মরীচিকার টানে । হামিদ আহসান
১.
এয়ারপোর্টে দেখে প্রথমে চিনতেই পারি নি ইসমত আরাকে। তিন বছর আগে শেষবার দেখেছি তাকে। এই তিন বছরে এ-কী অবস্থা হয়েছে শরীরের। অথচ যেমন রূপবতী তেমনি স্বাস্থ্যবতী মেয়ে ছিল ইসমত আরা। গ্রামের ছেলেপেলে তাকে শাবনুর আপা ডাকত। সেই উচ্ছ্বল চঞ্চল তরুণীটি এখন আর আগের মত নেই। এইডস আক্রান্ত আফ্রিকান কোন নারীর মতো লাগছে। একদম কঙ্কালসার অবস্থা।
ঢাকার শহজালাল অন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আগত যাত্রীদের বের হওয়ার জন্য যে পথ আমি সেখানে আনমনে পায়চারী করছিলাম। একটা ট্রলি ঠেলে ঠেলে একটি মেয়ে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল আমি ভাবলাম কে না কে। আমি এক দিকে সরে গিয়ে তাকে যাবার রাস্তা করে দিলাম। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম মেয়েটি ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে এবং অনেকটা শব্দ করেই কাঁদছে। কান্নার শব্দ শুনেই আমি ভাল করে তাকাই তার দিকে এবং চিনতে পারি তাকে।
ইসমত আরা আমার চাচাতো বোন। ভালবাসত পাশের গ্রামের ছেলে কাজলকে। প্রেমের টানে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছিল ঢাকায়। ঢাকায় এসে বিয়ে করেছিল । উভয়ের পরিবারই পরে মেনে নেয় তাদের বিয়ে। সুখের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু “সুখেরও লাগিয়া এ ঘর বাধিনু অনলে পুড়িয়া ছাই”-এই কথা বাস্তব হয়ে দেখা দেয় তার জীবনে। আগুন কেড়ে নেয় তার সব সুখ। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ঢাকায় কাজ করত। পোষাক কারখানায়। দুজনেই এস এস সি পাশ ছিল। একটু লেখাপড়া জানা থাকায় তুলনামূলক ভাল কাজই করত তারা। এক সন্ধ্যায় জীবন ইসমত আরার কাছ থেকে কেড়ে নেয় তার সর্বস্ব। এক সন্ধ্যায় ভয়াবহ আগুন লাগে সেই পোষাক কারখানায় যেখানে তার স্বামীটি কাজ করত। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ভালবাসার মানুষটিকে হারিয়ে একা হয়ে পড়ে ইসমত আরা আর তাদের পাঁচ এবং তিন বছরের ছেলে দু’টি অকালেই চির বঞ্চিত হয়ে যায় পিতৃ স্নেহ থেকে।
এর পর ইসমত আরার আর শহরের কাজে মন বসেনি। ফিরে আসে গ্রামে। গ্রামে এসে স্বামীর ভিটাতেই উঠেছিল। শ্বশুর শাশুরি বেঁচে নেই। এক দেবর আর এক ননদ তার। দেবর বউ বাচ্চাসহ এই বাড়িতেই থাকে। আর ননদেরও বিয়ে হয়েছে একই গ্রামেই। কিন্তু স্বামীর ভিটায় বেশি দিন থাকা হল না তার। কারণ হল কিছু টাকা। স্বামীর মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার এবং বিজিএমইএর কাছ থেকে মোট দুই লাখ টাকা পেয়েছিল ইসমত আরা। সেই টাকাই শ্বশুর বাড়িতে থাকতে দিল না তাকে। টাকাটা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিল ইসমত আরা। ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই কাজটা করেছিল সে। নিজে টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেদের নিয়ে বেঁচে থাকবে, তাদের লেখা পড়া শিখাবে এমনই ছিল পরিকল্পনা।
কিন্তু মাঝখান দিয়ে ঝামেলা লাগিয়ে দিল তার দেবর আর ননদ। ভাই বোন মিলে ঢোল পিটাতে লাগল, ইসমত আরা পরের মেয়ে, জোয়ান মেয়ে, যে কোনো দিন বিয়ে বসে চলে যাবে আরেক বেটার ঘরে। আমরাই এতিম বাচ্চা দু’টির প্রকৃত অভিভাবক, তাই ভাইয়ের ক্ষতিপূরণের টাকা আমাদের জিম্মায় দিতে হবে। ভাইয়ের এতিম শিশু দু’টিকে আমরাই দেখে রাখব। ইসমত আরা ভালই বুঝতে পারে তাদের মতলবটা। আসলে মায়া তো বাচ্চাদের জন্য না, মায়া হল টাকার জন্য। তাদের চোখ পড়েছে ঐ দুই লাখ টাকার উপর। কীভাবে সেই টাকাটা হাতিয়ে নিবে সেই ধান্ধায় নেমেছে ভাই বোন।
এক পর্যায়ে ইসমত আরা ভাই ভাবীর সাথে পরামর্শ করে চলে আসে বাবার বাড়িতে। ভাই আর ভাবী ছাড়া বাড়িতে তার বৃদ্ধা মা মানে আমার চাচিও আছেন। ভাই-ভাবী দুজনেই তাকে বেশ ভাল ভাবেই গ্রহণ করল। এমন কি ভাই নিজের টাকায় তাকে একটা সেলাই মেশিনও কিনে দিল।
সেলাইয়ের কাজটা বেশ ভালই পারে ইসমত আরা। তার কাজে কাস্টমার বেশ খুশি। ঘরে থেকেই গ্রামের মেয়েদের জামা কাপড় সেলাই করে আয় রোজগার যা হচ্ছিল তাতে দিন চলে যাচ্ছিল এক রকম। বড় ছেলেকে স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। তার চোখে মুখে এখন কেবল একটাই স্বপ্ন খেলা করে, আর তা হল ছেলে দুটোকে লেখা-পড়া শেখাবে। অনেক বড় হবে তারা। তার এখন কেবল একটাই ভাবনা, ছেলে দুটো তার আর কাজলের স্বপ্নগুলো পূরণ করবে একদিন।
সুতরাং খারাপ চলছিল না তার জীবন। সকল নষ্টের মূল ঐ আদম ব্যাপারীর দালাল শরীফ মিঞা। একদিন বিকেলে সেলাই মেশিনে কাজ করছিল ইসমত আরা। সে সময় তার সাথে দেখা করতে আসে তার শ্বশুর বাড়ির গ্রামের আদম ব্যবসার দালাল শরীফ মিঞা। চা বিস্কুট খেতে দেয় তাকে ইসমত আরা। চা খেতে খেতে শরীফ মিঞা তাকে বুঝায়-
‘গার্মেন্টস ভিসা, পঁচিশ হাজার টাকা বেতন; তার উপর আবার ওভারটাইমও আছে। বছরে দুই ঈদে বোনাস পাইবেন, দেশে আসার জন্য ছুটি পাইবেন বছরে একমাস। পাঁচটা মাত্র ভিসা পাইছি। প্যাসেঞ্জার যাইতে চায় কম হলেও পাঁচ পাঁচে পঁচিশ জন। দুই লাখ চাইলেও রাজি। কিন্তু আমি শরীফ মিঞা টাকার কাঙ্গাল না। মানুষের উপকার করতে পারলে আমি যে সুখ পাই সেই সুখ টাকা দিয়া কেনা যায় না। তাই আপনার উপকার করতে চাই। ছেলে দুইটার ভবিষ্যতের কথা তো আপনাকেই চিন্তা করতে হবে। ঘরে বসে মেশিন চালিয়ে পারবেন ছেলেদের উচ্চ শিক্ষিত করতে? দেখেন চিন্তা করে। আপনার তো আর আজীবন বিদেশে থাকা লাগবে না। এক সময় টাকা পয়সা জমিয়ে দেশে এসে পায়ের উপর পা তুলে খাবেন। দেখেন চিন্তা করে। আপনি গেলে আমি দেড় লাখেই দিয়ে দিব ভিসা। আমার লাভের দরকার নাই। আপনি আমার গ্রামের বউ, আপনি ছেলে-পেলে নিয়ে সুখে থাকবেন এতেই আমি খুশি।’
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সে কিছুটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। এক পর্যায়ে আমার কাছেও এসেছিল পরামর্শের জন্য। সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বলল, ‘আজিম ভাই আপনি শিক্ষিত মানুষ। কলেজে পড়ান। নানা কিছুর খোঁজ খবর রাখেন। আপনি ভাল বুঝবেন। কী করি বলেন তো?’
আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম যেতে। নিজের বিবেকের কাছে সম্পূর্ণ সৎ থেকেই আমি সেটা করেছিলাম। কিন্তু তার মুখ দেখেই বুঝে গেলাম আমার নিষেধ করাটা তার পছন্দ হয় নি। আমার সব কথা শেষ হওয়ার আগেই সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল। ইসমত আরার এই দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারি না। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর ইসমত আরা বলতে লাগল-
‘আজিম ভাই! আমার কথা ভেবে ভেবে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন? আমি কোনো দিনই আপনার হব না। এটা এখন আর সম্ভবও না! তাছাড়া আমি তো আপনার যোগ্যও নই। আপনি আপনার উপযুক্ত কাউকে ঘরে এনে সংসার পাতেন। চাচির মনে কত কষ্ট আপনার জন্য! আপনি আমার চাচাতো ভাই। আমিও আপনাকে সুখি দেখতে চাই। আমার মধ্যে আপনি এমন কী পাইলেন আমি বুঝি না। আমি তো অতি সাধারণ বলতে গেলে অশিক্ষিত একটা মেয়ে। আর আপনি কতো লেখাপড়া করেছেন। আমার জন্য কেন নিজের জীবনটা নষ্ট করবেন?’ একটানা কথাগুলো বলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। চোখ দু’টি তার কেমন ভেজা ভেজা মনে হল। গলাটাও যেন ধরে এসেছে।
একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম চমকে উঠার মত একটি প্রতিবেদন। প্রতিবেদনটি বলছে, “অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এমন একজন ব্যক্তি লেবাননে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে আছেন যার স্ত্রীর নিজেরই গৃহকর্মী নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে। লেবানন প্রবাসী দুই লাখ বাংলাদেশি নারীর সুখ-দু:খ দেখভালের দায়িত্ব আজ সেই রাষ্ট্রদূতের। গৃহপরিচারিকার স্বার্থ রক্ষায় যিনি নিজের ঘরেই ছিলেন উদাসীন, তিনি কী করে আজ লেবাননের হাজার হাজার স্বদেশী নারীর কান্না থামাবেন”?









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন