কনসেনট্রেশন ক্যাম্প | আসাদুজ্জামান খান জিনজির
‘দিদি, ওগুলো কি শাপলা ফুল?’
অরুণা ওদের বাড়ীর পাশে যে বড় দিঘিটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশে উড়তে থাকা অচেনা পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবছে, এই পাখিগুলোর নাম কী? অতিথি পাখি না তো? পানির সামনে এলেই অরুনার কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে চলে যায় মনের অনেক গভীরে। যেখানে সে খুবই একা এবং বিষণ্ন একটা মানুষ। শ্যামলকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল অরুণা, ‘কেন পানির কাছে এলেই তার মন খারাপ হয়!’
শ্যামল বলেছিল, ‘পানি শুধু তোমাকে না, সব মানুষকেই বিষন্ন করে দেয়। কারণ তখন তার মনে পড়ে যায় এই পানি থেকেই সে তৈরী হয়েছে। শিকড়ের মায়ার টান বলতে পার।’
শ্যামল দু’বছর হল ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমএ শেষ করেছে বাংলা সাহিত্য নিয়ে। তুখোড় মেধাবী এমনটা তাকে কোন ভাবেই বলা যায় না। কারণ তুখোর মেধাবীরা পড়া লেখার পাট শেষ করেই ধুম করে চাকুরি পেয়ে যায়। শ্যামল এখনও পায়নি। সে রাত জেগে কবিতা লিখে আর দিনভর রোদে হেটে হেটে খোঁজ করে একটা দুই হাজার টাকা বেতনের চাকুরি। বাংলা সাহিত্য নিয়ে এমএ করে শ্যামল কি চাকরী করবে এটা ভেবেই পায়না অরুণা। যে ছেলে ছয় সাত বছর রবীন্দ্রনাথ, মানিক আর জীবনানন্দর কাছে প্রকৃতি আর মানুষ জীবনের মায়া শিখেছে, সে কি চাকুরি করবে এই মায়াহীনতার বাজারে? সে বিচারে বলা যায়, অনার্সে অরুণা অর্থনীতি নিয়ে বেশ ভাল করেছিল। এমএ শেষ করার পর আশা করা যায় সে ভাল একটা চাকরী খুব সহজেই জুটিয়ে নিতে পারবে। অর্থ আয়ের জন্য অর্থনীতি খুব ভাল একটা সাবজেক্ট। সারা দুনিয়া এই সহজ কথাটা বুঝলেও শ্যামল বুঝে না। তার মন পড়ে থাকে মায়া ভালবাসাতে। সামান্য একটা পিঁপড়ার জন্যও তার সীমাহীন মায়া! এই জন্যই কি শ্যামলকে এত ভালবাসে অরুণা? অথচ তিন বছর এক সাথে ঘুরাঘুরি করেও ‘আমি তোমাকে খুব ভালবাসি শ্যামল’ এই কথাটা বলতে পারেনি একবারও। শ্যামলও কখনও বলেনি। ২৫ শে মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর অরুণা যখন গ্রামে চলে আসে পরিবারের সাথে তখন শ্যামল অনেকটা সময় বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওর সামনে। একবারও বলেনি, ভাল থেকো অরুণা। মনের গভিরে একা দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবতে ভাবতে অরুণার চোখে পানি চলে আসে। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে এ জীবনে শ্যামলের সাথে আর দেখা হবে না। কেন এমনটা মনে হচ্ছে? কেন? অরুণার জানা নেই।
আট বছরের ছোট ভাই অনুপমের প্রশ্ন শুনে খুব কষ্টে মনের গভির থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলো অরুণা। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘না’রে, ওগুলো পদ্ম ফুল। শাপলা সাদা রঙ এর হয়’।
অনু আবার প্রশ্ন করে, ‘শাপলা ফুল সাদা রঙ এর হয় কেন দিদি? লাল হয় না কেন?’
অরুণা লক্ষ করেছে অনু ইদানিং খুব প্রশ্ন করা শিখেছে। দু’চোখে যা দেখে তাই নিয়েই তার শতেক প্রশ্ন। গ্রামে চলে আসার পর প্রশ্ন করা আরও বেড়েছে।
অরুণা এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ‘জানি না! এত প্রশ্ন করিস না তো! তারচে চল, ওই ঝাকড়া গাছটার নিচে গিয়ে বসি। পাখিদের মাছ খাওয়া দেখি। আয়।’
অরুণা ছোট ভাইয়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে ঝাকড়া গাছটার দিকে হাটা ধরল। সাথে ওদের ছায়ারাও।
‘যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস রে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে মারে এবং মরে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। এ হল হারানোর খেলা। একবার হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে জীবন হারায় জীবনকে। তবে আমি তোকে হারাতে দিব না ভাই। তুই সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবি। তোর দিদি তোকে হারাতে দিবে না কোন ভাবেই।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেন যেন অরুনার চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করল।









মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন