ করে, “সবাই কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে, নিশ্চয়ই বাজে দেখাচ্ছে আমাকে!”
সবচেয়ে বড় সংকট হয় জমজমাট কোন আড্ডায়। ওই লোকটা ভাবে, তার কথা কেউ তেমন শুনছেনা, তার দিকে কেউ খেয়াল করছেনা! মানব চরিত্রের বড় জটিল কিন্তু স্বাভাবিক একটা দিক হচ্ছে এই অস্তিত্ব সংকটে ভোগা। মজার বিষয় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষ কিন্তু এ ধরণের কোন ঝামেলায় পড়েনা,  উচ্চবিত্তও না, এ সমস্যার মূল ভুক্তভোগী হল মধ্যবিত্ত কিংবা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্তরা। পুঁজির প্রকোপ এইখানে মলম হিসেবে কাজ করতে পারে যেমন দারিদ্যের অতি চুড়ান্ত পর্যায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে মরিয়া করে তোলে, সে ব্যক্তিত্ব সংঘাতকে গুঁড়িয়ে দিয়ে যায় কিংবা অদরকারি বানিয়ে ফেলে।
হঠাৎ এইসব নিয়ে কেন লিখছি? লিখছি কারণ লিখতে বাধ্য হচ্ছি। রাশিয়ান ঔপোন্যাসিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির “নোটস ফ্রম দি আন্ডারগ্রাউন্ড” পড়া শেষ করে কীভাবে বসে থাকা যায়? দু’কলম যে লিখতে শিখেছে, সে লিখবেই। যে লিখতে পারছেনা, সে থম মেরে বসে থাকবে পর পর দু’দিন!
নিয়তির সন্তান মানুষ মাঝে মাঝে নিজ হাতে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। আপন দুর্ভাগ্য সে খাল কেটে কুমির আনার মতো নিজের জীবনে বয়ে আনে, সর্বনাশা মনের বিচিত্র সব অনুভবে জর্জরিত হয়েই। তাহলে দুঃখে জর্জরিত মানুষ শেষ পর্যন্ত অভিযোগের আঙুল কার দিকে তুলবে? নিজের দিকে কি আঙুল তোলা যায়? ব্যক্তিত্বের দ্বন্দে ভুগতে ভুগতে তখন সে নিজেকে ভাবতে থাকে অন্ধকার গর্তে বাস করা ইঁদুরের মতো। নিজের গল্পগুলো তখন সে বলতে থাকে ওই গর্তে বসে বসেই!
বইটি দু’পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব “ভুগর্ভবাস” এ নামহীন এক সরকারি কর্মচারি নিজের মনের ভিতর চলতে থাকা চিন্তা ভাবনা আপনার সামনে উগরে দেবে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। নিজের বক্তব্য সম্পর্কে তার মতামত হলো, আপনার দাঁতে ব্যাথা হলে প্রথমে আপনি অসম্ভব যন্ত্রণা টের পাবেন, পেতে পেতে এক পর্যায়ে কিন্তু আপনি ওই অসম্ভব যন্ত্রণা থেকেই আনন্দ খুঁজে পাবেন!
বইয়ের দ্বিতীয়াংশ হলো “তুষারপাতের গল্প”। সেই সময়ের গল্প যখন এ গল্পের নামহীন নায়কের বয়স ২৪। ওই যে দাঁতে ব্যাথার উদাহরণ দিলাম, গল্পটা দাঁড়িয়ে যাবে ওই উদাহরণের উপরেই। কী সেই বিচিত্র নিয়তির গল্প? বিশ্বসাহিত্যে অস্তিত্ববাদ বিষয়টির সূচনা হয় দস্তয়েভস্কির এ উপন্যাস থেকে যদিও পরবর্তিকালে তার সুবিখ্যাত ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট কিংবা শেষ উপন্যাস ব্রাদার্স কারামাজোভে তিনি বিষয়টিকে আরও বিকশিত করেন এবং সমাজে টিকে থাকবার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাক্তি সংকট আর তার সমাধানের দ্বারা আঁকেন মানবাত্মার মহাসড়ক।
অস্তিত্ববাদ বিষয়টা পুঁজিবাদী পৃথিবীতে উদ্ভব হওয়া সম্ভব ছিলনা কেননা এই যে নিজেকে নিয়ে ভাবা, নিজের সমস্যা উদঘাটন আর তার সমাধান, এইসবের মাঝদিয়ে গোটা সমাজের বদলে যাওয়ার প্রচেষ্টা কেবলমাত্র নিপীড়িত মানুষের মগজ থেকেই বেরুনো সম্ভব। তৎকালীন জারের শাসনামলে সাধারণ মানুষের যে নিত্য যাতনা, তার মেটাফোরিক প্রতিফলন তাই আমরা দেখতে পাই দস্তয়েভস্কির এ ক্ষুদ্রাকার উপন্যাসটিতে। যদিও পরবর্তিতে ফরাসি দেশে বসে সার্ত্রের মতন দার্শনিক অস্তিত্ববাদকে আরও বিকশিত করেন, সেটা গোটা পৃথিবীতে হয়ে ওঠে আরও জনপ্রিয়।
চলবে.........

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই