চিলেকোঠা ওয়েবজিনে প্রকাশিত সাহিত্যকর্ম ও অন্যান্য

ইনডকট্রিনেশন


ইনডকট্রিনেশন
মোকাররম হোসাইন

জ্ঞান অন্বেষী বেশিরভাগ মানুষের গন্তব্য পূর্ব নির্ধারিত থাকে। জ্ঞানের অভিযাত্রায় তারা কোনো নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করে না। কারন মানুষ পাঠ শুরু করে একটা বদ্ধ ধারণা থেকে। তারা ধরে নেয় সত্য জ্ঞানটা তাদের অধিত বটে কিন্তু ভিন্নমত বা তাদের ভাষায় গোমরাহি মোকাবেলা করতে অপরাপর ধারণাগুলোর পাঠ জরুরি। এইভাবে কোন নির্দিষ্ট ধর্ম, আদর্শ বা জ্ঞান কাঠামোর উপর স্থির বিশ্বাস রেখে বিবিধ দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, বইপত্র পাঠ করে বিপুল তথ্য হাসিল করা যায় কিন্তু জ্ঞান হাসিল হয় না কিছু। যে সত্য মানুষ জানে বলে মনে করে সেটা পরিক্ষিত সত্য নয়। সচেতন কোনো অর্জন নয়। যে জ্ঞানে পাণ্ডিত্য আছে কিন্তু উপলব্ধি নাই সেটা বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। জ্ঞানের এই রক্ষণশীল দশা হলো ক্বালবে মোহর পড়ে যাওয়া বা ইনডকট্রিনেটেড ইন্টিলেকচুয়াল কন্ডিশন। এই কন্ডিশনকে আমরা চিহ্নিত করবো যখন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সচেতন উপলব্ধি ছাড়া কোনো ধারণা, আদর্শ বা বিশ্বাস পরিবার, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের মনোজগতে অকাট্য সত্য বলে স্থিত হয়ে যায়।

ইনডকট্রিনেশন শুরু হয় পরিবার থেকে। এই পর্যায়ে পিতামাতা থেকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রাপ্ত ধারণা সমূহের সাথে শিশু বা কিশোরদের আবেগময় সংযুক্তি তৈরি হয়। যেহেতু পিতামাতার প্রতি সন্তানদের ভালবাসা ও অগাধ বিশ্বাসের সম্পর্ক তাই পিতামাতার বয়ানগুলো ভালোবাসা ও বিশ্বাসের স্রোতে অকাট্য সত্য জ্ঞান হিসেবে শিশু, কিশোরদের মনোজগতে শিকড় বিস্তার করে। বেশিরভাগ মানুষ এই ইনডকট্রিনেশন থেকে মুক্ত হতে পারে না কোনো দিন। এই সব ইনডকট্রিনেটেড মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীস্টানের মধ্যে ভেদ কিছু নাই। সত্যটা কারও উপলব্ধিজাত নয়। এদের বিশ্বাসের বিচার হয় না। বিচার হয় সৎ ও অসৎ কর্মের।

যে জ্ঞানে পাণ্ডিত্য আছে কিন্তু উপলব্ধি নাই সেটা বিশ্বাস ছাড়া কিছু নয়। জ্ঞানের এই রক্ষণশীল দশা হলো ক্বালবে মোহর পড়ে যাওয়া বা ইনডকট্রিনেটেড ইন্টিলেকচুয়াল কন্ডিশন।

ইনডকট্রিনেশন পরিহার করে কেবল শিক্ষা দান করা হয়, তেমন কোনো শিক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ত্ব সম্ভবত দুনিয়াতে নাই। শিক্ষা দানের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত শিক্ষার্থীদের ইনডকট্রিনেটেড করে থাকে। কাগজের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত জ্ঞান শিক্ষক বা অথরিটির প্রভাব, ক্ষমতা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে শিশুরা সরাসরি সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে শেখে সেই বয়স থেকে যখন তাদের সচেতন উপলব্ধিই তৈরি হয় না। যে কোনো জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একপাক্ষিক ও আনক্রিটিকাল বয়ান হাজির থাকে। তথ্য নিয়ন্ত্রিত এক পাঠ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি উৎপাদিত হয় সম্মতি বা কনসেনসাস।

শিক্ষাব্যবস্থায় কিভাবে ইনডকট্রিনেশন অন্তর্নিহিত থাকে সেই অবস্থা বুঝতে হলে বাংলাদেশের তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। জাতীয় পাঠ্যসূচী ভিত্তিক স্কুল ও কলেজ, ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক মাদ্রাসা ও বৃটিশ শিক্ষা ভিত্তিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। প্রতিটি শিক্ষাব্যবস্থা স্বতন্ত্রভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন মনন তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাদের লয়ালিটিও যথাক্রমে জাতীয়তাবাদ, ইসলাম ও পাশ্চিমা ধারায় বিকশিত ও বিভক্ত হয়। তারপর ইনডকট্রিনেশন ঘটে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। ইনডকট্রিনেশন একপাক্ষিক ও আনক্রিটিকাল। পদ্ধতিগতভাবে ইনডকট্রিনেশনে প্রভাবক্ষমতা, বলপ্রয়োগ থাকে। মতাদর্শিক কতৃত্ব জারি রাখতে ঐতিহ্যকে হাজির করা হয় প্রবল আবেদনময়তার সাথে। ইনফরমেশনের উপর আরোপ করা হয় নিয়ন্ত্রণ। এইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় সম্মতি বা কনসেনসাস। আর এডুকেশন সম্মতি বা কনসেনসাস নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব প্রভাব, ক্ষমতা, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি পরিহার করে। শিক্ষা বহুমুখী যা স্বাধীন পর্যালোচনা অনুমোদন করে।

শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইনডকট্রিনেশন আরোপ করে ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন: মঠ, মাদ্রাসা, মনস্টারি, কনভেন্ট, বিহার, ইত্যাদি। ধর্মশিক্ষায় অথরিটির প্রভাব ও ক্ষমতার চুড়ান্ত প্রয়োগ থাকে। ঐতিহ্যের আবেদন এখানে প্রবল। নির্দিষ্ট সিলেবাসের বাইরে যেকোনো পাঠকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এমনকি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়। ধর্ম ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ ধর্মকেও সামষ্টিকভাবে ধারণ করে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একটা সেক্টারিয়ান ধর্মতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। ঐশী রেফারেন্সের কারনে ধর্মমতগুলো মানুষের চৈতন্যে স্বতসিদ্ধ সত্য রূপে ঠায় পেয়ে যায় যার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ অন্য মতগুলোতে কোনো সত্যের সম্ভাবনা দেখতে পায় না। ধর্মতত্ত্ব পদ্ধতিগতভাবে ধর্মকে একটা কাঠামো দেয়। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব ঐসব আনক্রিটিকাল মানুষদের জন্য যাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম, নীতির সমষ্টি দান করে জীবন যাপনের একটা সীমিত পথ শিক্ষা দেয়া যায়। মানব সমাজের জন্য তেমন একটা সীমিত জীবনাচরণ প্রস্তাব হয়তো জরুরি। কিন্তু সমস্যা হল যখন এই ধর্মমতগুলো একমাত্র সত্য হিসেবে অনতিক্রম্য এক দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে ভিন্নমতকে গোমরাহি বিবেচনায় নির্মূল করতে চায়। ধর্মশিক্ষা হলো হাজার হাজার রেফারেন্সের একপাক্ষিক ও আনক্রিটিকাল মুখস্থ বিদ্যা। ব্যতিক্রম এইখানে বিরল।

ইনডকট্রিনেটেড কন্ডিশন মুক্ত না হলে জ্ঞান অসম্ভব। এই কন্ডিশন থেকে মুক্তির আদি উদাহরণ নবী ইব্রাহিম (আ.) । যে পৌত্তলিক কওমে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন চাঁদ, সূর্য ছিল তাদের দেবতা। অথচ ইব্রাহিম (আ.) নবুওত প্রাপ্তির আগেই চাঁদ, সূর্যের দেবত্ব খারিজ করেন। সূর্যের প্রখরতা তাকে আকৃষ্ট করলেও তিনি উপলব্ধি করেন যে সূর্যের প্রখরতা সময়ে সময়ে বদলে যায়। রাত্রির অন্ধকারে হারিয়ে যায় যার আলো, সেই সূর্য কোনো দেবতা হতে পারে না। চাঁদের জোছনা ইব্রাহিম (আঃ)-কে মুগ্ধ করলেও দিনের আলোয় চাঁদের ম্লান মুখ দেখে তার বুঝতে বাকি থাকে না কেন ঐ রুপালী চাঁদ যতই মায়াবী হোক দেবতা নয়। তিনি আবিষ্কার করেন স্রষ্টা এমন এক স্বত্ত্বা যার ক্ষয় নাই, বিলয় নাই, রূপান্তর নাই। তিনি এক। তিনি অবিভায্য। গৌতম বুদ্ধ বা রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-কেও তাদের সময়ের বিদ্যমান জ্ঞানকাঠামো খারিজ করে সত্য আবিষ্কার করতে হয়েছিল। মধ্যযুগে ইমাম গাজ্জালি লিখেছেন আত্মজীবনী আল মুনকিদ মিন আল দ্বলাল যেখানে তিনি তার সংশয় থেকে সত্য আবিষ্কারের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। আধুনিক দর্শনের জনক রেনে ডেকার্ত লিখেছেন মেডিটেশন যেখানে গাজ্জালির প্রায় কাছাকাছি যদিও আরো বেশি দার্শনিক সংশয় তিনি প্রয়োগ করেন।

সংশয় ইনডকট্রিনেটেড কন্ডিশন থেকে মুক্তির একটি পথ। এই সংশয় হলো জ্ঞানের শুরু। কোন দার্শনিক গন্তব্য নয়। আমরা যা সত্য বলে জানি সেই সত্যের নিশ্চয়তাকে প্রশ্ন করা। যা মিথ্যা বলে জানি, সেই জানাকেও প্রশ্ন করা। অর্থাৎ নিরেট সত্য বা মিথ্যা হিসেবে কোনকিছুকে গ্রহণ বা বর্জন না করে বরং প্রতিটি ছাইয়ের স্তুপের নিচে যে আগুন গুপ্ত থাকে তাকে খুঁজে বের করা। সংশয় সেই দরজা যা উন্মুক্ত হলে এক অসীম সম্ভাবনার জগত সামনে হাজির হয়। অন্ধকার সাগরের বুকে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা বাতির মতো ইশারায় আহ্বান করতে থাকে সব জ্ঞানের তরী।

লেখা পাঠান- chilekothasahitto@gmail.com


মন্তব্যসমূহ

দেশসেরা বুকশপ থেকে কিনুন চিলেকোঠার বই

চিলেকোঠা বেস্ট সেলার বইসমূহ

‘নক্ষত্রের খোঁজে’ প্রতিযোগিতা ২০২২ এর নির্বাচিত বই