চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

কনসেনট্রেশন ক্যাম্প | আসাদুজ্জামান খান জিনজির  


‘দিদি, ওগুলো কি শাপলা ফুল?’
অরুণা ওদের বাড়ীর পাশে যে বড় দিঘিটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশে উড়তে থাকা অচেনা পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবছে, এই পাখিগুলোর নাম কী? অতিথি পাখি না তো? পানির সামনে এলেই অরুনার কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে চলে যায় মনের অনেক গভীরে। যেখানে সে খুবই একা এবং বিষণ্ন একটা মানুষ। শ্যামলকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল অরুণা, ‘কেন পানির কাছে এলেই তার মন খারাপ হয়!’
শ্যামল বলেছিল, ‘পানি শুধু তোমাকে না, সব মানুষকেই বিষন্ন করে দেয়। কারণ তখন তার মনে পড়ে যায় এই পানি থেকেই সে তৈরী হয়েছে। শিকড়ের মায়ার টান বলতে পার।’
শ্যামল দু’বছর হল ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমএ শেষ করেছে বাংলা সাহিত্য নিয়ে। তুখোড় মেধাবী এমনটা তাকে কোন ভাবেই বলা যায় না। কারণ তুখোর মেধাবীরা পড়া লেখার পাট শেষ করেই ধুম করে চাকুরি পেয়ে যায়। শ্যামল এখনও পায়নি। সে রাত জেগে কবিতা লিখে আর দিনভর রোদে হেটে হেটে খোঁজ করে একটা দুই হাজার টাকা বেতনের চাকুরি। বাংলা সাহিত্য নিয়ে এমএ করে শ্যামল কি চাকরী করবে এটা ভেবেই পায়না অরুণা। যে ছেলে ছয় সাত বছর রবীন্দ্রনাথ, মানিক আর জীবনানন্দর কাছে প্রকৃতি আর মানুষ জীবনের মায়া শিখেছে, সে কি চাকুরি করবে এই মায়াহীনতার বাজারে? সে বিচারে বলা যায়, অনার্সে অরুণা অর্থনীতি নিয়ে বেশ ভাল করেছিল। এমএ শেষ করার পর আশা করা যায় সে ভাল একটা চাকরী খুব সহজেই জুটিয়ে নিতে পারবে। অর্থ আয়ের জন্য অর্থনীতি খুব ভাল একটা সাবজেক্ট। সারা দুনিয়া এই সহজ কথাটা বুঝলেও শ্যামল বুঝে না। তার মন পড়ে থাকে মায়া ভালবাসাতে। সামান্য একটা পিঁপড়ার জন্যও তার সীমাহীন মায়া! এই জন্যই কি শ্যামলকে এত ভালবাসে অরুণা? অথচ তিন বছর এক সাথে ঘুরাঘুরি করেও ‘আমি তোমাকে খুব ভালবাসি শ্যামল’ এই কথাটা বলতে পারেনি একবারও। শ্যামলও কখনও বলেনি। ২৫ শে মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর অরুণা যখন গ্রামে চলে আসে পরিবারের সাথে তখন শ্যামল অনেকটা সময় বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওর সামনে। একবারও বলেনি, ভাল থেকো অরুণা। মনের গভিরে একা দাঁড়িয়ে কথাটা ভাবতে ভাবতে অরুণার চোখে পানি চলে আসে। ওর কেন জানি মনে হচ্ছে এ জীবনে শ্যামলের সাথে আর দেখা হবে না। কেন এমনটা মনে হচ্ছে? কেন? অরুণার জানা নেই।
আট বছরের ছোট ভাই অনুপমের প্রশ্ন শুনে খুব কষ্টে মনের গভির থেকে ধীরে ধীরে উঠে এলো অরুণা। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘না’রে, ওগুলো পদ্ম ফুল। শাপলা সাদা রঙ এর হয়’।
অনু আবার প্রশ্ন করে, ‘শাপলা ফুল সাদা রঙ এর হয় কেন দিদি? লাল হয় না কেন?’
অরুণা লক্ষ করেছে অনু ইদানিং খুব প্রশ্ন করা শিখেছে। দু’চোখে যা দেখে তাই নিয়েই তার শতেক প্রশ্ন। গ্রামে চলে আসার পর প্রশ্ন করা আরও বেড়েছে।
অরুণা এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ‘জানি না! এত প্রশ্ন করিস না তো! তারচে চল, ওই ঝাকড়া গাছটার নিচে গিয়ে বসি। পাখিদের মাছ খাওয়া দেখি। আয়।’
অরুণা ছোট ভাইয়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে ঝাকড়া গাছটার দিকে হাটা ধরল। সাথে ওদের ছায়ারাও।
‘যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস রে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে মারে এবং মরে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। এ হল হারানোর খেলা। একবার হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে জীবন হারায় জীবনকে। তবে আমি তোকে হারাতে দিব না ভাই। তুই সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবি। তোর দিদি তোকে হারাতে দিবে না কোন ভাবেই।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেন যেন অরুনার চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করল।
এপ্রিল মাসের পনের তারিখ। রাত আটটা। অরুণার বাবা মা বাংলো ঘরে জরুরী আলোচনায় বসেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে অরুণার মামা অতনু। আলোচনার বিষয় বাংলাদেশ ত্যাগ করা। অতনু তার পরিবার নিয়ে কাল খুব ভোরে বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া চলে যাবে। সাথে অরুণারাও যাবে কিন্তু কিভাবে কি করবে এই নিয়েই আলোচনা চলছে। বাংলো ঘরের সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করল, দেশের এই অবস্থায় এখানে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারীরা নির্বিচারে মুসলমানদের তো মেরে ফেলছেই, সেই সাথে হিন্দু পেলে তাদেরকে আগে মারছে। পাকবাহিনীর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে দেশ থেকে সব হিন্দু মেরে শেষ করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর সাথে যোগ হয়েছে আবার রাজাকার বাহিনী। তাদের সহযোগীতায় পাকবাহিনী যেখানেই হিন্দু পাচ্ছে সেখানেই গিয়ে হামলে পড়ছে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতন। যৌবনবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। অরুণাকে নিয়ে তাই দুশ্চিন্তার শেষ নেই ওর বাবার। কখন কি হয় কিছুই বলা যাচ্ছে না। চারদিকে ভয়ানক সব খবরের ফিসফিসানি। দম আটকানো অবস্থা। দুই মাইল দূরে বায়রা বাজারে পাক মিলিটারিরা ক্যাম্প ফেলেছে গত দিন। অরুণার বাবা মায়ের ভয়ে দম আটকানোর পিছনে এই ক্যাম্পটাও দায়ী। যে কোন দিন এখানেও আক্রমন হতে পারে।
সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, আপাতত জান বাঁচানোটাই প্রধান কাজ। জমি জমা যা আছে থাকুক পড়ে। এসব নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নাই এখন। দেশ স্বাধীন হলে তখন আবার ফিরে আসা যাবে। অরুণার মা’কে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নেয়ার জন্য বলল অরুণার বাবা। আর দেরী করার কোন মানে হয় না। আরও আগেই ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার দরকার ছিল। বিরাট ভুল হয়ে গেছে। কাল যেহেতু খুব ভোরে উঠতে হবে তাই সবাইকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বলল অরুণার বাবা। সবাই যার যার ঘরে চলে গেল। অতনুও ফিরে গেল তার বাড়ীতে। সবাইকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বললেও অরুণার বাবা নিজে ঘুমাতে পারল না। অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগল ঘরের বারান্দায়। আর অজানা ভয়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠতে লাগল।
অরুণার বাবা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবারের সবাইকে বর্ডার ক্রস করিয়ে দিয়ে সে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবে। পরিবারের কেউ এই তথ্যটা এখনও জানে না। ইচ্ছে করেই সে জানায়নি। এত ভয় ভীতির মধ্যে আবার নতুন করে সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায়নি। সে নীরবে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবে। তবে যাওয়ার আগে আগে রাণীকে অবশ্যই বলে যাবে। যে মেয়েটা দীর্ঘ পচিশ বছর তার সাথে ঘর সংসার করল, ছানা পোনা আর ছায়া দিল, তার অধিকার আছে জানার। তবে সে জানলেও বাঁধা দেবে না। রাণী জানে, যে দেশের আলো বাতাস গায়ে মেখে তার স্বামী এত বড় হয়েছে, তার দুর্দিনে পাশে দাঁড়াবে না এমন নিমক হারাম সে কখনই হতে পারবে না। জননী জন্মভূমি, তার পাশে যদি তার সন্তানরা না দাঁড়ায় তাহলে আর কে দাঁড়াবে? ঢাকা থেকে যখন গ্রামে আসছিল তখন পথে সে দেখেছে পাক বাহিনী কি ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সমস্ত ঢাকা শহর জুড়ে। ওদের এই নির্মম ধ্বংসযজ্ঞই প্রমাণ করে, ওরা কখনই বাঙ্গালীদের আপন ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চোখে পূর্ব পাকিস্তান ছিল যৌবনবতী দরিদ্র সুন্দরী রমণীর মত। যার মায়া ভরা অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে শুধু ধর্ষণই করে গেছে ওরা। ওদেরকে আর ছাড় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। মুজিবের ডাকে সারা বাংলা আজ একত্রিত। দেশ স্বাধীন হবেই, হবেই। কোন সন্দেহ নেই!
অরুণা ওর ঘরে ছোট ভাই অনুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। তবে কারও চোখের পাতা এক হচ্ছে না। ভাই বোন দুজনেই জানালা গলে চলে আসা রুপালী চাঁদের আলো গায়ে মেখে জেগে আছে। অরুণা মনে করার চেষ্টা করছে আজ ভরা পূর্ণিমার রাত কিনা। কারণ ভরা পূর্ণিমাতেই চাঁদের আলো এত তীব্র আর অস্থির ধরনের সুন্দর হয়। গৌতম বুদ্ধ নাকি এই ভরা পূর্ণিমার জোছনাতে ভিজতে ভিজতেই গৃহত্যাগ করেছিল। একজন মানুষকে গৃহত্যাগী করতে বাধ্য করার মত ক্ষমতা কি এই তীব্র জোছনার আছে আসলে? কে জানে, হয়ত আছে!
ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল অরুণা। চাঁদের আলো অনুর মুখটাতে যেন অসম্ভব এক মায়ার প্রলেপ মাখিয়ে দিয়েছে। তবে ওর মুখে সব সময়ের সেই হাসিটা এখন আর নেই। অরুণার মনে হল ছোট ভাইয়ের মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। ভয়ের কারণেই কি? ও মনে মনে ঠিক করল, অনু বুঝুক বা না বুঝুক কিছু কিছু করে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওকে বলবে। সেই সাথে সাহস দেবার চেষ্টা করবে। অরুণা আলতো করে একটা হাত রাখল ছোট ভাইয়ের মাথায়। অনু ওর দিদির দিকে ফিরে তাকাল। দেখল দিদি ওর দিকেই চেয়ে আছে। আট বছরের অনু কি হয়েছে তা পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও কিছু একটা ঝামেলা যে হয়েছে এটা বেশ বুঝতে পারছে।
অনু বিরবির করে প্রশ্ন করল, ‘দিদি, কাল আমরা কোথায় চলে যাব?’
অরুনা বলল, ‘কাল আমরা ইন্ডিয়া চলে যাব। পিয়ালদের বাড়ীতে। এখানে যুদ্ধ হচ্ছে তো, তাই। এখানে থাকলে মিলিটারীরা আমাদের মেরে ফেলবে। তুই কি ভয় পেলি আমার কথা শুনে?’
অনু বলল, ‘না দিদি, তুমি থাকলে আমার কোন ভয় নেই।’
অরুনা কথা শুনে হাসল। বলল, ‘এই তো গুড বয়। আমার লক্ষী ভাই। যাই হোক, কখনও ভয় পাবি না। ঠিক আছে?’
অনু মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘দিদি, যুদ্ধ কী? যুদ্ধে কি হয়?’
অরুনা হতাশ গলায় বলল, ‘যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস রে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে মারে এবং মরে। যুদ্ধে মানুষ মানুষকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে। এ হল হারানোর খেলা। একবার হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে জীবন হারায় জীবনকে। তবে আমি তোকে হারাতে দিব না ভাই। তুই সব সময় আমার কাছে কাছে থাকবি। তোর দিদি তোকে হারাতে দিবে না কোন ভাবেই।’ কথাগুলো বলতে বলতে কেন যেন অরুনার চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করল।
অনু বলল, ‘দিদি, তুমি কাঁদছ কেন? আমি হারাব না। এই তোমাকে ছুঁয়ে বললাম, কখনো হারাব না, কখনও না।’ অরুনা ভাইকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘হ্যা, কখনও হারাস না।’
অনুও দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দিদি, কবিতা শুনবে? মা শিখিয়েছে!’
অরুনা মৃদু স্বরে বলল, বল শুনি। অনু দিদির কোলে জড়সর হয়ে সুর করে কবিতাটা বলতে শুরু করল...
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
অনুর কপালে চুমু দিয়ে অরুনা বলল, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড় ভাই। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে।’ অরুনা পাশ ফিরতেই লক্ষ করল ওর চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। অরুনা সে চেষ্টাও আর করল না। ঝরছে ঝরুক। যুদ্ধের সময় চোখের পানি ঝরা ভাল, খুব ভাল।
কতক্ষণ পরে অরুনা বলতে পারবে না। ওর ঘুম ভাঙ্গল অনেক জোড়া বুট পড়ে হাটাহাটি আর কথাবার্তার শব্দে। ও বুঝতে পারল বাড়ি ভর্তি অনেক মানুষ। ওরা কারা? পাক মিলিটারি? এত রাতে কি চায় এখানে?
এমন সময় শুনতে পেল একজন বেশ ভরাট কন্ঠে বলছে, ‘তুমহারা নাম কিয়া হ্যায় মিস্টার?’
অরুনা শুনতে পেল ওর বাবা বলছে, ‘হামারা নাম প্রসূন ব্যানার্জি। আপ লোক ইহা কিউ আয়ে হো? কিয়া চাহিয়ে?’
ভরাট কন্ঠ বলল, ‘তুম হিন্দু হো! আচ্ছা হ্যায়, বহুত আচ্ছা!’
এর মধ্যে বাঙ্গালী একজন বলল, ‘স্যার, আমি তো আপনারে আগেই কইতা হ্যায়, এ শালা খচ্চর হিন্দু! পাকিস্তানের কঠিন শত্রু! মানে এনিমি স্যার!’
ভরাট কন্ঠ বলল, ‘আচ্ছা হ্যায়, বহুত আচ্ছা হ্যায়!’
বাঙ্গালী কন্ঠ এবার খুব জলীয় গলায় বলল, স্যার, এর একখান একুশ বছরের মাইয়া আছে! মাইয়া মানে অওরত হ্যায় স্যার! সুন্দরী, মেলা খুব সুরত লারকি! আপনের পছন্দ হইব!’
ভরাট কন্ঠ আবার বলল, ‘আচ্ছা হ্যায়, বহুত আচ্ছা হ্যায়!’
বাড়ীর উঠোনে অরুনার দুই হাত দুপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে কয়েকজন পাক আর্মি। এত ঝামেলাতেও অনু ওর দিদিকে ছাড়েনি। অরুনার কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনু। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে আছে পাক আর্মির একজন ভরাট কন্ঠের অফিসারের দিকে। অফিসারের চেহারা কুৎসিত। কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রিভাবে ঠোট চাটছে সে। ঘনঘন সিগারেট টানছে। অরুনার ডানে প্রায় হাত দশেক দূরে বাবা আর মা দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর মত। ভরাট কন্ঠের অফিসার একবার অরুনা আর অনুর দিকে তাকাচ্ছে আবার তাকাচ্ছে ওদের বাবা মায়ের দিকে। আঙ্গুলের ফাকে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরিয়ে হাতের ইশারায় বাঙ্গালী লোকটাকে ডাক দিল ভরাট কন্ঠের অফিসার। বাঙ্গালী লোকটা কাচুমাচু করে এগিয়ে এল।
হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ‘হুকুম দেন হুজুর। কি করুম কন। অফিসার কালো ঠোট চাটতে চাটতে বলল, তুমহারা দিলমে কিয়া হ্যায় মুন্সি? তুম কাহো। ইয়ে তুমহারা আদমী।’
মুন্সি অরুনার বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে রাগের সাথে বলল, ‘স্যার, এই শালা হিন্দুর বাচ্চা! এগোরে মাইরা ফালানিই ভাল! এনিমি বাঁচাইয়া রাখা ঠিক না। এরপর আবার ধরেন বুড়া বুড়ি দিয়াও কুনু কাম নাই। পিচ্চি পুলাটারেও শ্যাষ করন ভাল। ভ্যাজাল রাখনের কি দরকার? তয় মাইয়াডারে মাইরেন না স্যার! তাইলে দিলে বহুত চুট পামু! লারকিরে ক্যাম্পে নিয়া যাওনই ভাল হইব! আমাগো এই এলাকার লারকি বহুত সরেস মাল হ্যায় স্যার! এর উপরে আবার হিন্দু! আপনে ভাল আনন্দ পাইবেন স্যার!’
ভরাট কন্ঠের অফিসার অরুনার দিকে তাকাল একবার। দেখল ভয়ে আতঙ্কে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে! অফিসার অরুনার আতঙ্কিত মুখ দেখে খুব আনন্দ পেল। মুন্সিকে বলল, ‘আচ্ছা হ্যায়, বহুত আচ্ছা হ্যায়!’
এর পরের বিশ মিনিটে অরুনাদের বাড়ীতে যেন নরক নেমে এল। বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল। লুটপাট করা হল বাড়ীর অস্থায়ী সম্পদ। এই লুটপাটের কাজটা করল মুন্সি নিজে দলবল নিয়ে। মুন্সি একফাঁকে অফিসারকে বলল, ‘স্যার, পাকিস্তানের পবিত্র পয়সায় কেনা গুলি দিয়া হিন্দু মারনের কাম নাই। ওইডা আমার উপরে ছাইড়া দেন। কুত্তা মালাউনের বাচ্চাগো লাইগা ভাল ব্যবস্থা আছে আমার কাছে।’
মুন্সি নিজ হাতে অরুনার বাবা মাকে গরু কাটার বড় ছুড়ি দিয়ে জবাই করল অরুনার চোখের সামনে। অরুনা আকাশ বাতাস এক করে কান্নাকাটি করল, দয়া ভিক্ষা চাইল কিন্তু কোন কাজ হল না। হিন্দু জবাইয়ের কাজটা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করল মুন্সি। সব শেষে অনুকে ওর দিদির কাছ থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসা হল যেখানে ওর বাবা মা কে জবাই করা হয়েছে সেখানে। অনু কাঁদতে কাঁদতে বলছে, আমাকে দিদির কাছে যেতে দাও। দিদির কাছে যেতে দাও। মুন্সি অনুকে আদর করে বলল, ‘আরে ডরাও ক্যা মিয়া? আগে তুমি যাও তুমার বাপ মা’র কাছে। দিদি কয়দিন পরই আইতাছে। তুমি কলমা জানো নি মিয়া? খাড়াও তুমারে শিখাই। কলমা পইড়া মুসলমান হইয়া মরলে বেহেস্ত পাইবা। কও, লা-ইলাহা ইলল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ।’
অনু কাঁদতে কাঁদতে ভাঙ্গা স্বরে বলে...‘লা-ইলাহা ইলল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ!’
মুন্সি খুশি খুশি গলায় বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ! তুমি মুসলমান হইয়া গেলা। তোমার নতুন নাম দিলাম, গোলাম রসুল। এর অর্থ কি জানোনি? থাউক অর্থের কাম নাই, এইবার শুইয়া পড়ো।’
মুন্সির দুজন সঙ্গী এগিয়ে এসে অনুর হাত আর পা শক্ত করে চেপে ধরল দুপাশ থেকে। মুন্সি গরুকাটা বড় ছুরিটা অনুর গলায় বসিয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাত্র দুবার আগুপিছু করল। ছোট্ট গলা খুব সহজেই কেটে নেমে গেল কোন রকম ঝামেলা করা ছাড়াই। অনু শেষবার ‘দিদি’ বলা ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। অরুনা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তাই দেখে মুন্সি বলল, ‘আহারে, নরম মাইয়া মানুষ। অজ্ঞান হইয়া গেল। দিলে বহুত চুট পাইলাম। ওই মিয়ারা, এরে আরাম কইরা ধরো, যেন চুট না পায়!’
এক মাস পরের ঘটনা...
স্যাতস্যাতে আবছা অন্ধকার ঘরটায় একটা রোঁয়া উঠা কাঠের টেবিল আর একটা আধ ভাঙ্গা চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। পুরো ঘরটাই ফাকা। ঠিক ফাঁকা না। ঘরে দু’জন মানুষ আছে। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। ছেলেটাকে রশি দিয়ে বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে। গায়ে কোন কাপড় চোপড় নেই। মেয়েটারও একই অবস্থা। তবে মেয়েটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে একটু দূরে একটা তোষকের উপর শুইয়ে রেখে। গত এক মাস ধরে এই ছেলেটার সাথে মেয়েটাও বন্দি হয়ে আছে এই ঘরে। ছেলে মেয়ে দুটোর কাজ একই। বাঙ্গালী মারতে মারতে হাঁপিয়ে ওঠা পাক আর্মিদের মনোরঞ্জন করা। পাক আর্মিদের মধ্যে মনোরঞ্জনের সাথী হিসেবে কেউ কেউ ছেলেটাকে পছন্দ করে কেউ আবার মেয়েটাকে। তবে মেয়েটার চাহিদাই বেশি। মনোরঞ্জনের সময় জামা কাপড় খোলা একটা ঝামেলার কাজ বলে আগেই খুলে রেখে দেয়া হয়েছে। এর একটা ভাল দিকও আছে। উলঙ্গ বলে দুজনের কেউই পালানোর চেষ্টা করে না।
ছেলেটার নাম শফিক। তবে এখানে কেউ তার নাম জানে না। মেয়েটার অরুনা নামটাও কেউ জানে না। নামের কি দরকার? কাজ হলেই হল! নাম নিয়ে তাই এখানে কেউ মাথা ঘামায় না। ফূর্তি করার দরকার, সেটুকু হলেই সবাই খুশি। তবে একটা কাজ সবাই নিয়ম মেনে করে। সেটা হল, যখন মেয়েটার সাথে কেউ শোয় তখন ছেলেটার চোখে একটা কালো কাপড় বেঁধে দেয়। আবার যখন ছেলেটার সাথে কেউ শোয়, তখন মেয়েটার চোখে কালো কাপড় বেঁধে দেয়। এই সময় ছেলে মেয়ে দুটো তাদের আর্তচিৎকার ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না। গত এক মাস ধরে দুজন দুজনের আর্তচিৎকার শুনছে। গত দিন থেকে অদ্ভুত একটা কান্ড হচ্ছে, ছেলেটা বা মেয়েটা এখন আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। অথচ ঘটনা আগের মতই ঘটে যাচ্ছে। পালা করে দুজনই ধর্ষিত হচ্ছে রাতভর। আর্তচিৎকার শুনতে না পাবার কি কারণ? কানদুটো কি নষ্ট হয়ে গেল? কই, প্রতিদিন ভোর বেলা যে পাখি ডাকে, এটা তো ঠিকই শোনা যাচ্ছে! এমনকি কুকুরের ঘেউ ঘেউ পর্যন্ত! তাহলে? কাকতালীয় ভাবে শফিক আর অরুনা দুজনে একই কথা ভাবে। তবে উত্তর খুঁজে পায় না।
আজ সকাল বেলা শফিকের বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে কিছু সময় পর পর ক্লান্ত গলায় ‘ব্যথা ব্যথা, মরে গেলাম, পানি...’ বলে চিৎকার করছে।
অরুনা এই চিৎকারটা শুনেছে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। সে শুধু তাকিয়ে আছে শফিকের দিকে। অরুনা শফিকের দিকে তাকিয়ে নিজের কথা ভাবছে। আজ অরুনার ব্যথা বেদনা বা শোকের কোন বোধ নেই। সব কিছু অসার হয়ে আছে। অরুনার সারা শরীরে হাজারো কামড়ের দাগ। ঠোট কেটে গেছে সেই কবেই। বুকও ক্ষত বিক্ষত। অরুনার ঠিক মনে নেই, তবে তিন বা চারদিন আগে পর্যন্ত হবে, দুই উরুর মাঝখানে ভয়ানক ব্যাথা টের পাচ্ছিল। এখন সে ব্যাথাটাও নেই। দুই উরুর মাঝখান বলে যে কোন কিছু আছে, তাই সে ভুলে যায় মাঝে মাঝে। তবে পাক আর্মিরা পুরোপুরি ভুলতে দেয় না। প্রতি রাতে মনে করিয়ে দেয় যে তার দুই উরুর মাঝখানে কিছু একটা আছে। ব্যথাটাও তখন চলে আসে। সীমাহিন ব্যথা। অরুনা মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে ভাবে বাবা মায়ের সাথে তাকেও জবাই করে মেরে ফেললে খুব ভাল হত, খুব ভাল হত।
আরও এক মাস পরের ঘটনা...
অরুনা বোধহীন ফুলে কালো হয়ে যাওয়া ক্লান্ত চোখে চেয়ে আছে কঙ্কালসার শফিকের দিকে। শফিকের বুকের হাড় গোনাই এখন অরুনার একমাত্র কাজ। কথা বলার শক্তি নেই অরুনার। সে শুধু চেয়ে চেয়ে শফিককে দেখে। শফিক অসার হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। কোন নড়াচড়া নেই। ঠোঁটের কোন বেয়ে রক্তমেশানো লালা ঝরছে সারাক্ষণ। অরুনার খুব ইচ্ছে করে শফিকের লালা মুছে দিতে। কিন্তু পারে না। অরুনা শফিকের বুকের হাড় গুনছে। এক, দুই, তিন, চার...বাইশ, তেইশ, চব্বিশ, পঁচিশ, ছাব্বিশ। গোনায় ভুল হয়েছে মনে করে আবার গোনে। আবার গোনে। কিন্তু প্রতিবার ছাব্বিশটাই হয়। কেন হয় অরুনা বুঝতে পারছে না। বুকে হাড় থাকার কথা পঁচিশটা, চাব্বিশটা না। শফিকের হাড় একটা বেড়ে গেল কিভাবে তাই ভাবছে অরুনা অসার হয়ে। ঠিক এই সময় অরুনা শুনতে পেল ‘কাজলা দিদি, ও কাজলা দিদি’ বলে অনু তাকে ডাকছে। অরুনা অস্থির চোখে খুঁজতে থাকে অনুকে। দেখে শফিকের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অনু দু’হাত আগে বাড়িয়ে। ছোট ভাইটাকে দেখে অরুনার ভাবলেশহীন মুখে হাসির ক্ষীণ একটা ধারা ফুটে উঠে। মনে মনে চিৎকার করে বলে, ভাই, আমার ভাই, কাছে আয়! তোকে কত দিন দেখি না! কাছে আয় ভাই! খুব ভয় পেয়েছিস সেদিন, না? কোন ভয় নেই, তোর দিদি আছে না? কাছে আয়, কাছে আয় ভাই। অনু কাছে আসে না। দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে হাত বাড়িয়ে। অরুনা বলে, রাগ করেছিস দিদির সাথে? দিদির সাথে রাগ করতে নেই! আয় ভাই, কাছে আয়। কাজলা দিদির কবিতাটা আর একবার শোনা। খুব শুনতে ইচ্ছে করছে! অরুনার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে পানি মোছার ক্ষমতা অরুনার নেই।
অরুনা শুনতে পেল অনু কাজলা দিদির কবিতাটা পড়ে চলেছে একমনে সুর করে। তবে সে কোথাও অনুকে খুঁজে পেল না। স্যাতস্যাতে ঘরের বাতাসে কবিতাটা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। এর মধ্যেই অরুনা টের পেল গভীর ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসছে। কোন ভাবেই খুলে রাখতে পারছে না। সে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে। তবে সে এই অন্ধকারকে ভয় পেল না। কারণ এই অন্ধকারেই অরুনা খুঁজে পেল তার ভাইকে। যে বাবা মায়ের সাথে তার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অরুনা মুক্তির আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বাবা মা’কে চিৎকার করে বলল, আসছি মা, এই আমি আসছি! সীমাহীন আনন্দের মধ্যেও অরুনা টের পেল শফিকের জন্য তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটা এখনও মুক্তি পায়নি। খুব শীঘ্রই পাবে কি? অরুনা জানে না।

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠার জনপ্রিয় বই


চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২৩’ এর নির্বাচিত বই



চিলেকোঠা সাহিত্য সম্মাননা ‘নক্ষত্রের খোঁজে ২০২২’ এর নির্বাচিত বই