চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

কারাগারগুলো কেন লেখকে ভর্তি না?


কারাগারগুলো কেন লেখকে ভর্তি না?

আখতার মাহমুদ


হঠাৎই এক ব্যস্ত সকালে একজন জানতে চান, ‘কারাগারগুলো লেখকে ভর্তি না কেনো?’ প্রশ্নটা প্রথম দেখায় ধাক্কা দিলেও কিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর এটা নিশ্চিত হই, প্রশ্নটা রোমান্টিক। রোমান্টিক, এই ভুল-ভাল দৃষ্টিভঙ্গীর কারণ; অনেকেরই এটা বদ্ধমূল ধারণা যে লেখক মাত্রই অন্যায়ের প্রতিবাদী, বিপ্লবী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক। লেখক কখনো কখনো স্রেফ বিনোদনদাতাও। কখনো কখনো লেখক শিক্ষকের স্থানও নিয়ে থাকেন। আর লেখকদের জেলে যেতে হবে, জেলে গিয়ে প্রস্ফুটিত হতে হবে এমনটা নিশ্চয়ই নিয়ম নয়? এমনও না যে লেখকরা চিরকাল অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছেন। সকলে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী নয়। কেউ কেউ সুবিধাবাদীও। এছাড়াও, কোনো অনিয়ম অত্যাচারের যৌক্তিক প্রতিবাদ করলে সাধারণত আজকাল জেলে যেতে হবে সময়টাও এমন নয়।

অন্যায়ের প্রতিবাদী হিসেবে জেলে গিয়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে যাবার একটা আকাঙ্ক্ষা লেখকদের আছে কী-না সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে এই যে, বলেছি প্রশ্নটা রোমান্টিক, তারচেয়ে বড় এবং প্রায়শই অস্বীকার করা ভাবনাটা হল এই যে- লেখক নিজের জন্যই কলম ধরেন। নিজের ভাবনাগুলো ছড়াতেই কলম ধরেন। যদিও বেশিরভাগ লেখকই রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে ভাবতে ভালবাসেন তিনি গণমানুষের জন্য লিখছেন। কখনো ভাবেন সমাজ ওলট-পালট করে নব অবয়বে এটিকে বিনির্মাণ করার মহৎ উদ্দেশ্যে তিনি লিখেন। মানুষের কল্যাণের জন্য লিখেন। সমাজ বদলে দেবার জন্যে শব্দের চেয়ে যে শ্রম-ঘাম-রক্ত অগ্রগামী, এটা লেখকরা প্রায়শই ভুলে যান মাথায় যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও তথ্য ধারণ করার পরও।

যা হোক, ফিরে যাই পূর্বোক্ত প্রশ্নে। লেখকের জন্যে জেলে যাওয়াটা লেখালেখির পূর্বশর্ত নয়। তবে প্রশ্নটা নিঃসন্দেহে আলোচনার দাবি রাখে এই কারণে যে, এই প্রশ্নে লেখকদের রোমান্টিসিজম ছিঁড়েখুড়ে দেয়ার একটা সুযোগ মেলে। প্রশ্নটার সরল উত্তরে হয়তো কেউ কেউ বলবেন, প্রতিবাদী লেখক আজকাল আর নেই বা লেখকদের লেখার ধার আর নেই.... এই প্রশ্নে সমসাময়িককালকে, এ কালের লেখকদের তাচ্ছিল্য করার একটা উছিলাও পাওয়া যায়এই তাচ্ছিল্যের প্রসঙ্গে, একটা ধারা লক্ষ্য করেছি। একে একটি চক্রও বলা যেতে পারে বা লেখক মনস্তত্ত্বের একটি সরল পর্যবেক্ষণও বলতে পারেন। সেটা হল-

একজন তরুণ লেখক তার সমসাময়িক কালের কাউকেই সচরাচর উপযুক্ত উল্লেখযোগ্য বা দুর্দান্ত লেখক বলে স্বীকৃতি দেয় না। তবে ওই তরুণ লেখক যখন প্রবীণ হয়ে ওঠেন তখন তার সামনে একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায়। দুটো পথ খোলা থাকে সামনে। এক, সামনে এসে পড়া তরুণ লেখকদের উল্লেখযোগ্য লেখক বলে স্বীকৃতি দেয়া। দুই, তার সমসাময়িক কালের কাউকে উল্লেখ্যযোগ্য লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। সহজাতভাবেই লেখক শেষের দিকে এসে তার সমসাময়িক লেখকদেরই মহৎ করে তোলেন যদিও তরুণ বয়সে তিনি তা স্বীকার করেন নি– এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু ব্যতিক্রমকে সাধারণত উদাহরণ হিসেবে নেয়া হয় না।

আপাতত ওই প্রসঙ্গ তোলা থাক। মূল প্রসঙ্গে ফিরি, বাংলার প্রতিষ্ঠিত-সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং মানুষের মুখে মুখে ঘুরে-ফেরা লেখকদের নামগুলো যদি আমরা নিই তবে আমরা দেখি যে এদের বেশিরভাগই জেলে না গিয়েও দিব্যি লিখে গিয়েছেন এবং মানুষের মনন ও রুচিকে প্রভাবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দোপধ্যায়, শামসুর রাহমানসুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহির, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ইত্যাদি নাম এই মুহূর্তে মাথায় আসছে এবং আশা রাখি যে সকলেই একমত হবেন বাংলায় এরা অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। আজকাল একদম আমপাঠকের কাছেও এরা সুপরিচিত। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যাদের আমরা উল্লেখযোগ্য ও সুপরিচিত লেখক বলে জানিতারা হলেন শামসুর রাহমান (১৯২৯)আহমদ ছফা (১৯৪৩)আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩), হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭)হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৪৮), শহীদুল জহির (১৯৫৩)। এদের মধ্যে আমার জানামতে কেউই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। যদিও তাদের প্রত্যেকেরই যুদ্ধে যাবার মত বয়স ছিল। তারুণ্য ছিল। তবু যুদ্ধে না যাওয়াটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। তারা অন্যভাবে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে উদ্যোগী ছিলেন। যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অপরাধ নয়।

এদের মধ্যে আমার জানামতে (জানার সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে) নজরুল এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া কেউই জেলে যান নি। নজরুল যদিও খাঁটি বিপ্লবী হিসেবে জেল খেটেছেন। সুনীল গঙ্গোপধ্যায়ের জেল যাওয়া খুব সম্ভবত এক-বা দু’রাতের জন্য ছিল। সেটা অবশ্যই আদর্শ বা বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য ছিল না। ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছিল সেটা। তুমুল জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে আদর্শ বিপ্লবী, প্রতিবাদী লেখক বলতে নজরুলকেই খুঁজে পাই কেবলনজরুল চরমভাবেই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সে বোধ তীব্র ছিল বলেই তিনি শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামি গজল আর সেক্যুলার ধ্যান-ধারণার কবিতা-গান লিখে গেছেন। তিনি সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন। যৌক্তিকভাবে এটাই সকলের অবস্থান হওয়া উচিত ছিল। নিজ নিজ ধারণা লালন ও চর্চা করে, এমনকি অন্যান্য ধ্যান-ধারণার সাথে দুরত্ব বজায় রেখেও সকলে সহনশীল, সহমর্মী হতে পারতেন। যদিও এমনটা খুব কমই দেখা যায়। যার ফলশ্রুতিতে নজরূলকে না হিন্দুরা আপন ভাবে, না মুসলিমরা না সেক্যুলাররা। প্রত্যেকেই নজরুলকে সন্দেহের চোখে বিচার করে থাকে। ভাবটা এমন যে, আমার ধ্যান-ধারণার পক্ষে লিখেছে ঠিক আছে। কিন্তু অন্যদের সম্পর্কে লিখল কেন? তার মধ্যে নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িকতা/নাস্তিকতা ছিল!

তো দেখা যায় যে, উল্লিখিত হেভিওয়েট লেখকদের মধ্যে নজরুল ব্যতিত আর কেউই লেখার জন্যে জেল খাটেননি। এর মানে এটা নয় যে, তারা কেউই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন না। শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন নি। তারা প্রত্যেকেই নিজ সামর্থ ও বিশ্বাস অনুসারে প্রতিবাদী ছিলেন। তাদের কেউ কেউ সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি সোচ্চার না হলেও সামাজিক অনাচার ও অনিয়ম এবং মানুষের অসদাচারণকে লেখায় বারবার ব্যঙ্গ করেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে হুমায়ুন আহমেদের একটি স্মৃতিকথায় স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা, অসমর্থন টের পাওয়া যায় কেবল। এর বাইরে হুমায়ুন আহমেদ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কলম ধরেননি। অন্তত আমার জানা নেই।

এর থেকে কী আমরা এটাই বলব যে আমাদের লেখকেরা সুবিধাবাদী, অপ্রতিবাদী? সেটা সবক্ষেত্রে বলার সুযোগ নেই। প্রতিবাদের ধরণ একটা ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কে কোন উপায়ে প্রতিবাদ করবেন সেটা সম্পূর্ণভাবেই তার ব্যক্তিগত বিষয়জেল এড়িয়ে যদি কেউ মানুষের জন্যে লিখে যেতে পারেন তবে ক্ষতি কী? বাংলাদেশের প্রধানতম লেখকেরা কেউই অনুকুল বয়স ও তারুণ্য থাকার পরও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। কিন্তু তাতে করে কী আমরা তাদের স্বাধীনতা বিরোধী বলতে পারি? না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্তের পরও তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লেখক বলতে আমরা দ্বিধা করি না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর যাদের আমরা উল্লেখযোগ্য ও সুপরিচিত লেখক বলে জানি, তারা হলেন শামসুর রাহমান (১৯২৯), আহমদ ছফা (১৯৪৩), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩), হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭), হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৪৮), শহীদুল জহির (১৯৫৩)এদের মধ্যে আমার জানামতে কেউই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। যদিও তাদের প্রত্যেকেরই যুদ্ধে যাবার মত বয়স ছিল। তারুণ্য ছিল। তবু যুদ্ধে না যাওয়াটা তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। তারা অন্যভাবে স্বাধীতার পক্ষে কাজ করতে উদ্যোগী ছিলেন। যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অপরাধ নয়।

তবে যখন সাধারণের চোখ দিয়ে দেখি, তখন এটা মেনে নেয়াটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সবরকম শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য থাকার পরও কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়নি- এটা ভাবতেই খারাপ লাগে। এবং সাধারণ মানুষ হিসেবে আরো খারাপ লাগে যখন দেখি মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে শব্দযোদ্ধাদের সম্মান লেখকসমাজে বেশি। সাধারণ মানুষ হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি একজন শহীদ বা জীবিত মুক্তিযোদ্ধা হাজারো শব্দযোদ্ধার চেয়েও লক্ষগুণ উত্তম। বেশি সম্মান ও মনোযোগ আকর্ষণের দাবিদার। বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শব্দযোদ্ধা শব্দটায় আমার যথেষ্ট এলার্জি আছে। এটি সম্ভবত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু আগে এবং স্বাধীনতার পর থেকে বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এতে করে মহৎ করে তোলার চেষ্টা হয়, লেখকদের। এটা লেখকরাই করেন। নিজেদের শব্দযোদ্ধা বলেন। কিন্তু যোদ্ধাশব্দটির ওজন ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে এদের ধারণাই নেই। শব্দে শব্দে সমাজ-দেশ বদলাতে চান একজন লেখক। কিন্তু দেশ-সমাজ প্রকৃতপক্ষে বদলায় একজন কর্মী- রক্ত-শ্রম-ঘামে। লেখক নন। লেখক শব্দ সাজান নিজের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে। নিজেকে মহৎ বলে তুলে ধরতে। সহজাতভাবেই লেখকরা অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে জনপ্রিয়তা আকাঙ্ক্ষা করে এসেছে। মানুষের মনে জায়গা নিতে চেয়েছে। বরাবরই যোদ্ধানা হয়ে শব্দযোদ্ধাহতে চেয়েছে। এই চাওয়াতে, সবসময়ই সামষ্টিক কল্যাণের চেয়ে ব্যক্তিগত কল্যাণ-মতবাদ প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

লেখক যোদ্ধা হবেন না শব্দযোদ্ধা, না দুটোই হবেন এটা শেষতক লেখকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে এই সিদ্ধান্তের বিষয়টা লেখকরা ধোঁয়াশা করে রাখেন। পরিষ্কার করে বলেন না কী তাদের সিদ্ধান্ত। এই ক্ষেত্রে আমি সুনীল গঙ্গোপধ্যায়কে পছন্দ করি কেননা তিনি এই বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্তটা স্পষ্ট করেছিলেন তার স্মৃতিকথায় এভাবে-

“ইট তো ছুঁড়েছিই, একবার খানিকটা বেশি সাহস দেখিয়ে পায়ের কাছে এসে পড়া একটি টিয়ার সেল সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছি এক পুলিশের মাথায় রাজশক্তি বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে আমার সশস্ত্র সংগ্রামের ভূমিকা শুধু ওই পর্যন্ত না, বোমা ছুঁড়িনি, নিজের হাতে কোনও ট্রাম-বাসে আগুনও ধরাইনি, বন্দুক-পিস্তল কখনও ছুঁয়ে দেখি নি এরপর ক্রমশ রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আলগা হতে থাকে দাদা শ্রেণীর নেতারা যখন কবিতা লেখা বিষয়ে উপদেশ ও খবরদারি শুরু করলেন, তখনই বুঝে গেলাম, এদের সংস্রবে আমি বেশিদিন টিকতে পারব না কিছুদিন পর, ট্রাম ভাড়া আন্দোলনে সরকার শেষ পর্যন্ত  পিছু হটে নতি স্বীকার করেছে বলে ছাত্রদের উদ্দীপনা তুঙ্গে আর একটি কোনও তুচ্ছ কারণে কলেজ স্ট্রিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে আকস্মিকভাবে মারামারি শুরু হয়ে যায়, দুপক্ষেই হিংস্রতা বাড়তে বাড়তে গুলি চলতে লাগল, পুলিশের তাড়া খেয়ে আমরা একদ সিনেট হলের এক পাশ দিয়ে ছুটে একটা গলির মতন জায়গায় ঢুকে টিনের দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে একটা গুলি সেই দরজা ফুটো করে এল চোখ বুজে রইলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য, শুধু ভাবছি, মরে গেছি না বেঁচে আছি? গুলিটা আমার বুকে লাগতেই পারত, লেগেছে পাশের ছেলেটির কাঁধে, সে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে মনে হল, যদি গুলিটা আমার বুকে লাগত, আমি প্রাণ দিতাম, সেই প্রাণদান কীসের জন্য? তা দেশের কোন উপকারে লাগত? এ তো নিতান্তই নির্বোধের মতন মৃত্যু এই ছেলেটিও  কি বাঁচবে? কিংবা এর ডান হাতটাই যদি অকেজো হয়ে যায়, তাতেই বা কোন আদর্শ জয়ী হবে? না এভাবে প্রাণ দিতে আমি রাজি নই এ পথ আমার নয়।” ------অর্ধেক জীবন

আমাদের প্রধানতম লেখকদের, যাদের নাম উল্লেখ করা গেল, তারা ইতিহাসের এমনসব সময় পার করে এসেছিলেন, যে সময়ে তীব্র প্রতিবাদ করে জেলে যাওয়া সহজতর ছিল। ওভাবে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যাওয়াও সহজ ছিল সে সময়ে। স্বৈরাচারের আমল পর্যন্তও এইসব লেখকদের জন্যে সুবর্ণ সুযোগ ছিল জেলভাগ্য বরণ করার। কিন্তু দেখা যায় যে, সেটা ঘটেনি। কেবল এটুকু জানতে পেরেছি, শামসুর রাহমান স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন কিংবা তাকে বাধ্য করা হয় ছফা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অণুপ্রাণিত হয়ে কমিউনিস্ট ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস রেখে কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে দেনপরে কিছুকাল চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় আত্মগোপন করেন। এর বাইরে উল্লিখিত বাংলাদেশি লেখকদের জীবনে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন স্পৃহা খুঁজে পাওয়া যায় না, লেখার খাতা ব্যতীত শেষদিকে অবশ্যই আমরা সবাই জানি, শামসুর রাহমান ও হুমায়ুন আজাদ মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছিলেন কিন্তু সেটা ভিন্ন বিষয়, শাসকগোষ্ঠীর সাথে কোন্দলের ব্যাপার ছিল না তা

গণতান্ত্রিক ধারায় ঢুকে পড়ার পর বাংলাদেশি লেখকরা যথেষ্ট স্বাধীনতা পেয়ে এসেছে ধারাবাহিকভাবে। গণতান্ত্রিক ধারায় ঢুকে পড়ার পর জেলে যাবার দরকার হয় নি উল্লেখযোগ্য কোনো লেখকের। প্রথমে বলেছিলাম, আবারো বলছি এমনটা নয় যে তাদের কারো মধ্যে প্রতিবাদ স্পৃহা নেই বা ছিল না। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবিধান মানুষদের অধিকতর নিরাপত্তা দেয় বলে নেহাতই জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করার মত অপরাধ ব্যতিরেকে কিংবা বৃহৎ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানার অপরাধ ব্যতীত অন্য কোনো সমালোচনার জন্য লেখকদের জেলে নেয়া হয় এমনটি দেখা যায় নি।

তীব্র সমালোচনার কমন বিষয়বস্তুও নেই আজকাল। একাত্তরে সকল বাঙালির কমন শত্রু ছিল পাকিস্তানিরা, রাজাকাররা। স্বৈরাচার সরকারের আমলে জনসাধারণের কমন শত্রু ছিল স্বৈরশাসন। এখন তেমন কিছু নেই। এখন বিভাজনগুলোও জটিল। তীব্র একতার পরিবর্তে তীব্র দলাদলি টের পাওয়া যায় সবখানেই। তারপরও রাষ্ট্রে বর্তমানে সামগ্রিকভাবে অতীতের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল একটা অবস্থা বিরাজ করছে। এটা লেখক গোষ্ঠীর জন্য একটি অনুকূল অবস্থা। সমসাময়িক এবং অতীতের সকল লেখকদের ছাড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা এই সময়ে বসেই লেখকেরা নিশ্চিন্তে করতে পারেন। প্রতিবাদী স্পৃহা কাজে লাগাতে পারেন মানুষের ভেতর সহনশীলতা, জাতীয় একতা সৃষ্টিতে।

বিঃদ্রঃ লেখার কোথাও কোনো তথ্যবিভ্রাট থেকে থাকলে সেটা জানানোর অনুরোধ করছি। শুধরে নেব নিজেকে।

লেখা পাঠান ই-মেইলে: chilekothasahitto@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই